ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

গুলশানের জঙ্গী হামলা ও রিলিজিয়ন হেজিমনি -স্বদেশ রায়

প্রকাশিত: ০৩:৪০, ১৪ জুলাই ২০১৬

গুলশানের জঙ্গী হামলা ও রিলিজিয়ন হেজিমনি -স্বদেশ রায়

গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে ও শোলাকিয়ায় যে ঘটনা ঘটেছে এটা খুব অস্বাভাবিক বা হঠাৎ কিছু ভাবলে ভুল হবে। ২০১২ থেকে রাজধানীতে দিনের বেলায় পুলিশের ওপর হামলা, তার পরে সাঈদীর রায়ের পরে সারাদেশে বিশেষ করে বগুড়ায় যা ঘটে। এছাড়া ২০১৩ সাল থেকে শুরু হয় রাজীব হায়দারসহ একের পর এক তরুণ বুদ্ধিজীবী হত্যা। কেন এ হত্যাকা-গুলো ঘটছে দেশের মানুষ সবাই তা জানেন। কোথা থেকে টাকা আসছে এই অপরাধগুলো ঘটানোর জন্য তাও সকলে জানেন। সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী, মীর কাশেম আলীর টাকা কোন্ পর্যন্ত গেছে তাও দেশের মানুষ জানেন। যে টাকার কথা উল্লেখ করতে গিয়ে জনকণ্ঠ সম্পাদক ও আমাকে শাস্তি পেতে হয়েছে, শাস্তি পেতে হয়েছে দুই মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রীর। মীর কাশেম আলী কি পরিমাণের টাকা বিদেশী লবিস্টদের জন্য ব্যয় করেছে তা মহামান্য সুপ্রীমকোর্ট মীর কাশেম আলীর মামলার রায়ে উল্লেখ করেছে। এবারও পত্র-পত্রিকায় খবর এসেছে হলি আর্টিজানের এই জঙ্গী হামলার জন্য জঙ্গীরা ব্যয় করেছে ১শ’ ৫০ কোটি টাকা। এই টাকার যোগান দিয়েছে মীর কাশেম আলী। হলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গী হামলার পরে দেশের এলিট ক্লাস ও সাধারণ একটি শ্রেণী (সাধারণ যে শ্রেণীটি এতদিন বিশ্বাস করছিলেন না দেশে জঙ্গী আছে, তারা আওয়ামী প্রচার হিসেবে মনে করছিলেন) তাদের ভুল ভেঙ্গেছে। তারা এখন বিশ্বাস করেছেন, দেশে জঙ্গী আছে। তারা হঠাৎ করে এও আবিষ্কার করেছেন যে, আমাদের মধ্যবিত্ত এমনকি তথাকথিত এলিট শ্রেণীর ছেলেরাও জঙ্গী হচ্ছে। এতে মনে হয় তারা এর আগে সংবাদপত্রে রাজীব হায়দার হত্যাকারী হিসেবে যাদের সরকার গ্রেফতার করেছিল ওই সংবাদটি পড়েননি, না হয় বিশ্বাস করেননি। রাজীব হায়দার হত্যার পরে যে ছয়জনকে গ্রেফতার করা হয়েছিল সবাই নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র এবং উচ্চ মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। এমনকি তারা যে তাদের বড় ভাইয়ের নাম বলেছিল তিনি ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। শুধু এটা নয়, হিযবুত তাহ্রী নিষিদ্ধ করার পরেও রাজধানীতে তারা দুটো কি তিনটে ঝটিকা মিছিল করে। পুলিশ তাদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়, জনকণ্ঠসহ কয়েকটি কাগজ তাদের ছবি ছাপে, এই ছবিগুলোও কি সবাই মনোযোগ দিয়ে দেখেননি যে, ছেলেগুলোর পোশাক, চেহারা বলে দিচ্ছে তারা কোন্ ঘরের ছেলে। শুধু তাই নয়, পুলিশ তাদের কয়েকজনকে গ্রেফতার করে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষক পুলিশের কাছে লিখিত মুচলেকা দিয়ে তাদের ছাড়িয়ে নিয়ে আসেন। এ খবরগুলো বা ঘটনাগুলো কেন সামাজিকভাবে আমরা এতদিন গুরুত্ব দিইনি? আর সামাজিকভাবে গুরুত্ব দিইনি বলেই কিন্তু হলি আর্টিজান বেকারির ঘটনা ঘটতে পেরেছে। হলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গী হামলা ও মানুষকে জিম্মি করার পরে সরকার যে দ্রুত ব্যবস্থা নিয়েছে তা যথেষ্ট। তবে সবার আগে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে হয় এসি রবিউল এবং ওসি সালাউদ্দিনের প্রতি; তারা জীবন দিয়ে, তাদের রক্তের বিনিময় অপারেশন থান্ডারবোল্ট করার সুযোগ করে দিয়েছেন। যার ফলে সব জঙ্গী নিহত হয়। ২০১২ সাল থেকে আমাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতিটি শাখা যেভাবে জঙ্গীদের রুখে দিচ্ছে তাতে করে দেশবাসী তাদের কাছে কৃতজ্ঞ। কারণ এ পর্যন্ত জঙ্গীদের হাতে সাধারণ মানুষ, বুদ্ধিজীবী, বিদেশী নাগরিক যত মারা গেছেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যও তার থেকে কম মারা যায়নি। তার পরেও দেশের মানুষের প্রশ্ন, গুলশানের মতো নিñিদ্র নিরাপত্তার বেষ্টনীর ভেতর এমন একটি জঙ্গী হামলা কি আগের থেকে রুখে দেয়া যেত না? গেলে ভাল হতো। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিভিন্ন শাখার সদস্যদের ভবিষ্যতে সেই চেষ্টাই করতে হবে। তবে এটা সত্য, জঙ্গীদের এই হামলার শিকার এখন আমেরিকা, প্যারিস, তুরস্ক, সৌদি আরব প্রতিটি দেশ হচ্ছে। এমনকি মসজিদে নববীও রেহাই পায়নি। কেন তারা রুখে দিতে পারছে না? এই রুখে দিতে না পারার মূল কারণ কিন্তু সব দেশেরই সামাজিক পরিবর্তন, জঙ্গীদের শক্তিশালী আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্ক ও বিপুল পরিমাণের অর্থ। বাংলাদেশে বিভিন্ন নামে জামায়াতে ইসলামীর ১শ’ ২০টি জঙ্গী সংগঠন আছে। এরা সবাই পাকিস্তানের আইএসআইয়ের সঙ্গে জড়িত। ড্রাগ, অস্ত্র প্রভৃতি ব্যবসার মাধ্যমে আইএসআই এখন পাকিস্তানের মূল অর্থনীতির থেকেও শক্তিশালী অর্থনীতি গড়ে তুলেছে। হিলারি পররাষ্ট্রমন্ত্রী থাকাকালে এই আইএসআইকে নিয়ন্ত্রণ করার কথা উল্লেখ করেন- বিশ্ব জঙ্গীবাদ দমনের স্বার্থে। বাংলাদেশে জামায়াতে ইসলামী, বিএনপি আইএসআই দ্বারা নিয়ন্ত্রিত তাই এদের অর্থ কত অঢেল তা বলার অপেক্ষা রাখে না। জামায়াতে ইসলামীর যেমন নিজস্ব অর্থ আছে তেমনি আইএসআইও তাদের অর্থ যোগান দেয়। যেমন এই হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলার পরে, বিদেশী পত্রিকায় খবর প্রকাশিত হয়েছে- এই অপারেশনের জন্য জামায়াত নেতা মীর কাশেম আলী ১শ’ ৫০ কোটি টাকা ব্যয় করে এবং এই অর্থ যে ব্যয় হচ্ছে, এই অপারেশন যে হবে তা বিএনপির খুব অজানা ছিল বলে মনে হয় না। কারণ, প্রথম আলোর অনলাইনে ১৮.১৭ মিনিটে আপডেট করা নিউজে বেগম জিয়ার যে প্রতিক্রিয়ার সংবাদ প্রকাশ হয় ওই প্রতিক্রিয়ায় বলা হয়, ‘দুষ্কৃতকারীদের নির্মম রক্তাক্ত অভ্যুত্থান দেশে বিরাজমান দুঃশাসনেরই বহির্প্রকাশ বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া। গতকাল শুক্রবার রাতে রাজধানীর হলি আর্টিজান বেকারিতে সন্ত্রাসী হামলার বিষয়ে আজ শনিবার বেলা ১টা ২২ মিনিটের দিকে দেয়া এক বিবৃতিতে তিনি এ মন্তব্য করেন।’ এখানে লক্ষণীয়, বেগম জিয়া জঙ্গীদের হামলাকে ‘রক্তাক্ত অভ্যুত্থান’ বলছেন। অন্যদিকে মীর কাশেম আলীর ১৫০ কোটি টাকা ব্যয়ের যে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে সেখানে বলা হচ্ছে, এদের উদ্দেশ্য ছিল সরকারকে চাপে ফেলে মীর কাশেম আলীকে মুক্ত করা। এছাড়া আরও যা ইতোমধ্যে জানা গেছে: ওই দিন তারা রাজধানীর আরও দুই-তিন জায়গায় এমন ঘটনা ঘটাতে চেয়েছিল যার প্রথম উদ্দেশ্য ছিল একটি অভ্যুত্থানের দিকে দেশকে নিয়ে যাওয়া যা বেগম জিয়া উল্লেখ করেছেন। আর সেভাবে যদি সরকার পতন না হয় তাহলে সরকারের অবস্থা যেন নাজুক হয়। এ ছাড়া ১৫০ কোটি টাকার ওই নিউজে বলা হয়, বেগম জিয়ার ও তারেক রহমানের এক সহকারীর ফোন সারারাত ব্যস্ত ছিল। এই যাবতীয় ঘটনা যে সত্য তার প্রমাণ কিন্তু বেগম জিয়া তার প্রথম দেয়া এই বিবৃতিতে প্রকাশ করেছেন। তিনি জঙ্গী হামলাকে ‘রক্তাক্ত অভ্যুত্থান’ হিসেবে উল্লেখ করেন। যা হোক, পরে এই নিউজ সরিয়ে নেয়া হয় এবং বেগম জিয়া তার স্ট্যান্ডিং কমিটির সদস্যদের নিয়ে বসে খুব মার্জিত একটি বক্তব্য দেন। কারণ ততক্ষণে তার শুভাকাক্সক্ষী ও জঙ্গী মদদদাতারা বুঝে গেছে বাংলাদেশের জনমত জঙ্গীদের বিপক্ষে। হলি আর্টিজান বেকারির জঙ্গী হামলা ও শোলাকিয়ার ঈদের জামাতে জঙ্গী হামলার চেষ্টার পরে বাস্তবে এখন দেশের জনমত জঙ্গীর বিপক্ষে। সরকার তা বুঝতে পেরে, ইতোমধ্যে মাঠে নেমেছে। জনসভা করছে। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে পাড়া-মহল্লা থেকে শুরু করে জেলা অবধি জঙ্গী প্রতিরোধ কমিটি হচ্ছে। সরকার এগুলো করছে ঠিকই, কিন্তু এই জনসভা ও প্রতিরোধ কমিটি গঠন করার ক্ষেত্রে সরকারকে একটা দিকে খেয়াল রাখতে হবে যে, জনসভায় এবং প্রতিরোধ কমিটিতে যেন তাদের প্রাধান্য না থাকে যারা এতদিন জামায়াতের সঙ্গে আপোস করে চলেছে এবং যাদের আচরণে ও দুর্নীতিতে দেশের মানুষ বা এলাকার মানুষ বিরক্ত। ইতোমধ্যে পত্রিকায় খবর এসেছে বগুড়ার জঙ্গী হামলার আসামি এক জামায়াত নেতা জঙ্গী প্রতিরোধ কমিটিতে। অন্যদিকে হলি আর্টিজান বেকারির জঙ্গী হামলায় আরও একটি বিষয় দেশের মানুষ দেখতে পেয়েছে যে এখন শুধুমাত্র শিবিরের ছেলেরা বা মাদ্রাসার ছাত্ররা জঙ্গী হচ্ছে না, নানা ঘর থেকে চলে আসছে। মধ্যবিত্ত এবং মাদ্রাসা পড়ুয়া ছাত্রদের একটি কম্বিনেশন হয়েছে। এটা কিন্তু নতুন ঘটনা নয়। আমাদের মতো ক্ষুদ্র সাংবাদিকরা আমরা বার বার এ কথা বলছি যে, সমাজে এই পরিবর্তন হচ্ছে। সর্বশেষ ২২ জুনও এই কলামে ‘কেন বা জঙ্গী হচ্ছে, ফিরবেও বা কোন্ পথে’ এ শিরোনামে সমাজের এই নতুন মেরুকরণের কথাই লিখেছিলাম। আমাদের মতো ক্ষুদ্র সাংবাদিকের কথা কিছু সাধারণ পাঠক ছাড়া অন্যরা পড়েনও না, গুরুত্বও দেন না। আমরা সেটা আশাও করি না। তবে জাতে সাংবাদিক যার অর্থ জাতির পাহারাদার কুকুর, তাই আমাদের দায়িত্ব জেল, ফাঁসি, মৃত্যু- সব কিছুকে মেনে নিয়ে জাতির জন্য ঘেউ ঘেউ করে যেতে হবে। যা হোক, হলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গী হামলার পরে আমরা এতদিন যা নিয়ে ঘেউ ঘেউ করছিলাম, জাতি ও জাতির নীতি-নির্ধারক সরকার সেটা উপলব্ধি করেছে এতেই খুশি। তবে তার পরেও বলা প্রয়োজন, গোটা জাতি ও সরকার মিলে যদি সমাজ কাঠামোতে বড় মাপের পরিবর্তন আনার চেষ্টা না করেন তাহলে কিন্তু দেশ যে দিকে যাচ্ছে, সমাজ যেদিকে যাচ্ছে তা মোটেই সুখকর কিছু নয়। সমাজের যারা গুণীজন তাদের প্রতি বিনীত অনুরোধ করব, সরকারকেও কাঁচের দেয়ালের বাইরে এসে, ক্ষমতার চশমা খুলে খালি চোখে দেখতে বলব- তাহলে নিশ্চয়ই দেখতে পাবেন, আমাদের কালচারাল হেজিমনি ইতোমধ্যেই রিলিজিয়ন হেজিমনির কাছে হেরে যাওয়ার পথে। অন্যদিকে আমরা প্রত্যেকে সচেতন, অবচেতন ও তাৎক্ষণিক স্বার্থে রিলিজিয়ন হেজিমনিকে নার্সিং করছি। কিন্তু আমাদের মনে রাখা উচিত, আমাদের জাতিরাষ্ট্রটির উদ্ভব হয়েছে কালচারাল হেজিমনির বিজয় থেকে। এখন যদি কালচারাল হেজিমনি সত্যি সত্যি হেরে যায়, তাহলে এই জাতিরাষ্ট্রের ভবিষ্যত অন্ধকারের দিকে যাবে। কারণ রিলিজিয়ন হেজিমনিতে কোন রাষ্ট্র আজও পৃথিবীতে হয়নি। এমনকি খ্রিস্টের জন্মের প্রায় দু’হাজার বছর আগে ব্যবিলনের রাজা হামমুরুবির সাম্রাজ্যে যে এক ধরনের সংবিধান করা হয় বলা যেতে পারে এটাই পৃথিবীর প্রথম, সেখানে ঈশ্বরের প্রতি আনুগত্য ছিল তবে ওই সাম্রাজ্যও কিন্তু রিলিজিয়ন হেজিমনিতে চলেনি। তার কোড অফ ল এবং সামাজিক কাঠামো ছিল সমাজের হেজিমনিভিত্তিক। সেটা চলেছিল তৎকালীন সমাজের বিরাজমান কৃষি কালচারের হেজিমনির ওপর ভর করে। তাই রিলিজিয়ন হেজিমনি জিতলে আমরা রক্তাক্ত হব, অন্ধকারের দিকে যাব এবং রাষ্ট্রের গতি হবে অনিশ্চিত। আমাদের এই বিপদ থেকে আমরা নিজেরা যদি নিজেদের রক্ষা না করি তাহলে কেউ আমাদের রক্ষা করতে পারবে না। সমাজের বর্তমান যে অবস্থা এখানে দাঁড়িয়ে কীভাবে কালচারাল হেজিমনিকে বাঁচানো যাবে তা যারা সমাজের বিজ্ঞজন তারাই ভাল বলতে পারবেন। তবে বাঁচানো যায়, কারণ রিলিজিয়ন হেজিমনি সমাজের ও মানব জীবনের সবটুকু নয়, তার সীমাবদ্ধতা আছে- অন্যদিকে কালচারাল হেজিমনি উন্মুক্ত আকাশের মতো অসীম। তাই এখন সমাজের জন্য প্রয়োজন প্রদীপ্ত সূর্যের আলো, অসীম আকাশ আর উজ্জ্বল পরমায়ু। মানুষের মনে এই আলো, অসীম জগত ও উজ্জ্বল পরমায়ুর আকাক্সক্ষা জাগাতেই হবে। তরুণ বয়সে মৃত্যুর আকাক্সক্ষা নয়। [email protected]
×