ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

জাফর ওয়াজেদ

ম্লান হয়ে আসে গৌরব যখন

প্রকাশিত: ০৩:৪৫, ১২ জুলাই ২০১৬

ম্লান হয়ে আসে গৌরব যখন

(গতকালের সম্পাদকীয় পাতার পর) কেবল পাঠদান আর পাঠ গ্রহণেই সীমাবদ্ধ নয়। চিন্তা-চেতনা, মেধা-মননের বিকাশ কেন্দ্রেও বিশ্বমানবের সঙ্গে নিজেকে সম্পৃক্ত করার চর্চা এই বিশ্ববিদ্যালয়ই প্রদান করে আসছে। বিশ্ববিদ্যালয় ধর্মান্ধতা, কুসংস্কার, মতলবীদের কুমতলবী সৃষ্টির স্থান নয়, মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে তার অবস্থান। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তার মূল অবস্থান থেকে সরে এসেছে ক্রমশ। বিশ্বে কোন ধর্মাবলম্বী হওয়া অতি সহজ। কিন্তু মানুষ হওয়া বড় কঠিন- বিশ্ববিদ্যালয় এই শিক্ষাটা দিয়ে আসে যে, মানুষ হতে হবে। কিন্তু আজকের দিনে বিশ্ববিদ্যালয় ঠিক উল্টো পথে যেন। মানুষ হওয়া নয়- বিশেষ ধর্মাবলম্বী হওয়াটাই তাদের মূল উদ্দেশ্য। ধর্মের অপব্যাখ্যা দিয়ে বিশবিদ্যালয়ের ছাত্রের ব্রেন ওয়াশ করে হত্যাকারী-খুনীতে পরিণত করার মতো ‘ব্ল্যাক ম্যাজিক’ যারা শেখান তাদেরও নিশ্চয়ই বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রী রয়েছে। খুনের মধ্যে পাপমোচন ও স্বর্গপ্রাপ্তি বিরাজ করছে বলে এই যে উচ্চ শিক্ষিতদের খুনী বানিয়ে আত্মঘাতী পথে ঠেলে দেয়া হচ্ছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা তাদের মানুষে উন্নীত করেনি, বরং নৃশংস খুনীতে পরিণত করেছে এবং তাদেরও খুন হতে হচ্ছে। জীবনের এই অপচয়, মানবের এই পরাজয় দেখে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর যে টনক নড়ছে না তা সমাজ টের পায়। আর পায় বলেই সমাজ দেখে, শিক্ষার কদাকার দিক। যেখানে মানবিকবোধ লুপ্ত, মানুষের মধ্যকার আত্মীয়তাবোধ নিঃস্ব, সভ্যতার দরজাগুলো বিনষ্ট, মমতাবোধ, উধাও এমন তারুণ্যের উদ্ভব বিপজ্জনক বৈকি। যে সময়ে তাদের দেশ জাতি সমাজকে সৃষ্টিশীলতা, কর্মকুশলতা, কর্তব্যনিষ্ঠা, দায়িত্ববোধে আকৃষ্ট করার কথা সে সময় তারা খুনী বনে যাচ্ছে এবং তা সীমাহীন এক কল্পিত স্বর্গের মোহে ভ্রান্ত জিহাদের টানে তারুণ্যকে বিভ্রান্তির চোরাবালিতে ঠেলে দেয়ার পেছনে শিক্ষার কুফলই প্রণোদনা দিচ্ছে। সমাজবিজ্ঞানী, মনস্তাত্ত্বিকরা বিশ্লেষণ করলে হয়ত স্পষ্ট হবে শিক্ষার্থীকে বিপদগামী করার নেপথ্যে শিক্ষা কোন ভূমিকা রাখছে কিনা। বিশ্ববিদ্যালয় নিশ্চয়ই দস্যুবৃত্তির শিক্ষাদান কেন্দ্র নয়, দৈত্য-দানব তৈরির কারখানাও নয়, বর্বর মধ্যযুগীয় ধ্যান-ধারণার প্রসার ঘটানোও তার কাজ বা লক্ষ্য নয়। বরং এসবের বিপরীতে সত্যসন্ধ জ্ঞানদান করাই তার মুখ্য কর্তব্য। চরিত্র এবং বুদ্ধিবৃত্তি উভয়েরই উৎকর্ষ সাধনের জন্য শিক্ষা বিস্তার। শিক্ষার ফলে শিক্ষার্থীরা আত্মনির্ভরশীল এবং মিতব্যয়ী সংযমী হতে পারে। খুনী হবার মন্ত্র শিক্ষার্থীর মধ্যে প্রবেশ যেভাবেই ঘটে থাকুক তাতে নিমগ্ন হবার প্রয়াস একজন উচ্চশিক্ষিত এবং উচ্চবিত্ত জীবনের অধিকারীর পক্ষে কীভাবে সম্ভব হয়েছে, তার কার্যকারণ উদ্ধার হলে পরিষ্কার হওয়া যাবে। কিন্তু উচ্চশিক্ষার কোন প্রতিফলন যদি না ঘটে তার মধ্যে তার বিপদটা চারদিক থেকেই আসে। এমনটা মনে হতে পারে, বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে যে শিক্ষাদান হচ্ছে তার কতগুলো গুণ রয়েছে বৈকি। আবার কতগুলোর বিশেষ দোষও রয়েছে। আর এই দোষগুলো এত বেশি যে, গুণ-ভাগ নগণ্য হয়ে যায়। এই শিক্ষায় মানুষ তৈরি হয় না। বরং একালে খুনী জঙ্গীতে পরিণত করে কারও কারও ক্ষেত্রে। এরূপ শিক্ষায় বা অন্য যে কোন নেতিবাচক শিক্ষায় সব ভেঙ্গেচুরে যায়, যা মৃত্যু অপেক্ষা ভয়ানক। একালের শিক্ষায় কেন যেন মৌলিক চিন্তাযুক্ত মানুষও তৈরি হচ্ছে না। মাথায় কতগুলো তথ্য-উপাত্ত প্রবিষ্ট করা হয়, সারাজীবন যা হজম হয় না। অসমৃদ্ধভাবে মাথা ঘুরতে থাকলে তাকে শিক্ষা বলে না। যা কিছু নেতিমূলক, সেই শিক্ষা থেকে মুক্তচিন্তার মানুষ বের হয় না। হয় অন্ধত্বজাত জন। সুবুদ্ধির কাজ দুর্বুদ্ধিতে নষ্ট যাতে না হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা সেই পথই দেখায়। কিন্তু একালে তার বিপরীত পথই নির্দেশিত হয়। শিক্ষার মানোন্নয়ন তথা জাতীয় উন্নয়নের অবদানে নিশ্চিতরূপে শিক্ষকই হলেন সবিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। তার ব্যক্তিগত গুণাবলী ও চরিত্র, তার শিক্ষাগত যোগ্যতা এবং পেশাগত পদমর্যাদা বাড়াবার জন্য সুকঠোর, সুদৃঢ় এবং নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়ে যাওয়া ক্রমশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। কিন্তু একালে অনেক শিক্ষকের মধ্যে অসদাচরণ ও চরিত্রহীনতার যে বহির্প্রকাশ ঘটেছে, তা কহতব্য নয়। কালের যাত্রার ধ্বনি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো মনে হয় আর শুনতে পায় না। যে বন্ধ্যা অবস্থা বিদ্যমান হয়ে পড়ছে, তা থেকে উত্তরণ ঘটানোর কোন পদক্ষেপ পরিলক্ষিত হয় না। স্তব্ধতার ভেতর থেকে মুক্তচিন্তা আর আলোড়িত হয় না। সাম্প্রতিক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিস্থিতি বেশ করুণই বলা যায়। প্রতিবছরই বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা বিশ্বের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর র‌্যাঙ্কিং প্রকাশ করে থাকে। সেই তালিকায় কবেকার প্রাচ্যের অক্সফোর্ডখ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নামগন্ধই মেলে না, বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালগুলোর নাম দূরে থাক। দেখা যায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যাবতীয় অর্জন হিসেবে যে সব সাফল্যের কথা উল্লেখ করা হয়, তার মধ্যে কোন বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার কিংবা সামাজিক কোন তত্ত্বের প্রবর্তন থাকে না। থাকে রাজনৈতিক সংগ্রামের বিজয়োপাখ্যান। স্মর্তব্য, ২৩ জুন অনুষ্ঠিত বার্ষিক সিনেট অধিবেশনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের ভাষণ। বলেছেন তিনি দেশের শিক্ষিত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর বিকাশ সাধন, আমাদের ভাষা আন্দোলন, বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলন, ছয় দফা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, মহান মুক্তিযুদ্ধসহ সকল সংগ্রাম ও সঙ্কটে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গৌরবদীপ্ত ভূমিকা পালন করে এসেছে। বলেছেন দেশের সমাজ ব্যবস্থা ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের লক্ষ্যে শিক্ষাখাতকে আরও গতিশীল ও সমৃদ্ধ করতে হবে। বর্তমান শতকের প্রয়োজনকে প্রাধান্য দিয়েই আমাদের শিক্ষা পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিতে হবে। এই ভাষ্যে স্পষ্ট হয় যে, অতীতের সংগ্রামী গৌরব ছাড়া অন্য গৌরব আর উপস্থাপিত হবার মতো নয়। একুশ শতকের দেড় দশক পার হয়ে গেছে, অথচ পরিকল্পনা প্রণয়নের কাজই হয়নি। সময়ের প্রয়োজনকে গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে বলা হলেও বাস্তবে তার কোন তৎপরতা নেই। অতীতে দেখা গেছে, এক একটি রাজনৈতিক আন্দোলন শেষ করে বিশ্ববিদ্যালয় যখন শিক্ষায় মনোযোগী হতে চাইছে তখন তার ঘাড়েও চাপিয়ে দেয়া হয়েছে এক একটি দলীয় প্রশাসনের বোঝা। পঁচাত্তর পরবর্তীকাল থেকে এই দফারফা শুরু হয়। যার রেশ এখনও টানতে হচ্ছে। তবে এখন আর স্রেফ ক্ষমতাসীন দলের লোকে ভারি হয় না। যে কারণে জামায়াত-বিএনপিসহ অন্য দলের লোকেরাও প্রশাসনজুড়ে বহালতবিয়তে। পাকিস্তানী ও জঙ্গী সন্ত্রাসবাদের মানসিকতার ব্যক্তিদের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাধারীরা একত্রে সহাবস্থান করছে। এই সংমিশ্রণ স্বাভাবিক বিকাশকে বিঘœ করছে। অথচ জ্ঞানের রাজ্যের জন্য প্রয়োজন এমন প্রশাসন দেখা যায় না। বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্বিক মানোন্নয়নে এইরূপ প্রশাসনের কোন পরিকল্পনা, ইচ্ছা ও উদ্যোগ দৃশ্যমান নেই। শিক্ষক রাজনীতির আড়ালে দলীয় রাজনীতির চর্চা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সুবিধাবাদের আসর বসিয়েছে। অপরদিকে শিক্ষকদের মধ্যেও বঞ্চনাবোধ দানা বাঁধে এবং গবেষণা হতে শিক্ষকের মনোযোগ যাচ্ছে মরে। অনেক সম্ভাবনা থাকলেও দেশের সার্বিক অগ্রগতিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যতটুকু অবদান রাখবার কথা ছিল, ততটুকু এখন আর রাখতে পারছে না। ধারণা অনেকের, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে বিপুল ভর্তুকি প্রদান করা অর্থই হচ্ছে রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা হওয়া রাজস্বের অপচয়। অথচ রাষ্ট্রযন্ত্র পরিচালনার জন্য সরকারের প্রয়োজন একটি দক্ষ মানবসম্পদ। আবার গবেষণা ছাড়া নতুন বৈজ্ঞানিক অগ্রগতি যেমন সাধিত হয় না, তেমনি নতুন অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক বাস্তবতায় দেশ কীভাবে চলবে, তার দিকনির্দেশনাও বিশ্ববিদ্যালয়ই সরকারকে দেবার কথা। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই সক্ষমতা এমনি এমনি অর্জিত হয় না। যদিও বিশ্ববিদ্যালয়ই হচ্ছে জাতীয় আভ্যন্তরিক জীবনের পবিত্র আশ্রয়স্থান। বুদ্ধিবৃত্তিক অভিযানের উৎস। বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তব্য জ্ঞান সৃষ্টি এবং মানসিক প্রশিক্ষণ দান করা, যাতে করে বস্তুগত সম্পদ ও মানবীয় শক্তির সমন্বয় সাধন করা যায়। জীবনযাত্রার মান উন্নত করতে হলে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষা পদ্ধতির আমূল পরিবর্তন অপরিহার্য হয়ে পড়ে। ১৯৪২ সালে ব্রিটিশ শাসক লর্ড উইলিয়াম বেভেরিজ উল্লেখ করেছিলেন, ‘অভাব, অজ্ঞতা, রোগ, অলসতা ও অপরিচ্ছন্নতা’Ñ মানুষের এই পাঁচটি বৃহৎ শত্রুর হাত থেকে যত অল্প সময়ে সম্ভব দেশকে মুক্ত করার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে সচেষ্ট হতে হবে। এরই আলোকে দেখা গেছে তৃতীয় বিশ্বের রাজনীতি ও সংস্কৃতিতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহ, বিশেষত উচ্চশিক্ষার পাদপীঠ বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। শিক্ষানীতি, রাষ্ট্র উন্নয়ন, সমাজ সংস্কার প্রভৃতি ক্ষেত্রে তৃতীয় বিশ্বের অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়কে সোচ্চার হতে দেখা গেছে যুগে যুগে, কালে কালে। এদিক থেকে সেকালে ‘প্রাচ্যের অক্সফোর্ড’ বলে খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বর্তমান বাংলাদেশ, সাবেক পূর্ব পাকিস্তান এবং তারও আগে অবিভক্ত ভারতের পূর্ব-উত্তর বঙ্গের সেরা বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে চিহ্নিত হয়েছিল। জ্ঞানের বিভিন্ন দিকে এখানে যে উৎকর্ষ সাধিত হয়েছে, এক কথায় বলা যায় যে, তা অত্যন্ত ব্যাপক এবং গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়ে ছিল। এসবের পাশাপাশি এখানে হয়েছে রাজনীতির প্রচার ও প্রসার, বিস্তৃত হয়েছে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন। পরিণতিতে ব্রিটিশ রাজত্বের অবসান। ভারত-পাকিস্তান বিভক্তির মাধ্যমে স্বাধীনতা প্রাপ্তি, পরবর্তী পর্যায়ে ভাষা আন্দোলনে মাতৃভাষার জন্য ছাত্রদের প্রাণদান। সমাজ সংস্কার ও রাষ্ট্র পরিচালনায় প্রতিনিধিত্বহীনতার প্রতিবাদে, শোষণ-বঞ্চনার ইতিহাস ভাঙার প্রত্যয়ে অগ্নিশপথ গ্রহণ পরিণতিতে স্বাধীন বাংলাদেশের সূচনা তথা অভ্যুদয়। এর প্রত্যেক ক্ষেত্রে সোনালি যুগ রচনা করেছে এই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও তার শিক্ষার্থীরা। স্বাধীন বাংলাদেশের নেতৃস্থানীয় এই বিদ্যাপীঠের আন্দোলন সংগ্রাম, সর্বোপরি অধ্যয়নের সঙ্গে সম্পৃক্ত রয়েছেন এমন এক মহান ব্যক্তিত্বের সংগ্রামী দিন, সংগ্রামী অধ্যায় কেটেছেÑ যিনি এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রাবস্থায় দিয়েছেন আন্দোলনের নেতৃত্ব । পরবর্তীকালে দিয়েছেন দেশের নেতৃত্ব এবং স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশকে উপস্থাপন করেছেন বিশ্বের দরবারে। তিনি বাঙালী জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। যিনি এই বিশ্ববিদ্যালয়ের গৌরব। দেশের ইতিহাসে সোনালি অধ্যায় সূচনাকারী। পঞ্চাশের দশকের ছাত্র শেখ মুজিবুর রহমান। তাঁর নেতৃত্বের প্রতাপে কেঁপে ওঠা পাকিস্তানী শাসকরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কারের মতো আস্পর্ধা প্রদর্শন করেছিলেন, যা তাঁকে সংগ্রামী প্রেরণায় আরও দৃঢ়তর করেছিল জাতির জাগরণের লক্ষ্যে। ঐক্যবদ্ধ করেছিলেন তিনি পুরো জাতিকে। বাঙালী জাতীয়তাবাদের পতাকাকে শক্ত হাতে ধরে তিনি ক্রমান্বয়ে হেঁটেছেন স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতায়। আলোকিত বাঙালী তৈরির স্বপ্ন দেখতেন বলেই তিনি স্বাধীন বাংলাদেশে প্রণয়ন করেছিলেন বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশ ১৯৭৩। শিক্ষকদের এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের মর্যাদা সমুন্নত রাখতে তিনি সার্বিক সহায়তা প্রদান করেছিলেন। বিশ্বাস করতেন, শিক্ষার উন্নয়ন ছাড়া পৃথিবীর কোন দেশই অর্থনৈতিক পর্যায়গুলো ক্রমশ অতিক্রম করতে পারে না। শিক্ষা কেবল ডিগ্রী ও সার্টিফিকেট লাভের ক্ষেত্র যাতে না হয় সেজন্য তিনি প্রাণপণ প্রচেষ্টা চালিয়েছেন। আলোকের ঝর্ণাধারায় স্ফুরিত হয়ে উঠুক উচ্চশিক্ষা, সেজন্য নানা ধরনের বৃত্তিরও প্রচলন করেছিলেন। শুধু শিক্ষক, শিক্ষার্থী নয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন শ্রেণীর কর্মচারীদের অধিকারের প্রতি ছিলেন অবিচল। ছাত্রজীবনে চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের অধিকার আদায়ের দাবিতে আন্দোলনের নেতৃত্ব দিতে গিয়ে বহিষ্কার হয়েছিলেন। মুচলেকা দিলে হয়ত বহিষ্কার হতেন না। কিন্তু আপোসহীন ছিলেন বলেই শাসকের ফাঁদে পা দেননি। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনে চ্যান্সেলর হিসেবে যোগদানের কর্মসূচী ছিল। কিন্তু ভোর রাতেই নির্মমভাবে হত্যা করা হয় বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে। তারপর পরিবর্তন হতে থাকে সবকিছু। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো জান্তা শাসকের ক্রীড়নকে পরিণত হবার অপচেষ্টা চলেছে; কিন্তু ছাত্র সমাজের প্রতিরোধের মুখে তা অনেক ক্ষেত্রেই সম্ভব হয়নি। চল্লিশ হাজার ছাত্র-ছাত্রী অধ্যুষিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা কাজ আর তেমন হয় না। সীমিত বাজেট গবেষণার অন্তরায় উল্লেখ করে কর্তৃপক্ষ যা বলে আসছেন, তা শাক দিয়ে মাছ ঢেকে রাখার মতোই। সত্যেন বসুর মতো বিজ্ঞানী আর উপহার দিতে পারছে না, কারণ গবেষণার গুরুত্ব হ্রাস পাওয়া। মুক্তবুদ্ধি চর্চার পথও কেমন যেন রুদ্ধ হয়ে আসছে। প্রগতিশীলতা ক্রমশ অন্ধকারে ধাবিত হচ্ছে, যা শঙ্কা জাগায়। নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গী সংগঠন হিযবুত তাহরীর প্রতিষ্ঠা এই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। কোমলমতি ছাত্রদের প্রলুব্ধ করে কতিপয় শিক্ষক এই সংগঠনটি গড়ে তোলে। ২০০১ সালে আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু করে। মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতাকে বিদ্রƒপ করা এবং কথিত ধর্মীয় চেতনার নামে বিকৃতির প্রসার ঘটানোর কাজটি তারা করে আসছিল। ২০০৯ সালের ২২ অক্টোবর হিযবুত তাহরীরকে সরকার নিষিদ্ধ করে। সংগঠনের প্রধান সমন্বয়ক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসা প্রশাসন ইনস্টিটিউটের (আইবিএ) সহযোগী অধ্যাপক মহিউদ্দিন আহমদ ছাত্রদের জঙ্গী মতবাদে উদ্বুদ্ধ করে আসছিল। জ্যেষ্ঠ উপদেষ্টা ছিল ব্যবস্থাপনা বিভাগের অধ্যাপক সৈয়দ গোলাম মাওলা। নিষিদ্ধ হবার পর এই দুই শিক্ষকসহ ৪শ’ জন র‌্যাব-পুলিশের হাতে গ্রেফতার হয়। বছর দু’য়েক আগে সংগঠনের হাজারখানেক সদস্যকে গ্রেফতার করেছিল। তারা জামিনে যথারীতি ছাড়া পেয়ে আবার জঙ্গীপনায় নেমে পড়ে। এই হিযবুত তাহরীর এখন বুয়েট, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়সহ প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছড়িয়ে পড়েছে। এর সদস্যরা অপেক্ষাকৃত ধনী পরিবারের সন্তান। এরা বর্তমান সরকারকে উৎখাত করতে চায়। এরা ধার্মিক না হলেও ধর্মের ভুল ব্যাখ্যা ধারণ করে মানুষ হত্যায় লিপ্ত হয়েছে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই শিক্ষকদের বিরুদ্ধে উল্লেখযোগ্য কোন পদক্ষেপ নেয়া হয়নি আজও। বছর দুয়েক আগে পুলিশ এই সংগঠনের হাজারখানেক সদস্যকে গ্রেফতার করে। তাদের অনেকেই জামিনে বেরিয়ে এসে আবার সংগঠিত হয়। একটি বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয় এদের ঘাঁটিতে পরিণত হয়েছে এখন। তাদের পাঠাগারে হিযবুত তাহরীরসহ জঙ্গীবাদ বিষয়ক বইপত্রের সন্ধানও মিলেছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পঁচানব্বই বছরে পা রেখেছে এবারের পহেলা জুলাই। দিনটিকে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ অনেক বছর ধরেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দিবস হিসেবে পালন করে আসছে। এ উপলক্ষে অনুষ্ঠানমালার আয়োজন করা হয়। স্মরণিকাও প্রকাশ করা হয়। এবারের উৎসবের প্রতিপাদ্য ছিল ‘সন্ত্রাস-জঙ্গীবাদ প্রতিরোধ ও মানবিক চেতনা বিকাশে উচ্চশিক্ষা।’ কিন্তু আয়োজন ছিল তার বিপরীতমুখী। প্রকাশিত স্মরণিকা স্পষ্ট করেছে সন্ত্রাস-জঙ্গীবাদ প্রতিরোধ নয়, বরং তাকে মর্যাদাদানেই উৎসাহ বেশি কর্তৃপক্ষের। স্বাধীনতাবিরোধী পরাজিত শক্তি তাদের শক্তিমত্তা অর্জন ও প্রদর্শনের ক্ষেত্রটি বহুদূর পর্যন্ত সম্প্রসারিত করেছে। দেশকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিতে অন্যতম নিয়ামক ঘাতক সন্ত্রাস ও জঙ্গীবাদের শেকড় উপড়ে দেয়া নয়, তার ডালপালা বিস্তৃত করার ক্ষেত্রে যেন কর্তৃপক্ষের নিরন্তর পথ চলা এখন। মানবিক চেতনাকে রুদ্ধ করে মৌলবাদ, সাম্প্রদায়িকতা, ধর্মান্ধতা, কূপম-ূকতা, কুসংস্কার ও সহিংসতাকে প্রাধান্য দেয়া হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে উঠছে জাতির আশা-আকাক্সক্ষা বিনষ্ট ও নির্মূলের ধারক-বাহক। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে লালন নয়, তাকে বিকৃত করে পরাজিত পাকিস্তানী ও তাদের দোসরদের ভাবাদর্শকে পুনর্প্রতিষ্ঠার কাজটি সূক্ষ্মভাবে চালানো হচ্ছে। আর তা যথাযথভাবে সম্পন্ন করার জন্য গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে পাকিস্তানী চেতনাধারী জামায়াত-বিএনপির পরীক্ষিত ও প্রশিক্ষিতদের বসানো হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে লেবাস বা খোলস বানিয়ে দেশপ্রেমহীনরা বেশ বহালতবিয়তে অপকর্ম সম্পন্ন করতে সক্রিয় রয়েছে। উপাচার্য গত ২৩ জুন সিনেটে প্রদত্ত ভাষণে বলেছেনও ‘সহনশীল জাতি বলে আমাদের অহঙ্কার ছিল। অন্যকে আপন, বন্ধু ও আত্মীয় বলে গ্রহণের ঐতিহ্য আমাদের প্রাচীন। কিন্তু এখন তা নিদারুণ পরীক্ষার সম্মুখীন হয়ে পড়েছে। অন্যের প্রতি আমরা হঠাৎই অসহিষ্ণু ও বিদ্বেষপ্রবণ হয়ে পড়ছি। অপরের অস্তিত্ব, তার ধর্মবোধ, ভিন্নমতকে আমরা শ্রদ্ধা করতে পারছি না। সেক্ষেত্রে প্রশ্রয় পাচ্ছে দানবিক জিঘাংসা।’ এই বক্তব্যে বর্তমানের চিত্র ফুটে ওঠে। তবে এর বিপরীতে বিশ্ববিদ্যালয় যে ভূমিকা পালন করছে তা বলা যাবে না। বরং বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকাশিত স্মরণিকাটি এই ভাষ্যের বিপরীতে অবস্থান নিয়ে দেশের স্বাধীনতা, ইতিহাস ও সংস্কৃতিকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। আগুন সন্ত্রাসী, বোমা সন্ত্রাসী, গুপ্তহত্যা ও জঙ্গীবাদের পৃষ্ঠপোষক রাজনৈতিক দলের বিকৃত ইতিহাসকে সত্যসন্ধ হিসেবে প্রকাশ করে প্রমাণ করেছে দেশনিন্দার মতো গর্হিত কাজ করে পার পাওয়া যায়। উপাচার্য নিজে যদি তার প্রদত্ত ভাষণের সারবত্তাকে উপলব্ধি করে থাকেন তবে তো দিব্যদৃষ্টি দিয়ে দেখতে পেতেন কী নিষ্ঠুরভাবে স্বাধীনতাবিরোধীদের ভাষ্যকে গুরুত্ব দিয়ে প্রচারের দায়িত্বটি নিয়েছে স্বয়ং তারই বিশ্ববিদ্যালয়। প্রতিষ্ঠার পঁচানব্বই বছর উপলক্ষে প্রকাশিত স্মরণিকায় ‘স্মৃতি অম্লান’ শিরোনামে প্রকাশিত লেখাটি ইতিহাস বিকৃতি শুধু নয়, দেশের স্বাধীনতাকেও প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পঁচানব্বই বছর উদ্যাপন কমিটির সদস্য সচিব ও টানা নয় বছর ধরে ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার (এই সময়ে স্থায়ী কোন রেজিস্ট্রার নিয়োগ দেয়া হয়নি) এবং এক সময়ের ছাত্রদল নেতা সৈয়দ রেজাউর রহমান এই রচনার লেখক। বঙ্গবন্ধুর প্রতি তার বিদ্বেষ যে কত নিম্নস্তরের তার প্রমাণও তিনি রেখেছেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলের পরিচিতি প্রদানে। লিখেছেন তিনি ‘শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক নেতা যিনি পূর্ব পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত্ব এবং বাংলাদেশের জাতির জনক হিসেবে বিবেচিত।’ মহামূর্খ না হলে ইতিহাসকে এভাবে বিকৃত করতে পারেন না। আবার লিখেছেন ‘জনসাধারণের কাছে তিনি শেখ মুজিব এবং শেখ সাহেব হিসেবে বেশ পরিচিত এবং তার উপাধি বঙ্গবন্ধু।’ বিকৃতি শুধু এখানেই নয়। আরও মিথ্যাচার করেছেন, যেখানে লিখেছেন, ‘১৯৬৮ খ্রিস্টাব্দে ভারত সরকারের সঙ্গে যোগসাজশ ও ষড়যন্ত্রের অভিযোগে তার বিচার শুরু হয়।’ আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা চলাকালে পাকিস্তানী জান্তারা এই অভিযোগ এনেছিল। কিন্তু ভারত সরকারের সঙ্গে যোগসাজশ বা ষড়যন্ত্রের ক্ষেত্রে প্রমাণ পায়নি। এই বাক্যটি জামায়াত নেতা গোলাম আযম ব্যবহার করেছেন। উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে এই বাক্যটি ব্যবহার করা হয়েছে যে, তা স্টষ্ট বোঝা যায়। আবার লিখেছেন, ‘১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে মার্চ ২৫ মধ্যরাতে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী ঢাকা শহরে গণহত্যা পরিচালনা করে। একই রাতে তাকে গ্রেফতার করে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হয়। আবার উল্লেখ করেছেন, ‘স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু।’ অন্যতম বলতে কী বোঝাতে চেয়েছেন তা সচেতন পাঠক অনায়াসে উপলব্ধি করতে পারেন। শেখ মুজিব যে স্বাধীনতা আন্দোলনের একমাত্র স্থপতিতে পরিণত হয়েছিলেন তা এই স্বাধীনতাবিরোধী চেতনাধারী ব্যক্তির পক্ষে উপলব্ধি করা সহজসাধ্য নয়। এসব ভাষ্যের বিস্তারিত ব্যাখ্যা প্রদান করা যায়; কিন্তু স্থানাভাবে বিরত থাকতে হচ্ছে। আবার মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমানকে তিনি লিখেছেন ‘বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি।’ এই ঘোষণা খালেদা ও তারেক গত ক’বছর ধরে দিয়ে আসছেন। এই বক্তব্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব প্রকাশনায় তুলে ধরে সেই মিথ্যাচারকে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। এটা টেস্ট কেসও হতে পারে। এতে কী ধরনের প্রতিক্রিয়া হয় সেটিও পরীক্ষা করে দেখছেন কর্তৃপক্ষ। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকাশনার ভেতরে ভেতরে জামায়াত-বিএনপি মিথ্যাচারকে প্রতিষ্ঠিত করতে কোথায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে, তার নমুনাও এটা। কারা কারা এ কাজ করেছে, ইতিহাস বিকৃত করেছে, কাদের স্বার্থ সংরক্ষণ করছে, পরিকল্পনায় কারা আছেন তা চিহ্নিত হওয়া জরুরী। যারা করেছেন তারা রাষ্ট্রীয় অপরাধ করেছেন। সেটি প্রমাণিত হয়েছে মাত্র। কিন্তু যাতে এসব আর এগোতে না পারে তার মূলোৎপাটন জরুরী এখন। কিন্তু কথা হচ্ছে, কে করবেন তা। কারণ শর্ষেতেই ভূতেরা উল্লম্ফন করছেন দীর্ঘসময় ধরে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে ক্রমশ মৌলবাদী ও স্বাধীনতাবিরোধীদের ঘাঁটিতে পরিণত করার যে পরিকল্পনা পাকিস্তানী গোয়েন্দা সংস্থা ও জামায়াতের রয়েছে, তা বাস্তবায়নকে ত্বরান্বিত করতে প্রশাসন প্রকাশিত স্মরণিকাটিকে কাজে লাগানো হয়েছে। প্রয়াত এ্যাথলেট সুলতানা কামাল যে ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর পরিবারের সঙ্গে নিহত হন তার কোন উল্লেখ করা হয়নি। অজস্র ভুল তথ্য বিভিন্নজন সম্পর্কে রয়েছে। পাঠে মনে হবে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে তা করা হয়েছে। এই লেখক স্মরণিকাটিতে লিখেছেন যে, তিনি ‘শতকের পথে গৌরবোজ্জ্বল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়’ নামক গ্রন্থ রচনা করেছেন, যা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকাশিত হয়েছে। গ্রন্থটি হাতে আসেনি। পেলে জানা যেত, তিনি আর কী কী মিথ্যাচার ও দেশবিরোধী বিষয়কে প্রাধান্য দিয়েছেন। সৈয়দ রেজাউর রহমানকে চিনি সেই পঁচাত্তর পরবর্তীকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯৭৬ সালে ভর্তি হওয়ার পর থেকে। ১৯৮০ সালে ডাকসুর সাহিত্য সম্পাদক ও সিনেট ছাত্র প্রতিনিধি থাকাকালে দেখেছি তারসহ অন্যদের ভূমিকা। তখন সামরিক জান্তার শাসন চলছে। আর এই সৈয়দের দাপট তখন তীব্রতর। তিনি জিয়া সরকারের আশীর্বাদপুষ্ট হয়ে টিএসসির উপ-পরিচালক বনে যান। বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় থাকাকালে উপাচর্য অধ্যাপক এস এম এ ফায়েজ এই সৈয়দকে টিএসসি থেকে এনে ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার পদে নিয়োগ দেন। ২০০৮ সালে বর্তমান উপাচার্য দায়িত্ব গ্রহণের পরও তিনি বহালতবিয়তে আছেন। এরই মধ্যে তার জামায়াতপ্রীতির কথা সর্বজনবিদিত। স্মরণিকায় উল্লেখ করা হয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয় দিবসের ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টের দায়িত্বে রয়েছেন মীর আহমেদ মীরু, পপুলার এ্যাডভার্টাইজিং। কে এই মীরু? খোঁজ-খবর নিয়ে প্রাথমিকভাবে জানা গেছে, তিনি জামায়াতের একজন নেতা। তার সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ দিতে পারেনি। তার এই নামে একজন আলোকচিত্রী সাংবাদিক রয়েছেন। জামায়াতপন্থী হিসেবে তিনি পরিচিত। ‘সত্যের জয় অবশ্যম্ভাবী’ মূলমন্ত্র নিয়ে প্রতিষ্ঠিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এখন মিথ্যার জয় অবশ্যম্ভাবী প্রতিষ্ঠিত করতে বদ্ধপরিকর যেন। তাই মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতকারী ও স্বাধীনতার প্রতি বিদ্বেষী সৈয়দ রেজাউর রহমানের কোন শাস্তি হলো না। চাকরির মেয়াদ শেষ হওয়ার প্রাক মুহূর্তে বরখাস্ত করে বিষয়টিকে ধামাচাপা দেয়া শাক দিয়ে মাছ ঢাকার নামান্তর। কেন তাকে আইনের হাতে সোপর্দ করা হলো না তা প্রশ্নবিদ্ধ করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্র হিসেবে আমি ভীষণ ভীষণভাবে মর্মাহত। প্রাণপ্রিয় প্রতিষ্ঠানটির করুণদশা আমাকে চিন্তিত করে। (সমাপ্ত)
×