ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

সুমন্ত গুপ্ত

চলে গেলেন কিংবদন্তি চলচ্চিত্রকার

প্রকাশিত: ০৬:৪২, ১৪ জুলাই ২০১৬

চলে গেলেন কিংবদন্তি চলচ্চিত্রকার

ফিল্মমেকার। অটিওর। কবি। কোন একটা সজ্ঞায় বাধা যাবে না তাকে। বাকি দুনিয়াকে ইরানের সিনেমা দেখতে শিখিয়েছিলেন তিনিই আব্বাস কিয়ারোস্তামি। গত ৪ জুলাই সোমবার রাতে প্যারিসে জীবনাবসান হলো ৭৬ বছরের পরিচালকের। গ্যাস্ট্রো-ইনটেস্টিনাল ক্যান্সারের সঙ্গে লড়াই করছিলেন তিনি। চিকিৎসার জন্যই প্যারিসে গিয়েছিলেন। বিখ্যাত ব্যক্তিত্বের মৃত্যুর পর তাঁর স্মৃতিচারণটা স্বাভাবিক। কিন্তু কিয়ারোস্তামি তো তাঁর দর্শককে জীবন সেলিব্রেট করতে শিখিয়েছেন। কারণ তিনিও তো জীবনকে ভালবাসতেন। প্রায় ৪০ বছরের কেরিয়ারে তাঁর ছবির সংখ্যা যত, পুরস্কারের সংখ্যা তার চেয়ে অনেক বেশি। কিয়ারোস্তামির মৃত্যুর সংবাদ পেয়ে অস্কারজয়ী ইরানী চলচ্চিত্রকার আসগর ফরহাদি বলেছেন, কিয়ারোস্তামি শুধুই একজন চলচ্চিত্র নির্মাতা ছিলেন না, তিনি ছিলেন একজন আধুনিক মরমি কবি। তিনি অন্যদের জন্য পথ তৈরি করে গেছেন। শুধু চলচ্চিত্র জগতই একজন মহান নির্মাতাকে হারাল না, পুরো পৃথিবীই একজন সত্যিকার মহান মানুষকে হারাল। আরেকজন খ্যাতিমান ইরানী পরিচালক মোহসেন মাখমালবাফ বলেছেন, পুরো পৃথিবীই তার অসাধারণ কাজের কথা জানে, কিন্তু নিজের দেশে তা পুরোপুরি পৌঁছে দেয়া সম্ভব হয়নি। কিয়ারোস্তামির মাধ্যমেই ইরানী ছবি আন্তর্জাতিক সুনাম পেয়েছে। কিন্তু ইরানে তার ছবিগুলোর প্রদর্শনী সেভাবে হয়নি। তিনি চলচ্চিত্রের ভাষা পরিবর্তন করে দিয়েছিলেন, হলিউডি ছবির তুলনায় চলচ্চিত্রকে মানবিক করে তুলেছেন। তিনি ছিলেন জীবনীশক্তিসম্পন্ন একজন মানুষ। তিনি জীবনকে ভালবাসতেন এবং তার চলচ্চিত্রে জীবনেরই জয়গান গেয়েছেন, তাই মৃত্যুর সঙ্গে তাকে মেলানো যায় না। তার মৃত্যুকে মানা যায় না। আব্বাস কিয়ারোস্তামিকে বলা হয় ইরানের চলচ্চিত্রগুরু। তার সম্পর্কে মার্কিন পরিচালক মার্টিন স্করসিস বলেন, ‘তিনি একেবারেই অন্যরকম মানুষ ছিলেন। শান্ত, মার্জিত, বিনয়ী, স্পষ্টভাষী এবং বেশ পর্যবেক্ষণশীল। তিনি ছিলেন আপাদমস্তক ভদ্রলোক এবং সত্যিকার অর্থেই আমাদের মধ্যে দারুণ একজন শিল্পী। চলচ্চিত্রে শিল্পদক্ষতার চূড়ান্ত পর্যায় উপস্থাপন করে গেছেন তিনি।’ নিউইয়র্কের চলচ্চিত্র বিষয়ক ম্যাগাজিন দ্য ফিল্ম স্টেজ টুইটারে উল্লেখ করেছে, ‘বিশ্ব অসাধারণ একজন চলচ্চিত্রকারকে হারাল।’ ব্রিটিশ ফিল্ম ইনস্টিটিউট টুইট করেছে, ‘এ মৃত্যু বিষাদের।’ আব্বাসকে টেলিগ্রাফের চলচ্চিত্র সমালোচক রবি কলিন বলতেন, ‘জাদুকরের ছদ্মবেশে অবিশ্বাস্য কাজের মানুষ।’ নিউইয়র্কের কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটির ইরানী শিক্ষার অধ্যাপক হামিদ দাবাশি বলেন, ‘তাঁর শিল্পের অদ্ভুত ব্যাপার হলোÑ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও শহুরে চেতনা। উভয় উঠে এসেছে তার চিত্রগ্রহণে। অসাম্প্রদায়িকতায় ইরানী দৃষ্টিভঙ্গিও তুলে ধরতে পেরেছেন তিনি।’ আব্বাসের ছবিগুলো বিশ্ব চলচ্চিত্রে যেন মুক্ত হাওয়ায় নিঃশ্বাসÑ এ মন্তব্য করেছেন যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী ইরানী চলচ্চিত্র অধ্যাপক জামশিদ আকরামি। তার ভাষ্য, ‘ইরানের উন্নত জীবন ও সংস্কৃতির যোগ্য প্রতিনিধি ছিলেন তিনি। স্বর্ণপাম জেতার পর তার ছবি ও বিষয়বস্তুর সঙ্গে দর্শকরা নিজেদের সম্পৃক্ত করে নিয়েছেন।’ তেহরানে জন্ম কিয়ারোস্তামির। সত্তর দশকের শেষের দিকে খোমেনি-বিদ্রোহের পর যখন বেশিরভাগ চিত্র-নির্মাতা ইরান ছেড়ে অন্য দেশে আশ্রয় নিচ্ছিলেন, কিয়ারোস্তামি সে পথে হাঁটেননি। দেশে থেকেই ছবি তৈরি করতে চেয়েছিলেন তিনি। মনে করতেন, একটা গাছের শিকড় উপড়ে যদি অন্য কোথাও লাগানো হয়, তাহলে গাছটা বাঁচবে ঠিকই, কিন্তু তাতে ফল হবে না। তাঁকে যদি নিজের দেশ ছেড়ে অন্য কোথাও চলে যেতে হয়, তাহলে তাঁর শিল্পসত্তা আর জিইয়ে রাখা যাবে না। ১৯৭০ সালে তিনি প্রথম শর্টফিল্ম তৈরি করেন, ‘ব্রেড এ্যান্ড এ্যালি’। একজন অটিওরের জন্মের আভাস তখন থেকেই পাওয়া গিয়েছিল। ১৯৯৭ সালে ‘টেস্ট অফ চেরি’ ছবিটির জন্য তিনি কান চলচ্চিত্র উৎসবে পাম দ’ওর পুরস্কার জিতেছিলেন। ততদিনে অবশ্য তাঁর অতুলনীয় ফিল্মমেকিংয়ের সঙ্গে অনেকেরই পরিচয় হয়ে গিয়েছে। ১৯৮৭ থেকে ১৯৯৪ সালের মধ্যে তাঁর বিখ্যাত কোকের ট্রিলজি ‘হোয়্যার ইজ মাই ফ্রেন্ড’স হোম?’, ‘লাইফ এ্যান্ড নাথিং মোর’ এবং ‘থ্রু দ্য অলিভ ট্রিজ’। বাস্তব আর কল্পনা কী করে পর্দায় মিশে যায়, তা দেখিয়েছিলেন কিয়ারোস্তামি। তাঁকে আর মিনিম্যালিস্ট সিনেমাকে আলাদা করা যায় না। ‘ফাইভ’ ছবিটি তিনি জাপানি মাস্টার ফিল্মমেকার ওজুকে উৎসর্গ করেছিলেন। পরিচালনার পাশাপাশি কবিতাও লিখতেন। অবশ্য তাঁর একেকটা ছবিও কবিতারই মতো। তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ ‘উইন্ড উইল ক্যারি আস’। হলিউড যখন সুপারহিরো তৈরি করতে ব্যস্ত, কিয়ারোস্তামি সে সময় সিনেমাকে রক্ত-মাংসের রূপ দিয়েছিলেন। সাধারণ মানুষের নিত্যদিনের গল্পও অসাধারণ হয়ে উঠত তাঁর ফ্রেমে। অনেকেই মনে করেন, রাজনীতি থেকে দূরে থাকতেন কিয়ারোস্তামি। কিন্তু ‘শিরিন’ বা ‘টেন’ দেখে সেটা মনে হবে না। ইরানের মতো দেশে একজন মহিলাকে গাড়ীর স্টিয়ারিংয়ের পেছনে বসানো যথেষ্ট নারীবাদী স্টেটমেন্ট। গোটা ছবিজুড়ে তার গাড়ীতে অনেক চরিত্র ওঠে। যাদের সংলাপে বার বার পুরুষ দ্বারা নিপীড়িত সমাজের ছবি উঠে আসে। ইরানের অন্যতম রাজনৈতিক ছবি-নির্মাতা জাফর পনাহিও কিন্তু কিয়ারোস্তামিরই ‘প্রটেজি’। কিয়ারোস্তামির দেখানো পথ ধরে অনেক প্রজন্মের পরিচালক তৈরি হয়েছেন। সেটা ইরানে হোক বা বাকি দুনিয়ার অন্য দেশগুলোয়। তাঁর ‘ক্লোজ আপ’ দেখে সিনেমাকে নতুনভাবে ভালবাসতে ইচ্ছে করবে। ‘শিরিন’ দেখে তাঁর সাহসকে কুরনিশ জানাতে হবে। গোটা ছবিজুড়ে শুধু কিছু মেয়ের হেডশট। যারা একটা ছবি দেখতে দেখতে আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ে। ক্যামেরা শুধু তাদের মুখগুলোই ধরে। পর্দায় ছবিটা একবারের জন্যও দেখা যায় না। কিয়ারোস্তামি চলে যাওয়ায় সিনেমায় যে শ্ন্যূস্থান তৈরি হলো, সেটা আর কখনও পূরণ হবে না। কোন বাচ্চা ছেলে আর তার বন্ধুকে খুঁজতে গুটি গুটি পায়ে অচেনা গ্রামে পাড়ি দেবে না। কোন খ্যাপাটে লোককে সুদূর গ্রামে গিয়ে ফোনের নেটওয়ার্ক ধরতে উদভ্রান্তের মতো দৌড় ঝাপ করতে দেখা যাবে না। বিস্তৃত মাঠ, আলো-আঁধারি জঙ্গল, শান্ত সমুদ্রসৈকত আর কখনোই ক্যামেরার ফ্রেমে ধরা দেবে না। জীবদ্দশায় ৪০টিরও বেশি ছবি তৈরি করেন আব্বাস কিয়ারোস্তামি। এর মধ্যে আছে প্রামাণ্যচিত্র। ইরানী চলচ্চিত্রে নতুন ঢেউ তুলেছিলেন তিনি। চলচ্চিত্রাঙ্গনে তার পথচলা শুরু হয় ১৯৬০ সালে। ১৯৬৯ সালে আব্বাস কিয়ারোস্তামি বিয়ে করেন পারভীন আমিরকোলিকে। ১৯৮২ সালে এ বিয়ে ভেঙ্গে যায়। আব্বাস কিয়ারোস্তামি তার দুই ছেলে আহমেদ ও বাহমানের সঙ্গে বাকিটা জীবন কাটিয়ে দেন। এদের মধ্যে আহমেদ মাল্টিমিডিয়া প্রকাশক ও বাহমান প্রামাণ্যচিত্র নির্মাতা।
×