ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

ড. আর এম দেবনাথ

অগ্রগতি ধরে রাখতে দরকার উদার সমাজ

প্রকাশিত: ০৪:০৯, ১৫ জুলাই ২০১৬

অগ্রগতি ধরে রাখতে দরকার উদার সমাজ

নতুন অর্থবছর ২০১৬-১৭ শুরু হয়েছে দেশের ইতিহাসে ভয়াবহতম এক দিনে। অন্যান্য বছরের মতো এবারও ২৯ জুন ২০১৬-১৭ অর্থবছরের অর্থবিল (ফাইন্যান্স বিল) পাস হয় এবং ৩০ জুন সংসদে পাস হয় বাজেট। যখন অপেক্ষা নতুন অর্থবছর শুরুর তখনই পহেলা জুলাই ঘটল জঘন্যতম হত্যাযজ্ঞ। গুলশানের অভিজাত রেস্তরাঁ ‘হলি আর্টিজান বেকারি’তে কুড়িজন দেশী-বিদেশীকে জিম্মি করে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। স্থানটি কূটনীতিক ও নিয়মিতভাবেই সবচেয়ে সুরক্ষিত এলাকা। এমন একটি এলাকায় এরকম ভয়াবহতম ঘটনায় সারাদেশ স্তম্ভিত। যখন আমরা সবেমাত্র সাত শতাংশের ওপরে ‘জিডিপি’ প্রবৃদ্ধি অর্জন করে অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে একটা মাইলফলক রচনা করেছি এবং যখন বৃহত্তর উন্নয়নের জন্য ২০১৬-১৭ অর্থবছরে কর্মকা-ে ঝাঁপিয়ে পড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছি ঠিক তখনই জঙ্গীরা এমন কালিমা লেপন করে দিল, যা মোচন করতে আমাদের আদাজল খেয়ে নামতে হচ্ছে। যে কুড়িজন নিরীহ মানুষকে জঙ্গীরা গুলি করে, চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করেছে এর মধ্যে তিনজন বাংলাদেশী ও বাংলাদেশীউদ্ভূত মার্কিন নাগরিক। বাকি সতেরোজন বিদেশী নাগরিক। এর মধ্যে নয়জন ইতালি, সাতজন জাপানী এবং একজন ভারতের নাগরিক। লক্ষণীয়, তিনটি দেশই আমাদের উন্নয়ন সহযোগী এবং দুটো দেশ আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সাথী। ইতালির যে নয়জন নাগরিক জঙ্গীদের গুলিতে নিহত হন তারা ছিলেন আমাদের পোশাক খাতের অন্যতম বড় ক্রেতা ও ইতালীয় প্রতিষ্ঠানের উর্ধতন কর্মকর্তা। এরা আমাদের ‘গার্মেন্টস’ ব্র্যান্ডিং করে ইউরোপে বাজারজাত করতেন। এদিকে জাপানের নিহত সবাই ছিলেন ‘মেট্রোরেলের’ কারিগরি সহায়তাকারী প্রকৌশলী। ‘মেট্রোরেল’ আমাদের একটি গর্বের প্রকল্প। এছাড়া জাপান আমাদের মুক্তিযুদ্ধকালীন বন্ধু দেশ। ভারতের যে নারী পহেলা জুলাই গুলশান হত্যাকা-ে নিহত হন তিনি এসেছিলেন বাবার কাছে, যিনি দীর্ঘদিন যাবত বাংলাদেশ থেকে ‘গার্মেন্টস’ নিয়ে যেতেন। অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে হামলাকারীদের লক্ষ্য ছিল এমন বিদেশী যারা আমাদের উন্নয়নের সহযোগী- কেউ প্রকল্পের সাহায্যকারী, কেউ গার্মেন্টস ক্রেতা। আমরা জানি ‘গার্মেন্টস’ আমাদের দ্বিতীয় বৃহত্তম বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী পণ্য, প্রথমটি অবশ্যই ‘রেমিটেন্স’। আমাদের অর্থনীতি রেমিটেন্স ও গার্মেন্টস রফতানির ওপর দাঁড়িয়ে আছে। এমতাবস্থায় প্রশ্ন দেখা দিয়েছে গুলশানের এই হত্যাযজ্ঞ আমাদের অর্থনীতিকে প্রভাবিত করবে কী না। প্রশ্নটি আরও জটিল আকার ধারণ করেছে কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়ার হত্যাকা-। গুলশানের হত্যাকা-ের ঝাঁকুনি হজম করতে না করতেই জঙ্গীরা আরেক হত্যাকা- ঘটায় পবিত্র ঈদের দিনে। সাত জুলাই দেশের সর্ববৃহৎ ঈদের জামাতের স্থান শোলাকিয়াতে নিরীহ এক নারীসহ তিনজনের প্রাণ নেয় জঙ্গীরা। ধারণা করা হচ্ছে দুই পুলিশ হত্যাকা-ে জঙ্গীরা বাধাগ্রস্ত না হলে সেদিন কিশোরগঞ্জে ঘটতে পারত বড় ধরনের হত্যাকা-। সেই থেকে দেশ মুক্তি পেয়েছে। কিন্তু গুলশান ও শোলাকিয়া হত্যাকা- আমাদের ভাবমূর্তিতে যে কালিমা লেপন করেছে তার প্রতিক্রিয়া ইতোমধ্যেই আমরা ব্যবসা-বাণিজ্যে পড়তে দেখছি; যদিও অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছেন, এসব জঙ্গীকা- অর্থনীতিতে কোন প্রভাব বিস্তার করবে না। অবশ্য বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ বলেছেন, অর্থনীতির উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করার জন্যই এই হত্যাকা- ঘটানো হয়েছে। অর্থনীতিকে বাধাগ্রস্ত করার যে আশঙ্কা বাণিজ্যমন্ত্রী করেছেন তার প্রথম আলামত দেখা যাচ্ছে দেশের পর্যটন শিল্পে। দেখা যাচ্ছে ‘এপিজি’ (এশিয়া প্যাসিফিক গ্রুপ অন মানিলন্ডারিং) সম্মেলনের অনুষ্ঠানস্থল পরিবর্তন হয়েছে। যে সম্মেলন ঢাকায় অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল তা এখন অনুষ্ঠিত হবে নিউইয়র্কে। এই সম্মেলন উপলক্ষে অতিথিদের জন্য ঢাকায় বিভিন্ন হোটেল ‘বুক’ করা ছিল। নিরাপত্তাজনিত কারণ দেখিয়ে এসব ‘বুকিং’ বাতিল করা হয়েছে। সংবাদপত্রের প্রতিবেদন থেকে দেখা যাচ্ছে সোনারগাঁও হোটেল, ওয়েস্টিন, রেডিসন ব্লু, ওয়াটার গার্ডেন নামীয় হোটেলের ‘বুকিং’ অবস্থা খারাপ। সমানে ‘বুকিং’ বাতিল হচ্ছে। গুলশানের গেস্ট হাউসগুলোরও একই অবস্থা। এরই মধ্যে তাদের অবস্থা আরও এক কারণে খারাপ। সরকারের সিদ্ধান্ত গুলশান অঞ্চলের অবৈধ স্থাপনা তুলে দেয়া হবে। এই সিদ্ধান্তে ছোট গেস্ট হাউসগুলো আতঙ্কে আছে। বলাবাহুল্য, এসব গেস্ট হাউস, হোটেল ইত্যাদির সঙ্গে জড়িত রেস্তরাঁর ব্যবসা। বিদেশীরা এখন বাড়ি থেকে বেরোচ্ছেন না। সেলফোন কোম্পানির বিদেশী উর্ধতন কর্মকর্তাদের বাড়িতে বসে কাজ করতে বলা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রসহ অনেক দেশ বাংলাদেশ ভ্রমণের ওপর সতর্কতা অবলম্বনের পরামর্শ দিচ্ছে। শুধু কনফারেন্স ও সম্মেলন ইত্যাদি সম্পর্কিত পর্যটক নয়, দেখা যাচ্ছে গার্মেন্টস খাতেও এর প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। অনেক ক্ষেত্রে কিছু কিছু অর্ডার বাতিল করা হয়েছে বলে খবর ছাপা হচ্ছে। অনেক ক্রেতা ঢাকায় বৈঠক না করে সেই বৈঠক হংকং, সিঙ্গাপুরে করতে চাইছে বলে ‘বিকেএমইএ’ এবং ‘বিজিএমইএ’র নেতৃবৃন্দ বলছেন। এদিকে সিঙ্গাপুরে ঘটেছে আরেক ঘটনা, যার জের পড়বে রেমিটেন্সে। সেখানে চার বাংলাদেশীকে বিভিন্ন মেয়াদে জেল দেয়া হয়েছে। তারা সেখানে সন্ত্রাসী কর্মকা- চালানো, বাংলাদেশ সরকার উৎখাতের জন্য অর্থ সংগ্রহ করছিল বলে যে অভিযোগ আনা হয় তা আদালতে প্রমাণিত হয়েছে। এর আগে কয়েক বাংলাদেশীকে একই অভিযোগে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো হয়। বলাবাহুল্য, সিঙ্গাপুরে বহু বাংলাদেশী কর্মরত এবং সেখান থেকে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে রেমিটেন্স আসে। দেখা যাচ্ছে গুলশান হত্যাকা-, শোলাকিয়া হত্যাকা-, সিঙ্গাপুুরে বাংলাদেশীদের দ- সবই এক সূত্রে গাঁথা। এসব জঙ্গী ঘটনা আমাদের ব্যবসা-বাণিজ্যকে ক্ষতিগ্রস্ত করার পথ সৃষ্টি করেছে। রেমিটেন্সকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে হয়েছে উদ্যত। এরই মধ্যে আমাদের প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়ন নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। বাংলাদেশের গ্রামগঞ্জসহ অনেক প্রকল্প এলাকায় চীনা, কোরীয় ও জাপানী থেকে শুরু করে অনেক বিদেশী কর্মরত। কয়েক লাখ বিদেশী ঢাকা শহরেই অবস্থান করছেন। এরা প্রকল্পসহ বিভিন্ন ব্যবসায়িক কাজেও নিয়োজিত। ‘জাইকা’ (জাপান ইন্টারন্যাশনাল কর্পোরেশন এজেন্সি) আমাদের মেট্রোরেল নিয়ে কাজ করছে। তারা আমাদের উন্নয়ন প্রকল্পে জড়িত। যদিও তারা বলছেন তাদের কাজে কোন ছেদ পড়বে না, তবু অনুমান করা যায় এক্ষেত্রেও নিরাপত্তা ইস্যু বড় হয়ে দেখা দেবে। এভাবে দেখলে বোঝা যাবে নানা ক্ষেত্রে ব্যবসায়িক অসুবিধা দেখা দিতে শুরু করেছে। কয়েকটি খবর আমাদের জন্য নেতিবাচক হিসেবে দেখা দিয়েছে। ইতিবাচক খবরের মধ্যে আছে মূল্যস্ফীতি। মূল্যস্ফীতি বহু বছর পর ৬ শতাংশের নিচে নেমেছে। কিন্তু এই মূল্যস্ফীতি কতদিন ধরে রাখা যাবে তা প্রশ্নসাপেক্ষ। আন্তর্জাতিক বাজারের খবর আমাদের জন্য ভাল নয়। তেলের দাম বাড়তে শুরু করেছে। চাল, ডাল থেকে শুরু করে প্রায় প্রত্যেকটি নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম আন্তর্জাতিক বাজারে সম্প্রতি বেড়েছে। এই অর্থে বিশ্বব্যাংক, ফাও ইত্যাদি প্রতিষ্ঠান নিয়মিত খবর দিয়ে যাচ্ছে। যে কয়টি পণ্যের নিম্নমুখী মূল্যের জন্য আমাদের অর্থনীতি গত কয়েক বছর যাবত স্বস্তিতে ছিল সেইসব পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি পাচ্ছে। এতে যে মূল্যস্ফীতির ওপর চাপ পড়বে তা বলাইবাহুল্য। কারণ আমাদের মূল্যস্ফীতির একটা বড় অংশ আমদানিজনিত কারণে প্রভাবিত হয়। খাদ্যশস্যের দাম স্থিতিশীল থাকায় মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে। কিন্তু খাদ্যবহির্ভূত পণ্যসমূহের দাম আন্তর্জাতিক বাজারে বাড়তে থাকলে আমাদের ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা আছে। অন্যদিকে খারাপ খবর ছিল রেমিটেন্স। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে রেমিটেন্স প্রবাহ হ্রাস পেয়েছে। উন্নত দেশগুলোর মন্দা এবং মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর অস্থিরতার কারণে রেমিটেন্স প্রবাহে টান পড়েছে। এরই মধ্যে খবর পাওয়া গেছে সৌদি আরব, কুয়েত ও ওমান প্রভৃতি দেশ প্রবাসীদের আয়ের ওপর দশ শতাংশ হারে কর বসাবে। এর অর্থ এসব দেশ থেকে আসা রেমিটেন্সের পরিমাণ হ্রাস পাবে, যদি না ঐসব দেশে নতুন শ্রমিক চাকরি নিয়ে যায়। এছাড়া আমাদের টাকা ডলারের বিপরীতে বেশ শক্তিশালী ও স্থিতিশীল। এসব কারণে ২০১৬-১৭ অর্থবছরে রেমিটেন্স প্রবাহে আরও টান পড়তে পারে বলে আশঙ্কা। এর মধ্যে যদি নিরাপত্তাজনিত কারণে আমাদের গার্মেন্টস ক্রেতারা তাদের মুখ ফিরিয়ে নেয় তাহলে সমূহ বিপদের সম্ভাবনা। অর্থাৎ বিপদটি ত্রিমুখী। একদিকে আন্তর্জাতিক বাজারে আমাদের আমদানিযোগ্য পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি পাচ্ছে, যা রিজার্ভ পরিস্থিতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে, মূল্যস্ফীতিকে উসকে দেবে, অন্যদিকে রেমিটেন্স প্রবাহ হ্রাস পেলে দেশীয় বাজারে তার প্রতিক্রিয়া দেখা দেবে। অভ্যন্তরীণভাবে ভোগ হ্রাস পাবে। বাংলাদেশের লাখ লাখ রেমিটেন্স প্রাপকের আয় হ্রাস পাবে, যা ইতোমধ্যেই বেশ হ্রাস পেয়েছে। তৃতীয়ত, বাকি আছে ‘গার্মেন্টস’। এখনও ‘গার্মেন্টস’ ঠিক আছে। কিন্তু অবিলম্বে নিরাপত্তা ইস্যু অর্থাৎ জঙ্গী ইস্যুতে দৃশ্যমান উন্নতি দেখাতে না পারলে সমূহ ধসের আশঙ্কা আছে। আশার কথা সরকার নড়েচড়ে বসেছে। নিরাপত্তা উন্নত করতে অনেক পদক্ষেপ গৃহীত হচ্ছে। আমার ধারণা প্রশাসনিক পদক্ষেপের পাশাপাশি দরকার সাংস্কৃতিক পদক্ষেপ। বর্তমান সমস্যাটি যতটুকু না রাজনৈতিক, তার চেয়ে বেশি সামাজিক ও সাংস্কৃতিক। জঙ্গীরা লালিত হয়, জঙ্গী ধারণা পালিত হয় সমাজের একাংশে। সেখানে তাদের ‘স্পেস’ আছে। এই জায়গাটাকে নির্মূল করতে হবে। গোড়া কেটে আগায় জল ঢাললে কোন লাভ হবে না। অর্থনৈতিক অগ্রগতি ধরে রাখতে হলে উদার সমাজ দরকার হবে। অগ্রগতি ও উদার সমাজ অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। লেখক : সাবেক শিক্ষক, ঢাবি
×