ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

১৯ মে ভাষা আন্দোলন ও আমাদের কৈফিয়ৎ

প্রকাশিত: ০৭:৪০, ১৪ জুলাই ২০১৬

১৯ মে ভাষা আন্দোলন ও আমাদের কৈফিয়ৎ

১৮ মে গিয়েছিলাম ভারতের অসম রাজ্যের শিলচরে বাংলা ভাষার শহীদদের প্রতি সম্মান জানাতে। অসম রাজ্যের অন্যতম সরকারী ভাষা হিসেবে বাংলাকে স্বীকৃতি দেয়ার দাবিতে বাঙালি অধ্যুষিত বরাক উপত্যকায় তুমুল আন্দোলন গড়ে উঠে। সে আন্দোলনেরই একপর্যায়ে ১৯৬১ সালের ১৯ মে সংগ্রাম কমিটির আহ্বানে সমগ্র বরাক উপত্যকায় অবরোধ কর্মসূচী পালিত হয়। রাজপথ, রেলপথ, সড়কপথ এবং সরকারী অফিস-আদালতে হাজার হাজার মানুষ অবরোধ সৃষ্টি করে। ভোর থেকেই কাছাড় জেলার শিলচর স্টেশনে রেলপথ অবরোধ করে বিপুলসংখ্যক নারী-পুরুষ। রেলপথ থেকে অবরোধকারীদের সরাতে ব্যর্থ হয়ে দুপুর আড়াইটায় সীমান্ত নিরাপত্তা বাহিনী (বিএসএফ) গুলিবর্ষণ করেন। অতর্কিত গুলিবর্ষণে ঘটনাস্থলে ১১ বীর বাঙালি শহীদ হন। তারা হলেনÑ (১) কমলা ভট্টাচার্য (২) কানাইলাল নিয়োগী (৩) তরণী দেবনাথ (৪) শচীন্দ্রনাথ পাল (৫) বীরেন্দ্র সূত্রধর (৬) সুনীল সরকার (৭) কুমুদ চন্দ্র সরকার (৮) সত্যেন্দ্র দেব (৯) হিতেস বিশ্বাস (১০) চ-ীচরণ সূত্রধর ও (১১) সুকমল পুরকায়স্থ। নিহতদের মধ্যে সদ্য উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা দেয়া কমলা ভট্টাচার্য হলে সম্ভবত : বিশ্বের প্রথম নারী যিনি ভাষা আন্দোলনে শহীদ হয়েছেন। এখানে উল্লেখ্য যে, কমলা ভট্টাচার্যের আদিবাস ছিল বাংলাদেশের সিলেট জেলার ঢাকা দক্ষিণ এলাকায়। পাঠকদের সুবিধার জন্য এই বরাক উপত্যকার ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপট সংক্ষেপে তুলে ধরা আবশ্যক বোধ করছি। বরাক উপত্যকার ভৌগলিক অবস্থান ও ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপট এক সময় বৃহৎ কাছাড় জেলা ছিল বর্মণ রাজাদের দ্বারা শাসিত। ১৯৩২ সালে ব্রিটিশ লাট বেন্টিঙ্কের শাসনামলে শেষ বর্মণ রাজা গোবিন্দচন্দ্রের বিধবা পতœী ইন্দুপ্রভার হাত থেকে ইংরেজরা কাছাড়ের শাসনভার গ্রহণ করে। ইংরেজ শাসিত এই কাছাড়া জেলা তৎকালে বঙ্গদেশের অন্তর্ভুক্ত হয়। এর পূর্বে ব্রিটিশ শাসনামলে ১৮৭৪ সালে বাংলার বৃহৎ জেলা শ্রীহট্টকে অসমের সঙ্গে যুক্ত করা হয় রাজস্ব আদায়ের সুবিধার্থে। ১৯৪৭ সালে দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ভারতবর্ষ বিভক্ত হয়ে ভারত ও পাকিস্তান নামের দুটি আলাদা রাষ্ট্র গঠনে ব্রিটিশ রাজশক্তি এবং কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ ঐকমত্য পোষণ করে। সে সিদ্ধান্ত মোতাবেক সিলেট ভারত না পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্ত হবে তা নির্ধারণের জন্য ১৯৪৭ সালে ৭ জুলাই বৃহত্তর সিলেটে গণভোট অনুষ্ঠিত হয়। ৫৫,৫৭৮ ভোটের ব্যবধানে সিলেট পাকিস্তানে থাকার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। তবে সিলেটের করিমগঞ্জ মহকুমার তিনটি থানা ভারতের অসম রাজ্যের সঙ্গে যুক্ত হয়। ১৮৭৪ সালে বঙ্গদেশের বাঙালি অধ্যুষিত তিন জেলা শ্রীহট্ট, কাছাড় ও গোয়ালপাড়া অসমের অন্তর্ভুক্ত হয়। সে সময় অসমে রাই ছিল সংখ্যা গরিষ্ঠ। কিন্তু পরবর্তী পর্যায়ে জাতিগত দাঙ্গা এবং খেদাও আন্দোলনের ফলে বাঙালিদের সংখ্যা কমতে শুরু করে। সে সময়কার কয়েকটি আদমশুমারি লক্ষ্য করলেই এ বক্তব্যের যথার্থতা নির্ণয় করা সহজ হবে। আদমশুমারি অনুযায়ী অসমের ভাষাভিত্তিক জনসংখ্যা হলো : ১৯৩১ সালের আদমশুমারি বাঙালি ৩৯,৫৪,০৩৫ জন অসমিয়া ১৯,৮৫,৫১৫ জন পাহাড়ী জনজাতি ১২,৫৩,৬১৩ জন বিভিন্ন ভাষাভাষী ৭,৫৬,১৫০ জন ১৯৫৬ সালের আদমশুমারি অসমিয়া ৫৯,৬৫,১৫৯ জন বাঙালি ১৭,১৯,১৫৫ জন পাহাড়ী জনজাতি ৭,৫৬,১৫০ জন অন্যান্য ভাষাভাষীর সংখ্যা উল্লেখ নেই ১৯৬১ সালের আদমশুমারি অসমিয়া ৮৯,৪৯,৯৬৬ জন বাঙালি ২৯,০৭,১০০ জন পাহাড়ী ও অন্যান্য জনজাতি ২৮,১৫,০৫৩ জন ১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্তির পর অসম বিধান সভার শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান ও ভাষণে ১৯৫০ সাল পর্যন্ত বাংলা ভাষার প্রচলন ছিল। ১৯৫৩ সালে রাজ্যে আইন করা হলো যাতে বিধান সভায় অসমিয়া এবং ইংরেজীকে সরকারী ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়। সে সময় রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন কংগ্রেসের বিমলা প্রসাদ চালিহা। একই মুখ্যমন্ত্রীর শাসনামলে ১৯৬০ সালের ১০ অক্টোবর অসম বিধান সভায় নতুন আইন ‘রাজ্য ভাষা বিল’ পাস হলো। এই আইনে একমাত্র অসমিয়াকে রাজ্যের সরকারী ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়। এই আইনের ফলে রাজ্যের দ্বিতীয় বৃহত্তম জনগোষ্ঠীর ভাষা বাংলাকে তার প্রাপ্ত মর্যাদা থেকে বঞ্চিত করা হয়। ভাষা আন্দোলনের সূত্রপাত অসম রাজ্যে অসমিয়াকে একমাত্র সরকারী ভাষা করার চক্রান্ত স্পষ্ট হয়ে গেলে ১৯৬০ সালের ২ জুলাই শিলচর শহরে নিখিল অসম বাংলা ভাষা ও অন্যান্য অনসমিয়া ভাষা সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। ঐতিহাসিক এই সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন প্রবীণ সাংবাদিক, আনন্দবাজার পত্রিকার সম্পাদক ও লোকসভা সদস্য শ্রীযুক্ত চপলাকান্ত ভট্টাচার্য। এই সম্মেলনে কংগ্রেস নেতা ও অসমের মন্ত্রী শ্রী বৈদ্যনাথ মুখোপাধ্যায় অভ্যর্থনা কমিটির সভাপতি হিসেবে অসমিয়াকে রাজ্যের একমাত্র সরকারী ভাষা করার উদ্যোগের তীব্র সমালোচনা করেন এবং এর পরিণতি সম্পর্কেও সবাইকে হুঁশিয়ার করে দেন। অসমে রাজ্যভাষা বিল পাস হবার পর ১৯৬১ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি কমিগঞ্জের রমনীমোহন ইনস্টিটিউটে ‘কাছাড় জেলা জনসম্মেলন’ অনুষ্ঠিত হয়। এই সম্মেলনে অভ্যর্থনা কমিটির সভাপতি শ্রী সুরেন্দ্রনাথ চৌধুরী গুরুত্বপূর্ণ লিখিত ভাষণ প্রদান করেন। তিনি ভাষণে বলেন, “ ............. এক শ্রেণীর সংকীর্ণমনা, প্রাদেশিকতাবাদী ও দূরদৃষ্টিহীন লোক এই রাজ্যে বিরোধ ও বিভেদ সৃষ্টি করে আসছেন। অসম রাজ্য যেন শুধু অসমিয়া ভাষাভাষীর- অন্য ভাষাভাষীরা যেন এই রাজ্যে অনভিপ্রেত ও অবাঞ্চিত। তাহাদের এ মনোভাব অদ্ভুত, অযৌক্তিক এবং দেশের স্বার্থের পরিপন্থী।” এই সম্মেলনের পর কাছাড় গণসংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। প্রতি মহকুমায়ও গঠিত হয় আলাদা আলাদা কমিটি। শিলচর মহকুমা গণসংগ্রাম কমিটির সম্পাদক হন পরিতোষ পাল চৌধুরী। কাছাড়ের অপর দুই মহকুমা করিমগঞ্জ ও হাইলাকান্দির প্রতি পাড়ামহল্লা, জনপদে বাংলাকে রাজ্যের অন্যতম সরকারী ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার দাবিতে তুমুল আন্দোলন গড়ে উঠে। সভা-সমাবেশ, পোস্টার-লিফলেটিং, আলাপ-আলোচনা পদযাত্রার মাধ্যমে মানুষ তার মতামত প্রকাশ করতে থাকে। বাংলাকে রাজ্যভাষা থেকে বিতাড়িত করার পাশাপাশি অসম থেকে ‘বাঙালি খেদাও আন্দোলন’ আরও নৃশংস হবার আশঙ্কায় এই বরাক উপত্যকার বাঙালিদের মধ্যে ক্ষোভ ও অস্থিরতা বৃদ্ধি পেতে থাকে। এই ষড়যন্ত্র প্রতিরোধ করে নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য সকল বাঙালি ঐক্যবদ্ধ হয়। এই আন্দোলনেরই চূড়ান্ত পর্যায়ে ১৯৬১ সালের ১৯ মে বরাক উপত্যকা রক্তে রঞ্জিত হয়। কাছাড় জেলার শিলচরে বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষার দাবিতে রেলপথ অবরোধকারী ১১ বীর বাঙালি রক্তের আখরে লিখে গেল বাংলা ভাষার নাম। ১৯ মে সংগঠিত বর্বর হত্যাকা-ের প্রতিবাদে পুরো বরাক উপত্যকা উত্তাল হয়ে উঠে। সভা-সমাবেশ, বিক্ষোভ-মিছিল, স্মরণসভার মধ্য দিয়ে শহীদদের প্রতি সম্মান এবং বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষার দীপ্ত শপথ পুনরুচ্চারিত হয়। এ সময় অসমের বাঙালিদের পাশে এসে দাঁড়ায় ত্রিপুরা এবং পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিরা। আগরতলায় হাজার হাজার ছাত্রছাত্রী ও সাধারণ মানুষ বিক্ষোভ মিছিল বের করে। শিলচর হত্যাকা-ের প্রতিবাদে কলকাতায় সর্বাত্মক ‘বন্দ’ পালিত হয়। এ সময় অসমে বাংলা ভাষার ভবিষ্যত নিয়ে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার ও রাজ্য সরকারের সঙ্গে আন্দোলনকারীদের বেশ কয়েক দফা বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বাঙালি অধ্যুষিত পশ্চিমবঙ্গের চাপও কেন্দ্রীয় সরকারের উপর প্রভাব বিস্তার করে। ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী প-িত জওহরলাল নেহেরু এবং সচিব জগজীবন রাম আন্দোলনকারীদের সঙ্গে কয়েক দফা বৈঠকে মিলিত হয়ে সঙ্কট সমাধানে উদ্যোগী হন। এ সময় পশ্চিমবঙ্গের মার্কসবাদী কমিউনিস্ট নেতা জ্যোতিবসু যুক্তরাষ্ট্রীয় পদ্ধতির ভারতীয় শাসন ব্যবস্থায় বিভিন্ন রাজ্যের প্রধান ভাষাগুলোকে সে রাজ্যের সরকারী ভাষার মর্যাদা দেবার পক্ষে মত প্রকাশ করেন। কেন্দ্রীয় সরকারের চাপ, জ্যোতিবসুর মতামত এবং সামগ্রিক সঙ্কটের কথা বিবেচনা করে অসম সরকার রাজ্যের বরাক উপত্যকার বাঙালি অধ্যুষিত তিনটি জেলায় রাজ্যের অন্যতম সরকারি ভাষা হিসেবে বাংলাকে স্বীকৃতি প্রদান করে। এ তিন জেলা হলো : কাছাড়, হাইলাকান্দি ও করিমগঞ্জ। এই স্বীকৃতির ফলে সরকারি অফিস-আদালতের নাম ফলক, সাইনবোর্ড, দাপ্তরিক কার্যাবলী, শিক্ষার মাধ্যমে বাংলা ব্যবহারের অধিকার নিশ্চিত হয়। কিন্তু সেখানকার বাঙালিদের আরও বেশ কয়েকটি দাবি এখনো অপূর্ণ রয়েছে। গোয়ালপাড়াসহ অসমের অন্য অঞ্চলে বন্ধ হয়ে যাওয়া বাংলা স্কুলগুলো পুনরায় চালু করা, শিলচর রেলস্টেশনকে ভাষা শহীদ রেলস্টেশন’ নামে নামকরণ এবং ১৯ মে কে সরকারিভাবে ‘ভাষা শহীদ দিবস’ অথবা ‘ভাষা প্রণাম দিবস’ হিসেবে ঘোষণা প্রদান। বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি লালন ও চর্চায় রাজ্যের আরও উদ্যোগী ভূমিকা গ্রহণ জরুরী বলে এ অঞ্চলের মানুষ মনে করে। তারা অন্যভাষার আগ্রাসী ভূমিকা থেকে বাংলা ভাষাকে রক্ষার জন্য নাগরিক উদ্যোগ এবং দায়িত্বের কথাও আমাদের বলেছেন। ফিরে আসি এবার ১৯ মে উদযাপনের কথায়। ভাষা শহীদ স্টেশন শিলচর স্মরণ সমিতির আমন্ত্রণে আমি ১৮ মে শিলচর পৌঁছাই। কাছাড় জেলা হেড কোয়ার্টার হলো প্রাচীন এই শহর। পুরো শহরজুড়েই ১৯ মে পালনের ব্যাপক প্রস্তুতি। রাজনৈতিক মতাদর্শের উর্ধে উঠে এই অঞ্চলের সব বাঙালি ১৯ মে দিবসটাকে আমাদের একুশের মতোই পালন করে। শহরের বাইরের বিভিন্ন এলাকায়ও কর্মসূচী পালিত হয়। কি ধরনের প্রস্তুতি এবং আন্তরিকতা নিয়ে অনেক সীমাবদ্ধতার মধ্যে মাতৃভাষা বাংলার মর্যাদা রক্ষার জন্য এই দিবসটিকে তারা পালন করে তার ব্যাপকতা বোঝানোর জন্য আমার অংশগ্রহণের সূত্র ধরে কয়েকটি অনুষ্ঠানের সংক্ষিপ্ত বিবরণী এখানে তুলে ধরছি। সম্মিলিত সাংস্কৃতিক মঞ্চ বাংলাদেশের সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের আদলে ২০০০ সালে শিলচরের ২৮ সংগঠন একত্রিত হয়ে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক মঞ্চ গঠন করে। ১৯ মে শহীদ দিবস স্মরণে শিলচর পাবলিক হল মিলনায়তনে ১৭-১৯ মে তিন দিনব্যাপী অনুষ্ঠান আয়োজিত হয়। আয়োজকরা আমাকে এবং শিল্পী শুভেন্দু মাইতিকে এখানে নিয়ে আসেন। আমরা দু’জনই এখানে আলোচনায় অংশ নেই। ১৯ তারিখ বাংলাদেশ থেকে আগত সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব নাসিরউদ্দিন ইউসুফ, মুক্তিযোদ্ধা মেজর শামসুল আরেফিন, সঙ্গীতশিল্পী ও অভিনেত্রী শিমুল ইউসুফ এবং সাংস্কৃতিক জোটের সাধারণ সম্পাদক হাসান আরিফ এই মঞ্চের অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেন। অসম বিশ্ববিদ্যালয় ১৯ মে উপলক্ষে শিলচরে বাংলাদেশের শিল্পী সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বদের ব্যাপক উপস্থিতি সেখানকার বাঙালিদের মাঝে উদ্দীপনার সৃষ্টি করেছে। ভাষা আন্দোলনের সূতিকাগার অমর একুশের স্রষ্টা বাংলাদেশের জনগণের প্রতি শিলচরবাসীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় আমরা অভিভূত। অসমে বাংলা ভাষার ভবিষ্যত নিয়ে তাদের মাঝে নানা শঙ্কা কাজ করলেও তারা এক বাক্যে বলছে যতদিন বাংলাদেশ থাকবে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির অস্বিত্ব কখনো হারিয়ে যাবে না। আমাদের একুশের পথ বেয়েই শিলচরে উনিশে মে’র জন্ম হয়েছে। শিলচরের বাঙালির রক্তস্রোত বরাক নদী থেকে সুরমা-কুশিয়ারায় মিলিত হয়ে বাংলাদেশে প্রবাহিত হয়েছে। আর সে রক্তস্রোতে অবগাহন করে ও আমরা কি নিজেদের বিস্মৃতির অন্তরালে গুটিয়ে রাখবো। আমাদের একুশে ফেব্রুয়ারি আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে সারা বিশ্বে পালিত হচ্ছে। আমাদের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা যখন জাতিসংঘে দাঁড়িয়ে বাংলায় বক্তৃতা দেন- বাংলাকে জাতিসংঘের অন্যতম দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেবার দাবি উথাপন করেন তখন গর্বে আমাদের বুক ফুলে উঠে। তার এ দাবি শুধু বাংলাদেশের বাঙালিদের দাবি নয় সারা পৃথিবীর সকল দেশের বাঙালিদেরও প্রাণের দাবি। একুশে ফেব্রুয়ারি আজ শুধু বাংলাদেশের নয় সারা পৃথিবীর মানুষদের। বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম বাঙালি অধ্যুষিত রাষ্ট্র ভারতের বিভিন্ন রাজ্য একুশে ফেব্রুয়ারি উদযাপন কি সেই সত্যের প্রতিধ্বনি নয়? তারা কি এ আন্দোলন ও রক্তস্রোত থেকে শক্তি সম্ভার করেনি? বিশেষত ভারতের পশ্চিমবঙ্গে, অসম, ত্রিপুরা, মেঘালয়, ঝাড়খ-, বিহার, মহারাষ্ট্র এবং অন্যান্য রাজ্যে যখন একুশে ফেব্রুয়ারি উদযাপিত হয় তখন তারা রাষ্ট্রীয় সীমানাকে অতিক্রম করে বৃহত্তর জাতিসত্তাকে আলিঙ্গন করে। শহীদ রফিক, শফিক, সালাম, জব্বার, বরকত, সালাউদ্দিন, আউয়াল, অহিউল্লাহ্ তখন আর ভিনদেশের নাগরিক থাকেন না- হয়ে উঠেন তাদের পরমাত্মীয়। একুশে ফেব্রুয়ারির রক্তস্রোত থেকে শিক্ষা নিয়েই তো অসমের শিলচরের মানুষ বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষার জন্য জীবন বিলিয়ে দিয়েছে। একুশ আর উনিশের মিলিত রক্তস্রোত বৃহত্তর বাঙালি জাতিসত্তার অস্তিত্বের বাঁধনকে আরো দৃঢ় করেছে। অথচ আমরা বাংলাদেশের বাঙালিরা কি অদ্ভুত নীরবতায় বিস্মৃতির মাঝে ১৯ মে পার করে দেই। একবারও ভাবিনা ওরাতো আমাদেরই মতো বাংলা ভাষার জন্য জীবন দিয়েছে- এক, দু’জন নয় এগারো জন। একটু সহানুভূতি, একটু শ্রদ্ধা, এক গুচ্ছ ফুলও কি তাদের প্রাপ্য নয় ? আসুন না একুশের উত্তরসূরি উনিশকেও আমরা শ্রদ্ধা জানাই, আমাদের করে নেই। বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির মূল সূতিকাগার বাংলাদেশই পারে নিজের বিশালত্ব দিয়ে সবাইকে আপন করে নিতে। শহীদ রফিক, শফিক, সালাম, জব্বার, বরকত, সালাউদ্দিন, কমলা ভট্টাচার্য, কানাইলাল নিয়োগী, সুনীল সরকারদের রক্তদান আমাদের অস্তিত্বের অহঙ্কার, যুথবদ্ধভাবে এগিয়ে যাবার অনুপ্রেরণা। ভাষা আন্দোলনের সকল শহীদদের প্রতি জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা ও অভিবাদন।
×