ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

হলি আর্টিজানে হামলায় দু’জন শনাক্ত হওয়ার পর নড়েচড়ে বসেছে প্রশাসন

আর কত জঙ্গী আছে বগুড়ায়, পুলিশী তদন্ত নেই

প্রকাশিত: ০৫:৫২, ১২ জুলাই ২০১৬

আর কত জঙ্গী আছে বগুড়ায়, পুলিশী তদন্ত নেই

সমুদ্র হক ॥ ঢাকার গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্তরাঁয় জঙ্গী হামলার পাঁচজনের মধ্যে বগুড়ার দুই জঙ্গীর পরিচয় নিশ্চিত হওয়ার পর বগুড়ার আর কত জঙ্গী আছে- সেই প্রশ্ন সামনে এসেছে। তথাকথিত জেএমবি নেতা বগুড়ার বাংলা ভাইয়ের (প্রকৃত নাম সিদ্দিকুল ইসলাম) বিচারে মৃত্যুদ- কার্যকর হওয়ার পর ধারণা করা হয় বগুড়া ও আশপাশের অঞ্চলকে ঘিরে তথাকথিত জেএমবির সংগঠিত হওয়ার বিষয়টি বিলুপ্ত হয়ে গেছে। জেএমবি যে একেবারে বিলুপ্ত হয়ে যায়নি বরং তার শাখা-প্রশাখার বিস্তার ঘটিয়েছে, তার বিচ্ছিন্ন প্রমাণ এখন মিলছে। গুলশানে জঙ্গী হামলায় পুলিশ প্রথম যে পাঁচজনের ছবি এবং পরিচিতি দিয়েছিল তার মধ্যে একটির পরিচয় ছিল ভুল। বগুড়ার দু’জনের একজন ধুনটের জঙ্গী শফিকুলের পরিচয় প্রথমে দেয়া হয়নি। পরে বগুড়ার দুই জঙ্গীরই পরিচয় দেয়া হয়। এদের একজন শাজাহানপুর উপজেলার বৃকুষ্টিয়া গ্রামের খায়রুজ্জামান (২২) ও অপরজন ধুনট উপজেলার গোসাইবাড়ির চিথুলিয়ার শফিকুল ইসলাম উজ্জ্বল (২০)। এই দুজনই কৃষক পরিবারের ছেলে। প্রথমজন মাদ্রাসা শিক্ষায় আলিম পাস। দ্বিতীয়জন স্নাতক। খায়রুল আরও দুই নামে পরিচিত- পায়েল ও বাঁধন। এই দুজনের সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে পরিবারের কোন যোগাযোগ ছিল না। খায়রুল মাস সাতেক আগে এক বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে দামী মোটরসাইকেলে চেপে গ্রামে গেলে গ্রামের লোক আশ্চর্যই হয়ে যায়। উজ্জ্বল আশুলিয়ায় একটি কেজি স্কুলে শিক্ষকতা করত। এই দুই কৃষক পরিবারের কথা- তাদের ছেলেরা জঙ্গী হবে এমনটি কল্পনাও করেনি। উজ্জ্বলের বাবা-মার কথা- ছেলে যখন বাড়িতে আসত তখন সব সময় ধর্মীয় অনুশাসনে চলার পরামর্শ দিত। মা-বাবা মনে করতেন ছেলে নামাজী ধর্মভীরু হচ্ছে। ডিসেম্বরে সে জানায়, তবলিগের চিল্লায় গেছে। যখন তারা জানল তাদের ছেলে জঙ্গী, তখন মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ার উপক্রম। ছেলেদের কৃতকর্মে মা-বাবারা অনুতপ্ত হয়ে বলেন, দেশের আরও কত ছেলে এভাবে বিপথে গেছে, আরও কত মা-বাবাকে ছেলের অপবাদ সইতে হবে, তা খুঁজে দেখা দরকার এখনই। এদিকে বিভিন্ন মাধ্যমে খোঁজ করে জানা যায়, বগুড়ার শাজাহানপুর, গাবতলী, ধুনট, গাইবান্ধা, জয়পুরহাট, নওগাঁ, দিনাজপুর, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রাজশাহী এলাকায় জেএমবির তৎপরতা ছিল বেশি। তথাকথিত জেএমবি নেতার বিচারে মৃত্যুদ- কার্যকর হওয়া শায়খ আব্দুর রহমান প্রায় এক বছর ধরে বগুড়ার ঠনঠনিয়ায় আত্মগোপনে ছিল। তখন পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থা কেউ তাকে ধরতে পারেনি। এ থেকে স্পষ্ট ধারণা করা যায়, তথাকথিত জেএমবির গোপনে থাকার এমন কৌশল যা পুলিশেরও ধরাছোঁয়ার বাইরে। বর্তমানেও তারা যে গোপনে থাকার আরও আধুনিক কৌশল অবলম্বন করছে, তা টের পাওয়া গেল গত এপ্রিলের প্রথমে বগুড়ার শেরপুরের জোয়ানপুর কুঠিরভিটা গ্রামে একটি বাড়িতে বোমা বানানোর সময় বিস্ফোরিত হয়ে দুই জঙ্গী নিহত হওয়ার পর। ওই বাড়িতে অভিযান চালিয়ে বিপুল পরিমাণ বোমা-গ্রেনেড বানানোর আধুনিক উপকরণ এবং অস্ত্র উদ্ধার করা হয়। এ ঘটনায় নিহত দুই জঙ্গী রাসেলের বাড়ি ময়মনসিংহ ও তারেকের বাড়ি সিরাজগঞ্জে। রাসেলের পরিচয় পাওয়া যায় ঘটনার প্রায় দেড় মাস পর। এই দুই জঙ্গী মেধাবী শিক্ষার্থী। তাদের পরিবারও কখনই টের পায়নি ছেলেরা বিপথে গেছে। জঙ্গী রাসেল চট্টগ্রামে বেশ কয়েকটি সন্ত্রাসী ঘটনা ছাড়াও হাটহাজারীতে বিপুল অস্ত্র মজুদের সঙ্গে জড়িত। মিজানুর রহমান নামে যে ব্যক্তি শেরপুরের গ্রামে সিএনজি অটোরিক্সা চালকের পরিচয়ে বাড়ি ভাড়া নেয়, পুলিশ এখনও তাকে গ্রেফতার করতে পারেনি। শেরপুরের ওই ঘটনা পরিষ্কার ইঙ্গিত দেয় দেশের ভেতরে বিভিন্ন স্থানে জঙ্গীরা নানান ছদ্মবেশে লুকিয়ে থেকে সন্ত্রাস করে যাচ্ছে। তার আরেকটি বড় প্রমাণ গেল নবেম্বরের শেষে শিবগঞ্জের চককানু হরিপুর গ্রামে শিয়া সম্প্রদায়ের আল মোস্তফা জামে মসজিদে এশার নামাজের সময় মুসল্লিদের ওপর গুলি করে একজনকে হত্যা। নিরীহ গ্রামবাসীর কল্পনাতেও আসেনি এমন হামলা হতে পারে। এমন ঘটনা যে জঙ্গীদের কাজ তা এখন স্পষ্ট। এ ঘটনার কোন কূলকিনারা করতে পারেনি পুলিশ। এদিকে পুলিশের অভিযানে বগুড়ায় গত ছয় মাসে প্রায় ৫০ জঙ্গীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- উগ্র সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের (এবিটি) বগুড়া জেলা কমান্ডার সদরের মধ্যপালশা গ্রামের মেহেদী হাসান জিহাদ (২২) ও কাহালুর দেওগ্রামের সহকারী জেলা কমান্ডার মুদাচ্ছির তানজিম (২০)। এ তথ্য পুলিশের দেয়া। সূত্র জানায়, তথাকথিত জেএমবির মতো আনসারুল্লাহও সংগঠিত হচ্ছে। মাস কয়েক আগে ঢাকার মিরপুরে জঙ্গী আস্তানায় যাদের গ্রেফতার করা হয় সকলেই আনসারুল্লাহর সদস্য। মাস চারেক আগে বগুড়ার শাজাহানপুরে মামুন নামে যে ব্যক্তিকে গ্রেফতারের পর স্বীকারোক্তি অনুযায়ী একে পয়েন্ট ২২ বোরের অস্ত্র উদ্ধার হয়, একই ধরনের অস্ত্র হাতে গুলশানে হামলায় জঙ্গীদের ছবি ইন্টারনেটে দেয়া হয়। এ বিষয়টিকেও এখন আর কাকতালীয় বলে নেয়া যায় না এ কারণে যে, গুলশানে জঙ্গী হামলার দু’জনই যখন বগুড়ার তখন বগুড়ায় এমন অস্ত্র নিয়ে আরও জঙ্গী কোন ছদ্মাবরণে লুকিয়ে আছে, যার ট্রেস করতে ব্যর্থ হচ্ছে পুলিশ। পুলিশ বলছে, তারা বসে নেই। প্রতিটি থানায় জঙ্গীদের সম্পর্কে খোঁজখবর নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেয়া আছে। যারা নিখোঁজ হয়েছে এবং সাধারণ ডায়েরি করা আছে, তাদের খোঁজখবর তো নিতে বলা হয়েছেই- এমনকি এলাকায় ও গ্রামে নিখোঁজ হয়েছে কিন্তু থানা পর্যন্ত খবর পৌঁছেনি তারও অনুসন্ধান চলছে। বিভিন্ন মাধ্যমে খোঁজ করে জানা গেছে, ‘নিখোঁজ’ তরুণদের বিষয়ে বর্তমানে অনেক পরিবার মুখ খুলতে চাইছে না। যারা তবলিগ জামাতের চিল্লায় গেছে তাদেরও সন্ধান করা হচ্ছে। দরকার হলে যে মসজিদে তারা অবস্থান করছে সেখানেও সন্ধান চালানো হচ্ছে। প্রসঙ্গত, গুলশানের জঙ্গী হামলার শফিকুলও তবলিগের চিল্লার কথা বলে ঘর থেকে বের হয়েছিল।
×