ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

মারুফ রায়হান

ঢাকার দিনরাত

প্রকাশিত: ০৩:৪৭, ১২ জুলাই ২০১৬

ঢাকার দিনরাত

আজকের লেখার শুরুতেই দু’জনের ঈদ-পরবর্তী অনুভূতি তুলে ধরছি। এ অনুভূতি তারা প্রকাশ করেছেন তাদের ফেসবুক ওয়ালে। প্রথমটি একজন তরুণীর, দ্বিতীয়টি দুই যুবকপুত্রের জননীর। এ থেকে ঢাকাবাসীর সাম্প্রতিক মনের অবস্থাটি আঁচ করতে অসুবিধে হয় না। ক. সারা রাত ধরে দুঃস্বপ্ন দেখেছি। গোলাগুলি, মারামারি, জিম্মি দশা। তন্দ্রামতন একটা দশায় রাতভর দুঃস্বপ্ন, দুঃস্বপ্নের ভেতরে ভাইয়ের মুখের আদল, ভয়ে নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসা, মাথার ভেতরে কেমন দুলুনি, ঝিমুনি, জ্বলুনি। এই নিয়ে রাত তিনটায় তন্দ্রা ছুটে যায়। তারপর থেকে- থেকে আসে আর যায়। বুকের মধ্যে কেমন ভার, ভয়, শঙ্কা, কান্না, আর্তনাদ জমে থাকে। ঘরে একটা টিকটিকি নড়লে কাল রাতে ডর লেগেছে। পাশের রাস্তায় গার্ডের বাঁশিতে একটা ফু শুনলে ডর লেগেছে। গলির মুখে একদল ছেলের হাসি শুনে ভয় লেগেছে। ভয় তো অবিশ্বাস, অনাস্থা, আশঙ্কার ফল। এত অবিশ্বাস আর ভয় নিয়ে প্রাণ তো তিষ্ঠানো যায় না। বিনাদোষে এমন নিরাশ্রয় এই দেশে কতজনকে তুমি করেছো, প্রভু! খ. দীর্ঘ নয় দিনের ঈদ ছুটি শেষে অফিস আদালত খুলেছে। ঢাকায় বসবাসরত উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষ নানা কষ্ট স্বীকার করেও প্রিয়জনদের কাছে ছুটে গেছেন ঈদ আনন্দ ভাগাভাগি করতে! এঁদের অনেকেই এখনও ফিরেননি! তা বোঝা যায় রাস্তা ঘাটের চেহারা দেখলেই। সব জায়গায় ছড়ানো ঈদের আমেজ বা ঈদের সুবাস! এই ফাঁকা রাস্তা টানছে বার বার দূরে কোথাও ঘুরে আসতে! অজানা আর জানা ভয় কিছুতেই পারছে না টেনে রাখতে! এর নামই বুঝি জীবন! এর নামই বুঝি মানুষ! না হারার ব্রত নিয়েই যারা ভূমিষ্ঠ হয়! ব্যর্থতাকে পুড়িয়ে যারা আলো তৈরি করে! সত্যের পথ দেখে, গড়ে তোলে সভ্যতা। চানরাতের রঙ সত্যিকারার্থে চানরাতই হলো ঢাকার কর্মজীবীদের শেষ কর্মদিবস বা কর্মরজনী। তবে ঈদের দিনও কাজে যান এমন মানুষের সংখ্যাও কি কম? ঈদ মানেই সবার ছুটি নয়। যেমন সাংবাদিকতার পেশায় জড়িত মানুষ, বর্জ্য ব্যবস্থাপনার সঙ্গে সংশ্লিষ্টজন, হাসপাতালের চিকিৎসক, কর্মচারী- এদের ছুটি নেই। কারও কারও রয়েছে অতিরিক্ত কাজ। কোথাও বেরুবো না, ঘরে থাকব। এমন পণ করলেও দুয়েকটা জায়গায় না গেলে চলে না। ঘর থেকে বেরুতেই দেখি রিকশাঅলা কাজে নেমে পড়েছেন। রিকশাঅলারা কাজে না বেরুলে আমাদের কি হাঁটতে হতো না? ট্যাক্সি ক্যাব নিয়ে চালকরা না বেরুলে গন্তব্যস্থানে যেতামই বা কী উপায়ে? আমি ঈদ করছি, আর আমার ঈদ উদযাপনের সুবিধার্থে কেউ ভূমিকা রাখছেন। যদিও সেটা তার বা তাদের পেশাগত দায়িত্ব পালন। আবার আমার অনেক বন্ধু, স্বজন ও সহকর্মীর মতো তিন দিন (ত্রিশ রোজার কল্যাণে এবার ছুটি চারদিন) নিরবচ্ছিন্ন ছুটি উপভোগ করা আমার পক্ষে কি সম্ভব হচ্ছে? যা হোক, চান রাতের কথায় আসি। মধ্যরাত পর্যন্ত মার্কেটগুলো প্রাণবন্ত ও উৎসবমুখর থাকে। সেই সাত সকালে সেলুন, বিউটি পার্লারগুলো খুলেছে, জানি বন্ধ হতে হতে মাঝরাত পেরিয়ে যাবে। রমজানে একটি মাস রাতে যারা তারাবি নামাজ পড়েছেন চানরাতে তাদের তো আর তারাবি নেই। বাড়তি সময়টুকু তাদের জন্য সুযোগ করে দেয় ঈদ নিয়ে পরিকল্পনার। চানরাত থেকেই মোবাইলে ঈদের শুভেচ্ছাবার্তা পাঠানো শুরু হয়ে যায়। আর একটি কাজও হয়। সেটি হলো মেয়েদের হাতে মেহেদি লাগানো। ঢাকায় মেহেদি পাতা বেটে কেউ কি আর মেহেদি লাগায়? এখন কত বাহারি নামে মেহেদির টিউব কিনতে পাওয়া যায়। চানরাতে মা বসে বসে মেয়েকে মেহেদি লাগিয়ে দেন। নিজের হাতেও লাগান শখ হলে। আমাদের বোন আর খালাদের দেখেছি তারা মেহেদি দিতেন সাতাশে রোজায়। নামাজ আর মেহেদি। তালগোল পাকিয়ে যেত কারও কারও। এখন সাতাশে রোজায় অল্পজনই মেহেদি লাগায় বলে ধারণা করি। চানরাতেই দেয়। একদিক দিয়ে এটাই ভাল। আগে শব-ই-কদরের রাতে দেয়ায় মেহেদি ঈদের দিনে অনেকটাই ঝাপসা দেখাত। চানরাতে দেয়ায় দারুণ উজ্জ্বল থাকে মেহেদির রং! আর কত বিচিত্র নকশা! পরিবারের কেউ যদি নজরকাড়া নকশায় মেহেদি দেয়ায় পারদর্শী হয়ে থাকে তাহলে সবাই তার কাছেই আবদার জানায়। এসবই ঈদের আনন্দকে আরেকটু রাঙিয়ে দেয়ার বাসনায়। ফাঁকা ঢাকার ভালমন্দ ঈদের দিন ঢাকা আরও ফাঁকা লেগেছে। লালমাটিয়া থেকে আমার এক স্বজন ফোনে জানালেন, সেখানে মসজিদ থেকেই ঘোষণা দেয়া হয়েছিল ঈদের জামাতে যেন জায়নামাজ ছাড়া অন্য কিছু বহন না করা হয়। কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়ার ঈদের নামাজ পড়ার স্থান থেকে অনেকটা দূরেই নামাজের আগেই শুরু হয়েছিল জঙ্গি আক্রমণ যা টের পাননি ওখানকার লাখো মুসল্লি। তবে সারাদেশে খবরটি পরে ছড়িয় পড়লে তার কিছুটা প্রভাব পড়ে মানুষের মনে। অস্বীকারের উপায় নেই মন বিষাদগ্রস্ত ও কিছুটা ভীত থাকায় এবং ঈদের আনন্দ কিছুটা ম্লান হয়ে পড়ায় বহু ঢাকাবাসীই আর ঘরের বার হননি সারা দিন। অবশ্য সারা দিন ঘরে বসে থেকে বিরক্তির একশেষ হয়ে আবার গা ঝাড়া দিয়ে বহু লোকই সন্ধেবেলা বেরিয়ে পড়েন। ঢাকার প্রধান প্রধান সড়কের সিগন্যাল পয়েন্টে সে সময়ে রীতিমতো জ্যাম লেগে যায়। ঈদের দিন অন্য সব দোকানপাট বন্ধ থাকলেও মিষ্টির দোকানগুলো ঈদের নামাজ শেষেই খুলেছিল। তবে ঈদের দুই দিন পরেও সিঙ্গাড়া সামুচার মতো নাস্তার ঝাল আইটেম মেলেনি হোটেল রেস্তোরাঁয়। কারিগররা যে সব ঈদের ছুটিতে গেছে! ধারণক্ষমতার তুলনায় দশ-পনেরো গুণ বেশি মানুষ বাস করলে একটি নগরী কি আর পুরোপুরি ফাঁকা হয়? ঈদে তবু অনেকটাই ফাঁকা লাগে রাস্তায় বেরুলে। এর বড় একটি কারণ যানবাহন উল্লেখযোগ্য সংখ্যক হারে কমে যায়। গণপরিবহনের সংখ্যা শোচনীয়ভাবে কমে যায়। বহু বাস-মিনি বাস ঢাকার বাইরে ভাড়ায় চলে যায়। প্রশ্ন হচ্ছে মহানগরীর একটি বিশেষ রুটের বাসের কি অনুমতি আছে দূরপাল্লায় যাওয়ার? উত্তরা থেকে মতিঝিলগামী একমাত্র এসি বাস সার্ভিস হলো বিআরটিসির। নামে সরকারী পরিবহন হলেও এটি বহুকাল প্রাইভেটে লিজে চলছে। প্রাইভেট হলেও তার একটা নিয়মনীতি থাকবে। এবার ঈদের সরকারী ছুটি ছিল নয় দিন। এই নয় দিন উত্তরা-মতিঝিল রুটে বিআরটিসির এসি বাস চলেনি। এমনকি রবিবার অফিস আদালত খোলার দিনও খাঁ খাঁ করছিল বাস স্টপেজ। কাউন্টার ঈদের অনেক আগে থেকেই বন্ধ। কাজটি কি সঠিক হয়েছে? এসব দেখার লোক কোথায় গেল? ঈদে দুস্থ রোগীদের শয্যাপাশে এই কলামের নিয়মিত পাঠকদের হয়ত বিষয়টা স্মরণে থাকতে পারে- গত কোরবানির ঈদে আমার ঘনিষ্ঠ এক বন্ধুর পঙ্গু হাসপাতালের রোগীদের সঙ্গে সারাদিন কাটানোর কথা। বহু বছর আগে সড়ক দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত হয়ে কিছুকাল তাকে থাকতে হয়েছিল পঙ্গু হাসপাতালে। সুস্থ হয়ে ওঠার পর ভেবেছেন কোন এক ঈদের দিন তিনি পঙ্গু হাসপাতালের সেই ওয়ার্ডটির রোগীদের সঙ্গে কাটাবেন, যে ওয়ার্ডে তিনি চিকিৎসাধীন ছিলেন। গত কোরবানি ঈদের নামাজ পড়ে, কোরবানির পশু জবাইয়ের পর স্ত্রীকে তা দেখভালের দায়িত্ব দিয়ে সোজা চলে যান পঙ্গু হাসপাতালে। সঙ্গে নিয়ে যান ৫০টি ছোট প্যাকেট, যাতে ছিল কয়েক রকম মিষ্টি। আর নগদ কিছু টাকা। এবারও একই কাজ করেছেন তিনি ঈদ-উল-ফিতরের দিন। ভেবেছিলাম বন্ধুটির ভেতর আত্মতৃপ্তি কাজ করবে, ভাল কিছু করেছেন বলে মন থাকবে তার প্রফুল্ল। সন্ধেবেলা অভিজ্ঞতা বর্ণনার সময় এবারও দেখলাম তার মন খারাপ, মুখটা মলিন হয়ে আছে। গত ঈদেও একই ধরনের প্রতিক্রিয়া তিনি জানিয়েছিলেন। বললেন, ‘বিচিত্র ধরনের দুর্ঘটনায় আহত ও পঙ্গু মানুষের এত কষ্ট। আর অনেকেই এত গরিব এবং অসহায়। একজনের সামান্য অর্থে ক’জনেরই বা যৎসামান্য উপকার হতে পারে? ঈদের দিন কাটে তাদের আনন্দে নয়, সংগোপন কান্নায়।’ আমি কী সান্ত¡না দেব, বুঝে পাই না। বন্ধুটিকে অনুরোধ করা আরেকটু খুলে বলতে। তিনি যা বললেন তার সারমর্ম এমন : অবস্থাসম্পন্ন রোগীরা যান প্রাইভেট ক্লিনিকে, আর গরিবদের ভরসা ওই পঙ্গু হাসপাতাল। শওকত, আবদুল বারী- দুই রোগীর সঙ্গেই বেশিক্ষণ কথা বলেছেন তিনি। সন্ধে পর্যন্ত মোহাম্মদপুরের শওকতকে দেখতে কোন স্বজন আসেননি। অকৃতদার লোকটি রিক্সা থেকে পড়ে পা ভেঙেছেন। ঈদের পরেই অপারেশন হবে। পায়ের মধ্যে প্রবিষ্ট ‘রড’ নিয়ে কারো সাহায্য বিনাই তিনি ক্রাচে ভর করে টয়লেটে যান। নার্স এসে তাকে বেডে না পেয়ে বেশ ঘাবড়ে যান। পাশের বেডের রোগী শওকতের একা একা টয়লেটে যাওয়ার কথা বললে নার্সের চোখ কপালে ওঠে। এক মাস হলো পাবনার রংমিস্ত্রি আবদুল বারী রং করার সময় বিদ্যুতস্পৃষ্ট হয়ে দোতলা থেকে নিচে পড়ে গিয়ে ঘাড়ে ও মেরুদ-ে বড় আঘাত পান। কোমর থেকে নিচের অংশ অবশ হয়ে গেছে তার, একটি হাতও প্রায় অচল। ঘাড় ঘোরাতে পারেন না। ছাদের দিকে তাকিয়ে থাকতে হয় বেশিরভাগ সময়। অথচ মা আর বউকে নিয়ে সারাক্ষণই তার আড্ডা চলছে। আশপাশের বেডের রোগীদের লোকজনও এসে ওই আড্ডায় শামিল হন। গোবিন্দগঞ্জের জয়নুলের অবস্থা আবদুল বারীর মতোই। একটা বেসামাল ট্রাক এসে ধাক্কা দিয়েছিল কংক্রিটের তৈরি বৈদ্যুতিক খুঁটিতে। সেই খুঁটি ভেঙে আঘাত হানে তার নিতম্বে। তারও দুই পায়ে সাড়া নেই। পেছনে অপারেশনের পরে প্লাস্টিক সার্জারি করা লেগেছে। ঈদ অবকাশে বিনোদন বহু প্রতীক্ষিত ঈদের দিন পার করেই পরের দিনটা পুরোপুরি সদ্ব্যবহার করার ইচ্ছা থেকে চিড়িয়াখানা, শিশুপার্ক থেকে শুরু করে বিভিন্ন পার্ক, দর্শনীয় স্থান ও বিনোদনকেন্দ্রে ভিড় করার একটা প্রবণতা লক্ষ্য করা যায় বরাবরই। সব মিলিয়ে ঈদে অবধারিতভাবে পাওয়া ছুটির দিনগুলো ঢাকার দিন ও রাত কী ব্যস্ততার ভেতর দিয়েই না চলে যায়। এখানেও দু’রকমের অনুভূতি কাজ করে। একদল আছেন যাদের কাছে তিনটে বা চারটে দিন যেন মোটে একটা দিনের সময় দৈর্ঘ্য নিয়ে উপস্থিত হয়। ঈদের ছুটি শেষে মনে হয়- ইস এত তাড়াতাড়ি ফুরিয়ে গেল! আরেক দলের ছুটি যেন ফুরোতেই চায় না। দিনগুলো তাদের কাছে অলস সুদীর্ঘ এক বিরক্তি। আসলে ঈদের আনন্দ আর চাঞ্চল্য সব যেন অল্পবয়সীদেরই, বড়রা স্রেফ নিয়ম রক্ষা করে চলেন। তবু তাদের প্রাণেও যে ঈদ এসে বাঁশি বাজায় না- এ কথাও আমরা জোরের সঙ্গে বলতে পারি না। ঈদ অবকাশে ঢাকায় পার্কে বা খোলা প্রাঙ্গণে নতুন নতুন বিনোদনকেন্দ্র চালুর কথা ভাবতে হবে কর্তৃপক্ষকে। হাতে গোনা কয়েকটি বিনোদনকেন্দ্রে উপচেপড়া ভিড় থাকলে সেই বিনোদন সবার জন্যই হয়ে ওঠে বিড়ম্বনা। ঢাকায় খেলার মাঠ কমে আসলেও কয়েকটি মাঠ রয়েছে যেখানে পালাপার্বণে বিভিন্ন মেলা বা প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়। ঈদ উপলক্ষে সেসব স্থানে ঈদ মেলা করা যেতে পারে। তাতে শিশু-কিশোরদের জন্য আনন্দময় কিছু ক্রীড়ার ব্যবস্থা অবশ্যই থাকা চাই। প্রিয় মেয়র, আপনাকেই বলছি আমরা এই কলামে ঢাকার দুই মেয়রের দৃষ্টি আকর্ষণ করে তাৎক্ষণিকভাবে সমস্যার সমাধান ও অনিয়মের সুরাহা চাইছি। এটা নিছক অনুরোধ নয়, সমাজেরই দাবি। আজ আমরা তুলে ধরব ঢাকার অন্যতম একটি ব্যস্ত সড়কের কথা। নতুন বাজার থেকে গুলশান লিংক রোডের দিকে শাহজাদপুর পর্যন্ত ড্রেন থেকে তোলা ময়লা একমাস পেরিয়ে গেলেও সরেনি। একজন এলাকাবাসী তার প্রতিক্রিয়া জানালেন এভাবে : ‘আসুন ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের মেয়রকে ও তাঁর টিমকে ধন্য ধন্য করি।’ ১০ জুলাই ২০১৬ [email protected]
×