ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

আন্তর্জাতিক গবেষণায় আশঙ্কা প্রকাশ

বড় ভূমিকম্প ঝুঁকিতে বাংলাদেশ- তবে কবে ঠিক নেই

প্রকাশিত: ০৫:৪৫, ১৩ জুলাই ২০১৬

বড় ভূমিকম্প ঝুঁকিতে বাংলাদেশ- তবে কবে ঠিক নেই

শাহীন রহমান ॥ বাংলাদেশ যে বড় ধরনের ভূমিকম্প ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে এবার আন্তর্জাতিক একটি গবেষণায় তা উঠে এসেছে। যুক্তরাষ্ট্র, বাংলাদেশ ও সিঙ্গাপুরের একদল বিশেষজ্ঞ সম্প্রতি তাদের গবেষণায় এ আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেছেন, এ ধরনের ভূমিকম্প হলে দরিদ্র এ দেশের ১৪ কোটি মানুষের জন্য তা ভয়াবহ বিপর্যয় সৃষ্টি করতে পারে। তবে এ ভূমিকম্প এখনই হবে না ৫শ’ বছর পরে হবে তা বিশেষজ্ঞ দল নিশ্চিত করে কিছু বলতে পারেননি। তবে তারা উল্লেখ করেছেন, ভারত প্লেটের পূর্বের এ অংশে বড় ভূমিকম্প সংঘটিত হওয়ার যথেষ্ট শক্তি সঞ্চয়ের বিষয়টি গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে। আন্তর্জাতিক এসব বিশেষজ্ঞের এ গবেষণায় উঠৈ এসেছে, ২০০৪ সালে যে ফ্রন্টলাইন থেকে ভূমিকম্প সৃষ্ট সুনামি হয়েছিল সেই একই ফ্রন্টলাইন থেকেই নতুন ভূমিকম্প সৃষ্টির আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। ২০০৪ সালে ওই সুনামিতে দুই লাখ ৩০ হাজারের বেশি মানুষ প্রাণ হারায়। বিশেষজ্ঞরা এ সাবডাকশন জোনটির নিচে অবস্থিত টেকটোনিক প্লেটের ওপর গবেষণা চালিয়ে এই মর্মে নিশ্চিত হয়েছেন যে, ২০০৪ সালে ভারত মহাসাগর অঞ্চলে যে ভূমিকম্প হয়েছিল সেটিও এই বিচ্যুতিরই ফল। এদিকে দেশী ও আন্তর্জাতিক গবেষকরা দেশে বারবার ভূমিকম্পের বিষয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করলেও এ ধরনের দুর্যোগ মোকাবেলায় সরকারের বড় ধরনের কোন প্রস্তুতি নেই। দুর্যোগ ও ত্রাণ মন্ত্রনালয় সূত্রে জানা গেছে, এখন পর্যন্ত দুর্যোগ মোকাবেলায় মাত্র ৬৯ কোটি টাকার যন্ত্রপাতি ক্রয় করে সরকারের বিভিন্ন বাহিনী ও সংস্থার কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। মাত্র ৩০ হাজার স্বেচ্ছাসেবী গড়ে তোলা হলেও তারা কিভাবে কাজ করবে সে বিষয়ে কোন সঠিক দিকনির্দেশনাও নেই। গত এপ্রিল মাসে রাজধানীর ৩২১টি ভবন এক মাসের মধ্যে ভেঙ্গে ফেলার নির্দেশনা দুর্যোগ ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে দেয়া হলেও এখন পর্যন্ত তা বাস্তবায়ন হয়নি। ত্রাণ ও দুর্যোগ মন্ত্রণালয়ের সচিব শাহ কামাল জানিয়েছেন, ভবনগুলো ভাঙ্গার জন্য রাজউককে বলা হলেও তারা এখন পর্যন্ত ভবন ভাঙ্গার কাজ শুরু করেনি। উল্টো তারা বলেছে এটি রাজউকের কাজ নয়, সিটি কর্পোরেশনের দায়িত্ব। কিন্তু সিটি কর্পোরেশনকে এটি ভাঙ্গার জন্য মন্ত্রণালয় থেকে নির্দেশনা দিলেও তারাও ভবনগুলো ভাঙ্গার কাজ শুরু করেনি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যেখানে ঝুঁকিপূর্ণ ভবন ভাঙ্গার কোন নির্দেশনা বাস্তবায়ন হয়নি সেখানে দুর্যোগকালীন সমন্বিত প্রচেষ্টা কিভাবে নেয়া সম্ভব হবে? বাংলাদেশে ভূমিকম্পের ঝুঁকি সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞদের বরাত দিয়ে গত সোমবার এ সংক্রান্ত ওই প্রতিবেদনটি নেচার জিওসায়েন্স পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, দুটি গতিশীল ভূগাঠনিক প্লেটের পরস্পরের দিকে চাপাচাপির ফলে সেখানে শক্তিশালী ভূমিকম্পের শক্তি জমা হচ্ছে। গবেষক দলের প্রধান নিউইয়র্কের কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ববিদ মাইকেল স্টেকলার টমসন বলেন, ওই ধরনের ভূমিকম্প কবে ঘটতে পারে সে পূর্বাভাস আরও গবেষণা না করে দেয়া সম্ভব নয়। ভারতের পূর্ব অংশ ও বাংলাদেশের যে অঞ্চল সম্ভাব্য সেই ভূমিকম্পের উপকেন্দ্র হতে পারে বলে বিজ্ঞানীরা মনে করছেন তার ১০০ কিলোমিটার ব্যাসের মধ্যে প্রায় ১৪ কোটি মানুষের বসবাস। ওই প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে রয়টার্সের প্রতিবেদনেও বলা হয়েছে, বিশ্বের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ ও অন্যতম দরিদ্র এ অঞ্চলে এ ধরনের একটি ভূমিকম্প মারাত্মক পরিণতি ডেকে আনতে পারে। আন্তর্জাতিক এ গবেষণা দলের বাংলাদেশী বিশেষজ্ঞ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক সৈয়দ হুমায়ুন আকতার বলেন, গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্র অববাহিকায় গভীর পলি জমে বাংলাদেশের যে ভূখ- তৈরি হয়েছে তা ওই ভূমিকম্পের প্রভাবে জেলাটিনের মতো কেঁপে উঠতে পারে। কিছু কিছু জায়গায় গ্রাস করতে পারে ইমারত, রাস্তাঘাট আর মানুষের বসতি। তিনি বলেন, তেমন মাত্রার ভূমিকম্প সত্যিই হলে তার ক্ষয়ক্ষতি এতটাই ভয়াবহ হবে যে, বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা হয়ত বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়বে। তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশের সব জায়গায় জনসংখ্যার ঘনত্ব মাত্রাতিরিক্ত। সবকটি প্রাকৃতিক গ্যাসক্ষেত্র, ভারি শিল্পকারখানা, সবকটি বিদ্যুতকেন্দ্রই সম্ভাব্য ভূমিকম্পস্থলের খুব কাছে অবস্থিত। ভূমিকম্প হলে এ সবকিছুই ধ্বংসস্তূপে পরিণত হবে। আর ঢাকায় ধ্বংসলীলা যে কী ভয়াবহ হবে তা আমাদের কল্পনারও বাইরে। বাংলাদেশে বড় ভূমিকম্পের ঝুঁকি নিয়ে বিশেষজ্ঞরা দীর্ঘদিন ধরে আশঙ্কা প্রকাশ করে আসছেন। তারা বলছেন, ভূতাত্ত্বিক গঠন কাঠামো ও অবস্থানের কারণেই বাংলাদেশে ভূমিকম্পের ঝুঁকি রয়েছে। এর কারণ হিসেবে তারা আগেই উল্লেখ করেছেন, তিনটি টেকটোনিক প্লেটের সংযোগস্থলে রয়েছে বাংলাদেশের অবস্থান। এর পাশেই রয়েছে অপর দুটি প্লেট মিয়ানমার এবং ইউরেশিয়ার প্লেটের অবস্থান। সেখানে একটি প্লেট অন্য প্লেটের দিকে ক্রমাগত চাপ সৃষ্টি করছে। বিশেষ করে বাংলাদেশ যে প্লেট অংশে অবস্থিত সেই ভারতীয় প্লেট ক্রমাগত উত্তরে ইউরেশিয়া প্লেট এবং পূর্বে মিয়ানমার প্লেটের নিচে তলিয়ে যাচ্ছে। এর বাইরে দেশের ভেতর অবস্থিত চারটি ভূতাত্ত্বিক চ্যুতি বা ফাটল রেখার বিষয়টি ভূমিকম্পের জন্য ঝুঁকি হিসেবে ধরা হচ্ছে। তবে আন্তর্জাতিক ওই গবেষণায় উল্লেখ করা হয়েছে যে, ভূগাঠনিক অবস্থানে বাংলাদেশ যেখানে দাঁড়িয়ে আছে বিশেষ করে সেখানে তিনটি প্লেটের চাপাচাপির কারণেই বড় ধরনের ভূমিকম্পের ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে। ভূমিকম্পের প্রস্তুতির বিষয়ে দুর্যোগ ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব শাহ কামাল আরও উল্লেখ করেন, ফায়ার সার্ভিস, সিভিল ডিফেন্স, হাসপাতাল, টেলিফোন, বিদ্যুত, গ্যাস, ওয়াসা এবং অন্য ১২টি মন্ত্রণালয় এবং অধিদফতরের দুর্যোগকালীন পরিকল্পনা প্রস্তুত করা হয়েছে। তিনি জানান, ভূমিকম্পে সরকারের কোন্ কোন্ সংস্থা কোন্ এলাকায় কী কী কাজ করবে তা উল্লেখ করে ঢাকা শহরকে ইতোমধ্যে আটটি জোনে ভাগ করা হয়েছে। তবে তিনি বলেন, আমাদের অবকাঠামো ভূমি ব্যবহার নীতিমালা অনুযায়ী দুর্যোগ সহনীয় করে গড়ে তোলা সম্ভব হয়নি। দুর্যোগের ঝুঁকি হ্রাস সন্নিবেশিত ভূমি ব্যবহার মানচিত্র আমাদের নেই। তবে সরকার ভূমিকম্প ঝুঁকি বিবেচনা করে জোনিং ম্যাপ তৈরি করেছে। এ ম্যাপ অনুযায়ী দেশকে তিনটি জোনে ভাগ করা হয়েছে। ভূমিকম্পের অধিকতর ঝুঁকিপূর্ণ শহরের কথা বিবেচনায় রেখে সরকার এর মধ্যে ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট, ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল, বগুড়া, দিনাজপুর এবং রাজশাহী শহরের ঝুঁকি চিহ্নিত করে মাইক্রো জোনেশন মানচিত্র প্রস্তুত করেছে। বাংলাদেশে ভূমিকম্প ঝুঁকির বিষয়ে আন্তর্জাতিক ওই প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়েছে, বিশেষজ্ঞরা এই মর্মে নিশ্চিত প্রমাণ পেয়েছেন যে, বিগত ৪০০ বছর ধরে বিশ্বের বৃহত্তম বদ্বীপ অঞ্চল বলে বিবেচিত বাংলাদেশের ভূস্তরের নিচের সাবডাকশন জোনে টেকটোনিক প্লেটগুলোতে প্রবল চাপ জমা হচ্ছে। আর তা এক প্রলয়ঙ্করী ভূমিকম্পে রূপ নিতে চলেছে। অল্পকালের মধ্যেই সেই ভূমিকম্প আঘাত হানবে ঢাকা ও এর পার্শ্ববর্তী এলাকায়। তারা বলছেন, এ বিশাল সাবডাকশন জোনটি হচ্ছে মূলত এক অতিকায় টেকটোনিক প্লেট, যা কোটি কোটি বছর ধরে উত্তর-পূর্ব দিকে এশিয়ার দিকে একটু একটু করে সরে আসছে। এ চাপটি ভূস্তরের নিচের দিকে আবর্তিত হয়ে বাংলাদেশের দিকে ধাবিত হচ্ছে। দশ বছরের তথ্য বিশ্লেষণ করে একটি কম্পিউটার মডেল তৈরির মাধ্যমে তারা দেখিয়েছেন, বাংলাদেশ ও ভারতের পূর্ব অংশের ভূগাঠনিক প্লেট উত্তর-পূর্ব দিকে সরে গিয়ে মিয়ানমারের পশ্চিম অঞ্চলের ভূগাঠনিক প্লেটে চাপ সৃষ্টি করছে। ওই গবেষণা প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস টাইমসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিজ্ঞানীরা টেকটোনিক প্লেটের গতিবিধি জিপিএসের (গ্লোবাল পজিশনিং সিস্টেম) মাধ্যমে পর্যবেক্ষণ করছেন ২০০৩ সাল থেকে। এতে দেখা গেছে, বাংলাদেশ ও ভারতের পূর্ব অংশের প্লেট মিয়ানমারের পশ্চিম অঞ্চলের প্লেটকে বছরে ৪৬ মিলিমিটার করে ঠেলছে। এর ফলে যে বিপুল চাপ তৈরি হচ্ছে তা মিয়ানমারের ভূপৃষ্ঠের উপরের ফল্টে জমা হচ্ছে। আর বাকি যে চাপ তা বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের দূরত্বকে কমিয়ে আনছে। গবেষণা দলের অন্যতম সদস্য মাইকেল স্টেকলার বলেন, এমন একটি বিপদ যে ঘনিয়ে আসছে সে ধারণা গবেষকদের কারও কারও মধ্যে ছিল। কিন্তু প্রয়োজনীয় তথ্য বা মডেল এতদিন হাতে ছিল না। তবে তিনি উল্লেখ করেন, আমরা জানি না ঠিক কবে ওই বিপদ আসবে। কারণ আমরা জানি না শেষ কবে ওই এলাকায় এ রকম পরিস্থিতি হয়েছিল। আমরা বলতে পারছি না এখনই না ৫শ’ বছর পর ওই ভূমিকম্প হবে। কিন্তু আমরা নিশ্চিতভাবে দেখতে পাচ্ছি ওখানে শক্তি জমা হচ্ছে। দীর্ঘদিন ধরে দেশের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া তিনটি প্লেটের গতিবিধি নিয়ে গবেষণা করছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সৈয়দ হুমায়ুন আকতার। তার প্রচেষ্টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে একটি আর্থ অবজারভেটরি কেন্দ্র। তিনি জনকণ্ঠকে বলেন, বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, আরব সাগর ও বঙ্গোপসাগরজুড়ে হলো ভারত প্লেট। ভারত প্লেটের উত্তরে ইউরেশিয়া প্লেট। পাকিস্তানের উত্তর-পূর্বে মুজ্জাফারাবাদ থেকে শুরু হয়ে হিমালয়ের দক্ষিণ পাদদেশ ঘেঁষে ভারতের উত্তর-পূর্বে অরুণাচল-চীন সীমান্ত পর্যন্ত ২৫০০ কিলোমিটার বিস্তৃত। আর পূর্বে মিয়ানমার প্লেটের সঙ্গে রয়েছে এর সংযোগ। এ সংযোগ উত্তরে অরুণাচল-চীন সীমান্ত থেকে শুরু হয়ে দক্ষিণে মনিপুর, মিজোরাম, মিয়ানমার হয়ে বঙ্গোপসাগরে আন্দামান দ্বীপপুঞ্জের পশ্চিম পাশ দিয়ে আরও দক্ষিণে সুমাত্রা পর্যন্ত তিন হাজার কিলোমিটার বিস্তৃত। ভারত প্লেট উত্তরে ইউরেশিয়া প্লেটের পর্যন্ত নিচে ও পূর্বে মিয়ানমার প্লেটের নিচে তলিয়ে যাচ্ছে। তিনি বলেন, ভূমিকম্প কোথায় ঘটবে তা নির্ভর করে নির্দিষ্ট এলাকার ভূতাত্ত্বিক ও টেকটনিক কাঠামোর ওপর। দুটি প্লেটের সংযোগ অঞ্চলে ও কোন এলাকায় ফাটল থাকলে সেখানে ভূমিকম্প হয়ে থাকে। বাংলাদেশ ভারত প্লেটের অংশ এবং উত্তর-পূর্বে তিনটি প্লেটের সংযোগস্থলে অবস্থিত। ভূতাত্ত্বিক গঠন ও টেকটোনিক কাঠামোর কারণেই বাংলাদেশ ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকা। বিশেষ করে সিলেট, চটগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলসমূহ ভূমিকম্পের ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে।
×