ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

শোলাকিয়ার ঘটনায় নিহত দুই পুলিশ সদস্য, এক জঙ্গী ও এক গৃহবধূ;###;গুলশান-শোলাকিয়ায় হামলাকারীদের ট্রেনিং হয় একই সঙ্গে ;###;উচ্চবিত্ত ও মাদ্রাসা ছাত্রের সমন্বয়ে গঠিত জঙ্গী দল;###;র‌্যাবের সূত্র অনুযায়ী নিখোঁজের সংখ্যা ১৩৭

গুলশান থেকে শোলাকিয়া

প্রকাশিত: ০৫:৪৯, ১০ জুলাই ২০১৬

গুলশান থেকে শোলাকিয়া

শংকর কুমার দে/মাজহার মান্না ॥ রাজধানীর গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে যারা হামলা করে ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছিল সেই একই জঙ্গীগোষ্ঠী জেএমবি হামলা চালিয়েছে কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়ায়। এ ধরনের স্বীকারোক্তিমূলক জবানব›ীদ দিয়েছে শোলাকিয়ায় সন্ত্রাসী হামলার সময়ে আহতাবস্থায় র‌্যাবের হাতে আটক জঙ্গী দিনাজপুরের ঘোড়াঘাটের রানীগঞ্জ বাজার এলাকার শরীফুল ইসলাম আবু মোকাতিল। দেশে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করে বিদেশের দৃষ্টি আকর্ষণের উদ্দেশ্যে সরকারকে বেকায়দায় ফেলার জন্য এসব জঙ্গী হামলাগুলোর পেছনে জামায়াত-শিবির, পাকিস্তান ও তাদের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই জড়িত বলে মনে করছে গোয়েন্দা সংস্থা। গোয়েন্দা সংস্থার তদন্তে উঠে এসেছে, সমাজের বিত্তবান ও উচ্চশিক্ষিত উঠতি বয়সী বিপথগামী তরুণদের মগজধোলাই (ব্রেনওয়াশ) করে আত্মঘাতী পথে ঠেলে দিয়ে এ ধরনের জঙ্গী হামলায় উৎসাহী করে তোলা হচ্ছে। তাদের উত্তেজক কিছু খাইয়ে নির্মম ও নৃশংসভাবে হত্যাকা-ের জন্য প্রস্তুত করা হচ্ছে কি-না তার ডিএনএ পরীক্ষা করা হচ্ছে। সারাদেশ থেকে দেড় শ’ থেকে দুই শতাধিক বিত্তবান ঘরের উচ্চশিক্ষিত তরুণ যারা নিখোঁজ রয়েছে, যাদের ফিরে আসার আহ্বান জানানো হচ্ছে, তারা জঙ্গীগোষ্ঠীর সঙ্গে জড়িয়ে গেছে বলে মনে করা হচ্ছে। জঙ্গীগোষ্ঠীর সন্ত্রাসী হামলাকারীর আশ্রয়দাতা, নির্দেশদাতা, অর্থদাতা, মদদদাতাদের খুঁজে বের করার জন্য তদন্ত ও অনুসন্ধান করছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থা। গোয়েন্দা সংস্থার দেয়া তদন্ত প্রতিবেদনে জানা গেছে, কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়ায় জঙ্গী হামলায় নিহত দুই পুলিশ সদস্য, এক জঙ্গী সদস্য ও এক গৃহবধূ ঝর্না রানী ভৌমিক- এ চারজন খুন হয়েছেন এবং অন্তত পনেরোজন আহত হয়েছেন। জঙ্গী হামলার সময় ঘটনাস্থলে আহতাবস্থায় ধরা পড়া শরীফুল ইসলাম আবু মোকাতিল নামের এক জঙ্গী সদস্য গুলশানের জঙ্গী হামলার ঘটনায় জড়িতদের সঙ্গে যোগাযোগ থাকার কথা স্বীকার করেছে। সন্ত্রাসী হামলায় সরাসরি জড়িত ছিল পাঁচ থেকে ছয়জন ও তাদের পেছনে আরও কয়েকজন জঙ্গী সদস্য ছিল বলে জানিয়েছে ধরা পড়া এই জঙ্গী। তার দেয়া জবানবন্দীর সূত্র ধরে পুলিশ, র‌্যাব, বিজিবি, গোয়েন্দা সংস্থাসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা সন্ত্রাসী হামলাকারী সবাইকে খুঁজে বের করার চেষ্টার জন্য অভিযান পরিচালনা করছে। রাজধানীর গুলশানে জঙ্গীগোষ্ঠীর ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলার পর শোলাকিয়ায় ঈদের জামাত নিয়ে বাড়তি সতর্কতা ছিল। ব্যাগসহ অন্যান্য জিনিসপত্র নিয়ে মাঠে প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়। এ কারণে জঙ্গীগোষ্ঠী শোলাকিয়া ময়দানে সন্ত্রাসী হামলার পরিকল্পনা ভেস্তে যায়। যা ঘটেছে কিশোরগঞ্জে ॥ রাজধানীর গুলশানের মতো একই কায়দায় কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়া ময়দানে ঈদ-উল-ফিতরের জামাতের দিনে সন্ত্রাসী হামলা চালিয়েছে একই জঙ্গীগোষ্ঠী জামা’আতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ (জেএমবি)। ঘটনাস্থলে নিহত আবির রহমান নামের এক জঙ্গী যিনি নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির অধ্যয়নরত এক ছাত্র। তার বিষয়ে খোঁজখবর নেয়া হচ্ছে। সন্ত্রাসীদের কাছে থাকা উদ্ধার করা দুটি বিদেশী পিস্তল, কয়েক রাউন্ড গুলি, একটি চাপাতি ও ককটেল পরীক্ষা করা হচ্ছে। পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) একটি টিম ও ক্রাইমসিন ইউনিট ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে আলামত সংগ্রহ করেছে। গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে যারা হামলা করে ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছিল, একই জঙ্গীগোষ্ঠী শোলাকিয়ায়ও হামলা চালিয়েছে এবং তারা নিষিদ্ধ জঙ্গী সংগঠন জামা’আতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশের (জেএমবি) সদস্য বলে মন্তব্য করেছেন পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) একেএম শহীদুল হক। কিশোরগঞ্জ থেকে নিজস্ব প্রতিনিধি মাজহার মান্না জানান, কিশোরগঞ্জের ঐতিহাসিক শোলাকিয়ার ঈদ জামাতকে টার্গেট করে হামলা চালিয়েছে সন্ত্রাসীরা। এজন্য দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে পাঁচজনের একটি দল ২৭ রমজানের দিন কিশোরগঞ্জে এসে অবস্থান নেয়। পরিকল্পনা অনুযায়ী বৃহস্পতিবার ঈদের দিন সকালে সন্ত্রাসীরা মুসল্লি বেশে শোলাকিয়া ঈদগাহে প্রবেশের জন্য শহরের আজিমউদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয়সংলগ্ন সবুজবাগ এলাকার রাস্তাটিকে বেছে নেয়। সকাল পৌনে ৯টার দিকে বিদ্যালয়ের সামনে পুলিশ চেকপোস্টে দেহতল্লাশির সময় একদল সন্ত্রাসী হাতবোমা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে ও চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে দায়িত্বরত ১০ পুলিশ সদস্যকে আহত করে। তাছাড়া সন্ত্রাসী-পুলিশের সংঘর্ষে আরও তিনজন পথচারী আহত হয়েছে। এ সময় আহত পুলিশ সদস্যরা আত্মরক্ষার্থে আশপাশের বিভিন্ন জায়গায় আশ্রয় নিতে ছোটাছুটি করে। তাদের মধ্যে কনস্টেবল জহিরুল ইসলাম (৩০) চেকপোস্টসংলগ্ন মুফতি মোহাম্মদ আলী (রহ) জামে মসজিদের সড়কের ওপর অবস্থিত টয়লেটে আশ্রয় নেয়ার চেষ্টাকালে তাকে চাপাতি দিয়ে কোপায় হামলাকারীরা। পরে অতিরিক্ত পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে হামলাকারীদের ধাওয়া করলে তারা সবুজবাগ এলাকার বাসাবাড়িতে ঢুকে পড়ে। পরে সেখান থেকে তারা পুলিশকে লক্ষ্য করে হাতবোমা নিক্ষেপ ও গুলি চালাতে থাকে। এ সময় পুলিশ গুলি চালালে তারাও পাল্টা গুলি ছোড়ে। বন্দুকযুদ্ধে পুলিশের গুলিতে আবির রহমান (২২) নামে এক সন্ত্রাসী ঘটনাস্থলেই ও চরশোলাকিয়া সবুজবাগের এলাকার ঝর্না রানী ভৌমিক (৪৫) নামে এক গৃহবধূ মাথায় গুলিবিদ্ধ হয়ে নিজ বাসাতেই মৃত্যুবরণ করেন। এছাড়া জহিরুল ইসলাম (নং-১৪৭৬) ও আনসারুল হক (নং-১৪৩০) নামে পুলিশের দুই কনস্টেবল ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট জেলা হাসপাতালে ও ময়মনসিংহ সিএমএইচ হাসপাতালে নেয়ার পর মারা যান। পুলিশ সূত্র জানায়, সংঘর্ষে নিহত সন্ত্রাসী আবির রহমানের লাশের কিছুটা দূরে একটি চাপাতি পড়ে থাকতে দেখা যায়। তার ঢোলা পোশাকে অস্ত্র রাখার ‘বিশেষ পকেট’ ছিল। সে সময় তার পরিচয় জানা যায়নি। নীল পাঞ্জাবি ও পায়জামা পরিহিত ওই যুবককে শনাক্ত করে তার পরিবারের লোকজন। শুক্রবার বিকেলে জেলা পুলিশ নিহতের পরিচয় সাংবাদিকদের কাছে প্রকাশ করে। এদিকে সংঘর্ষের একপর্যায়ে বন্দুকযুদ্ধে নিহত সন্ত্রাসী আবির রহমানের কাছ থেকে পুলিশ হামলায় ব্যবহৃত একটি ধারালো চাপাতি ও একটি পিস্তল উদ্ধার করেছে। এছাড়া ঘটনাস্থল থেকে পুলিশ দুটি বিদেশী পিস্তল, কয়েক রাউন্ড গুলি, একটি চাপাতি ও ককটেল উদ্ধার করেছে। অন্যদিকে শরীফুল ইসলাম আবু মোকাতিল নামে অপর এক সন্ত্রাসীকে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় আটক করেছে র‌্যাব-১৪। এ সময় তার কাছ থেকে হামলায় ব্যবহৃত একটি ধারালো চাপাতি ও একটি পিস্তল উদ্ধার করা হয়েছে। সন্ত্রাসী হামলায় নিহত পুলিশ কনস্টেবল জহিরুল ইসলাম (নং-১৪৭৬) ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া থানার ভাটিপাড়া গ্রামের আঃ মজিদের ছেলে। অপরজন পুলিশ কনস্টেবল আনসারুল হক (নং-১৪৩০) নেত্রকোনার মদন থানার দৌলতপুর গ্রামের সিদ্দিকুর রহমানের ছেলে। অন্যদিকে সংঘর্ষ চলাকালে সবুজবাগের বাসিন্দা ঝর্না রানী ভৌমিক (৪৫) নামে এক গৃহবধূ মাথায় গুলিবিদ্ধ হয়ে নিজ বাসাতেই মৃত্যুবরণ করেন। তিনি ওই এলাকার ব্যবসায়ী গৌরাঙ্গ চন্দ্র ভৌমিকের স্ত্রী। এছাড়া সংঘর্ষে ঘটনাস্থলেই নিহত সন্ত্রাসী আবির রহমান কুমিল্লার দেবীদ্বার উপজেলার ত্রিবিদ্যা গ্রামের সিরাজুল ইসলামের ছেলে। সে নর্থসাউথ ইউনিভার্সিটির বিবিএ’র ফাইনাল ইয়ারের ছাত্র। সংঘর্ষে আহত পুলিশ সদস্যদের উদ্ধার করে ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক জহিরুল ইসলাম নামে এক কনস্টেবলকে মৃত ঘোষণা করেন। অপর কনস্টেবল আনসারুল হক (২৮) ময়মনসিংহের সিএমএইচ হাসপাতালে মারা যান। আহত অন্য ছয় পুলিশ সদস্য এসআই নয়ন মিয়া (৩০), কনস্টেবল রফিকুল (৩০), প্রশান্ত (৩২), তুষার আহাম্মদ (৩০), জুয়েল (৩৫) ও মশিউরকে (৩২) আশঙ্কাজনক অবস্থায় প্রথমে ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়। পরে তাদের ময়মনসিংহের সিএমএইচে নেয়া হয়। সেখান থেকে তাদের হেলিকপ্টারে ঢাকার সিএমএইচে নেয়া হয়েছে। এছাড়া আহত অন্যরা হলেনÑ জেলার হোসেনপুরের হুগলাকান্দি গ্রামের আবুল হোসেনের ছেলে হৃদয় (১৮), শহরের হারুয়া এলাকার মাহতাব উদ্দিনের ছেলে মোতাহার (২২), এমদাদুল হক (২৫) ও টেংরা বাজারের অটোরিক্সাচালক আব্দুর রহিম (৪০)। তাদের জেলা হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। এদিকে সংঘর্ষ চলাকালে পুলিশ ও র‌্যাব অভিযান চালিয়ে হামলাকারী সন্দেহে তিনজনকে আটক করেছে। আটককৃতরা হলোÑ দিনাজপুরের ঘোড়াঘাটের রানীগঞ্জ বাজার এলাকার আঃ হাইয়ের ছেলে শরীফুল ইসলাম আবু মোকাতিল (২০), শহরের পশ্চিম তারাপাশার বাসিন্দা আব্দুস সাত্তারের ছেলে জাহিদুল হক (২৪) ও শহরের বয়লার বাসিন্দা আব্দুল হাইয়ের ছেলে আহসান উল্লাহ (২৫)। তাদের মধ্যে শরীফুল ইসলাম আবু মোকাতিল গুলিবিদ্ধ অবস্থায় র‌্যাবের হাতে আটক হয়। তাকে প্রথমে জেলা হাসপাতালে ও পরে আশঙ্কাজনক অবস্থায় ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়। তার কাছ থেকে দুটি পিস্তল উদ্ধার করা হয়েছে। অন্যদিকে বন্দুকযুদ্ধে নিহত সন্ত্রাসী আবির রহমানের কাছ থেকে হামলায় ব্যবহৃত একটি ধারালো চাপাতি ও একটি পিস্তল উদ্ধার করা হয়েছে। এর আগে পুলিশের সঙ্গে অভিযানে যোগ দেয় র‌্যাব ও বিজিবি। পরে পুলিশ ও বিজিবির সমন্বয়ে যৌথবাহিনী সবুজবাগ এলাকার বাসাবাড়িতে ব্যাপক তল্লাশি চালায়। ওস্তাদের এ্যাসাইনমেন্ট নিয়ে ॥ সন্ত্রাসী হামলার সময় আটক জঙ্গী শরীফুল ইসলাম আবু মোকাতিলের দিনাজপুরের ঘোড়াঘাটের এক মাদ্রাসা থেকে তার আলিম পরীক্ষা দেয়ার কথা ছিল। পরীক্ষা না দিয়ে ‘ওস্তাদের’ কথায় ‘এ্যাসাইনমেন্ট নিয়ে’ সে কিশোরগঞ্জ আসে। তার সঙ্গে হামলায় আরও পাঁচজন ছিল। তাদের সে চেনে না বলে র‌্যাবের কাছে দাবি করেছে। শোলাকিয়ার ঈদ জামাতকে টার্গেট করে তারা হামলার পরিকল্পনা করেছিল। এজন্য পাঁচ সদস্যের একটি সন্ত্রাসী দল ২৭ রমজানের দিনই কিশোরগঞ্জে এসে অবস্থান নিয়েছিল। এই তিন দিন তারা ঈদগাহ এলাকাসহ প্রবেশপথ রেকি করে সন্ত্রাসী হামলার পরিকল্পনা করেছে। অজ্ঞাত স্থান থেকে ফোন করত ॥ শোলাকিয়া ঈদগাহ মাঠের কাছে হামলার ঘটনায় আটক ‘সন্দেহভাজন জঙ্গী’ শফিউল গত প্রায় এক বছর বাড়িতে আসেনি। তবে মাঝেমধ্যে সে অজ্ঞাত স্থান থেকে ফোন করত। শফিউল দিনাজপুরের বিরামপুর উপজেলার বিজুল দারুল হুদা স্নাতকোত্তর মাদ্রাসার আলিম শ্রেণীর ছাত্র। শফিউলের বাড়ি দিনাজপুরের ঘোড়াঘাট উপজেলার নূরপুর গ্রামে। তার বাবার নাম আবদুল হাই। তিনি স্ত্রী এবং ছোট মেয়েকে নিয়ে ঢাকায় চলে যান। বড় মেয়ে ও শফিউল মাদ্রাসার হোস্টেলে থেকে লেখাপড়া করত। তখন থেকেই শফিউল পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। নিখোঁজ ছেলেদের জন্য অভিভাবকদের প্রতি আহ্বান ॥ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বৃহস্পতিবার রাতেও অভিভাকদের কাছে আবেদন করেছেন, ছেলে নিখোঁজ থাকলে পুলিশকে জানান। র‌্যাবের প্রধান বেনজীর আহমেদও বলেছেন, তাঁরা ইতোমধ্যেই বিশেষ দল গঠন করেছেন। নিখোঁজদের সন্ধান শুরু হয়েছে। গত এক বছরে অন্তত ১৩৭ কিশোরের নিখোঁজ হওয়ার খবর পেয়েছে পুলিশ। তবে লোকলজ্জায় অনেকেই পুলিশকে খবর না দেয়ায় প্রকৃত নিখোঁজের সংখ্যা আরও বেশি বলেই তাঁদের ধারণা। এদের একটা বড় অংশ বিত্তশালী পরিবারের। নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয় ॥ কিশোরগঞ্জে হামলার জন্য জেএমবি (জামা’আতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ) জঙ্গীদেরই দুষছে পুলিশ। দুই হামলাকারীর পরিচয়ও জানা গেছে। একজন পুলিশের গুলিতে মারা গেলেও একজনকে ধরা সম্ভব হয়েছে। তাকে জেরা করে অনত নয়জনকে আটক করা হয়েছে। ধৃত তরুণ জেএমবির প্রথম সারির চাঁই। পুলিশের গুলিতে নিহত তরুণ আবির রহমান (১৯) বেসরকারী নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিল। গত শুক্রবার গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারির অন্যতম হামলাকারী নিবরাস ইসলামও এই বিশ্ববিদ্যালয়েরই ছাত্র ছিল। নিবরাস ও আবির একই সঙ্গে জঙ্গী সংগঠনে নাম লিখিয়েছিল বলে পুলিশের ধারণা। একসঙ্গে তারা অস্ত্র প্রশিক্ষণও নিয়ে থাকতে পারে। ধৃত আরেক জঙ্গী শফিউদ্দিন সোহান জামায়াতে ইসলামীর ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবিরের নেতা হিসেবে পরিচিত ছিল। পরে সে জেএমবিতে যোগ দেয়। এর আগে ব্লগার রাজীব হত্যা মামলায় চার্জশীটভুক্ত পাঁচ ছাত্রও নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়েরই ছাত্র। দুই কনস্টেবলের দাফন সম্পন্ন, অনুদান প্রদান ॥ শোলাকিয়ায় সন্ত্রাসী হামলায় নিহত দুই পুলিশ কনস্টেবল (নং-১৪৭৬) জহিরুল ইসলাম (৩০) ও (নং-১৪৩০) আনসারুল হকের (৩০) জানাজা শেষে তাদের নিজ গ্রামের বাড়িতে দাফন সম্পন্ন করা হয়েছে। অন্যদিকে পুলিশের সঙ্গে সন্ত্রাসীদের প্রায় তিন ঘণ্টা বন্দুকযুদ্ধ চলাকালে নিহত সবুজবাগের বাসিন্দা গৃহবধূ ঝর্ণা রাণী ভৌমিকের (৪৫) মরদেহও দাহ করা হয়েছে। কিশোরগঞ্জ পুলিশ লাইনে নিহত পুলিশ কনস্টেবল জহিরুলের জানাজা শেষে মরদেহ নিজগ্রাম ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া থানার ভাটিপাড়া বালাশর গ্রামে পাঠালে ওইখানে রাত সাড়ে ১২টায় তাঁর লাশ দাফন সম্পন্ন হয়। এছাড়া নিহত অপর পুলিশ সদস্য আনসারুল হকের জানাজা বৃহস্পতিবার বিকেল সাড়ে ৪টায় ময়মনসিংহ পুলিশ লাইন্স জামে মসজিদ প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত হয়েছে। ওইদিন রাত সাড়ে ৮টায় নিজগ্রাম নেত্রকোনার মদন থানার দৌলতপুরে তাঁর লাশ দাফন করা হয়েছে। এদিকে পুলিশের মহাপরিদর্শক একেএম শহীদুল হক শোলাকিয়া হামলায় নিহত দুই পুলিশ কনস্টেবলের পরিবারকে তাৎক্ষণিকভাবে এক লাখ টাকা করে অনুদান দিয়েছেন বলে জানা গেছে। দুই চায়নিজ কুড়াল ও চাপাতি উদ্ধার ॥ সন্ত্রাসী হামলার পরদিন শুক্রবার দুপুরে কিশোরগঞ্জ আজিমউদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয় সংলগ্ন চর শোলাকিয়া এলাকায় অভিযান চালিয়ে একটি পুকুর থেকে দুটি চায়নিজ কুড়াল ও একটি চাপাতি উদ্ধার করা হয়েছে। এ অস্ত্রগুলো ঈদের দিন সকালে সংঘর্ষের সময় সন্ত্রাসীদের ব্যবহৃত হয়ে থাকতে পারে বলে র‌্যাব-১৪ এর কিশোরগঞ্জ ক্যাম্পের অধিনায়ক রাজীব কুমার দেব জানিয়েছেন। আটক ৮ জনের মধ্যে ৬ জনকে ছেড়ে দেয়া হয়েছে ॥ জেলা পুলিশ সুপার আনোয়ার হোসেন খান জানান, শোলাকিয়ায় হামলার ঘটনায় কিশোরগঞ্জ মডেল থানায় মামলা দায়েরের পস্তুতি চলছে। এ পর্যন্ত ৮ জনকে আটক করা হয়েছিল। তাদের মধ্যে দুইজন সন্দেহভাজন হামলাকারী। বাকি ৬ জনকে জিজ্ঞাসাবাদ করে ছেড়ে দেয়া হয়েছে। বিশেষ নিরাপত্তার কারণে পুলিশ এখনও হামলাস্থলে অবস্থান করছে। এছাড়া চরশোলাকিয়া সবুজবাগ এলাকায় পুলিশের তল্লাশি অভিযান অব্যাহত রয়েছে। দু’শ’ বছরের মধ্যে এই প্রথম ॥ প্রায় দু’শ’ বছরের মধ্যে এই প্রথমবারের মতো কিশোরগঞ্জের ঐতিহাসিক শোলাকিয়া ময়দানে সন্ত্রাসী হামলা চালিয়েছে জঙ্গী গোষ্ঠী। এটা ছিল কিশোরগঞ্জের ঐতিহাসিক শোলাকিয়া ময়দানে ১৮৯তম ঈদ-উল-ফিতরের জামাত। প্রায় দু’শ’ বছর ধরে জামাত অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। কিন্তু এমন হৃদয়বিদারক ঘটনা এর আগে কখনও দেখেনি কিশোরগঞ্জবাসী। প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ অনুযায়ী, সকাল নয়টার দিকে মুসল্লিরা যখন নামাজের জন্য শোলাকিয়ার মাঠে যাচ্ছিলেন তখন চাপাতি হাতে কয়েকজন যুবককে দৌড়াদৌড়ি করতে দেখি। এসময় মাঠের পাশেই আজিমউদ্দীন স্কুলের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা টহল পুলিশের একটি দল তাদের দিকে এগিয়ে গেলে বোমা হামলা করে দুর্বৃত্তরা। তখন প্রাণ ভয়ে যে যেদিকে পারে দৌড়ে আত্মরক্ষার চেষ্টা করেন। প্রত্যক্ষদর্শীর ঘটনার বর্ণনা ॥ কিশোরগঞ্জের ঐতিহাসিক শোলাকিয়া ঈদগাহ ময়দানের পাশে বোমা হামলার ঘটনার বর্ণনা দেন প্রত্যক্ষদর্শীরা। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, হামলাকারীরা সংখ্যায় ৮-১০ জন ছিল। বোমা হামলার পর পুলিশ ও হামলাকারীদের মধ্যে দফায় দফায় গুলিবিনিময় হয়। হামলাকারীরা প্রথমে আজিমউদ্দিন স্কুলের আশপাশের বাড়িতে গিয়ে ঢুকে পুলিশের ওপর গুলি চালায়। এ সময় পুলিশও পাল্টা অবস্থান নিয়ে গুলি করে। গুলশানের সন্ত্রাসী হামলার পর এবার শোলাকিয়া মাঠে প্রবেশে সর্বোচ্চ কড়াকড়ি ও কঠোর নিরাপত্তা ছিল। মাঠে প্রবেশের সব পথে নিরাপত্তা চৌকি বসানো হয়। মুসল্লিদের ব্যাগ ও দেহ তল্লাশি করে মাঠে প্রবেশ করতে দেয়া হয়। এই ধরনের কড়াকড়ি ও কঠোর তল্লাশি না করলে সাধারণ মুসল্লিদের সাথে নির্বিঘেœ মাঠে প্রবেশ করে আরও বড় ধরনের ভয়াবহ নাশকতা ও প্রাণহানির জঘন্যতম ঘটনা ঘটত বলে মনে করছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কড়াকড়ি ও কঠোর নিরাপত্তার মাঝেই লাখ লাখ মুসল্লি মাঠে প্রবেশ করেন। সকাল সাড়ে ৮টার মধ্যেই কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে যায় পুরো মাঠ। সন্ত্রাসী হামলার খবর পুলিশ ও মাঠে উপস্থিত সুশীল সমাজের নেতৃবৃন্দ জানতে পারলেও আগত মুসল্লিদের তা জানতে দেয়া হয়নি। দূরদর্শী সিদ্ধান্তের কারণেই মাঠে কোন গোলযোগ হয়নি। জামাতে ইমামতি করার কথা ছিল মাওলানা ফরিদউদ্দিন মাসুদের। হেলিকপ্টারযোগে তিনি কিশোরগঞ্জ এলেও নিরাপত্তার কারণে তিনি মাঠে আসেননি। তিনি না আসার পরও মাওলানা সোয়েবকে দিয়ে নামাজ সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণভাবে শেষ করা হয়। সন্দেহ হয়, কিছু একটা হয়েছে ॥ শোলাকিয়ার মূল ইমাম মাওলানা ফরিদ উদ্দিন মাসউদের অনুপস্থিতিতে ঈদ জামাতের প্রথম ইমামতি শুরু করেন কিশোরগঞ্জের বড়বাজার এলাকার শাহাবুদ্দীন মসজিদের ইমাম সোয়াইব আবদুর রউফ। সকাল নয়টা থেকে নয়টা ৪০ মিনিট পর্যন্ত তার বয়ান (বক্তৃতা) করার কথা থাকলেও নির্দিষ্ট সময় পার হয়ে যায়। কিন্তু মাওলানা ফরীদউদ্দিন মাসউদ আসছেন না, আবার কেউ সোয়াইবকে বয়ান থামাতে বলছে না। তখন তাকে ইশারা দেয়া হলো, বয়ান চালিয়ে যান। এতেই তার প্রথম সন্দেহ হয়, কোথাও কিছু একটা সমস্যা হয়েছে। জামাত শেষে মাইকে ঘোষণা ॥ শোলাকিয়া ময়দানে জামাত শেষ হওয়ার পর মাইকে যখন ঘোষণা দেয়া হয়- ‘আপনারা পশ্চিম দিকের সড়ক দিয়ে যাবেন না।’ তখন মুসল্লিরা ঘটনা কিছুটা আঁচ করতে পেরে এদিক-সেদিক ছুটে যান। শোলাকিয়ায় জঙ্গী গোষ্ঠীর সন্ত্রাসী হামলায় হতাহতের ঘটনা ছড়িয়ে পড়ে সবার মুখে মুখে। কে এই জঙ্গী আবির ॥ কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়ায় সন্ত্রাসী হামলাকারী নিহত জঙ্গী সদস্য আবির রহমান নিখোঁজ ছিল চার মাস ধরেই। শোলাকিয়ায় নিহত হওয়ার আগের দিন তাঁর নিখোঁজ থাকার বিষয়ে পরিবারের পক্ষ থেকে সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করে রাজধানীর ভাটারা থানায়। পরিবারটি ফেসবুক ও গণমাধ্যমে ছবি দেখে স্বজনেরা জানতে পারেন, শোলাকিয়ায় নিহত হয়েছেন আবির। আবির রহমানের বাবার নাম সিরাজুল ইসলাম। রাজধানীতে তাদের বাড়ি, ঢাকার বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায়। তাঁর বাবা ঠিকাদারি করেন। চার ভাইয়ের মধ্যে সবার ছোট আবির বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় নর্থ সাউথে বিবিএ পড়তেন। এর আগে তিনি ‘ও’ লেভেল ও ‘এ’ লেভেল সম্পন্ন করেন বাংলাদেশ ইন্টারন্যাশনাল টিউটোরিয়ালে (বিআইটি)। আবিরদের গ্রামের বাড়ি কুমিল্লার দেবীদ্বার উপজেলায়। ভাটারা থানার কর্তব্যরত কর্মকর্তা জিডির বিষয়ে বলেছেন, আবিরের পরিবার ৬ জুলাই জিডি করে। এতে বলা হয়, গত মার্চ থেকে নিখোঁজ আবির। মার্চের ১ তারিখের পর থেকে তার সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ নেই। নিহত আবিরের বাবা সিরাজুল ইসলাম গণমাধ্যমকে বলেন, আবির ছেলেবেলা থেকে চুপচাপ ও শান্ত স্বভাবের ছিল। বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়েও উশৃঙ্খল হয়ে পড়ার মতো স্বভাব লক্ষ্য করা যায়নি। ছোটবেলা থেকেই নামাজ পড়ত সে। গত মার্চ মাসের ১ তারিখ বলে, পড়াশোনা করতে মালয়েশিয়ায় যাবে। আমি বলি, তোমার দুই ভাই থাকে অস্ট্রেলিয়ায়, পড়াশোনা শেষ করে অস্ট্রেলিয়ায় যাও। কিন্তু সে মানতে চায়নি। এ নিয়ে বাগ্বিত-া হয়। পরে ওই দিন সে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়। আর ফিরে আসেনি। ভেবেছিলাম ছেলেটা তো ছোট, রাগ করে হয়ত বা মালয়েশিয়া চলে গেছে, আবার ফিরে আসবে। কিন্তু এমন কাজে জড়িয়েছে বুঝতেই পারিনি। গুলশানে রেস্তরাঁয় হামলার ঘটনার পর সন্দেহ হয়। তারপর জিডি করি। নিহত আবিরের বাবা সিরাজুল ইসলাম বলেন, আর কোন বাবার যেন এমন পরিস্থিতিতে পরতে না হয়। সব বাবা-মার কাছে আহ্বান, সন্তানদের খোঁজ নিন। কোথায় যায়, কী করে খোঁজ নিন। কাউকে যেন আমার মতো বিপর্যস্ত হতে না হয়-বললেন নিহত আবিরের বাবা। শোলাকিয়ার ভিডিওতে অস্ত্র হাতে হামলাকারী দুই তরুণ ॥ ঈদ জামাতের আগে শোলাকিয়া ঈদগাহ ময়দানের প্রবেশ পথে হামলার একটি ভিডিও চিত্রে অস্ত্র হাতে দৌড়াতে দেখা গেছে দুই তরুণকে। বৃহস্পতিবার সকালে হামলাস্থল শোলাকিয়া মাঠের কাছের আজিম উদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয়ের পাশের সবুজবাগের একটি ভবনের ছাদে বসানো সিসি ক্যামেরায় ওই চিত্র ধরা পড়েছে বলে জানিয়েছে পুলিশ। পুলিশ বলেছে, সকাল ৮টা ৪৩ মিনিট থেকে ওই ভিডিওচিত্র ধারণ হয়েছে। এ ঘটনার একটি ভিডিও ফেসবুকে ভাইরাল হয়েছে, যেখানে পাঞ্জাবি পরা একজন পুলিশ কর্মকর্তাকে অন্য সহকর্মীদের থেকে এগিয়ে গিয়ে হামলাকারীদের বিরুদ্ধে গুলি ছুড়তে দেখা গেছে। একটি দেয়ালের পাশে দাঁড়িয়ে গুলিবর্ষণের এক পর্যায়ে বিপরীত দিক থেকেও কয়েকটি গুলির শব্দ পাওয়া যায়, সে সময় পাশে সরে গিয়ে আত্মরক্ষা করতে দেখা যায় ওই পুলিশ কর্মকর্তাকে। ভিডিওতে পায়জামা-পাঞ্জাবি ও টুপি পরা এক তরুণ ও দুই শিশুকে রাস্তার একপাশ দিয়ে দৌড়ে আসতে যায় আতঙ্কিত চেহারায়। একটু দাঁড়িয়ে পিছন থেকে চেয়ে আবার তারা দৌড় দেয়। এরপর একই দিক থেকে দৌড়ে আসতে দেখা যায় ভীত-সন্ত্রস্ত এক আনসার সদস্যকে। সে সময় পাশ থেকে রাস্তায় বেরিয়ে আসেন তিন তরুণী, যাদের গতিবিধিতেও হতবিহ্বলতার ছাপ। মুহূর্তের মধ্যে তাদের সবাইকে ওই দিকে এগোতে দেখা যায়, যেদিক থেকে দৌড়ে এসেছিলেন আগের চারজন।
×