ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

কমলাপুরে জব্দ রাইফেল আর গুলশানে ব্যবহৃত অস্ত্র একই চালানের!

প্রকাশিত: ০৫:৪৩, ১২ জুলাই ২০১৬

কমলাপুরে জব্দ রাইফেল আর গুলশানে ব্যবহৃত অস্ত্র একই চালানের!

গাফফার খান চৌধুরী ॥ কাস্টমার সেজে গুলশানে হলি আর্টিজান রেস্তরাঁয় ঢোকে ছয় জঙ্গী। তাদের গায়ে ছিল দামী পোশাক। পেছনে ভারি ব্যাগ। দেখতে কেতাদুরস্ত। সুদর্শন চেহারা। তারা দরজার কাছে আসা মাত্রই সম্মানের সঙ্গে তাদের ভেতরে ঢুকে বসার আহ্বান জানান রেস্তরাঁর অভ্যর্থনাকারীরা। হোটেলে ঢুকেই তারা সবাইকে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে ফেলে। মাত্র পাঁচ থেকে সাত মিনিটের মধ্যে বাংলাদেশী ও বিদেশীদের আলাদা করে। এরপর বিদেশীদের ছুরিকাঘাতে দুর্বল করার পর একের পর এক জবাই করতে থাকে। যেসব বিদেশী ছুরিকাঘাতে ও জবাই করার পরও জীবিত ছিলেন, তাদের গুলি চালিয়ে হত্যা নিশ্চিত করে জঙ্গীরা। জঙ্গীদের ব্যবহৃত রাইফেলের বিষয়ে কমলাপুর রেলওয়ে থানার ওসি আব্দুল মজিদ জনকণ্ঠকে বলেন, গুলশানের আর্টিজান থেকে একে টু টু রাইফেল উদ্ধার হয়। হুবহু একই রাইফেল ২০১৪ সালে কমলাপুর রেলস্টেশন থেকে পর পর দুটি উদ্ধার হয়। উদ্ধারকৃত রাইফেলের বিষয়ে একটি বাহিনীর প্রধান গোয়েন্দা কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, গুলশান থেকে উদ্ধার হওয়া রাইফেল আর কমলাপুর থেকে পুলিশের জব্দ করা রাইফেল হুবহু এক ও অভিন্ন। রেল পুলিশ উদ্ধারকৃত রাইফেল দুটি চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় পাঠানো হয়েছিল। রাইফেল উদ্ধারের ঘটনায় ২ জন গ্রেফতারও হয়েছিল। রাইফেলগুলো একই চালানের কিনা সে বিষয়ে তদন্ত চলছে। গুলশানে ব্যবহৃত রাইফেলের সঙ্গে কমলাপুর থেকে উদ্ধারকৃত রাইফেলের কোন যোগসূত্র আছে কিনা সে বিষয়ে অনুসন্ধান চলছে। প্রয়োজনে কমলাপুর থেকে রাইফেলসহ গ্রেফতার হওয়াদের গুলশানের মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে রিমান্ডে আনা হবে। এদিকে পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলো গুলশান থেকে উদ্ধারকৃত রাইফেল আর ২০১৪ সালে দেশব্যাপী বিএনপি-জামায়াত-শিবির-জঙ্গীদের তা-বের সময় রাজধানীর কমলাপুর থেকে উদ্ধারকৃত রাইফেল হুবহু এক ও অভিন্ন বলে নিশ্চিত করেছে। গুলশান ও কমলাপুর থেকে উদ্ধারকৃত অস্ত্রের মধ্যে বিশেষ কোন যোগসূত্র আছে কিনা সে বিষয়ে অনুসন্ধান করছেন গোয়েন্দারা। রেস্তরাঁ থেকে বেঁচে আসা প্রত্যক্ষদর্শী বরিশালের ছেলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে জনকণ্ঠের কাছে সেদিনের ঘটনার রোমহর্ষক বর্ণনা দেন। তিনি দেড় বছর ধরে হলি আর্টিজানে কিচেনে সহকারী হিসেবে কাজ করছিলেন। বলেন, দোতলা হোটেলটি খুবই সাজানো গোছানো। নিচ তলায় কাস্টমারদের খাওয়ার ব্যবস্থা। আর উপরের তলায় রান্নাবান্নাসহ আনুষঙ্গিক কাজকর্ম হয়। তবে কাজের জন্য অনেক সময়ই কিচেন বয়, সহকারী পরিচারকসহ অনেকেরই নিচে আসতে হয়। কারণ হোটেলটির মূল কাউন্টার নিচে। কাউন্টারের ম্যানেজারও অনেক সময় কাউকে কাউকে ডেকে পাঠান। তখন স্বাভাবিক কারণেই যেতে হয়। হোটেলের পূর্ব দিকে সুন্দর বারান্দা রয়েছে। সেখানে অন্তত দশ জনের খাবার ব্যবস্থাও আছে। আবার অনেকে সেখানে গল্পও করে থাকেন। তবে দোতলায় খাবারের ব্যবস্থা শুধুমাত্র ভিআইপিদের। অনেক সময় মালিকের লোকজন ও বিদেশী মেহমানরাও সেখানে বসে গল্প করেন। সেখান থেকে গুলশান লেক দেখা যায়। রেস্তরাঁ থেকে লেকের দূরত্ব মাত্র ২০ থেকে ২৫ হাত পূর্বে। লেক লাগোয়া পাকা রাস্তা। সেটি মূলত হাঁটার রাস্তা। আর হোটেলের বাইরে সুন্দর ঘাসের মাঠ রয়েছে। মাঠে বসে গল্প ছাড়াও খাবার ব্যবস্থাও আছে। প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনা মোতাবেক, ঘটনার কয়েক মিনিট আগে তাকে হোটেলের নিচে ডাকা হয়। বিদেশী মেহমানদের জন্য খাবার দাবার যেন সুন্দর রুচিশীল হয় সে বিষয়ে পরামর্শ দেয়া হয়। তার মতো অনেককেই এমন পরামর্শ দেয় রেস্তরাঁ কর্তৃপক্ষ। রাত পৌনে নয়টার দিকে ছয় যুবক হেঁটে হোটেলের সদর দরজার কাছে আসে। দেখে বোঝা যাচ্ছিল তারা ধনাঢ্য মানুষের সন্তান। হোটেলটিতে সাধারণত যেনতেন লোকের যাতায়াত নেই। তার মধ্যেও তারা অধিক কেতাদুরস্ত। যুবকরা হেঁটে রেস্তরাঁয় আসে। অত্যন্ত কেতাদুরস্ত যুবকরা আসা মাত্রই অভ্যর্থনাকারীরা ব্যস্ত হয়ে পড়েন। তাদের সযতেœ বসার আহ্বান জানান হোটেল বয়রা। যুবকরা হোটেলে ঢুকেই একবার শুধু চারদিকে চোখ বোলায়। এরপর পিঠের ব্যাগ থেকে আগ্নেয়াস্ত্র বের করে। অস্ত্রের মুখে সবাইকে জিম্মি করে ফেলে। সবাইকে হৈচৈ বন্ধ করে নীরব থাকতে বলে। এরপর পর্যায়ক্রমে বাংলাদেশী ও বিদেশীদের আলাদা করে। অধিকাংশ বিদেশী নিচ তলায় ছিলেন। হোটেলের দরজায় একজন ভারি অস্ত্র নিয়ে পাহারা দিতে থাকে। বাংলাদেশীদের দোতলার চলে যেতে ইশারা করে। আর দেখে দেখে বিদেশীদের নিচতলায় আটকে রাখে। বাংলাদেশীরা যখন দোতলায় যাচ্ছিলেন, তখনই শুরু হয় জঙ্গীদের তা-ব। তারা ছোট ছোট তলোয়ার দিয়ে বিদেশীদের এলোপাতাড়ি আঘাত করতে থাকে। তাদের চিৎকারে নিচতলায় এক বিভীষিকাময় পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। তাদের বাঁচানোর মতো কেউ ছিল না। যে যার যার মতো জীবন বাঁচাতেই ব্যস্ত ছিল। প্রথমে বিদেশীদের এলোপাতাড়ি কুপিয়ে জখম করে। এরপর নিচ তলায়ই তেরো বিদেশীকে নৃশংসভাবে জবাই করে। ছুরিকাঘাতে ও গলা কাটার পরও যাদের দেহ নড়াচড়া করছিল, তাদের গুলি করা হয়। পুরো ফ্লোর রক্তে ভিজে যায়। দোতলায় থাকা বাংলাদেশীদের অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে রাখা হয়েছিল। তবে তাদের ওই সময় কোন রুমে ঢুকিয়ে আটকে রাখা হয়নি। এ সময় দোতলায় থাকা দুই বিদেশী লাফিয়ে পড়েন। তারা রেস্তরাঁর দেয়ালের সঙ্গে মিশে লুকিয়ে ছিলেন। পরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাদের উদ্ধার করে। হত্যাকা- শেষ হওয়ার পর তাকেসহ ৯ জনকে দোতলার একটি বাথরুমে আটকে রাখে জঙ্গীরা। তাদের বাথরুমে ঢুকিয়ে দরজা বাইরে থেকে লাগিয়ে দেয়। সেই বাথরুমে তিনি ছাড়াও সবুজ, শিশির, সমির, রিন্টু ও রাজীবসহ মোট নয় জনকে আটকে রাখা হয়েছিল। বাথরুম থেকেই তিনি তার বোনের সঙ্গে প্রথমে কয়েক দফায় মোবাইল ফোনে কথা বলেন। ওই সময় ভালভাবে নেটওয়ার্ক পাওয়া যাচ্ছিল না। ফলে জোরে কথা বলতে হচ্ছিল। এতে বিপদ আঁচ করতে পেরে তিনি মেসেজের মাধ্যমে বোনের সঙ্গে যোগাযোগ অব্যাহত রাখেন। সকাল পৌনে ছয়টা পর্যন্ত সর্বশেষ যোগাযোগ হয়। এরপর থেকেই মোবাইল ফোনের যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। তার কাছে থাকা মোবাইল ফোন দুটি কে বা কারা নিয়ে যায়। সেনা কমান্ডোরা অভিযান চালানোর পর থেকে উদ্ধার হওয়ার আগ পর্যন্ত আর পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল না তার। উদ্ধারের পর তাদের একটি নির্দিষ্ট দফতরে যেতে বলা হয়। সেখান থেকে তাকে তার পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়। সকালে সেনা কমান্ডোরা অভিযান চালায়। সেনাবাহিনী অত্যন্ত বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে অপারেশন পরিচালনা করে। একটি পক্ষ সাঁজোয়া যান থেকে গুলি চালায়। আরেকটি কমান্ডো দল সোজা দরজা ভেঙ্গে দোতলায় উঠে যায়। পরে সেনা কমান্ডোরা বাথরুম ভেঙ্গে তাদের নয়জনকে উদ্ধার করে। একদিকে কমান্ডোরা জঙ্গীদের লক্ষ্য করে গুলি চালাতে থাকে। এতে জঙ্গীরা কমান্ডোদের হামলা মোকাবেলা করতে ব্যস্ত থাকে। এই ফাঁকে অন্য কমান্ডোরা নয়জনকে দেয়াল টপকে বাইরে নামিয়ে দেন। এভাবেই কমান্ডোরা ১৩ জনকে উদ্ধার করতে সক্ষম হন। উদ্ধারকৃতদের সমস্ত পরিচয় লিখিতভাবে নেয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ অন্যান্য গোয়েন্দা সংস্থা। তাদের জবানবন্দীও রেকর্ড করে রাখা হয়। এরপর যাচাইবাছাই শেষে যার যার পরিবারের কাছে ফেরত পাঠানো হয়। সোমবার খানিকটা দূর থেকেই হলি আর্টিজান রেস্তরাঁর পরিস্থিতি দেখা যায়। ঘটনার পর থেকে রেস্তরাঁটিসহ আশপাশের এলাকা সিল করে দেয়া হয়েছে। সেখানে সর্বসাধারণের প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। দূর থেকে দেখা যায়, সেনাবাহিনীর কমান্ডোদের সাঁজোয়া যানের গুলির আঘাতে সবুজ স্টিলের বাউন্ডারি দেয়াল দুমড়ে মুচড়ে গেছে। ঝাঁঝরা হয়ে গেছে হোটেলের দরজা জানালাসহ আসবাবপত্র। চেয়ার টেবিলগুলো উল্টে আছে। সেখানে দায়িত্বরত এক পুলিশ কর্মকর্তা জানান, রেস্তরাঁটির পরিবেশ অনেকটা যুদ্ধবিধ্বস্ত এলাকার মতো। সেখানে ছোপ ছোপ রক্ত জমে আছে। রক্ত পচে পুরো এলাকায় দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পড়েছে। দুর্গন্ধে রেস্তরাঁর আশপাশে যাওয়া যায় না। যে কোন সময় বাড়িটি ধসে পড়াও বিচিত্র নয়।
×