ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

নদনদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত

কক্সবাজারে ভেসে গেছে ৪ শিশু, কুড়িগ্রামে ৪০ হাজার মানুষ পানিবন্দী

প্রকাশিত: ০৬:০৮, ১০ জুলাই ২০১৬

কক্সবাজারে ভেসে গেছে ৪ শিশু, কুড়িগ্রামে ৪০ হাজার মানুষ পানিবন্দী

স্টাফ রিপোর্টার ॥ দেশের প্রধান প্রধান নদ নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। কুড়িগ্রামে পানিবন্দী হয়ে আছে প্রায় ৪০ হাজার মানুষ। নীলফামারীতে নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে প্রায় অর্ধ শতাধিক পরিবারের বসতভিটা। কক্সবাজারে জোয়ারের পানিতে ভেসে গেছে চার শিশু। মৌসুমী বায়ু বাংলাদেশের ওপর মোটামুটি সক্রিয় এবং উত্তর বঙ্গোপসাগরের অন্যত্র মাঝারি অবস্থা বিরাজ করছে। গত দু’দিন সারাদেশে বৃষ্টিপাত হ্রাস পেয়েছে, বেড়েছে তাপমাত্রা। বাতাসে জলীয় বাষ্পের পরিমাণ বেশি থাকায় রাজধানীতে অনুভূত হচ্ছে ভ্যাপসা গরম। শনিবার ঢাকায় বাতাসে আপেক্ষিক আর্দ্রতা ছিল ৮৯ শতাংশ। পানি উন্নয়ন বোর্ডের সহকারী প্রকৌশলী সরদার উদয় রায়হান জানান, ব্রহ্মপুত্র নদ ও সুরমা-কুশিয়ারা নদীসমূহের পানি সমতল হ্রাস পাচ্ছে। অপরদিকে যমুনা, গঙ্গা-পদ্মানদীসমূহের পানি সমতল বৃদ্ধি পাচ্ছে। যমুনা নদীর পানি সমতল আগামী ২৪ ঘণ্টা পর হ্রাস পেতে পারে। ব্রহ্মপুত্র নদ চিলমারি পয়েন্টে বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে যা আগামী ৪৮ ঘণ্টা পর্যন্ত অব্যাহত থাকতে পারে, অপরদিকে যমুনা নদী বাহাদুরাবাদ এবং সারিয়াকান্দি পয়েন্টে আগামী ৪৮ ঘণ্টায় বিপদ সীমার নিচে নেমে আসতে পারে। গঙ্গা-পদ্মা নদীসমূহের পানি সমতল আগামী ৪৮ ঘণ্টা পর্যন্ত বৃদ্ধি পেতে পারে। পর্যবেক্ষণাধীন ৯০টি পানি সমতল স্টেশনের মধ্যে শনিবার সন্ধ্যা পর্যন্ত ৪৭টির পানি বৃদ্ধি এবং হ্রাস পায় ৩৬টি স্টেশনের পানি। বিপদসীমার ওপর দিয়ে বইছে ৬টি নদীর পানি। শনিবার সন্ধ্যায় ব্রহ্মপুত্র নদের পানি চিলমারী পয়েন্টে ৩১ সেন্টিমিটার, বাহাদুরাবাদ পয়েন্টে যমুনার পানি ৫ সেন্টিমিটার, সারিয়াকান্দিকে যমুনা ও এলাসিনে ধলেশ্বরীর পানি ১ সেন্টিমিটার এবং জারিয়াজঞ্জাইল পয়েন্টে কংস নদীর পানি বিপদ সীমার ৩৬ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল বলে বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র থেকে জানানো হয়েছে দেশের ওপর মৌসুমী বায়ু (বর্ষা) দুর্বল হয়ে বৃষ্টি কমে যাওয়ায় দু’দিনে তাপমাত্রা সর্বোচ্চ ৫ দশমিক ৮ ডিগ্রী সেলসিয়াস বেড়েছে। এখন দেশের তাপমাত্রা বেড়েই চলেছে বলে জানিয়েছেন আবহাওয়াবিদরা। দেশের ওপর মৌসুমী বায়ু সক্রিয় থাকায় গত ৬ জুলাই পর্যন্ত প্রায় সারাদেশেই ভারি বৃষ্টি হচ্ছিল। ৭ জুলাই থেকে বৃষ্টি কমে যায়। শনিবার ঢাকার আকাশে মেঘ ও রোদের খেলায় রোদের ভাগই ছিল বেশি। ভ্যাপসা গরমে অস্বস্তি বিরাজ করছে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে। আবহাওয়াবিদরা বলছেন, বাতাসে জলীয় বাষ্পের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় অস্বস্তিকর গরমে পড়েছে মানুষ। আগামী ২ থেকে ৩ দিন পর বৃষ্টির পরিমাণ বাড়লে তাপমাত্রা কমে গিয়ে স্বস্তি আসবে বলেও জানিয়েছেন তারা। আবহাওয়াবিদ হাফিজুর রহমান শনিবার বলেন, বৃষ্টি কমে যাওয়ায় সারাদেশের তাপমাত্রা বেড়ে গেছে। এ মুহূর্তে সারাদেশে গড়ে স্বাভাবিকের চেয়ে ১ থেকে ২ ডিগ্রী তাপমাত্রা বেশি। এখন যে তাপমাত্রা এটা সহনীয়, আমাদের এখানে তো তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রীতেও পৌঁছায়। তবে বৃষ্টি না হওয়ায় বাতাসে জলীয় বাষ্পের পরিমাণ বেড়ে গেছে। এজন্য গরমটা অস্বস্তিকর লাগছে। আগামী ২ থেকে ৩ দিনের মধ্যে বৃষ্টির প্রবণতা বাড়তে পারে জানিয়ে তিনি আরও বলেন, এখন যে বৃষ্টি হচ্ছে না তা নয়, তবে কম। আবহাওয়া অধিদফতর জানায়, শনিবার দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা তেঁতুলিয়ায় ৩৬.৫ এবং সর্বনিম্ন কুমারখালীতে ২৪.৫ ডিগ্রী সেলসিয়াস রেকর্ড হয়। আর ঢাকার সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড হয় যথাক্রমে ৩৪.১ ও ২৮ ডিগ্রী সেলসিয়াস। স্টাফ রিপোর্টার, কুড়িগ্রাম থেকে জানান, উজানের পাহাড়ী ঢলে কুড়িগ্রামে ব্রহ্মপুত্র নদের পানি চিলমারী পয়েন্টে বিপদসীমার ৩১ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে তিস্তা ও ধরলা নদীসহ শাখা নদীগুলোর। ফলে চিলমারী, রৌমারী, রাজিবপুর ও সদর উপজেলার শতাধিক চর ও দ্বীপচর প্লাবিত হয়ে পড়েছে। পানিবন্দী হয়ে পড়েছে নদ-নদী তীরবর্তী, চর ও দ্বীপচর এলাকার প্রায় ৪০ হাজার মানুষ। বন্যা কবলিত এলাকায় দেখা দিয়েছে বিশুদ্ধ খাবার পানির সঙ্কট। হাতে কাজ না থাকায় বিপাকে পড়েছে এসব এলাকার শ্রমজীবী মানুষ। ভেঙ্গে পড়েছে এসব এলাকার যোগাযোগ ব্যবস্থা। সদর উপজেলার যাত্রাপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মোঃ আইয়ুব আলী জানান, আমার ইউনিয়নের বেশিরভাগ এলাকা ব্রহ্মপুত্রের চর। চরাঞ্চলের সবগুলো ঘর-বাড়িতে পানি ঢুকে পড়েছে। বন্যাকবলিত মানুষেরা আমার নিকট সাহায্য চাইতে আসে। কিন্তু সরকারীভাবে এখনও কোন ত্রাণ সহায়তা না পাওয়ায় তাদের দেয়া সম্ভব হচ্ছে না। জরুরী ভিত্তিতে বন্যাকবলিত এলাকাগুলোতে ত্রাণ সহায়তা দেয়া হোক। জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, ঈদের আগে বন্যা কবলিত এলাকাসহ সকল ইউনিয়নে রিলিফের চাল দেয়া হয়েছে। বন্যার্তদের জন্য এখনও কোন বরাদ্দ দেয়া হয়নি। স্টাফ রিপোর্টার, নীলফামারী থেকে জানান, উজানের পানি ও নদী ভাঙ্গনে নীলফামারীর ৭টি চরের মানুষজনের ঈদ আনন্দ ভেসে গেছে। তিস্তা নদী ফুঁসে ওঠায় নীলফামারীর ডিমলা উপজেলার টেপাখড়বাড়ি ইউনিয়নের তিস্তা নদীর ওপারে তিনটি ওয়ার্ডের ৭টি গ্রাম যথাক্রমে চরখড়িবাড়ি পূর্বখড়িবাড়ি, টাপুরচর, ঝিঞ্জিরপাড়া, পুরাত টাপুরচর ও মেহেরটারী ও খালিশা চাঁপানী ইউনিয়নের ইউনুছের চরের ঘরবাড়ীতে পানি প্রবেশ করেছে। নদী ভাঙ্গনে ইউনুছের চরের ৪২টি পরিবারের বসতভিটা নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে। ওই চরের লোকজন ঘরের চালা ভেঙ্গে অন্যত্র চলে গেছে। ডালিয়া তিস্তা ব্যারাজের ভাটিতে তিস্তা নদীবেষ্টিত খালিশা চাঁপানী ইউনিয়নের পূর্ব বাইশপুকুর চরের ভেতরের ইউনুছের চর। নদী ঘেরা এই চরের পরিবারগুলো চরের জমিতে ফসল আবাদ ও তিস্তায় মাছ শিকার করে জীবন-জীবিকা চালালেও বন্যায় ভেসে গেছে তাদের ঈদের আনন্দ। সব কিছু হারিয়ে এসব মানুষ ঈদে ছেলে-মেয়েদের নতুন কোন কাপড়-চোপড় দিতে পারেনি। তারা ঈদ আনন্দকে শপে দিয়েছে প্রকৃতির হাতে। খালিশা চাঁপানী ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান সামশুল হুদা বলেন, চরবাসীকে ত্রাণের ২০ কেজি করে চাল দেয়া হয়েছে। টেপাখড়িবাড়ি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান রবিউল ইসলাম জানান, ওই সব এলাকার পরিবারগুলোতে ত্রাণের ২০ কেজি করে চাল দেয়া হয়েছে। এ ছাড়া নগদ টাকাও দেয়া হয় ৫শ’ টাকা করে। কিন্তু এ দিয়ে কি চলে তাদের। স্টাফ রিপোর্টার, কক্সবাজার থেকে জানান, ঈদের খুশি ভাগ করা আর হলো না কুতুবদিয়ার চার শিশুর। জোয়ারের পানিতে ভেসে মারা গেছে তারা। একজন সরকারী কর্মচারীর মনগড়া সøুইচ গেটের দরজা লাগানোর কারণে পানি সরে যেতে না পেরে শিশুদের মর্মান্তিক মৃত্যু ঘটেছে বলে অভিযোগ উঠেছে। বৃহস্পতিবার বিকেলে দ্বীপের মনছুর আলী হাজির পাড়ায় এ ঘটনা ঘটে। মৃত শিশুরা হলো- আবুল হোসাইনের কন্যা নয়ন মনি (১১), আকতার হোসাইনের পুত্র মিছবাহ উদ্দিন (৭), কামাল হোসাইনের কন্যা সুমি আকতার (৮) ও কায়ছার হামিদের কন্যা পিয়া মণি (৫)। স্থানীয়রা জানান, ওই চার শিশু বিকেলে ঈদের খুশি ভাগ করার জন্য নিকটস্থ স্বজনের বাড়িতে যাচ্ছিল। ওই সময় ভাঙ্গা বেড়িবাঁধ দিয়ে জোয়ারের পানিতে রাস্তা তলিয়ে যায়। এক পর্যায়ে প্রবল স্রোতের তোড়ে ভেসে যায় অবুঝ শিশুরা। খবর পেয়ে স্বজনরা বহু খোঁজাখুঁজির পর সন্ধ্যায় তাদের উদ্ধার করে মুমূর্ষু অবস্থায়। কুতুবদিয়া স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাদের মৃত ঘোষণা করেন। কুতুবদিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) রবিউল আলম বলেন, মৃত শিশুর পরিবারের অভিভাবক প্রত্যেককে ১৫ হাজার টাকা ও ১ বস্তা করে চাল দেয়া হয়েছে। কুতুবদিয়ায় জোয়ারের পানি প্রবেশ অব্যাহত রয়েছে এবং জনসাধারণকে সজাগ থাকার অনুরোধ করেছেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা। ঘূর্ণিঝড় রোয়ানুর আঘাতে বিধ্বস্ত বেড়িবাঁধ দিয়ে প্রতিনিয়ত জোয়ারের পানি প্রবেশ করছে কুতুবদিয়ায়। অমাবস্যার জোয়ারের পানির উচ্চতা বেড়ে তলিয়ে গেছে কুতুবদিয়ার উত্তর ধুরুং, আলী আকবর ডেইল, দক্ষিণ ধুরুং, লেমশীখালী ও কৈয়ার বিল ইউনিয়নের ৩০টিরও বেশি গ্রাম। ভেসে গেছে অসংখ্য ঘরবাড়ি, হাঁস মুরগি, মৎস্য ও গবাদি পশু। অনাবাদী হয়ে পড়েছে হাজার হাজার একর ফসলি জমি। রাস্তাঘাট তলিয়ে যাওয়ায় মানুষের স্বাভাবিক জীবন দুর্বিসহ হয়ে উঠেছে। অতিবৃষ্টি এবং অমাবস্যার জোয়ারের পানির উচ্চতা বৃদ্ধি পাওয়ায় বর্তমানে কুতুবদিয়ার হাজারো মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। জোয়ার-ভাটার বৃত্তে বন্দী যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন ওসব পাড়ার মানুষ আশ্রয়কেন্দ্রে দুর্বিসহ কালাতিপাত করছেন।
×