ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

সুমন্ত গুপ্ত

দ্য কুইন্স ইয়ং লিডারশিপ এ্যাওয়ার্ড

প্রকাশিত: ০৩:৫২, ১২ জুলাই ২০১৬

দ্য কুইন্স ইয়ং লিডারশিপ এ্যাওয়ার্ড

সময়টা ২০১২ সাল। ২২ বছরের তরুণ টগবগে যুবক ছোটবেলা থেকেই স্বপ্ন দেখতেন- বিমান চালাবেন। কিন্তু পরিবারের চাপে দাখিল ও কামিল পাস করে ভর্তি হলেন আপডেট ডেন্টাল কলেজে। দেশের তরুণ সমাজের কথা ভাবতেন প্রতিনিয়ত, তার কাজের স্বীকৃতি হিসেবে গত ২৩ জুন বৃহস্পতিবার ব্রিটেনের রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথের কাছ থেকে ‘দ্য কুইন্স ইয়াং লিডারশিপ এ্যাওয়ার্ড- ২০১৬ পুরস্কার নেন। বন্ধুরা এতক্ষণে বুঝতে পাড়ছেন আমি কার কথা বলছি- আমি বলছি বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয় সাময়িকী ফোর্বসের এশিয়ার অনূর্ধ্ব-৩০ তরুণ সামাজিক উদ্যোক্তার তালিকায় স্থান করে নেয়া ২৫ বছর বয়সী তরুণ ওসামা বিন নূরের কথা। ৩০ জন তরুণ উদ্যোক্তার মধ্যে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো থেকে ভারতের দুজন, পাকিস্তানের দুজন, শ্রীলঙ্কার একজন, মালদ্বীপের একজন স্থান পেয়েছেন। ওসামা বিন নূরের বাড়ি নরসিংদীর রায়পুরার আদিয়াবাদ ইউনিয়নের সিরাজনগর নয়াচর গ্রামে। বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক বাবা মোহাম্মদ নূরল ইসলাম, মা আঁখিনূর বেগম আর চার ভাইবোনের সংসারে বেড়ে ওঠা ওসামার। কোন দিনও অনলাইনে কাজ করবেন ভাবেননি ওসামা। আড্ডা, লেখাপড়া নিয়ে ভালই কাটছিল। লেখাপড়ার ফাঁকে ফাঁকে বিভিন্ন সংস্থায় স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে কাজ করতেন। কাজ করতে করতে তার মনে হলো, নিজেকে আরও দক্ষ করে তুলতে হবে, যোগাযোগ দক্ষতা বাড়াতে হবে, নেতৃত্বের গুণাবলী তৈরি করতে হবে। সেজন্য ব্রিটিশ কাউন্সিলের এ্যাকটিভ সিটিজেন প্রোগ্রামে অংশ নেন। বাংলাদেশ ইয়ুথ লিডারশিপ সেন্টারের চার মাসের প্রশিক্ষণও নেন ওসামা। ২০১১ সালে ভারতে সাউথ এশিয়ান ইয়ুথ কনফারেন্সে গিয়েও তরুণদের সঙ্গে পরিচয় হলো। দেখলেন, বিশ্ব সম্পর্কে তারা কতটা অবগত , ভবিষ্যত জীবনের জন্য তাদের কত দারুণ দারুণ পরিকল্পনা আছে। দেশে ফেরার পরই জীবনের লক্ষ্য তাঁর বদলে গেল। অনেকের সঙ্গে তরুণদের নিয়ে কাজ করার কথা শেয়ার করলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএর ছাত্র মাকসুদুল আলম, ভারতের কয়েকজন বন্ধু সাহায্য করতে এগিয়ে এলেন। তাঁদের সবার দেয়া তথ্য সহায়তা নিয়ে ২০১২ সালে চালু হলো ‘ইয়ুথ অপরচুনিটিজ’ নামের একটি ফেসবুক পেজ। যেখানে বিভিন্ন ওয়েবসাইট ঘেঁটে তাঁরা শিক্ষাবৃত্তি, সেমিনার-কনফারেন্স, সম্মাননা ইত্যাদি শিক্ষামূলক তথ্য দিতে শুরু করলেন। কাজ শুরুর কয়েক দিনের মধ্যে দেখলেন, ফেসবুকে তাঁদের পোস্টগুলো খুব শেয়ার হচ্ছে। পেজ চালু করার দেড় বছরের মাথায় ৫০ হাজার লাইক হলো। ওসামা ২০১৩ সালের জানুয়ারি মাসে পাঁচ হাজার টাকা ধার করে চালু করলেন তাদের ওয়েবসাইট িি.িুড়ঁঃযড়ঢ়.পড়স, সেটিও কিছুদিনের মধ্যে খুব জনপ্রিয়তা পেয়ে গেল। এর পরের গল্প কেবল সাফল্যের। এই সাইট আসলে সারা বিশ্বের তরুণদের নানা ধরনের সুযোগ নেয়ার একটি মঞ্চ, যেখানে তাঁরা নিজেদের দক্ষতা ও যোগ্যতার প্রকাশ ঘটাতে পারবেন। পাশাপাশি ক্যারিয়ারের উন্নতি করার জন্য নানা চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার মাধ্যমে তাঁদের তৈরি হওয়ারও সুযোগ থাকছে। মাত্র ৪ বছরে ১৯২টি দেশ থেকে ১ লাখ তরুণ ইয়ুথ অপরচুনিটিজের মাধ্যমে বিভিন্ন রকম কাজে অংশ নেয়। ভলান্টিয়ার ফর বাংলাদেশসহ নানা স্বেচ্ছাসেবী উদ্যোগকে নিজের ধ্যান-জ্ঞান হিসেবে নেয়া ওসামা অংশ নিয়েছেন বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী কাজে। উপস্থাপক হিসেবে বয়ঃসন্ধিকালে কিশোরদের সমস্যা নিয়ে ‘টিন-টেক্কা’ নামে কালারস এফএম রেডিওতে একটি অনুষ্ঠানের সঙ্গেও নিজেকে যুক্ত রেখেছেন। এ তো গেল আমাদের ওসামার কথা আসুন জেনে নেই আমাদের দক্ষিণ এশিয়ার যারা পেলেন এই এ্যাওয়ার্ড তাদের সম্পর্কে- ভারত কার্তিক সাওহানি-কার্তিক ছোটবেলা থেকেই শিক্ষার সম্প্রসারণের ব্যাপারে খুব উৎসাহী। যদিও তিনি অন্ধ হয়ে জন্মেছেন, কার্তিক স্কুলে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে বিষয়ে পারদর্শী ছিলেন। তিনি লক্ষ্য করেন যে অন্ধ শিক্ষার্থীদের গ্রেড ১০ পরে উচ্চশিক্ষা ক্ষেত্রে বাধা প্রদান করা হয়। কার্তিককে আটকানো ছিল মর্মস্পর্শী। সমাজের যারা আছেন তাকে হেয় করতেন বলতেন কার্তিক অন্ধ সে আর এগুতে পারবে না। পরে কার্তিক অনেক চেষ্টার পর ভারতের প্রথম গ্রেড ১১ অন্ধ বিজ্ঞান ছাত্র হিসেবে নাম নথিভুক্ত করান। তিনি যখন ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ প্রবেশের চেষ্টায় অনুরূপ চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন, তাই ২০১৩ তিনি যুক্তরাষ্ট্রের স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি বৃত্তি গুহণ করেন। কার্তিক ঝঞঊগ অপপবংং প্রজেক্টের প্রতিষ্ঠাতা যা যুব সমাজকে বিজ্ঞান শিক্ষা দিয়ে থাকে। নেহা সায়িন-নেহা বর্তমানে পাঁচ বছরের জন্য একটি যুব সংগঠনে ফ্যাসিলিটর হিসেবে কাজ করেছেন। দুই বছর আগে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন জঁনধৎড়ড় নামক এনজিও। সংগঠন অল্প বয়সী ছেলেমেয়েদের জন্য একটি স্থান প্রদান করে যা তাদের আর্থ-সামাজিক উন্নায়ন ঘটিয়ে তাদের নেতৃত্বের দক্ষতা বিকশিত করার লক্ষ্যে কাজ করে। তারা প্রত্যন্ত অঞ্চলে নিজের খরচে শিক্ষা প্রদান করে থাকে এ পর্যন্ত হায়দরাবাদ শহরে প্রায় ২ হাজার অল্পবয়সী ছেলেমেয়েদের তাদের সঙ্গে একত্রিত করতে পেরেছেন তারা। মালদ্বীপ সাফাত আহমেদ জাহির- সাফাত কর্মক্ষেত্রে নারীর ক্ষমতায়নে ব্যাপারে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করে যাচ্ছেন। তিনি মালদ্বীপে পুঁজিবাজারের নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠান এ ইন্টার্নশিপ করা কালীন সেখানে একটি সেমিনারে কর্পোরেট ক্ষেত্রে নারীরা কিভাবে কাজ করতে পারেন, কিভাবে দেশের উন্নায়নে অংশীদার হতে পারেন তার ওপরে একটি বক্তব্য রাখেন। তারপর সাফাতকে সরকার থেকে ঐ প্রতিষ্ঠানের নারী মহাসচিব হওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। সাফাত বিশ্বাস করে তিনি মালদ্বীপের নারীরদের নিজেদের পায়ে দ্বার করাতে সক্ষম হবেন। ভবিষ্যতে সাফাত শিশুদের জন্য একটি ডে কেয়ার সেন্টার চালু করবেন বলে আসা প্রকাশ করেন। পাকিস্তান মুহাম্মদ উসমান খান- সকল শিশু যেন শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে তার জন্য নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। ব্রিটিশ কাউন্সিলের সক্রিয় নাগরিক কর্মসূচীতে যোগদান করার পর, তিনি একটি শিক্ষামূলক কার্যক্রম ইধপশ ঃড় খরভব ঊফঁঃধরহসবহঃ ভড়ৎ ংঃৎববঃ পযরষফৎবহ নামক প্রোগ্রাম ডিজাইন করেন। তিনি সামাজিক মাধ্যম ব্যবহার করে সব তরুণদের সঙ্গে যুক্ত করেছেন। বর্তমানে ৫০০ জনেরও বেশি তরুণদের যুক্ত করেছেন। মুহাম্মদ উসমান খান ইঊণখও ঙৎমধহরুধঃরড়হ এর প্রতিষ্ঠাতা, যা শিক্ষিত এবং সুবিধাবঞ্চিত তরুণদের সমর্থন করার লক্ষ্যে কাজ করে। জয়নাব বিবি- জয়নাব একজন পরিবেশবিদ, তিনি নবায়নযোগ্য শক্তিকে কিভাবে কাজে লাগানো যায় তার ওপর কাজ করে যাচ্ছেন। ২০১৩ সালে তিনি চধশরংঃধহ ঝড়পরবঃু ভড়ৎ এৎববহ ঊহবৎমু প্রতিষ্ঠা করেন এর প্রধান কাজ হলো মানুষর মাঝে সচেতনতা বৃদ্ধি করা যাতে করে মানুষ সবুজায়ন এর মাধ্যমে প্রাকৃতিক বিপর্যয় থেকে রক্ষা পায়। এরপর তিনি সফলভাবে বর্জ্য টিস্যু কাগজ, থেকে একটি বায়োইথানল (একটি বায়ো-ফুয়েল) উৎপাদন করেন যা পরিবেশবান্ধব। জয়নাব এছাড়াও একটি প্ল্যান্ট করেন যা থেকে নরড়বঃযধহড়ষ (নরড়ফরবংবষ). ‘ঈধসবষরহধ ংধঃরাধ’ তৈরি হয় যা পরিবেশের জন্য খুব উপকারী। শ্রীলঙ্কা নুসালি ডি সিলভা-নুসালি তার দেশের গৃহযুদ্ধে আক্রান্ত জনপদের বাসিন্দাদের মাঝে শান্তি ও সমন্বয়সাধন জন্য একটি প্রকল্পে কাজ করছেন। তিনি তরুণদের মাঝে সংলাপের মাধ্যমে জাতিগত সংঘর্ষ কিভাবে দূর করা যায় তার ওপরে কাজ করেছেন। তিনি বর্তমানে স্থাপত্য বিষয়ে পিএইচডি সম্পন্ন করেছেন, তার স্থাপত্য কর্ম যুদ্ধোত্তর এলাকা পুনর্গঠন প্রক্রিয়া একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।
×