ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

জাফর ওয়াজেদ

ম্লান হয়ে আসে গৌরব যখন

প্রকাশিত: ০৩:৪৬, ১১ জুলাই ২০১৬

ম্লান হয়ে আসে গৌরব যখন

অর্জন তার বিশাল। গৌরব ও অহঙ্কার তার প্রতিটি পরতে পরতে। প্রাগ্রসর মানবের জন্য বয়ে নিয়ে এসেছিল মহান সব কীর্তি, সৃষ্টির আকাশ। সৃষ্টিশীল মানব তৈরির কাজটি করে আসছিল সুনিপুণভাবে প্রতিষ্ঠার পর হতে, বিংশ শতাব্দীতে। দেশের ইতিহাসের প্রতিটি পর্বে, প্রতিটি বাঁকে নিজের সাহসী ভূমিকার সংমিশ্রণ ঘটিয়েছিল। জাতিকে দেখিয়েছিল মুক্তি ও স্বাধীনতার পথনির্দেশিকা। সেসব আজ ইতিহাসের পাতায় ঠাঁই নিয়েছে। কিন্তু নতুন করে আর প্রণোদনা জাগাতে পারেনি। বরং ক্রমেই স্তিমিত হয়ে আসছে তার গৌরবের ক্ষেত্রগুলো। পঁচানব্বই বছর আগে ১৯২১ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ‘সত্যের জয় অবশ্যম্ভাবী’ এই মূলমন্ত্র নিয়ে। সত্যের জয় বার বার হয়েছিল বৈকি। সত্যানুসন্ধানী দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে প্রতিটি পদক্ষেপে সম্মুখে এগিয়ে গিয়েছিল। যাবারই কথা তার। পূর্ববঙ্গের উচ্চশিক্ষা ও শিক্ষার্থীদের জন্য যখন উন্মুক্ত হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুয়ার, তখন অবিচার, অবহেলা, বঞ্চনা ও প্রত্যাখ্যানের অন্ধকারের বিপরীতে জয় হয়েছিল আলোর। তাই গাত্রে তার লেখা হয়ে যায় শিক্ষাই আলো। সেই আলো সে প্রজ্বলিত করেছিল বাঙালীর অন্তরে বাইরে। ১৯২০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আইন পাস হয়। এর পরের বছর পহেলা জুলাই থেকে শুরু হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম। শুভকর্ম পথে ধরেছিল সে নির্ভয় গান। গত শতকে দেশসেরা নাগরিকদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশই ছিল এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য বলা হয়েছিল, সমগ্র বিশ্ব এবং এক অখ- জীবন পদ্ধতির একটি সুসামঞ্জস্য চিত্র পরিবেশন করা। এর মাধ্যমে লাভ করতে হয় একটি সামগ্রিক বোধ এবং জ্ঞানের বিভিন্ন দিকের পরিপূর্ণ অথচ সংক্ষিপ্ত একটি ভাবচিত্র। শুধু বিক্ষিপ্ত কতগুলো তথ্যের ওপর ভিত্তি করে মানুষ বেঁচে থাকতে পারে না। একটি সুশৃঙ্খল বুদ্ধিভিত্তিক ভাবচিত্র লাভ করার সহজাত প্রেরণা মানুষের রয়েছে। বিচিত্র বিকাশের মধ্যেও জীবনের এক অখ- সত্তা অভিব্যক্ত তথ্যাবলীর গভীরে প্রবেশ করে একটি অখ- জ্ঞান অর্জন করতে হয়। বিচ্ছিন্ন এবং বিক্ষিপ্ত সংগ্রহরূপে নয়। একে পেতে হয় একটি সুসমন্বিত সত্তারূপে। জ্ঞানের মূলভিত্তিকে বাদ দিয়ে কখনও জ্ঞানী হওয়া যায় না। সহজলভ্য জ্ঞান দিয়ে কখনও প্রজ্ঞার ভা-ার পূর্ণ হয় না। তথ্যভিত্তিক জ্ঞান আর বোধশক্তির মধ্যে দার্শনিক প্লেটো পার্থক্য নিরূপণ করেছিলেন তার সময়কালেই। এটা আজকের বাস্তবতা যে, উচ্চশিক্ষার অবস্থা মোটেই সন্তোষজনক নয়। শুধু তাই নয়, ক্ষেত্র বিশেষে নেহাতই আশঙ্কাজনক। গড়পড়তা শিক্ষার মান দ্রুত পতনশীল। শিক্ষা খাতের এক বিপুল অংশেই প্রয়োজনের তুলনায় বিষয়বস্তু আর গুণাগুণের দিক থেকে অপ্রতুলতা বিরাজ করছে। শিক্ষাবিদদের অনেকেই আজও সম্পূর্ণরূপে উপলব্ধি করে উঠতে পারেননি যে, এ দেশের কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের শিক্ষাক্ষেত্রে কি এক ভয়ঙ্কর অবস্থা বিরাজ করছে! এমনকি যারা এ অবস্থা সম্পর্কে মোটামুটিভাবে সচেতন, এ রূপ অবস্থার সঙ্গে বহু পরিচিতির কারণে এর মর্মান্তিক পরিণতি সম্পর্কে তারাও বেখেয়াল রয়েছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিণতি শঙ্কা জাগায়। নয়টি দশক পেরিয়ে আরেকটি দশকের মাঝামাঝি এসে ঘুণপোকাদের ঘুণে ধরানো প্রক্রিয়ার প্রসার ঘটেছে এর রন্ধ্রে রন্ধ্রে যেন। গত পঁচানব্বই বছরে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের বহু সাংগঠনিক পরিবর্তন এবং শিক্ষাগত ও বাহ্যিক পরিবর্ধন ঘটেছে। পরিধি বাড়লেও প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমের প্রসার ঘটায়নি। ফলে জটিলতা, সমস্যা ইত্যাকার বিষয়ের প্রাদুর্ভাব ঘটে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অতীত ইতিহাস পর্যালোচনায় উঠে আসে কিভাবে এবং কেমন করে একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নানা ঘাত-প্রতিঘাত ও উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে ক্রমে ক্রমে পরিণত ও ঋজু হয়েছে। এই সময়ে বহু রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিবর্তন ঘটেছে, সংঘর্ষ বেধেছে পুরনো চিন্তাধারার সঙ্গে নতুন চিন্তাধারার, ঔপনিবেশিকতার সঙ্গে জাতীয়তাবাদের, প্রতিক্রিয়ার সঙ্গে প্রগতির। এই অঞ্চলে দু’বার প্রভু বদল ঘটেছে। বহু রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর অবশেষে লক্ষ্য হাসিল হয়েছে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর। এই বিশ্ববিদ্যালয় একটি ভাষা ও পতাকা দিয়েছে এবং দেশের স্বাধীনতা অর্জনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল ছাত্র-শিক্ষক-কর্মচারীরা। সব অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে ছাত্র সমাজ সব সময় গর্জে উঠেছে। সামরিক জান্তা শাসকের নিপীড়ন, নির্যাতন, অস্থিতিশীল অবস্থা সৃষ্টিসহ শিক্ষাবিরোধী ভূমিকার বিরুদ্ধে তার সন্তানদের গর্জে উঠতে প্রেরণা দিয়েছিল। সেসব ইতিহাস বিশ শতকের প্রায় মানুষের জানা। শিক্ষা-দীক্ষা, জ্ঞান-গরিমা, জাতির সুযোগ্য সন্তান উপহারদানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়ে গেছে। শিক্ষা মানুষের আত্মীয়তাবোধকে প্রসারিত করে। আপন পরিবার-পরিজন ছাড়িয়ে পাড়া-প্রতিবেশীতে, প্রতিবেশী ছাড়িয়ে নিকটস্থ লোকালয়ে, লোকালয় ছাড়িয়ে চতুর্পার্শ্বস্থ অঞ্চলে, অঞ্চল অতিক্রম করে উপজেলা হয়ে গোটা জেলা। জেলা ছাড়িয়ে বিভাগ আর বিভাগ ছাড়িয়ে সমগ্র দেশে এবং দেশ ছাড়িয়ে মহাদেশে, সেখান থেকে বিশ্বভুবনে। শিক্ষিত মনের কাছে কেউ অনাত্মীয় নয় বৈকি। শিক্ষা যদি সুস্থ ধারার হয় তাহলে অযাচিত আন্দোলন বা হস্তক্ষেপ হতে পারে না। শিক্ষার নামে যদি বিস্তার হয় কুশিক্ষার তবে তাকে রোধ করবে কে? কুশিক্ষা আবহাওয়াকে বিষাক্ত করে তোলে। সেই অবস্থা যে দৃশ্যমান হয় প্রায়শ তা অবশ্য নয়। তবে কুশিক্ষার কুফল মাঝে-মধ্যে প্রকাশিত হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা পুঁথিগত না হয়ে মানুষকে চিনবার, জানবার শিক্ষা হলে বিভেদ-বিরোধ অনেকাংশে দূর হয়। শিক্ষাদান অশিক্ষিতের হাতে পড়লে তাতে বিড়ম্বনা ঘটার কথা। ঘটেও তাই। এমনিতেই শিক্ষার অভাবে দেশ পিছিয়ে যায়। প্রথমাবধি যদি শিক্ষার ওপর জোর দেয়া যায় তাহলে মিথ্যাচার ও বিকৃতি প্রশ্রয় পায় না। বিশেষত বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে। বিশ্ববিদ্যালয় বিশ্বের জ্ঞানভা-ারে প্রবেশের দ্বার এবং জাতীয় মণীষা বিকাশের শ্রেষ্ঠতম লালন ক্ষেত্র। বাঙালীর জাতীয় জীবনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এক অনন্য ঐতিহ্যের অধিকারী। যেমন বিশ্বের জ্ঞানভা-ার এই বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃতী অধ্যাপকদের অবদানে সমৃদ্ধ হয়েছে, তেমনি এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীবৃন্দই জাতির নানা সঙ্কটে সঠিক ও বলিষ্ঠতম ভূমিকা পালন করেছে। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাপ্রাপ্ত তরুণরাই বাংলাদেশের সাহিত্য, সাংস্কৃতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক চেতনা বিকাশের নানা পর্যায়ে যুগে যুগে নেতৃত্ব দিয়েছেন। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের বিগত অর্ধশতাব্দীর সংগ্রামী ঐতিহ্য উজ্জ্বলতম হয়ে উঠেছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়। ভাষা আন্দোলন থেকে স্বাধীনতা যুদ্ধ পর্যন্ত এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ত্যাগ ও অবদান অবিস্মরণীয়। এ দেশের সর্বস্তরের মানুষের সঙ্গে একাত্ম হয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক-কর্মচারীরা সংগ্রাম করেছেন। আত্মদান করেছেন। বিশ্বের বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের ইতিহাসে এ এক অভূতপূর্ব অতুলনীয় দৃষ্টান্ত। যদিও বাংলাদেশের সমাজ প্রগতির ধারায় এবং বাঙালীর জাতীয় জীবনে এর অবদানের সম্যক পর্যালোচনা অদ্যাবধি হয়নি। একাত্তরে প্রফেসর ও ডিনসহ ১৯ জন শিক্ষককে পাকিস্তানের সামরিক জান্তা নৃশংসভাবে হত্যা করে। বহু ছাত্র এবং কর্মচারীকে হানাদার ও তাদের দোসর রাজাকার, আল-বদরদের হাতে নির্মমভাবে প্রাণ হারাতে হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের বহু মূল্যবান সম্পত্তিও বিধ্বস্ত করে দেয়া হয়। এক অপরিণামদর্শী ক্ষতির শিকার হয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয়। আর শতবর্ষে পৌঁছার আগে সত্যের জয়কে ভূলুণ্ঠিত করতে বিকৃত মিথ্যাচারকে উপস্থাপন করা হয়েছে এবারের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দিবসে। ভাবতে বিস্ময় জাগে, এটা কেমন করে সম্ভব হলো! ইতিহাসকে বিকৃত করে বিদ্বেষপূর্ণ তথ্য উপস্থাপন কুশিক্ষা-অশিক্ষার নামান্তর। ইতিহাস শুধু ইতিকথা নয়। ইতিহাস আসলে আগামী দিনের প্রেরণার সঞ্চয়। কিন্তু এ ইতিহাস রচনার কাজটি সহজ নয়। বিশেষ করে যদি ইতিহাস হয় সমকালের। কেননা, সমকালের সঙ্গে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে সম্পর্কিত থাকতে হয় বলে নিরপেক্ষতা অর্জন হয় দুরূহ। কিন্তু বাঙালী জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মূল্যায়নে ইতিহাসকে বিকৃত করার প্রবণতা পরাজিত শক্তির গভীর ষড়যন্ত্রেরই অংশবিশেষ। বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটির স্বাধীনতা যারা চায়নি, যারা সশস্ত্রভাবে বিরোধিতা করেছে, তাদের প্রথম ও প্রধান আক্রমণ বঙ্গবন্ধুর ওপরই। তারই ধারাবাহিকতায় বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করা হয়েছিল। আন্তরিক, নিরপেক্ষ ও বিশ্লেষণী প্রজ্ঞার ফসল দিয়ে সত্যিকার ইতিহাস রচনা করতে হয়। কিন্তু বিকৃত মনোভাব আর পরাজিত শক্তির দৃষ্টি দিয়ে রচিত ইতিহাস মূলত ইতিহাস নয়। ইতিহাস বলে, বাংলাদেশের সর্বশ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে বাংলাদেশের স্থপতি ও বাঙালী জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছিল সুদীর্ঘকালের সম্পর্ক। তাঁর নামে বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি হলের নামকরণ স্বাভাবিক বিষয়। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যার কোন সম্পর্ক নেই; বরং বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের ঢিলপাটকেলে যিনি ক্যাম্পাসে প্রবেশে বাধা পেয়েছিলেন, অস্ত্রের মুখে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে দেশে সামরিক শাসন বহাল করেছেন, তার নামে ছাত্র হলের নামকরণ দ্বিধা জাগায়। গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সূতিকাগারে এমন অবস্থান বৈসাদৃশ্যপূর্ণ বৈকি। কিন্তু এমনটাই হয়েছে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে। স্মরণ করা যায়, ১৯৭৬ সালের আগস্ট মাসে সামরিক জান্তা শাসক রাজনৈতিক দল অধ্যাদেশ ঘোষণা করে। এই সুযোগে স্বাধীনতাবিরোধী দলগুলোও সামরিক সরকারের স্বীকৃতি নিয়ে বাংলাদেশে রাজনীতি করার সুযোগ লাভ করে। তাদের অনুসারীরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অনুপ্রবেশের সুযোগ পায় তখন থেকেই। এরা প্রশাসন থেকে শুরু করে শিক্ষকতায় পর্যন্ত ঠাঁই নেয়। এর সঙ্গে সামরিক জান্তা প্রতিষ্ঠিত ছাত্র ও রাজনৈতিক দলের সহযোগিতা তীব্র হয়ে ওঠায়, এই দুই শক্তি মিলে ক্যাম্পাসকে নিয়ন্ত্রণে নিতে সক্রিয় হয়ে ওঠে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মচারীসহ শিক্ষকরা একাত্তর সালে শহীদ হয়েছিলেন। আবার অনেক শিক্ষক পাকিস্তানী হানাদারের দালালি করেছে প্রকাশ্যে। জাতিসংঘে গিয়ে বাংলাদেশবিরোধী প্রচারও চালিয়েছে। কেউ কেউ সহকর্মীদের হত্যার জন্য রাও ফরমান আলির কাছে তালিকা দিয়েছে। একাত্তরের পহেলা জুলাই দখলদার পাকিস্তানী হানাদাররা ক্যাম্পাসে ক্লাস চালু করে। অনেক শিক্ষক যোগদান করে নিয়মিত ক্লাস, টিউটোরিয়াল পরীক্ষা নিয়েছে। স্বাধীনতার পর দালাল আইনে অনেকের সাজা হলেও পঁচাত্তর পরবর্তী জান্তা শাসক তাদের শাস্তি মওকুফ করে জেল থেকে মুক্তি দিয়েছিল। এদের অনেকে মামলা করে বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরি ফেরত পায়। ছিয়াত্তর সাল হতে দলে দলে পাকিস্তানী দালাল শিক্ষকরা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান শুরু করে। বাংলাদেশবিরোধী বক্তব্য ক্লাসে দিতে বিন্দুমাত্র অনুতপ্ত বা অপরাধবোধ করত না তারা। এদের ছত্রছায়ায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সাতাত্তর সালে সাবেক ইসলামী ছাত্র সংঘের সদস্যরা সংঘবদ্ধ হয়ে ইসলামী ছাত্র শিবির গড়ে তোলে। এই সংগঠনটি প্রথমেই অপরাজেয় বাংলা ভাঙ্গার জন্য গাঁইতি শাবল নিয়ে হামলা চালিয়েছিল। ছাত্রদের প্রতিরোধের মুখে তারা পালিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু গোপনে এদের সাংগঠনিক তৎপরতা বাড়তে শুরু করে। ১৯৭৯ সালে ডাকসু ও হল সংসদ নির্বাচনে শিবির বিনা বাধা ও প্রতিরোধে অংশ নেয়ার সুযোগ পায়। দু’একজন ছাত্রনেতা বিরোধিতা করলেও তা ধোপে টেকেনি। শিক্ষক ও বুদ্ধিজীবী হত্যার সঙ্গে জড়িতরা স্বাধীনতাবিরোধী তৎপরতার সুযোগ পেয়ে যায়। ক্রমেই তাদের পরিধি বিস্তৃত হতে থাকে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনেও। আর এখন তো শিবির থেকে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার সংখ্যা কম নয়। এরা ছাত্রদের যা শিক্ষা দেয় তা স্বাধীনতার ইতিহাসকে ম্লান করে দিতেই সচেষ্ট। তা একদিন জঙ্গীবাদে উদ্বুদ্ধ হতে বিলম্ব করবে না। তাই দেখা যায়, এই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের তত্ত্বাবধানে স্টাডি সার্কেলের নামে হিযবুত তাহ্রীর নামক জঙ্গী ও সন্ত্রাসবাদী সংগঠন গড়ে তোলা হয়। এই যেখানে অবস্থা সেখানে মুক্তচিন্তা, প্রগতিশীল সাহিত্য সংস্কৃতি চর্চা হতে পারে না এবং আর হয়ও না। এই বিশ্ববিদ্যালয় একদা কত সহস্র জ্ঞানীগুণী উপহার দিয়েছে। শিক্ষা-সাহিত্য, সংস্কৃতির পুরোধা ব্যক্তিত্ব উপহার দিয়েছে, আর আজ সেরকম প্রতিভাবান কারও নাম যেমন শোনা যায় না, তেমনি সাহিত্য-সংস্কৃতির সংগঠনও গড়ে ওঠে না। শিক্ষার সামগ্রিক কাঠামোর মূল কেন্দ্রবিন্দু হচ্ছেন শিক্ষক। তার ব্যক্তি গুণাবলী ও চরিত্র, তার শিক্ষকতার যোগ্যতা, মতাদর্শ এবং অধিগত ও পেশাগত নৈপুণ্যের ওপরই নির্ভর করে সকল শিক্ষা সংক্রান্ত প্রচেষ্টার সফলতা। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রায়ই সংবাদপত্রের শিরোনাম হয়। গৌরবের জন্য নয়, অধঃপতিত শিক্ষকদের জন্য। ছাত্রীদের সঙ্গে যে আচরণ করা সঙ্গত তাকে ছাড়িয়ে গিয়ে বিকৃত মানসিকতার যে বহির্প্রকাশ ঘটানো হয় তা অভব্য এবং কদাকার। শিক্ষক সমাজের মুখে কালিমালেপন করতে সহায়ক হয়। গত ত্রিশে জুন সংবাদপত্রে প্রকাশ হয়েছে ছাত্রী নিপীড়নের জন্য দুই শিক্ষকের বিরুদ্ধে অভিযোগ। দুর্বৃত্তরা যখন শিক্ষক বনে যান, তখন বিপত্তি জাগা স্বাভাবিক। মূলত শিক্ষকদের সচেতন থাকতে হয়। কাজের সঙ্গে সঙ্গে সমাজের শ্রদ্ধাও অর্জন করতে হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক জ্ঞানী-গুণী শিক্ষক হিসেবে অনেকের নাম আজও স্মরিত হয়। অনেকে কিংবদন্তিতে পরিণত হয়েছেন। অনেকের নাম সমকালে মানুষের মুখে মুখে ফিরত তাদের কর্মের জন্য। সমাজ তাদের শ্রদ্ধা জানাত। একবিংশ শতকে এসে তেমন কোন শিক্ষকদের নাম আর শোনা যায় না। এমনকি তাদের কীর্তিকর্মেরও হদিস বা নিশানা মেলে না। গবেষণাকর্ম কবে করেছেন মনেও করতে পারেন না। জ্ঞানী-গুণী, প-িত, গবেষকের সংখ্যা মনে হয় ক্রমশ হ্রাস পাচ্ছে। একদা ‘প্রাচ্যের অক্সফোর্ড’ বলে খ্যাত এই বিশ্ববিদ্যালয় জ্ঞানের বিভিন্ন দিকে যে উৎকর্ষ সাধিত হয়েছিল, এক কথায় বলা যায় তা অত্যন্ত ব্যাপক এবং গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়ে ছিল। এসবের পাশাপাশি এখানে হয়েছে রাজনীতির প্রচার ও প্রসার। জন্ম নিয়েছে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন। এক সোনালি যুগ রচনা করেছিল প্রত্যেক ক্ষেত্রে। আজ সেসব শুধু স্মৃতি। এখন আর সেই অবস্থা দৃশ্যমান নয়। সঠিক এক গ্লানিকর অবস্থাই পরিলক্ষিত হয়। শিক্ষার নামে অশিক্ষা কুশিক্ষার বিস্তার যদি ঘটে তবে ভয়াবহতা বাড়ে। এসবই বিশ্বের জলবায়ু ও পরিবেশসহ সমাজজীবনকে বিষাক্ত করে তোলে। শিক্ষার নামে এমনিতেই দেশময় কুশিক্ষার বিস্তার হচ্ছে। দেশের যুবশক্তিকেই এসব রোধ করার জন্য এগিয়ে আসা দরকার। আজ যেসব উগ্রবাদী, জঙ্গীবাদী, সন্ত্রাসবাদী চরম নৃশংসতা প্রদর্শন করছে, তারা বিশ্ববিদ্যালয়েরই প্রডাক্ট। হোক সে বেসরকারী ও খ্যাতনামা। কুশিক্ষার ফল যে এই প্রবণতার বিস্তার ঘটিয়েছে, এটা বলাইবাহুল্য। শিক্ষা যদি সুস্থ ধারার হতো তা হলে এভাবে উগ্রবাদী তথা মানুষ হত্যাকারী গড়ে উঠত না। শিক্ষালয় যেখানে মানুষকে উদার করার কথা, মানবিক বোধ ও অসাম্প্রদায়িক চেতনায় জারিত করার কথা- সেখানে মৌলবাদী, সন্ত্রাসবাদীদের বিকশিত হবার অর্থ সামনে ভয়ঙ্কর সময় ও দিন অপেক্ষমাণ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এই অধঃপতন নৃশংসতা থেকে ফেরাতে কোন উদ্যোগী হয়েছে, এমনটা বলা যাবে না। বরং নির্লিপ্ত, নির্বিকার একটা ভাব। যেখানে মঙ্গলকামীরা প্রকাশ্যে বলেন না, শিক্ষার একি বেহাল অবস্থা! তারা অন্ধকারের শক্তির উত্থান দেখেও কী এক আড়ষ্টতায় ও ভয়ার্ততায় নীরব থাকাকেই জীবনের বেদ হিসেবে নির্ধারণ করেছেন যেন। ইতিহাস, ঐতিহ্য বিকৃত ও বিরোধিতাকে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে উৎসাহ শুধু নয়, তা লিপিবদ্ধ করে প্রকাশ্যে উপস্থাপন করতে সামান্য দ্বিধাও জাগে না তাই। উচ্চশিক্ষার পাঠদানের অবস্থাটা সহজেই অনুমেয় তার প্রকাশনা ও প্রকাশনার অভ্যন্তরের বক্তব্য বিশ্লেষণেই। বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে বিদ্রুপ করার এই নিকৃষ্টপনাকে বিশ্ববিদ্যালয় যদি জনসমক্ষে তুলে ধরে, বঙ্গবন্ধুকে হেয় করার মতো ধৃষ্টতা প্রদর্শন করে, তবে সেই বিদ্যায়তনের বর্তমান ও ভবিষ্যত নিয়ে ভাবতে হয় বৈকি। ব্যক্তি বিশেষের জন্য প্রতিষ্ঠানটির সুনাম ক্ষুণœ হচ্ছে- এমন আপ্তবাক্য উচ্চারণ করে আত্মতৃপ্তি পাওয়া যেতে পারে। কিন্তু সার্বিকভাবে যে এক ধরনের অধঃপতন, এক ধরনের পশ্চাৎপদতা আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধেছে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। (বাকি অংশ আগামীকাল চতুরঙ্গ পাতায়)
×