ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

বিশ্ব জনসংখ্যা দিবস আজ

আগামী ৫০ বছরে দেশে মানুষ হবে দ্বিগুণ

প্রকাশিত: ০৫:৫৩, ১১ জুলাই ২০১৬

আগামী ৫০ বছরে দেশে মানুষ হবে দ্বিগুণ

নিখিল মানখিন ॥ পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি ব্যবহারকারীর ড্রপআউটের উচ্চ হার এবং বাল্যবিবাহ জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিভিন্ন পদ্ধতিতে ড্রপআউটের হার এখনও ৩৫.৭ শতাংশ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ১৮ বছর পূর্ণ হওয়ার আগেই দেশের ৬৬ শতাংশ কিশোরীর বিয়ে হয়। আর বিবাহিতদের মধ্যে কিশোরী অবস্থাতেই গর্ভধারণ করেন শতকরা ৬৪ দশমিক ৩ ভাগ। গত তিন বছরে পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি ব্যবহারের হার মাত্র ১ শতাংশ বেড়েছে। অন্যদিকে প্রজনন হার প্রায় একই আছে। প্রজনন হার বা মহিলা প্রতি গড় সন্তান জন্মদানের হার ২ দশমিক ৭। বর্তমানে প্রজননক্ষম সকল দম্পতি পরিবার পরিকল্পনার কোন না কোন পদ্ধতি সম্পর্কে অবগত রয়েছেন। কিন্তু পদ্ধতি ব্যবহারকারীর হার সন্তোষজনক হারে বাড়েনি। ১১.৭ শতাংশ দম্পতিদের মধ্যে চাহিদা থাকা সত্ত্বেও পরিবার পরিকল্পনা সেবা প্রদান করা সম্ভব হচ্ছে না। অসচেতনতার অভাবে অনেক দম্পতির বেশিসংখ্যক সন্তান নেয়ার ঘটনাও ঘটছে। কিশোরী অবস্থায় সন্তান ধারণের জন্য দারিদ্র্য ও অশিক্ষাও এর পেছনে ভূমিকা রাখছে। মাঠকর্মীরা এখন আর বাড়ি বাড়ি পরিদর্শন করেন না। এমন অবস্থার মধ্য দিয়ে আজ সোমবার পালিত হচ্ছে বিশ্ব জনসংখ্যা দিবস। দিবসটি উপলক্ষে বাণী দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সরকারী ও বেসরকারী উদ্যোগ নানা কর্মসূচী গ্রহণ করা হয়েছে। পরিবার পরিকল্পনা অধিদফতরের পরিসংখ্যানে পদ্ধতি ব্যবহারকারীর হার বৃদ্ধির চিত্র লক্ষ্য করা গেছে। বাংলাদেশের জনসংখ্যা ১৬৫০ সালে ১ কোটি ছিল। তা ২শ’ বছর পর ১৯৫১ সালে বৃদ্ধি পেয়ে দ্বিগুণ অর্থাৎ ২ কোটি ৩ লাখ হয়। এই জনসংখ্যা ৪ কোটি ২০ লাখ হয় ৯০ বছরে (১৯৪১ সালে)। দেশের বর্তমান জনসংখ্যা ১৪ কোটি ২৩ লাখ ১৯ হাজার। বর্তমান জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ১ দশমিক ৩৭ শতাংশ। প্রতি বর্গকিলোমিটারে বাস করে ৯৭৯ জন মানুষ। বর্তমান হারে জনসংখ্যা বৃদ্ধি অব্যাহত থাকলে আগামী ৫০ বছরে বাংলাদেশের জনসংখ্যা দ্বিগুণ হবে। জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারের দিকে তাকালে দেখা যায়, ১৯৫০ থেকে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ছিল উর্ধগামী। ২০০১ সাল থেকে এ পর্যন্ত জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার কমতে শুরু করলেও তা প্রত্যাশিত হারে নামেনি। বিশেষজ্ঞরা বলেন, পরিবার পরিকল্পনা কার্যক্রমে এমডিজির লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে বাল্যবিবাহ। এটি এখনও একটি বড় সামাজিক সমস্যা হিসেবে বিদ্যমান। ১৮ বছর বয়স হওয়ার পূর্বে মেয়েদের বিয়ে না দেয়ার বিদ্যমান আইন বেশি মাত্রায় লঙ্ঘন করা হয়ে থাকে। ১৮ বছর বয়স হওয়ার আগেই দেশে শতকরা ৬৬ ভাগ মেয়ের বিয়ে হয়। এর এক-তৃতীয়াংশ ১৯ বছর বয়স হওয়ার আগেই গর্ভবতী অথবা মা হয়ে যান। দেশে প্রতি হাজার শিশুর জন্ম দিতে গিয়ে ২ দশমিক ৯ জন মা মারা যান। তাদের মধ্যে কিশোরী বয়সে হওয়া মায়ের সংখ্যাই বেশি। পরিবার পরিকলল্পনা অধিদফতর জানায়, মা ও শিশু স্বাস্থ্য এবং কিশোর-কিশোরীদের প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা কার্যক্রম সফল করে তুলতে হবে সামাজিক আন্দোলন। আরও জোরালো করতে হবে জনসচেতনতামূলক কার্যক্রম। পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি গ্রহণের মাধ্যমে জনসংখ্যা বৃদ্ধির অস্বাভাবিক হার নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে। নানা প্রতিকূল অবস্থার মধ্যে পরিবার পরিকল্পনা এবং মা ও শিশু স্বাস্থ্য কর্মসূচী বেশ অগ্রগতি অর্জন করেছে। প্রতি বছর পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি গ্রহীনতা শতকরা গড়ে ১ দশমিক ৫ ভাগ হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। গত দশ বছরে আধুনিক জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতির ব্যবহারকারীর হার বৃদ্ধি পেয়ে ৬১.২ শতাংশে উন্নীত হলেও স্থায়ী ও দীর্ঘমেয়াদী পদ্ধতিতে তেমন কোন অগ্রগতি পরিলক্ষিত হয়নি। প্রজনন হার বা মহিলা প্রতি গড় সন্তান জন্মদানের হার কমে বর্তমানে ২ দশমিক ৭ ভাগে নেমেছে। অপূর্ণ চাহিদার ক্ষেত্রে একটি উদ্বেগজনক বিষয় হলো, ১৫ থেকে ১৯ বছর বয়সী বিবাহিত মহিলাদের মধ্যেই অপূর্ণ চাহিদার হার সবচেয়ে বেশি। এ হার ১৯.৮ শতাংশ। এ বয়সীদের মধ্যে মাত্র ৩৭.৬ শতাংশ পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি ব্যবহার করছেন। ১৮ বছর পূর্ণ হওয়ার আগেই দেশের ৬৬ শতাংশ কিশোরীর বিয়ে হয়। আর বিবাহিতদের মধ্যে কিশোরী অবস্থাতেই গর্ভধারণ করেন শতকরা ৬৪ দশমিক ৩ ভাগ। এই হিসাবে দেশের ১৬ মিলিয়ন কিশোরী প্রতি বছর সন্তান জন্ম দেয়। শহরের তুলনায় গ্রামে কিশোরী অবস্থায় মা হওয়ার প্রবণতা বেশি। রাজশাহী বিভাগে এই প্রবণতা সবচেয়ে বেশি শতকরা ৩২ দশমিক ৮ ভাগ এবং সিলেট বিভাগে সবচেয়ে কম ১৯ দশমিক ৭ ভাগ। ১৫ থেকে ১৯ বছর বয়সী ১৬ মিলিয়ন কিশোরী প্রতিবছর সন্তান জন্ম দেয়, যাদের প্রতি ১০ জনের মধ্যে ৯ জনেরই ইতোমধ্যে বিয়ে সম্পন্ন হয়েছে। স্থায়ী ও দীর্ঘমেয়াদী পদ্ধতি গ্রহণের হারও তুলনামূলকভাবে অনেক কম। শতকরা ৫ দশমিক ৭ ভাগ স্থায়ী এবং ৮ দশমিক ৬ ভাগ দীর্ঘমেয়াদী পদ্ধতি গ্রহণ করছেন। মহিলাদের তুলনায় পুরুষদের পদ্ধতি গ্রহণের হার এখনও অনেক কম। শতকরা ৫ দশমিক ২ ভাগ পুরুষ স্থায়ী এবং অস্থায়ী পদ্ধতি গ্রহণ করছেন। বস্তি এলাকার মেয়েরা নিজেরা সিদ্ধান্ত নিতে পারে না ॥ রাজধানীর বস্তি এলাকাসমূহে এমনিতেই সরকারীভাবে পরিবার পরিকল্পনা কার্যক্রম নেই। এসব এলাকার নারীরা স্বাস্থ্যসেবা সুবিধা পান না। বস্তির শতকরা ৮৭ ভাগ মহিলা সন্তান প্রসব করার আগে মেডিক্যাল পরীক্ষা করানোর সুযোগ পান না। ১৫ বছর পূর্ণ হওয়ার আগেই এক-তৃতীয়াংশ মেয়ের বিয়ে হয়ে যায়। স্বামীদের অসহযোগিতার কারণে শতকরা ৮৫ ভাগ মহিলা স্বাস্থ্যসেবা নিতে পারেন না। আইসিডিডিআর’বি এবং পপুলেশন কাউন্সিল চালিত গবেষণা প্রতিবেদনে এ তথ্য বেরিয়ে এসেছে। রাজধানীর মহাখালী, মোহাম্মদপুর ও যাত্রাবাড়ী এলাকার বস্তিতে এক গবেষণা চালায় আইসিডিডিআর’বি এবং পপুলেশন কাউন্সিল। প্রায় সাড়ে হাজার বস্তিবাসীর সঙ্গে কথা বলেন গবেষণা দলের সদস্যরা। প্রতিবেদনে বলা হয়, বস্তি এলাকার শতকরা ৭৩ ভাগ নারী শারীরিক ও লিঙ্গ বৈষম্যের শিকার হন। বস্তিতে বাল্যবিবাহের মাত্রা খুবই বেশি। মেয়েদের বিয়ে দেয়ার ক্ষেত্রে তাদের সম্মতিকে গুরুত্ব দেয়া হয় না। শতকরা ৬১ ভাগ মেয়ের বিয়ে হয় তাদের অভিভাবকদের সম্মতিতে। যৌতুকের শিকার হন শতকরা ৩১ ভাগ মহিলা। ইচ্ছার বাইরে বিয়ে হয় ২৮ ভাগ মেয়ের। অধিকাংশ মহিলার যৌন শিক্ষা ও জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতির বিষয়ে ধারণা নেই। যৌন সম্পর্কের মাধ্যমে জটিল রোগ সংক্রমিত হতে পারে, যা অনেক নারীই জানেন না। শতকরা ৯০ ভাগ মহিলা তাদের স্বামীর দ্বারা খারাপ আচরণের শিকার হন। শারীরিক বা যৌন হয়রানির শিকার হন শতকরা ৭৬ ভাগ নারী। অবিবাহিত মেয়েদের অধিকাংশই বাড়িতে নানা সহিংসতার অভিজ্ঞতা পান। নিজ পরিবার ও বাইরে বস্তির নারীরা তুলনামূলকভাবে বেশি অসহায় হয়ে পড়েন। প্রতিটি মুহূর্তে তাদের আতঙ্কে থাকতে হয়। স্বাস্থ্যসেবার চেয়ে তাদের প্রতিনিয়ত দু’বেলা খাবার ও কোন রকম বেঁচে থাকার বিষয় নিয়ে ব্যস্ত থাকতে হয়। অসুস্থ হয়ে পড়লেও তাদের কেউ কেউ গোপন করে যান। আর স্বামীকে জানালেও সহযোগিতা পান না। গর্ভবতী মায়েরা হয়ে পড়েন চরম অসহায়। হাসপাতালে স্বাস্থ্য পরীক্ষাসহ প্রয়োজনীয় পরামর্শ নেয়ার সুযোগ পর্যন্ত থাকে না। এমন পরিস্থিতিতে তারা হাসপাতাল ও ক্লিনিকে সন্তান প্রসব করার কথা ভাবতেই পারেন না।
×