ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

সুমন্ত গুপ্ত

সঙ্কট উত্তরণের চেষ্টায় গান্ধী পরিবার

প্রকাশিত: ০৩:৪৯, ১৩ জুলাই ২০১৬

সঙ্কট উত্তরণের চেষ্টায় গান্ধী পরিবার

চরম রাজনৈতিক সঙ্কটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে ভারতের ১৩০ বছরের পুরনো দল কংগ্রেস। সর্বশেষ অসমের বিধানসভা নির্বাচনে ক্ষমতা হারিয়েছে তারা। এই অসমে টানা ১৫ বছর ধরে ক্ষমতায় ছিল কংগ্রেস। শুধু অসম নয় কেরেলায়ও হেরেছে দলটি। পশ্চিমবঙ্গেও বামপন্থিদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে এক প্রকার লজ্জার মধ্যে পড়েছিল সর্ব ভারতীয় এ রাজনৈতিক দল। বিবিসির এক নিবন্ধে বলা হয়েছে, দুই বছর আগে সাধারণ নির্বাচনে ভরাডুবির পর কংগ্রেসের পুনরুজ্জীবিত হওয়ার লক্ষণ খুব সামান্যই। মে মাসে পাঁচ রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনের ফলাফল এক প্রকার দুঃস্বপ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে দলটির জন্য। বর্তমানে ভারতের মোট ২৯ রাজ্যের মধ্যে ছয়টিতে ক্ষমতায় কংগ্রেস। এর মধ্যে বেশির ভাগ রাজ্যই ছোট এবং ভারতের রাজনীতিতে এসব রাজ্যের প্রভাবও সীমিত। আর বিহারে কংগ্রেস ক্ষমতায় আঞ্চলিক দলের বদৌলতে। ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভারতের কংগ্রেস শাসিত রাজ্যগুলোতে জনসংখ্যা দেশটির জনসংখ্যার মাত্র ছয় শতাংশ। ভারত স্বাধীন হওয়ায় পর কংগ্রেসের অবস্থা বর্তমানে সবচেয়ে খারাপ। ২০০৪ ও ২০০৯ সালে নির্বাচনে জয়ের মাধ্যমে টানা দুইবার ক্ষমতায় এসেছিল কংগ্রেস। যদিও তা জোটবদ্ধভাবে। কিন্তু দুর্নীতির অভিযোগ ও কিছু সিদ্ধান্তহীনতার কারণে তাদের ক্ষমতায় থাকাকালীন সফলতা অনেকটাই ম্লান হয়েছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষক যোগেন্দ্র যাদবের মতে, কংগ্রেস এখন অনেকটাই সংকুচিত হয়ে এসেছে। এদিকে মৃত্যুর একযুগ পর, জাতীয় রাজনীতিতে কোণঠাসা কংগ্রেসের অস্বস্তি আরও বাড়িয়ে ফিরে এলেন পামুলাপার্তি বেঙ্কট নরসিমা রাও! সম্প্রতি সাবেক এই প্রধানমন্ত্রীর ৯৫তম জন্মদিনের (২৮ জুন) ঠিক মুখে প্রকাশিত বিনয় সীতাপতির লেখা ‘হাফ লায়ন’ গ্রন্থটি কংগ্রেসের অভ্যন্তরীণ অবিশ্বাসের ইতিহাসকে সামনে নিয়ে এসেছে। যা নরেন্দ্র মোদি তথা বিজেপি শীর্ষ নেতৃত্বের হাতে অস্ত্রও তুলে দিয়েছে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা। প্রকাশ্য নির্বাচনী জনসভা থেকে বিভিন্ন সাক্ষাতকার সর্বত্র কংগ্রেসের পরিবারতন্ত্রকে আক্রমণ করে কার্যত রাহুল গান্ধীর কর্তৃত্বকে খর্ব করতে চাইছেন নরেন্দ্র মোদি। বিজেপি শীর্ষ নেতৃত্ব প্রচার করছে গণতন্ত্রের নামে পরিবারতন্ত্রেরই পূজা করে গিয়েছে কংগ্রেস। নরসিমা রাওয়ের ডায়েরি এবং ব্যক্তিগত কাগজপত্র থেকে গবেষণা করে যে বইটি লেখেছেন বিনয় সীতাপতি, তা মোদির এই আক্রমণকেই কার্যত পুষ্ট করছে। নরসিমা- সোনিয়াকে ঘিরে চলতি বিতর্কে একটু তা দেয়া! বেশ কিছু দিন ধরেই নেহরু গান্ধী পরিবারের বাইরের কংগ্রেস নেতাদের বিচ্ছিন্ন করে দেখা এবং দেখানোর এক কৌশল নিয়ে চলছেন মোদি। এর আগে বল্লভভাই প্যাটেল, মদনমোহন মালব্য, লালবাহাদুর শাস্ত্রী প্রশংসা করেছেন মোদি। মোহনদাস কর্মচন্দ গান্ধীকেও আপন করে নিয়েছেন বিজেপি নেতৃত্ব। দলীয় সূত্রের বক্তব্য, কংগ্রেসের পরিবারতন্ত্রকে আক্রমণ করে কার্যত সনিয়া-রাহুলকে রাজনৈতিকভাবে কোণঠাসা করাই এর উদ্দেশ্য। বিজেপির এই ‘কৌশল তালিকায়’ এবার ঢুকে পড়লেন রাও-ও। কী রয়েছে নরসিংহ রাওকে নিয়ে নতুন করে উত্তাপ তৈরি করা এই বইয়ে? কী ভাবছেন এর লেখক তথা রাজনৈতিক গবেষক বিনয় সীতাপতি? ‘নরসিংহ রাওয়ের পরিবারের সদস্যরা সম্পূর্ণ সাহায্য না করলে এই বই লেখা সম্ভব হতো না। তার ব্যক্তিগত চিঠি, কাগজপত্র, ডায়েরি, ততকালীন গোয়েন্দা রিপোর্ট- সবই তারা আমার সামনে খুলে দিয়েছেন কোন রাখঢাক না করেই। কোন সেন্সরশিপ করা হয়নি। ফলে তার সম্পর্কে অজানা অনেক তথ্যই জানা গিয়েছে,’ আনন্দবাজারকে বললেন বিনয়। বইতে দেখা যাচ্ছে, পরবর্তীকালে মনমোহন সরকারের মন্ত্রিসভার বহু সদস্যই নরসিংহ রাও প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন ধরণা দিতেন ১০ নম্বর জনপথ রোডে। কান ভারি করতেন সোনিয়ার। অন্যদিকে কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা দফতরের প্রতি ততকালীন প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ ছিল, সোনিয়ার বাসভবনে কারা যাতায়াত করছেন, তাদের সাপ্তাহিক তালিকা তৈরি করে তাকে জানানোর। বাবরি মসজিদ ভাঙ্গার ১২ দিন পর গোয়েন্দা বাহিনীর একটি রিপোর্ট বলছে, ‘ডিসেম্বরের ৭ তারিখ থেকে ১৪ তারিখের মধ্যে সোনিয়া গান্ধীর বাসভবনে গুরুত্বপূর্ণ অতিথিদের মধ্যে রয়েছেন অর্জুন সিংহ, দিগিবজয় সিংহ, এনডি তিওয়ারি, মাধবরাও সিন্ধিয়া, অজিত যোগী এবং অহমেদ পাটেল। সোনিয়ার সঙ্গে আলোচনায় এই নেতারা পরিস্থিতি মোকাবেলায় প্রধানমন্ত্রীর ভূমিকার সমালোচনা করেছেন।’ প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর থেকে ৯৩ সাল পর্যন্ত নরসিমা রাও প্রত্যেক সপ্তাহে একবার সোনিয়ার সঙ্গে দেখা করতে যেতেন। সেই বৈঠক বন্ধ হয়ে গেল। বাবরি মসজিদ ভাঙ্গার পর সোনিয়া গান্ধী ঘটনার চরম নিন্দা করে বিবৃতি দেন। তাতে নরসিমা রাও’র নাম উল্লেখ না থাকলেও এ বিবৃতির লক্ষ্যবস্তু যে নরসিমা তা বোঝার বাকি ছিল না। সেই তিক্ততা চরমে ওঠে ৯৫ সালে। সোনিয়া গান্ধী বিশ্বাস করতে শুরু করেন, রাজীব হত্যার তদন্তে ঢিলে দিচ্ছেন নরসিমা রাও। তিনি এ বিষয়ে নিজের ক্ষোভ জানিয়ে প্রধানমন্ত্রীকে চিঠিও লেখেন। নরসিমা চেষ্টা করেও সোনিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে পারেননি। বরঞ্চ নটবর সিংহকে তিনি জানিয়েছেন, ‘আমি সোনিয়া গান্ধী কে এক হাত নিতেই পারি। কিন্তু সেটা চাইছি না। ওর অনেক পরামর্শদাতা আমার নামে সোনিয়ার কান ভারি করছে। আমার প্রতি সোনিয়ার আচরণ আমার স্বাস্থ্যের ক্ষতি করছে।’ তাৎপর্যপূর্ণভাবে, এই বইটি প্রকাশিত হওয়ার পর নিঃশব্দ কংগ্রেস শীর্ষ নেতারা। মজার বিষয় হলো, যে নটবর সিংহ নরসিমা রাওয়ের বিরোধিতা করে এনডি তিওয়ারির হাত ধরেছিলেন, সেই নটবরই বইটি সম্পর্কে প্রশংসায় পঞ্চমুখ। নরসিমা রাওকে ‘পণ্ডিত’ হিসেবে বর্ণনা করে তিনি বলেছেন, ‘ইতিহাস তার প্রতি সদয় হয়নি।’ এদিকে নির্বাচনের এখনও প্রায় এক বছর দেরি। তা সত্ত্বেও এখন থেকেই উত্তরপ্রদেশে এবার দলের অন্যতম স্টার ক্যাম্পেনারের নাম প্রিয়াঙ্কা গান্ধী। শুধু আমেথি-রায়বেরিলি নয়, রাজ্যের অন্যত্রও দলের প্রচারমুখ এবার রাজীব-তনয়াই। আর এখানেই কংগ্রেস পড়েছে বেজায় সমস্যায়। প্রশ্ন, প্রিয়াঙ্কাকে ঠিক কতটা প্রচারের কাজে লাগানো যাবে? রাহুলকে কম গুরুত্ব দিয়ে প্রিয়াঙ্কাকে নিয়ে যদি বেশি মাতামাতি হয়, তাহলে প্রশ্ন উঠবে রাহুলের নেতৃত্ব নিয়ে। আওয়াজ উঠবে, রাহুল ফেল। পাশাপাশি আছে স্বামী রবার্ট ওয়াধেরার বিরুদ্ধে জমি কেলেঙ্কারির অভিযোগ। সেটাও কিন্তু নির্বাচনী প্রচারে বেশি করে সামনে আনতে পিছপা হবে না বিজেপি। সে নিয়েও কংগ্রেসের কম মাথা ব্যথা নেই! তাই খানিক অঙ্ক কষেই প্রিয়াঙ্কাকে মাঠে নামাতে চান সোনিয়া। হাইকমান্ডের একাংশ জানাচ্ছে, ২০১২ সালে রাহুলের মতো মেয়েকেও অতি-প্রচারে আনাটা কতটা উচিত হবে, সে নিয়েই উদ্বেগে রয়েছেন কংগ্রেস সভানেত্রীর। প্রিয়াঙ্কাই কংগ্রেসের তুরুপের তাস। কাজেই অত্যন্ত বুঝে তাকে কাজে লাগানো উচিত। ২০১২ সালে উত্তরপ্রদেশে ব্যাপক প্রচার করেছিলেন রাহুল গান্ধী। ২০০৭ সালের বিধানসভা ভোটের তুলনায় আসন সংখ্যাও বেড়েছিল। কেন্দ্রে তখন কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন দ্বিতীয় ইউপিএ সরকার থাকা সত্ত্বেও রাহুল যে হারে প্রচার করেছিলেন, সেই অনুপাতে আসন আসেনি। ২০০৭ সালে কংগ্রেস পেয়েছিল ২২ আসন। ২০১২ সালে মিলে ছিল ২৮। সেই হিসাবে তারপর থেকে গত পাঁচ বছরে উত্তরপ্রদেশে কংগ্রেসের সংগঠন তেমন চাঙ্গা হয়নি। কেন্দ্রেও এখন কংগ্রেস ক্ষমতাচ্যুত। এমতাবস্থায় উত্তরপ্রদেশে প্রিয়াঙ্কাকে প্রচারের মুখ করলে কংগ্রেস কতটা লাভবান হবে, তা নিয়ে দলের মধ্যেই গুঞ্জন শুরু হয়েছে। তবে রাহুলের জোশহীন ক্লিশে মোদি বিরোধী বক্তব্য, রাজ্যের বর্তমান শাসকদল সমাজবাদী পার্টিকে আক্রমণ করব কি করব না দ্বন্দ্ব, এসবের থেকে প্রিয়াঙ্কার আদবকায়দা অনেক বেশি আকর্ষণীয় হবে বলেই মনে করে দলের একাংশ। তাই রাহুলকে সামনে রেখেও প্রিয়াঙ্কাকে কাজে লাগাতে চায় কংগ্রেস। এবার বিজেপি যেমন এবার উত্তরপ্রদেশ দখল করতে মরিয়া, একইভাবে কংগ্রেসও চেষ্টার কসুর করছে না। যদিও গোটা দেশে বর্তমানে কংগ্রেসের যা হাল, তাতে উত্তরপ্রদেশ দখল করার ভাবনা সোনার পাথরবাটির সমান। তবুও প্রিয়াঙ্কা গান্ধীকে দিয়ে চমক তৈরি করে কংগ্রেসের অবস্থা ভাল হতে পারে বলেই মত দিয়েছেন প্রশান্ত কিশোর। গত লোকসভায় নরেন্দ্র মোদি এবং ২০১৫ সালে বিহারে নীতীশ কুমারের প্রচার পরিকল্পক ছিলেন প্রশান্ত কিশোর। উত্তরপ্রদেশের নির্বাচনে দলের হাল বদলে তাকেই কাজে লাগাতে চাইছে কংগ্রেস। দলীয় সূত্রে খবর, প্রশান্ত কিশোরের সঙ্গে প্রিয়াঙ্কা গান্ধী ইতোমধ্যেই বেশ কয়েকবার স্ট্র্যাটেজিক বৈঠক করেছেন। এরপর রাহুল গান্ধী বিদেশ থেকে ফিরলে প্রচার এবং নির্বাচন স্ট্র্যাটেজি তৈরি হবে। চলতি জুলাই মাসের মাঝামাঝি লক্ষেèৗ কংগ্রেসের একটি সম্মেলন রয়েছে। সেখানেই প্রিয়াঙ্কাকে সামনে আনা হবে বলে খবর। কেবল প্রিয়াঙ্কাকে সামনে আনাই নয়। সংগঠনের অন্যান্য নেতৃত্বেও বদল হবে বলে এআইসিসি সূত্রে জানা যায়। ইতোমধ্যেই গুজরাটের মানুষ মধুসূদন মিস্ত্রিকে উত্তরপ্রদেশের ইনচার্জের পদ থেকে সরানো হয়েছে। আনা হয়েছে গুলাম নবি আজাদকে। একইভাবে উত্তরপ্রদেশ প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি নির্মল খাত্রিকে সরিয়ে দলের সাবেক এমপি জিতিন প্রসাদকে আনার কথা চলছে।
×