ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

অঞ্জন সরকার জিমি

স্বল্প ও মুক্তদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রের সম্ভাবনা

প্রকাশিত: ০৩:৫৩, ১২ জুলাই ২০১৬

স্বল্প ও মুক্তদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রের সম্ভাবনা

১৯৯৭ সাল। বিশ্ব চলচ্চিত্রে ইরানী জাগরণ চলছে। আব্বাস কিয়েরোস্তামি, মহসেন মাখমালবাফ, জাফর পানাহি, মাজেদ মাজেদি প্রমুখ খ্যাতিমান এশীয় পরিচালকের ভিড়ে ‘লাইফ ইন ফগ’ নামে, একটি স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র দিয়ে পাদপ্রদীপের আলোয় আসেন এক কুর্দি তরুণ। নাম বাহমান গোবাদি। এটি ছিল তাঁর নবম স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র। তথ্যচিত্রটির ব্যাপক সাফল্যই তাঁর শিল্পের ক্ষুধাকে উসকে দেয়। পরবর্তীতে এই পরিচালকের ‘টার্টলস ক্যান ফ্লাই’, হাফ মুন, রাইনোসিজনসহ বেশ কয়েকটি ছবি বিশ্ব-চলচ্চিত্রের শ্রেষ্ঠ প্রতিযোগিতাগুলোতে স্থান করে নেয় এবং পুরস্কৃত হয়। পৃথিবীর অনেক খ্যাতনামা পরিচালকই স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রের মাধ্যমে তাদের শিল্পজীবন শুরু করেছেন। এদের মধ্যে আব্বাস কিয়েরোস্তামি, এমির কুস্তরিকাসহ বিশ্ব চলচ্চিত্রের অনেক রথী-মহারথীই আছেন। ছোট ছোট চলচ্চিত্র নির্মাণের মাধ্যমে এঁরা নিজেদের মেধা, শিল্পবোধ, দর্শন, মনন ইত্যাদিকে যেমন ঝালিয়ে নিয়েছেন একদিকে, অন্যদিকে চলচ্চিত্রের বিভিন্ন কারিগরি দিকগুলোর ব্যবহার ও সম্ভাবনা রপ্ত করে নিয়েছেন; যা পরবর্তীতে পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণের ক্ষেত্রে তাদের ব্যাপক সহযোগিতা করেছে। এসব বিখ্যাত পরিচালকের প্রায় প্রত্যেকের আত্মজীবনীতে প্রথম জীবনে নির্মিত স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র কিভাবে তাদের চলচ্চিত্র নির্মাণে উদ্বুদ্ধ করেছে তার বর্ণনা আছে। বাংলাদেশে অনেকেই স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণের সঙ্গে জড়িত। গত এক দশকে অনেক শিল্পমানসম্পন্ন স্বল্পদৈর্ঘ্য কাহিনী ও তথ্যচিত্র দেশের বাইরে সুনাম অর্জন করেছে। এগুলোর মধ্যে ইশতিয়াক জিকোর ৭২০ ডিগ্রী উল্লেখযোগ্য। তথ্যচিত্রের মধ্যে শাহীন দিল রিয়াজের লোহাখোর, কামার আহমেদ সাইমনের ‘শুনতে কি পাও’। এদের ধারাবাহিকতায় অনেক তরুণ স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণে আগ্রহী হয়ে উঠেছে। প্রতিবছর অসংখ্য স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মিত হচ্ছে বাংলাদেশে। দেশে ও দেশের বাইরের বিভিন্ন চলচ্চিত্র উৎসবে প্রদর্শিত হচ্ছে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রকারদের নির্মিত স্বল্প ও মুক্তদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র। এসব ছোট ছোট ছবির অনেকগুলোই আঙ্গিক ও বিষয়ে বিশ্বমানের। বিষয় ও কাহিনীর কাঠামো থেকে শুরু করে দৃশ্যধারণ, সম্পাদনা, শিল্প ও পোশাক নির্দেশনা, এমনকী ভিজ্যুয়াল গ্রাফিক্সেও নতুনত্ব নিয়ে আসছে বাংলাদেশের তরুণরা। তাদের এসব সৃষ্টিকর্মের ওপর ভিত্তি করে প্রতিবছর দেশের বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন ক্যাটাগরির চলচ্চিত্র উৎসব হচ্ছে। এলাকাভিত্তিক, বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রিক, জনরা ও ফরম্যাটভিত্তিক অনেক চলচ্চিত্র উৎসব আয়োজিত হচ্ছে প্রতিবছর। প্রতিযোগিতামূলক এসব উৎসব একদিকে যেমন নির্মাতাদের সৃষ্টির প্রতি দায়িত্বশীল করে তুলছে, অন্যদিকে নতুনদের উৎসাহিত করছে চলচ্চিত্র নির্মাণে এগিয়ে আসতে। যেসব স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র উৎসব বাংলাদেশে আয়োজিত হয় তার মধ্যে ‘আন্তর্জাতিক স্বল্প ও মুক্তদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র উৎসব’ সবচেয়ে প্রাচীন এবং কুলীনও বটে। প্রতি দু’বছর পরপর অনুষ্ঠিত হওয়া এই চলচ্চিত্র উৎসবটিতে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের বিশ্বমানের সব চলচ্চিত্র প্রদর্শিত হয়। ঢাকা শহরের অনেক ভেন্যুতে খুবই কম দর্শনীর বিনিময়ে আগ্রহী দর্শকদের জন্য তারা স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র দেখার সুযোগ করে দিয়েছে এই উৎসবের মাধ্যমে। আমাদের চারপাশের রাষ্ট্রগুলো যখন সিনেমাকে তাদের মেধা ও মতামত প্রকাশের প্রধান হাতিয়ার বানিয়ে তুলছে। তখন আমরা ক্রমশ চলচ্চিত্র বিমুখ হয়ে পড়ছি। হলে দর্শক নেই, প্রদর্র্শনীতে দর্শক নেই, কোথাও দর্শক নেই। সব দর্শক টিভি চ্যানেলে হিন্দী সিরিয়াল দেখছে। আমরা চলচ্চিত্রের বাণিজ্যিকতার প্রসঙ্গ এলেই গ্রামবাংলার দর্শকদের রুচির প্রতি নেতিবাচক ইঙ্গিত করতে কুণ্ঠাবোধ করি না, কিন্তু শহুরে মধ্যবিত্ত শিক্ষিত দর্শকরাও নিম্নমানের ছবিগুলোর প্রতি আগ্রহ দেখায় না। আমরা হলের নাজুক পরিবেশের অজুহাতে হলে গিয়ে সিনেমা দেখি না, কিন্তু এইসব রুচিসম্মত প্রদর্শনগুলোতেও আসি না অনভ্যস্ততার কারণ দেখিয়ে। অনেকে বলেন, খবর পান না বলেই আসা হয় না, আবার অনেকে সময় মেলাতে পারেন না। এইসব ছেদোকথার আড়ালে শহুরে মধ্যবিত্ত তার জীর্ণতাকে ঢেকে রাখার চেষ্টা করলেও লাভ হয় না তেমন। অথচ বাংলাদেশ সরকার চলচ্চিত্র শিল্পের উন্নয়নে চলচ্চিত্রকে রাষ্ট্রীয়ভাবে শিল্প হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে। বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে ডিজিটাল ফরম্যাটের নতুন সব কারিগরি যন্ত্রপাতি এনে বিএফডিসিকে সমৃদ্ধ করেছে। নির্মাতাদের উৎসাহী করতে পূর্ণ ও স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রে অনুদান দিচ্ছে। বিভিন্ন চলচ্চিত্র উৎসবগুলোকে আর্থিক সহায়তা দিচ্ছে সরকারীভাবে। রাষ্ট্রের তরফ থেকে যা যা করার সম্ভব তাই করা হচ্ছে আমাদের রুগ্ন এ শিল্পকে গতিশীল করতে। কিন্তু লাভ হচ্ছে না কোন। রাষ্ট্রের সব পৃষ্ঠপোষকতা ব্যর্থ হচ্ছে এই সেক্টরের কিছু গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় ব্যক্তি ও নির্বোধ চলচ্চিত্র-জীবীদের সদিচ্ছার অভাবে। আশা করি সরকার একদিন সর্ষের ভেতরের ভূতগুলোকে ঝেটিয়ে বিদায় করতে সমর্থ হবে। আমাদের মেধার কোন অভাব নেই। আমাদের ঘটনার কোন অভাব নেই। আমাদের সীমার কোন অভাব নেই। এমনকি আমাদের প্রতিবন্ধকতারও কোন অভাব নেই। বিশ্ব দরবারে আমাদের চলচ্চিত্র বর্তমান অবস্থানই তার প্রমাণ। আমাদের চলচ্চিত্র এখন বিশ্ব চলচ্চিত্র উৎসবগুলোতে নিয়মিত হয়ে উঠেছে। প্রতি বছরই আমাদের দেশের কোন না কোন সিনেমা প্রেস্টিজিয়াস ফেস্টিভ্যালগুলোতে অংশগ্রহণ করে পুরস্কার নিয়ে আসছে। তরুণ পরিচালকরাই জিতে আনছে চলচ্চিত্রের সব দুর্লভ সম্মান। উদাহরণ হিসেবে ‘শুনতে কি পাও’ চলচ্চিত্রটির কথাই বলা যায়। কামার আহমেদ সাইমন নির্মিত এই ডকু-ফিকশনটি একাই ‘সিনে দ্য রিল’সহ অসংখ্য আন্তর্জাতিক পুরস্কারে ভূষিত হয়েছে। শস্যক্ষেতে আগাছা থাকবেই। প্রকৃত চলচ্চিত্র নির্মাতাদের ভিড়ে সস্তা জনপ্রিয়তা-লোভী অসংখ্য নির্মাতাতে ছেয়ে গেছে চলচ্চিত্রের এই ক্ষেত্রটি। মাখন-বিলাসী এইসব নির্মাতার টার্গেট টিভি নাটকেই সীমাবদ্ধ। দুয়েকজন টিভি নাটকের গ-ি পেরিয়ে বিজ্ঞাপনচিত্র পর্যন্তও পৌঁছে যেতে পারে। তবে বিজ্ঞাপন নির্মাণের জন্য ভিন্ন এলেম দরকার যা সবাই রপ্ত করে উঠতে পারে না। এই মুহূর্তে চলচ্চিত্র শিল্পের এইসব মেধাবী তরুণের জন্য জরুরীভাবে সুষ্ঠু প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ও কারিগরি সহযোগিতা প্রয়োজন। প্রয়োজন, তাদের স্বীকৃতির যথাযোগ্য ব্যবস্থা করা। সঠিক ও নিরপেক্ষ জুরির মাধ্যমে বাছাই করে সেরা ছবিগুলোকে পৃথিবীর কুলিন চলচ্চিত্র উৎসবগুলোতে রাষ্ট্রীয়ভাবে পাঠানোর ব্যবস্থা করা দরকার। সেই্সঙ্গে একটা তথ্যকেন্দ্র বানানো উচিত যেখান থেকে বিভিন্ন সম্মানজনক চলচ্চিত্র উৎসবগুলোতে ছবি জমা দেয়ার সঠিক তথ্য ও নিয়মাবলী পাওয়া যায়। যদি রাষ্ট্র এই ব্যবস্থা গ্রহণ করে তবে নিশ্চিতভাবেই বলা যায় ক্রিকেটের পরে বাংলাদেশকে বিশ্ব দরবারে স্থান পাইয়ে দিতে আমাদের চলচ্চিত্র ও স্থিরচিত্র শিল্প সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখবে।
×