ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

গুলশান হামলার নেপথ্য নায়কদের খুঁজে বের করার চেষ্টা

প্রকাশিত: ০৫:৫৪, ১৩ জুলাই ২০১৬

গুলশান হামলার নেপথ্য নায়কদের খুঁজে বের করার চেষ্টা

শংকর কুমার দে ॥ গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলাকারী জঙ্গী গোষ্ঠীর সঙ্গে সিরিয়ায় অবস্থিত আইএসের রাজধানী রাকায় অবস্থানকারী তিন বাংলাদেশী জঙ্গীর সঙ্গে যোগাযোগের বিষয়টি তদন্ত করে দেখছে তদন্তকারী সংস্থা কাউন্টার টেররিজম এ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট। এ জন্য ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরার ভিডিও ফুটেজ (সিসি টিভি) ও মোবাইল ফোনের কল পরীক্ষার সাহায্য নিচ্ছে তারা। গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে অপারেশন থান্ডারবোল্ট সমাপ্তির পর ৩০টি মোবাইল ফোন সেট উদ্ধার করা হয়েছে, যার মধ্যে ৩টি মোবাইল ফোনে দেশের বাইরের কারও সঙ্গে কথা বলেছে জঙ্গীরা এমন তথ্য উপাত্ত পাওয়ার বিষয়টি আরও পরীক্ষা করে দেখা হচ্ছে। এসব ফোনের কল রেকর্ডসহ ফরেনসিক পরীক্ষা করে দেখছেন তদন্তকারীরা। এছাড়াও গুলশানের আক্রান্ত রেস্তরাঁ ও গুলশান এলাকায় স্থাপিত সকল সিসি টিভির ভিডিও ফুটেজ পরীক্ষা করে দেখা হচ্ছে কারা জঙ্গীদের পৌঁছে দিয়েছে এবং কোন পথ দিয়ে কিভাবে তারা চলে গেছে তা পরীক্ষা করে গুলশান হামলার নেপথ্যের সকল রহস্য উদঘাটন করা হচ্ছে। তদন্তকারী সংস্থা সূত্রে এ খবর জানা গেছে। সূত্র জানান, তিন তরুণকে বাংলায় কথা বলে গুলশানে হামলাকারীদের প্রশংসা করে বাংলাদেশে ফের জঙ্গী হামলার হুমকি দেয়ার বিষয়ে আইএসএ’র এক নতুন ভিডিওর খবর দিয়েছে সাইট ইনটেলিজেন্স গ্রুপ। আইএসের পতাকা সম্বলিত ভিডিওতে তিন তরুণের মধ্যে একজনের মুখ ছিল কাপড়ে ঢাকা, আরেকজনের মুখভর্তি দাড়ি, তাদের পরিচয় উদঘাটিত হয়েছে। ১ জুলাই শুক্রবার হামলার রাতে যখন গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে সন্ত্রাসী হামলা চালানো হয় সেই রাতেই আইএসের কথিত সাইট ইন্টেলিজেন্স গ্রুপের হামলার দায় স্বীকার করে নিহত কয়েকজনের নৃশংসতার ছবি ও হামলাকারী পাঁচজনের ছবি প্রকাশ করার ঘটনায় হামলাকারী জঙ্গীদের সঙ্গে সিরিয়ায় অবস্থানকারী তিন তরুণের যোগাযোগ থাকার বিষয়টি তদন্ত করে দেখছে। জঙ্গীরা গুলশানে রেস্তরাঁয় সন্ত্রাসী হামলা করার সময়ে সিরিয়ায় অবস্থানকারী তিন তরুণের সঙ্গে মোবাইল ফোনে কথা বলেছে কিনা কিংবা অন্য কোথাও কারও সঙ্গে যোগাযোগ করেছে কিনা সেই দিকগুলো নিশ্চিত হওয়ার জন্য মোবাইল ফোনগুলোর কললিস্ট ও ফরেনসিক পরীক্ষা করা হচ্ছে। তদন্তের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা বলেছেন, অপারেশন থান্ডারবোল্ট শেষ হওয়ার পর গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্তরাঁ থেকে অন্তত ৩০টি মোবাইল ফোন সেট উদ্ধার করা হয়েছে। উদ্ধার করা এসব মোবাইল ফোন সেটের মধ্যে জঙ্গী সদস্যদের সেট আছে কিনা তা পরীক্ষা করে দেখা হচ্ছে। মোবাইল ফোনের কললিস্টে জঙ্গী সদস্যদের কথোপোকথনের বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া গেলে সিরিয়ায় অবস্থানকারী তিন তরুণসহ ঢাকায় তাদের আশ্রয়দানকারী কারা সেটাও জানা যাবে। মোবাইল ফোনে কলের সূত্র ধরে গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারি এ্যান্ড রেস্টুরেন্টে হামলার নেপথ্যে থাকা ব্যক্তিদের চিহ্নিত করার চেষ্টা চলছে। ১ জুলাই ওই হামলার পর ঘটনাস্থল থেকে উদ্ধার করা ৩০টি মোবাইল ফোন সেটের মধ্যে জঙ্গীরা তিনটি মোবাইল নম্বরে কয়েকবার কথা বলেছে এমন তথ্যও পাওয়া গেছে, যা যাচাই-বাছাই করে দেখা হচ্ছে। সন্দেহভাজন ওই নম্বরগুলোর দুটি দেশের বাইরের। হামলাকারীরা ঘটনার রাতে কাদের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ করেছেন তা নিশ্চিত হওয়া গেলেই তদন্ত অনেক দূর এগিয়ে যাবে বলে মনে করেন তদন্তকারীরা। ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার ও জঙ্গী দমনে গঠিত কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম বলেছেন, গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলার পর জঙ্গীরা নির্দিষ্ট কয়েকটি নম্বরে একাধিকবার কথা বলেছে। ছবি আপলোড করেছে। তিনি বলেন, যাদের সঙ্গে জঙ্গীরা কথা বলেছে, তাদের পরিচয় জানার চেষ্টা করা হচ্ছে। এক প্রশ্নের জবাবে ওই পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, জঙ্গীরা মোবাইল ফোনে অপর প্রান্তে থাকা ব্যক্তির সঙ্গে বাংলায় কথা বলেছে। এর থেকে তারা নিশ্চিত অপর প্রান্তে থাকা ব্যক্তিরা বাংলাদেশী। তিনি আরও বলেন, হামলার পর মোবাইল এ্যাপিকেশন ব্যবহার করে জঙ্গীরা অপর প্রান্তে থাকা ব্যক্তিকে জিম্মিদের হত্যা করার বিষয়টি নিশ্চিত করেছে। জঙ্গীরা এ সময় কয়েকটি বিদেশী নম্বরেও কল করে। এসবই তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। তদন্তের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানান, গুলশানে হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলার সময়েও তো ভিডিও প্রকাশ করা হয়েছেই, এমনকি তিন দিনের মাথায় বাংলাদেশে ফের হামলার হুমকি দিয়ে প্রকাশিত ভিডিও বার্তাটি নিয়েও তদন্ত করা হচ্ছে। ইসলামিক স্টেটের (আইএস) মুখপাত্র বা দায়েশের বরাত দিয়ে ওই ভিডিওটি আপলোড করে বিতর্কিত সাইট ইনটেলিজেন্স গ্রুপ। গুলশানে জঙ্গী হামলার পর সব কিছুকেই গুরুত্বের সঙ্গে তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। সব কিছুকেই তদন্তের আওতায় নিয়ে ওই তিন যুবকের পরিচয় মোটামুটি নিশ্চিত হওয়া গেছে। কয়েক মিনিটের ওই ভিডিওতে দেখা যায়, বাংলা ও ইংরেজীতে কথা বলছে তিন তরুণ। এদের একজনের মুখ ঢাকা। গুলশানের হামলাকে এক ঝলক উল্লেখ করে বাংলা ও ইংরেজীতে এক তরুণ বলেন, এ ধরনের ঘটনা আরও ঘটবে। ভিডিওটিতে আরেক তরুণকে বলতে শোনা যায়, শেখ আদনানির নির্দেশে তারা খ্রীস্টান, ইহুদী ক্রসেডার ও তাদের মিত্রদের বিরুদ্ধে এ যুদ্ধ করছে এবং এ যুদ্ধ কোনভাবেই কৌতুক নয়। ভিডিওতে তিন তরুণের বক্তব্যের আগে বাংলায় লেখা ভেসে ওঠে বাংলায় খিলাফাহর বীরদের প্রতি। আপলোডকারী সংস্থা দাবি করেছে, ভিডিওটি রাকা (ইউফ্রেতাস নদীর উত্তর তীরে গড়া সিরিয়ার একটি শহর, আইএসের ঘোষণা দেয়া সিরিয়ার রাজধানী) থেকে ধারণ করা হয়েছে। ভিডিওটি আপলোডের পর তারা ওই তিন তরুণের পরিচয় জানতে বিভিন্ন স্থানে খোঁজ নিতে থাকেন গোয়েন্দারা। গোয়েন্দা সূত্র জানান, সংগৃহীত তথ্যানুযায়ী ভিডিওটির তরুণের পরিচয় হচ্ছে, ক্লোজআপ ওয়ানের তাহমিদ রহমান শাফি, তৌফিক হাসান, জুনুন শিকদার। শেষোক্ত জন জুনন ২০১৪ সাল থেকে তিনি নিখোঁজ রয়েছেন। রাজধানীর গুলশান হামলার পর যে ১০ তরুণের সন্ধান চেয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে তাদের পরিবারের পক্ষ থেকে যে আবেদন করা হয়েছে তার মধ্যে জুনুনের পরিবারও রয়েছে। এই জুনন ব্লগার রাজীব হায়দার শোভন হত্যা মামলায় প্রধান সন্দেহভাজন বলে গোয়েন্দাদের দাবি। ২০১৩ সালে পুলিশ তাকে গ্রেফতারও করে। পরে জামিন নিয়ে তিনি পালিয়ে যায় জুনন। গোয়েন্দা সংস্থার একজন কর্মকর্তা বলেন, মোবাইল ফোন কল রেকর্ড ছাড়াও গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলার আগে জঙ্গীরা কোন পথে কিভাবে এসেছে এবং তাদের এখানে আসতে সাহায্য করেছে কারা তা খুঁজে বের করতে রেস্তরাঁ ও গুলশান এলাকার সিটি টিভিগুলোর ভিডিও ফুটেজ পরীক্ষা করে দেখা হচ্ছে। এ ছাড়াও জঙ্গীরা অস্ত্র ও গ্রেনেড কোথা থেকে পেয়েছে সেটাও এক বড় প্রশ্ন। যেসব অস্ত্র ও গ্রেনেড উদ্ধার করা হয়েছে তা ব্যবহার করছে জঙ্গী সংগঠন জেএমবি। অবশ্য, বাংলাদেশের পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, গুলশানের পেছনে রয়েছে বাংলাদেশের নিষিদ্ধ সংগঠন জেএমবি। জেএমবির যেসব পলাতক জঙ্গী সদস্য আছে তাদেরও গ্রেফতারের মধ্য দিয়ে গুলশান ট্র্যাজেডির নেপথ্যের রহস্য উদঘাটনের তদন্ত করা হচ্ছে। প্রসঙ্গত. গত ১ জুলাই রাতে রাজধানীর কূটনৈতিক জোন গুলশানের ২ নম্বর সার্কেলের ৭৯ নম্বর সড়কে হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলা চালায় জঙ্গীরা। এতে দুই পুলিশ সদস্য, ১৭ বিদেশী নাগরিক ও তিন বাংলাদেশী নিহত হন। পরে সশস্ত্র বাহিনীর নেতৃত্বে পরিচালিত থান্ডারবোল্ট কমান্ডো অভিযানে ছয় জঙ্গী নিহত হয় বলে সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়। ওই অভিযানে তিন বিদেশী নাগরিকসহ ১৩ জিম্মিকে জীবিত উদ্ধার করা হয়।
×