ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

অধ্যাপক মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান

ঈদ-উল-ফিতরের তাৎপর্য ও মাহাত্ম্য

প্রকাশিত: ০৬:২০, ৫ জুলাই ২০১৬

ঈদ-উল-ফিতরের তাৎপর্য  ও মাহাত্ম্য

এক মাস সিয়াম সাধনার পর ঈদ-উল-ফিতর সারাবিশ্বের মুসলমানদের রোজা ভাঙ্গার খুশির উৎসব। এ এক অনাবিল উৎসব, সীমাহীন আনন্দ। বছরজুড়ে নানা প্রতিকূলতা, দুঃখ-কষ্ট, বেদনা সব ভুলে ঈদের দিনে মুসলমান মাত্রই পরস্পরের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে মিলিত হয়। পেছনের সব গ্লানি বিস্মৃত হয়। সাধ্যমতো নতুন পাজামা-পাঞ্জাবি-টুপি পরে পূত-পবিত্রতার সৌকর্যে ঈদগাহের পথে নামে ধর্মপ্রাণ মানুষ। ঈদের দিন সকাল থেকে রাত অবধি অপার আনন্দে ডুবে থাকে সবাই। ঈদ ধনী-গরিবের নির্মল আনন্দ ও পুণ্যের এক দুর্লভ অনুভূতি যা ভাগাভাগি করলে ক্রমশ বৃদ্ধি পায়। ঈদের নতুন চাঁদ দেখামাত্রই রেডিও-টিভি ও পাড়া-মহল্লার মসজিদের মাইকে ঘোষিত হয় খুশির বার্তা ‘ঈদ মোবারক’। সেইসঙ্গে চারদিকে শোনা যায় জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের বিখ্যাত রোজার ঈদের গান : ‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশীর ঈদ/তুই আপনারে আজ বিলিয়ে দে শোন আসমানি তাগিদ...।’ ঈদ মানবসমাজের ধনী-গরিব ব্যবধান ভুলিয়ে দেয়ার একটি দিন। ঈদের দিনে সবাই সমান। ঈদের দুই রাকাত নামাজ হলো বার্ষিক নামাজ। মসজিদে, ময়দানে ঈদের নামাজে বিপুল সংখ্যক ধর্মপ্রাণ মুসলিমের সমাগম হয়ে থাকে। সবাই সুশৃঙ্খলভাবে কাতারবদ্ধ হয়ে ঈদের নামাজ পড়েন। ঈদের দিনে ধনী-গরিব, বাদশা-ফকির, মালিক-শ্রমিক নির্বিশেষে সব মুসলমান এক কাতারে ঈদের নামাজ আদায় ও একে অপরের সঙ্গে আলিঙ্গন করে সাম্যের জয়ধ্বনি করেন। হাদিস শরিফে বর্ণিত আছে, ‘যারা ঈদের নামাজ আদায় করার জন্য ময়দানে একত্রিত হয়, আল্লাহ তাআলা তাদের সম্পর্কে ফেরেশতাদের জিজ্ঞাসা করেন, যারা স্বেচ্ছায় দায়িত্ব পালন করে আজ এখানে উপস্থিত হয়েছে তাদের কি প্রতিদান দেওয়া উচিত? ফেরেশতারা বলেন, তাদের পুণ্যময় কাজের সম্পূর্ণ পারিশ্রমিক দেওয়া উচিত। তখন আল্লাহ তাআলা তাঁর মর্যাদার শপথ করে বলেন, অবশ্যই তিনি তাদের প্রার্থনা কবুল করবেন। এরপর আল্লাহ তাআলা ঈদের নামাজ সমাপনকারী তাঁর নেক বান্দাদের উদ্দেশে ঘোষণা করেন, আমি তোমাদের ক্ষমা করে দিয়েছি। আর তোমাদের কৃত অতীত পাপকে পুণ্যে পরিণত করে দিয়েছি।’ রোজার পুণ্যময় মাস যেন একটি স্বচ্ছ সলিল সরোবর, যার জলের নির্মলতায় মানুষের অভ্যন্তরীণ যাবতীয় কাম-ক্রোধ, লোভ-লালসা, হিংসা-বিদ্বেষ ও বিভেদের সব কালিমা ধুয়ে-মুছে সাফ হয়ে যায়। মুসলমানগণ পুণ্যস্নাত ঈদের মধ্য দিয়ে সমর্পিত হয়, সেই নির্মলতার সীমানায় উত্তীর্ণ হয়। কামাচার, পানাহার, পাপাচার, মিথ্যাচার থেকে বিরত থেকে মাহে রমজানে সম্পূর্ণ দিবাভাগে অর্থাৎ সুবেহ সাদিকের পূর্বক্ষণ থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত রোজাদার আত্মশুদ্ধির প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত হন, যা তার জীবন-চেতনায় বয়ে আনে পরিশীলিত অনুভূতি। পুরো এক মাস সিয়াম সাধনার পর আনন্দ ও উৎসবমুখর পরিবেশে সারাদেশে পবিত্র ঈদ-উল-ফিতর পালিত হয়। রমজান মাসে সংযম ও আত্মশুদ্ধি অনুশীলনের পর ঈদ-উল-ফিতর ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে সকল শ্রেণীর মানুষকে আরও ঘনিষ্ঠ বন্ধনে আবদ্ধ করে, গড়ে তোলে সবার মধ্যে সম্প্রীতি, সৌহার্দ্য ও ঐক্যের মেলবন্ধন। ঈদের নামাজ শেষে ধনী-নির্ধন, পরিচিত-অপরিচিত সকলে সানন্দে কোলাকুলি করেন। ঈদ উৎসবের সন্ধিক্ষণে কে কত দামী পোশাক পরল, কে কত উত্তম পানাহার করল সেটা কখনও বিচার্য নয়; বরং বিচার্য বিষয় হচ্ছে নিজ আত্মাকে কে কতটুকু নিষ্পাপ রাখতে পেরেছে। এক মাস সংযম সাধনার মাধ্যমে আত্মশুদ্ধির যে নিরলস প্রচেষ্টা বিশ্বাসীগণ চালান, ঈদ-উল-ফিতর এরই পূর্ণতার সুসংবাদ। ঈদ-উল-ফিতরের তাৎপর্য হলো সিয়ামের দাবি পূর্ণ করে নতুন অবস্থায় উত্তীর্ণ হওয়ার খুশি। নবী করিম (সা) সানন্দে ঘোষণা করেছেন, ‘লিকুলি কাওমিন ঈদ, হাযা ঈদুনা’ অর্থাৎ ‘প্রত্যেক জাতিরই নিজস্ব আনন্দ-উৎসব রয়েছে, আমাদের আনন্দ-উৎসব হচ্ছে এই ঈদ।’ (বুখারী ও মুসলিম) ঈদ সকলের মাঝে আনন্দ বিতরণের ঐশী বাণীরূপে মুসলমানের জীবনে ফিরে আসে। বস্তুগত জাগতিক প্রাচুর্য, ঐশ্বর্য ও ধন-সম্পদের মোহ থেকে যথাসম্ভব মুক্ত রেখে মানুষের অন্তরকে বিকশিত নির্মল উজ্জ্বল ও সুন্দর করে তোলাই সিয়াম সাধনার উদ্দেশ্য আর ঈদ-উৎসবের মাহাত্ম্য। ঈদ মানুষের মধ্যে ইসলামের সাম্য ও মৈত্রীর বন্ধন সৃষ্টি করে। ভেদাভেদহীন সমাজ তৈরির বিষয়টি পবিত্র ঈদ উৎসবের মধ্যে নিহিত রয়েছে। মাহে রমজানের একটি মাস ধরে কঠোর সংযমব্রত পালনের পর যখন ঈদ আসে তখন সেটা তো মহাআনন্দের ফল্গুধারা হয়ে দেখা দেয়। প্রকৃতপক্ষে যারা রোজার যাবতীয় হক আদায় করেছে, তাদের জন্য ঈদ-উল-ফিতরের দিনটি মহাসম্মানের, আনন্দের, অভিনন্দনের, শান্তির, ক্ষমার এবং মহাপুরস্কারের দিন। ঈদের দিনের মর্যাদা ও ফজিলত বর্ণনা করে রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন, ‘সংযম সাধনার পর ঈদের দিনে রোজাদারগণ শিশুর ন্যায় নিষ্পাপ হয়ে যায়। যে ব্যক্তি পুণ্য লাভের অদম্য স্পৃহায় দুই ঈদের রাতে জেগে ইবাদতে মশগুল থাকবে, সেদিন তার হƒদয় এতটুকু ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়বে না, যেদিন সবার অন্তর ভীতসন্ত্রস্ত মৃতবৎ হয়ে পড়বে।’ ইসলামের মর্মবাণী সামাজিক ঐক্য, সাম্য, মৈত্রী, সৌহার্দ্য, সহমর্মিতা প্রকাশ ও সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠা এবং মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর রহমত, মাগফিরাত ও নাজাত সম্পর্কে সুগভীর উপলব্ধি। ঈদ উৎসব পালন একটি নিছক আনন্দ-বিনোদনের পর্ব নয়, এর মধ্যে নিহিত আছে সামাজিক দায়িত্ব-কর্তব্য পালন ও ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্য উদযাপনের তাগিদ। মাহে রমজানের সিয়াম সাধনার যথার্থ সমাপনান্তে ঈদের আনন্দ প্রকৃত রূপ লাভ করে, সাদাকাতুল ফিতর ও জাকাত আদায়ের মাধ্যমে নিজের আনন্দ পরের তরে বিলিয়ে দেয়ার আসমানি তাগিদ পালনের সুবর্ণ সুযোগ মিলে। মানবজীবনের সুখ-দুঃখ-সঙ্কট ও আনন্দ-বেদনার ভেতর দিয়ে ঈদ-উল-ফিতর মুসলমানদের জন্য ভালবাসা ও কলুষমুক্ত নতুন জীবনের উপলব্ধি নিয়ে আসে। ধনী-দরিদ্র, আমির-ফকির, সাদা-কালো, উঁচু-নীচু সব শ্রেণীর মানুষ মিলে একই আনন্দ-অনুভবে, একই খুশির জোয়ারে মহাঐক্যের মিলন মোহনায় এসে সম্মিলিত হওয়ার এক অনন্য ব্যবস্থা এই পবিত্র ঈদ-উল-ফিতর। ঈদ কেবল পার্থিব আনন্দই প্রদান করে না, বরং এ ঈদ ইহকাল ও পরকালের সামগ্রিক কল্যাণের দিকনির্দেশনা প্রদান করে। ঈদের আনন্দ প্রাচুর্যে ভরা, এ আনন্দ বরকতময়। ঈদের দিনে ‘ঈদ মোবারক আস-সালাম’ অভিবাদনে মশগুল হয় সবাই। কিন্তু এ সাদর অভিবাদন যাতে গতানুগতিক ও নিছক নিষ্প্রাণ অভিবাদনে পর্যবসিত না হয়, অন্তরের বক্রতাকে জিইয়ে রেখে পরস্পরের ভেদাভেদ, অবমাননা ভুলে সম্প্রীতি ও সৌহার্দ্য প্রকাশের ঈদের মর্মবাণী যাতে হারিয়ে না যায় সেদিকে লক্ষ্য রাখা বাঞ্ছনীয়। ঈদের দিনের দাবি অপর মুসলমানকে ক্ষমা করে দেয়া এবং জাতি-বর্ণ, দলমত নির্বিশেষে পরস্পরকে ভাই-বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করা। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ভাষায় : ‘পথে পথে আজি হাঁকিব, বন্ধু/ঈদ মোবারক! আস্সালাম!’ জীবনের সব দুঃখ-যাতনা ও বৈষম্য-বঞ্চনা ঘোচাতে পারে না এক ঈদ; কিন্তু সবকিছুর ভেতর দিয়েও একটুখানি আনন্দ, একটুখানি সহযোগিতা, সহমর্মিতা ও সম্প্রীতির নজির সৃষ্টি করতে পারে। সারাবিশ্ব সর্বপ্রকার লোভ-লালসা, হিংসা-বিদ্বেষ ও হানাহানিমুক্ত হোক! দেশে-বিদেশে সন্ত্রাস ও জঙ্গীবাদের বিভীষিকা দূরীভূত হোক! পৃথিবীতে মানবতার ঐক্য-ভ্রাতৃত্ব, শান্তি-সম্প্রীতি ও সৌহার্দ্যরে বন্ধন দৃঢ়তর হোক! সবাইকে জানাই পবিত্র ঈদ-উল-ফিতরের প্রাণঢালা শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন! লেখক : চেয়ারম্যান, ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয় ফৎ.সঁহরসশযধহ@ুধযড়ড়.পড়স
×