ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

জঙ্গী গডফাদারদের টার্গেট উচ্চবিত্তের শিক্ষিত সন্তান! পাঁচ তরুণের পরিচয় প্রকাশ

প্রকাশিত: ০৫:৩৫, ৫ জুলাই ২০১৬

জঙ্গী গডফাদারদের টার্গেট উচ্চবিত্তের শিক্ষিত সন্তান! পাঁচ তরুণের পরিচয় প্রকাশ

বিভাষ বাড়ৈ ॥ ‘আমরা বেহেস্তে যাচ্ছি তোমরা পালাও। আমরা সবাই জান্নাতে যাব।’ হলি আর্টিজান রেস্তরাঁর যেসব স্টাফ দিয়ে খাবার তৈরি করে জঙ্গীরা খেয়েছিল রবিবার সকালে কমান্ডো অভিযানের আগে তাদের উদ্দেশে জঙ্গীরা ওসব কথা বলেছিল। অভিযানের পর বের হয়ে আসা হলি আর্টিজানের শেফের সহকারী শাহরিয়ার আহমেদ এ কথা জানান পরিবারের সদস্যদের। এখানেই শেষ নয়, কেবল জান্নাতের আশায় হত্যাই নয়। ‘আমি নেটওয়ার্কের বাইরে চলে যাচ্ছি। পরকালে দেখা হবে।’ বাসা থেকে পালিয়ে যাওয়ার সময় মা-বাবাকে সেলফোনে এমন মেসেজ পাঠিয়ে হারিয়ে গিয়েছিলন জঙ্গীদের একজন। জঙ্গী হামলাকারীদের নাম পরিচয় ও পরিবারের তথ্য বেরিয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে উদ্বেগ ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। আগে কেবল মাদ্রাসার ছাত্রদের টার্গেট করা হলেও জঙ্গীদের টার্গেট যে এখন উচ্চবিত্ত পরিবারের শিক্ষিত সন্তান তা শতভাগ স্পষ্ট করে তুলেছে দেশের ইতিহাসে ভয়াবহ এ হামলা। হামলাকারীরা আত্মঘাতী ছিল তা নিশ্চিত, পরিচয় প্রকাশের পর তাদের নেটওয়ার্কের বিষয়ে তথ্য পাচ্ছে র‌্যাব, পুলিশ ও সিআইডি। সাত জঙ্গী জামা’আতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ (জেএমবি) নিষিদ্ধ হওয়ার পর ইসলামিক স্টেটে (আইএস) যোগাযোগ করে। পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন করে তাদের পরিকল্পনা ও টার্গেট ঠিক করে অর্থ ও অস্ত্র যোগান দেয়া হয়। বিশেষজ্ঞরা বলেন, জঙ্গী গডফাদারদের টার্গেট এখন শিক্ষিত উচ্চবিত্ত এবং প্রভাবশালী পরিবারের সন্তান। ধর্মের নামে সরকারী ও বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রযুক্তিমনষ্ক তরুণ-তরুণীদের দলে টানছে জঙ্গী সংগঠনগুলো। সরলমনা ধনাঢ্য পরিবারের সন্তান ও উচ্চ শিক্ষিত তরুণদের টার্গেট করে জঙ্গী গ্রুপে নেয়া হয়। শুরুতেই তাদের মগজ ধোলাই করে এ্যাডভেঞ্চারের স্বপ্ন দেখানো হয়। অর্থ-বিত্তের মোহ না থাকায়, সরলমনা তরুণরা কথিত ইসলামী রাষ্ট্র কায়েমের স্বপ্নে বিভোর হয়ে বিপথগামী হয়। ‘কতল মিশন’ সাজিয়ে বেহেশতের যাত্রী হওয়ার জন্য তাদের ইসলামী কথিত শত্রু খতমের জন্য তৈরি করা হয়। পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন করে প্রশিক্ষিত করা হয় অত্যাধুনিক মারণাস্ত্র চালনায়। এর পর টার্গেট চিহ্নিত ও পরিকল্পনা করে তাদের পাঠানো হয়। যাদের মধ্যে অনেকে আত্মঘাতী ও কেউবা সিøপার সেলের সদস্য। তথ্য বলছে, গুলশানে জঙ্গী হামলাকারীরা প্রায় সকলেই ধনাঢ্য পরিবারের সন্তান। একজন মাদ্রাসার ছাত্র ছাড়া বাকিরা সকলেই আধুনিক শিক্ষিত ও দেশ-বিদেশের নামীদামী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছেন ও পড়ছেন। পরিবারেও যাদের কোন কিছুরই অভাব ছিল না। বিত্তশালী পরিবারের সন্তান হিসেবে বিলাসবহুল জীবনযাপনে অভ্যস্ত। এসব কিছু ছেড়ে হঠাৎ উধাও হয়ে যায়। সন্ধান করা হয় পরিচিত, আত্মীয়স্বজনের বাসায়। কোথাও কোন সন্ধান মেলেনি। এমনকি কেউ কেউ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর শরণাপন্ন হন। তবুও হদিস মেলেনি তাদের। গুলশানে জিম্মি সংকটের রক্তাক্ত অবসান হওয়ার পর ছয় তরুণের লাশ পাওয়া যায়। তারাই হামলাকারী জানিয়ে তাদের লাশের ছবি প্রকাশ করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। একইভাবে কালো পাঞ্জাবি ও মাথায় কাপড় বাঁধা, অত্যাধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র হাতে হাস্যোজ্জ্বল পাঁচ তরুণের ছবি প্রকাশ করে আইএস। মুহূর্তের মধ্যেই ছবিগুলো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। শনাক্ত হয় তাদের পরিচয়। যদিও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নিহতদের মধ্যে পাঁচ তরুণের নাম জানিয়েছে আকাশ, বিকাশ, ডন, বাঁধন ও রিপন। তাদের স্বজনরা জানান, প্রকাশিত ছবির তরুণদের মধ্যে চারজন হচ্ছেন- রোহান ইমতিয়াজ, মীর সামিহ মোবাশ্বির, নিবরাস ইসলাম ও আন্দালিব রহমান। রোহান ইমতিয়াজ ॥ আওয়ামী লীগের ঢাকা মহানগর কমিটির যুব ও ক্রীড়া বিষয়ক সম্পাদক ইমতিয়াজ খান বাবুলের ছেলে রোহান ইমতিয়াজ (২০)। বাবা বাংলাদেশ অলিম্পিক এ্যাসোসিয়েশনের ডেপুটি সেক্রেটারি জেনারেল এবং বাংলাদেশ সাইক্লিস্ট ফেডারেশনের জেনারেল সেক্রেটারি। ফেসবুক দেখে বোঝা যায়, তিনি কিছুদিন ছেলেকে খুঁজে পাচ্ছিলেন না। ২১ জুন তিনি ফেসবুকে ছেলের উদ্দেশ্যে লিখেছেন, ‘প্লিজ কাম ব্যাক’। তিনি ঢাকা মহানগর উত্তর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে ৩১ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর পদে আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী ছিলেন। নির্বাচনে তিনি জয়ী হতে পারেননি। মোহাম্মদপুর থানাধীন লালমাটিয়ার জি ব্লকের ৯/৭ নম্বর বাড়ির পাঁচতলার ফ্ল্যাটে তিনি গত ৭ বছর ধরে সপরিবারে ভাড়া থাকেন। রোহান স্কলাসটিকায় পড়াশুনা শেষ করে পড়ছিলেন ব্র্যাক ইউনিভার্সিটিতে। তার মা স্কলাস্টিকার শিক্ষক। রোহানদের লালমাটিয়ার বাড়ির নিরাপত্তা প্রহরী নূরুন্নবী বলেন, ৬-৭ মাস আগে রোহান বাসা থেকে নিখোঁজ হয়ে যায়। তবে এ বিষয়ে তার বাবা অনেক খুঁজেছেন কিন্তু পাননি। খুব শান্ত প্রকৃতির ছিল রোহান। তবে তার সঙ্গে জঙ্গীদের কোন সংশ্লিষ্টতা ছিল কিনা তা তিনি জানেন না। তিনি আরও বলেন, পত্রিকায় রোহানের ছবি প্রকাশ হওয়ার পর পরিবার বাসায় তালা দিয়ে চলে গেছে। রোহানের মা পরিচয় দানকারী এক মহিলা বলেন, তার সন্তান খুব মেধাবী ছিল। তবে হামলাকারী নিহতদের ছবির মধ্যে তার ছেলের ছবি নেই বলে তিনি দাবি করেন। পরিবারের সদস্যরা ইতোমধ্যেই জানিয়েছেন, নিখোঁজ হওয়ার পর জিডি করার ছাড়াও বিষয়টি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে জানানো হয়। এক পর্যায়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী রোহানের কর্মকা- সম্পর্কে নিশ্চিত হয়। পরিবারকে জানানো হয়, সে হয়ত দেশের বাইরে চলে গেছে। মীর সামিহ মোবাশ্বির ॥ গত ২৯ ফেব্রুয়ারি বিকেল তিনটার দিকে মীর সামিহ মোবাশ্বির গুলশানের এমিনেন্স কোচিংয়ে যাওয়ার উদ্দেশে গাড়িতে করে বাসা থেকে বের হয়। যানজট থাকায় কোচিং সেন্টারের আগেই গাড়ি থেকে নেমে যায়। পরে সন্ধ্যা ছয়টার দিকে গাড়িচালক জুয়েল কোচিং থেকে আনতে গেলে তাকে আর পাওয়া যায়নি। পরে মোবাশ্বিরের বাবা মীর এ হায়াত কবীর ওইদিনই গুলশান থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (নম্বর ১৮৪৮) করেন। পুলিশ তার খোঁজ করতে গিয়ে গুলশান এলাকার সিসিটিভি ফুটেজে দেখতে পায়, মোবাশ্বির গাড়ি থেকে নামার পর একটি রিক্সা নিয়ে বনানীর ১১ নম্বর সড়কের দিকে চলে যাচ্ছে। মুবাশ্বেরের বাবা অ্যালকাটেল-লুসেন্ট বাংলাদেশের কর্মকর্তা। মা খালেদা পারভীন সরকারী কলেজের শিক্ষক। বড় ভাই পড়ছেন কানাডার টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ে। মোবাশ্বির স্কলাসটিকা স্কুল থেকে ও-লেভেল সম্পন্ন করেছে। এ লেভেলে ভর্তি হওয়ার জন্য সে গুলশানের এমিনেন্স কোচিং সেন্টারসহ দুটি কোচিং সেন্টারে পড়ছিল। পরিবারের সঙ্গে সে বনানী ডিওএইচএসের ৫ নম্বর সড়কের ৬৮/এ বাসার ৫/বি ফ্ল্যাটে থাকত। ৬৮/এ নম্বর বাড়িতে গিয়ে দেখা গেছে, ফ্ল্যাটে তালা ঝুলিয়ে চলে গেছেন। মোবাশ্বিরের ছবি শেয়ার করে ফেসবুকে নিঝুম মজুমদার লিখেছেন, আমার ফেসবুকের বন্ধু/ছোটভাই আমাকে কনফার্ম হয়ে জানাল, এই ছেলেটির নাম মীর সামিহ মোবাশ্বির। যেহেতু দীর্ঘদিন একজন আরেকজনকে চেনেন। এই ছেলেটি এই বছরের মার্চ মাস থেকে মিসিং। তাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। এ লেভেল পরীক্ষার আগ থেকেই মিসিং ছিল। ঢাকায় নিহত হামলাকারীদের যে ছবি প্রকাশিত হয়েছে তা দেখেই তারা শনাক্ত করেছেন। ছবিটি আইডেন্টিফাই করা ব্যক্তি এও বলেছেন, ছেলেটাকে একটু মোটা লাগছে কিন্তু প্রচুর মিল আছে তা বলা বাহুল্য। তিন মাস যদি মিসিং থাকে, তাহলে এই সময়ের ট্রেনিংয়ে শারীরিক এই অবয়ব হয়ত সম্ভব। নিবরাস ইসলাম ॥ হামলাকারীদের আরেক জন নিবরাস ইসলাম নর্থ-সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্র। সাবেক সহপাঠীরা শনাক্ত করে তার ছবি ও পরিচয় সামনে এনেছেন। বলা হচ্ছে, নিবরাস অস্ট্রেলিয়াভিত্তিক মোনাশ ইউনিভার্সিটির মালয়েশিয়া ক্যাম্পাসে ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্ট সার্ভিসেসের কোষাধ্যক্ষ ছিল। ওয়ারী ও উত্তরায় বাড়ি থাকা নিবরাস ধনী পরিবারের সন্তান। পড়েছে ঢাকার ইন্টারন্যাশনাল টার্কিশ হোপ স্কুলে। নিবরাসের তিন চাচার মধ্যে একজন সরকারের উপ-সচিব, একজন পুলিশের এএসপি, আরেকজন বিজ্ঞানী। দ্য এশিয়া ফয়েলসের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক আসিফ নেওয়াজ লিখেছেন, আমি আমার চিন্তাগুলোকে এক জায়গায় করতে চেষ্টা করছি। হামলাকারীদের মধ্যে অন্তত দুই জনকে আমাদের অনেকেই চেনে। কয়েক বছর আগে এদেরই একজনকে (নিবরাস ইসলাম) আমি কাছ থেকেই দেখেছি। এদেরই একজন ফুটবল খেলতে পছন্দ করত, তার আচরণের জন্য বেশ জনপ্রিয় ছিল। এই ছেলেই কিন্তু বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে চেক-ইন দিতে পছন্দ করত। গত ফেব্রুয়ারি থেকে তাকে পাওয়া যাচ্ছিল না। নিবরাস যখন নর্থ সাউথে পাড়ালেখা করে তখন সেখানকার শিক্ষক ছিলেন হামলার ঘটনায় আটক হাসনাৎ রেজা করিম। প্রতিষ্ঠানটির ট্রাস্টি মোঃ শাজাহান বলছিলেন, এই শিক্ষক আমাদের মাত্র দুই সেমিস্টার ছিলেন। মৌলবাদী কর্মকা-ের জন্য আমরা কয়েকজন শিক্ষককে বহিষ্কার করেছিলেন। তিনি তার মধ্যেই ছিলেন। ওই সময় এ ছাত্রও আমাদের এখানে পড়ালেখা করেছে। তাই তাদের যোগাযোগ থাকাটা অস্বাভাবিক নয়। তাসিন রওনক আন্দালিব ॥ নিহত হামলাকারী ৫ জনের মধ্যে একজনের ছবি শনাক্ত করা হয়েছে তাসিন রওনক আন্দালিব নামে। এর আগে আন্দালিব ধানম-ির সানিডেল স্কুল থেকে ও লেভেল পাস করে। সে মালয়েশিয়ায় মোনাশ ইউনিভার্সিটিতে নিবরাস ইসলামের সহপাঠী। তাদের এক সঙ্গে ছবি ফেসবুকে প্রকাশ হয়েছে। ফেসবুকে প্রকাশিত ছবি থেকেই নিহত জঙ্গীদের একজনের ছবির সঙ্গে মিল রয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। খায়রুল ইসলাম ॥ ছয়-সাত মাস ধরে উত্তরবঙ্গের অন্তত তিনটি হত্যাকা-ে খায়রুল ইসলামের নাম এসেছে। তাকে তখন থেকেই খোঁজা হচ্ছিল। খায়রুল যে গুলশানে হামলার নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, এ বিষয়ে পুলিশ মোটামুটি নিশ্চিত। বগুড়ার শাজাহানপুর উপজেলার চুতিনগর ইউনিয়নের ব্রিকুষ্টিয়া গ্রামের দিনমজুর আবু হোসেনের দুই মেয়ে ও এক ছেলের মধ্যে খায়রুল বড়। ব্রিকুষ্টিয়া দারুল হাদিস সালাদিয়া কওমি মাদ্রাসায় কিছুদিন পড়েছিলেন খায়রুল। এরপর ডিহিগ্রাম ডিইউ সেন্ট্রাল ফাজিল মাদ্রাসা থেকে তিনি দাখিল পাস করেন বলে প্রতিবেশীরা জানান। খায়রুলের মা পেয়ারা বেগম বলেন, এক বছর ধরে খায়রুল নিখোঁজ ছিল। স্থানীয় সাংবাদিকদের কাছে হারানো বিজ্ঞপ্তি দেয়ার জন্য আট-নয় মাস আগে গিয়েছিলেন বাবা-মা। কিন্তু থানায় জিডি করতে হবে শুনে তারা আর বিজ্ঞপ্তি দেননি। নিহতদের মধ্যে অপর একজনের ছবি সাইফুল ইসলাম নামে একজন হলি আর্টিজান বেকারির একজন কর্মচারীর। ওই রেস্তরাঁর মালিক সাদাত মেহেদি বলেন, পত্রিকায় সাদা রঙের টি-শার্ট পরা যে ছবি প্রকাশ হয়েছে সেটি তার রেস্তরাঁর কর্মচারীর। পুলিশ ও গোয়েন্দা সূত্রগুলো বলছে, সরলমনা ধনাঢ্য পরিবারের সন্তান ও উচ্চ শিক্ষিত তরুণদের টার্গেট করে জঙ্গী গ্রুপে নেয়া হয়। শুরুতেই তাদের মগজ ধোলাই করে এ্যাডভেঞ্চারের স্বপ্ন দেখানো হয়। অর্থ-বিত্তের মোহ না থাকায়, সরলমনা তরুণরা কথিত ইসলামী রাষ্ট্র কায়েমের স্বপ্নে বিভোর হয়ে বিপথগামী হয়। ‘কতল মিশন’ সাজিয়ে বেহেশতের যাত্রী হওয়ার জন্য তাদের ইসলামের কথিত শত্রু খতমের জন্য তৈরি করা হয়। পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন করে প্রশিক্ষিত করা হয় অত্যাধুনিক মারণাস্ত্র চালনায়। এর পর টার্গেট চিহ্নিত ও পরিকল্পনা করে তাদের পাঠানো হয়। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছেন, জড়িতরা ধনাঢ্য পরিবারের সন্তান ও উচ্চশিক্ষিত। প্ররোচনায় পড়ে তারা এ পথ বেছে নিয়েছে। আইজিপি এ কে এম শহীদুল হক বলেছেন, হামলাকারীরা জেএমবি সদস্য ও পুলিশের কাছে ওয়ান্টেড ছিল। তাদের আন্তর্জাতিক যোগসূত্র থাকতেও পারে। ২০১৩ সালে মিরপুরে ব্লগার রাজীব হত্যায় আটক হয় ফয়সাল বিন নাইম ওরফে দীপ (২২), মাকসুদুল হাসান অনিক (২৬), এহসান রেজা রুম্মন (২৩), নাঈম সিকদার ইরাদ (১৯), নাফিজ ইমতিয়াজ (২২), সাদমান ইয়াসির মাহমুদ (২০)। এরা প্রত্যেকেই বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র এবং ধনাঢ্য পরিবারের সন্তান। রাজীব হত্যার আটককৃত জুন্নুন সিকদার ছিল নর্থ-সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। পরে সে ভর্তি হয় দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবি বিভাগে। গত ২৫ ফেব্রুয়ারি অভিজিত হত্যায় গ্রেফতার শফিউর রহমান ফারাবী ছিল নটরডেম কলেজের ছাত্র। পরে সে ভর্তি হয় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। এর মধ্যেই জড়িয়ে পড়ে জঙ্গী সংগঠনের সঙ্গে। গত ১৫ মে রাজধানীর বারিধারা থেকে আটককৃত বাংলা টিমের সদস্য আবদুল্লাহ-আল গালীব একটি ইংরেজী মাধ্যম স্কুল থেকে ‘এ’ লেভেল পাস করে। তার বাবা মেজর (অব) আবদুল্লাহ। গালীব আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের সক্রিয় সদস্য। সে আল কায়েদার আদলে বাংলাদেশে নতুন একটি সংগঠন তৈরির কাজ শুরু করে। ২০১৪ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর রাজধানীর সেগুনবাগিচা থেকে আটক করা হয় বাংলা টিমের সদস্য আসিফ আদনানকে। তার বাবা অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তর পাস করেন। একই সময় আটক ফজলে এলাহী ‘এ’ লেভেল পাস করেন রাজধানীর একটি ইংরেজী মাধ্যম স্কুল থেকে। তার মা যুগ্ম সচিব, যিনি বর্তমানে ওএসডি। কেন শিক্ষিত, বিত্তবানরা অশনি সঙ্কেত বলছেন বিশেষজ্ঞরা ॥ ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) অতিরিক্ত কমিশনার মনিরুল ইসলাম বলছিলেন, উচ্চশিক্ষিতদের প্রশিক্ষিত জঙ্গীরা দলে টানার চেষ্টা করছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষিত তরুণ ও যুবকের জঙ্গী কার্যক্রমে প্রবেশ তারই নতুন মাত্রা। এটা রোধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পাশাপাশি ঘরে ঘরে অভিভাবকদের আরও সজাগ ও সচেতন হতে হবে। তার সন্তান কোথায় যাচ্ছে, সে কী আদর্শ লালন করছে, তা ভাবার ও যাচাই করার সময় এসেছে। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) সিনিয়র এডিসি ছানোয়ার হোসেন বলেন, প্রধানত দুটি কারণে ধনাঢ্য পরিবারের শিক্ষিত সন্তানরা জঙ্গী তৎপরতায় জড়িয়ে পড়ছে, এসব ছেলে টার্গেটে পরিণত হচ্ছে। যারা এসব জঙ্গী সংগঠনের সঙ্গে সম্পৃক্ত, এরাই এ ধরনের ছেলেদের চিহ্নিত করে টার্গেট করে থাকে। বাংলাটিমের মতো জঙ্গী সংগঠনগুলো সাধারণত আলকায়েদা, আইএসের মতো আন্তর্জাতিক জঙ্গী সংগঠনগুলোকে কপি-অনুসরণ করে থাকে। এ জন্য তাদের প্রয়োজন হয় তথ্যপ্রযুক্তিগত জ্ঞান ও এ ধরনের টেকনোলজির ব্যয় বহন করতে পারে এমন তরুণদের। জঙ্গী সংগঠন নিয়ে কাজ করা ডিবির এই কর্মকর্তার মতে, এরা একেবারে জিরো (শূন্য) থেকে শুরু করে না। অর্থাৎ ধর্ম নিয়ে যাদের দুর্বলতা বা কৌতূহল আছে শুধু সেসব শিক্ষিত তরুণকেই এরা টার্গেট করে থাকে। ছানোয়ার হোসেন জানান, ২০০৯ সাল থেকে রাজধানীর বেশ কিছু উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে গোয়েন্দা নজরদারির মধ্যে রাখা হয়। এ ছাড়া বিদেশে পড়তে যাওয়া যেসব তরুণকে জঙ্গী সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে ফেরত পাঠানো হয়েছে, তাদেরও নজরদারির মধ্যে রাখা হয়। সূত্রগুলো বলছে, সরকারী ও বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘাঁটি গেড়েছে উগ্রপন্থী দলের নেতারা। শিক্ষিত যুবকদের ব্রেনওয়াশ করে জিহাদী চেতনায় উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে। কৌশলে ইসলাম ধর্মের নানা দিক তুলে ধরে অত্যন্ত মেধাবী তরুণদের মগজ ধোলাই করছে। বিত্তশালী পরিবারের পাশাপাশি দরিদ্র ঘরের মেধাবী সন্তানদেরও দলে টানছে এরা। অনেক ক্ষেত্রে দরিদ্র পরিবারের মেধাবী ছাত্র বা ছাত্রীর শিক্ষার ব্যয়ভার নিজেরা বহন করছে। শিক্ষার ব্যয় বহনের নামে কার্যত ওই ছাত্র বা ছাত্রীকে তারা কিনে ফেলছে। ভবিষ্যতে তারা এই চক্র থেকে আর বের হতে পারে না। ভয়াবহ এই জঙ্গী জালে প্রিয় সন্তান কখন জড়িয়ে পড়েছে প্রথমদিকে পরিবারের অন্য সদস্যরা তা জানতেও পারেন না। বিশেষজ্ঞরা বলেন, জঙ্গী দলে তরুণদের টানতে বলা হচ্ছে, তোমরা দুনিয়ার অনেক জ্ঞান অর্জন করেছ। তোমাদের অনেক মেধা আছে। এখন সেই মেধাকে কাজে লাগিয়ে ধর্মের জন্য কাজ করার সময় এসেছে। এই সেবায় তোমরা জিতলে ‘গাজী’ আর মরলে ‘শহীদ’। আর ‘শহীদ’ মানে পরকালে বিনা হিসাবে জান্নাত পাবে। সেখানে কোন কষ্ট থাকবে না। ধর্মের সেবার নামে শুধু যে তরুণদের মোটিভেটেড করে উগ্রপন্থী দলে টানা হচ্ছে সেটি নয়, বর্তমানে তরুণীদেরও একই আদর্শের কথা বলে জঙ্গী দলগুলো তাদের দলে যোগ দিতে বলছে। ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইমস স্ট্র্যাটেজি ফোরামের পক্ষ থেকে ড. রায়হান রশিদ বলছিলেন, আমরা যদি মনে করি জিম্মি পরিস্থিতির অবসানের সঙ্গে সঙ্গেই সংশ্লিষ্ট সবার দায়িত্ব শেষ হয়ে গেছে, তাহলে ভুল করব। ভয়ঙ্কর এক জিম্মি পরিস্থিতির অবসান হয়েছে মাত্র। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর এখন আরও কঠিন দায়িত্ব বর্তেছে এই মুহূর্তে- আর তা হলো অংশগ্রহণকারী এই ৫ জঙ্গীর ব্যক্তিগত, পারিবারিক নেটওয়ার্ক ও সামাজিক পরিম-লের ওপর একটি পূর্ণাঙ্গ তদন্ত। ৫ তরুণ বিচ্ছিন্নভাবে হঠাৎ করে জঙ্গী অপারেশন করে বসে না; তাদের কর্মকা-ের পেছনে একটি সাপোর্ট নেটওয়ার্ক থাকার সম্ভাবনাই বেশি। তাই ভবিষ্যতের নিরাপত্তার স্বার্থেই তাদের সেই নেটওয়ার্কটির ওপর সঠিক তদন্ত হওয়া দরকার। তবে সেক্ষেত্রেও এটুকু নিশ্চিত করে যে কোন অবস্থাতেই যেন কারও মৌলিক অধিকার লঙ্ঘিত না হয়। ব্লগার লেখক অমি রহমান পিয়াল লিখেছেন, একটা প্যাটার্ন কিন্তু চোখে পড়তেছে। নাস্তিক হত্যার নামে ব্লগার খুন কিংবা ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের ওপর হামলা আসলে নৃশংসতার প্রথম পাঠ। হাতেখড়ি। যোগ্যতা যাচাইয়ের পরীক্ষায় উত্তরণ। এরপর বিদেশে তাদের নিবন্ধন, ট্রেনিং এবং বড় কিছু ঘটানোর জন্য দেশে ফিরে আসা। গুলশান হামলায় জড়িত প্রত্যেকেই চার-পাঁচ মাস ধরে নিখোঁজ ছিল। কিছুদিন আগে মাদারীপুরে ধরা পড়া জঙ্গী ফাহিম বাড়িতে মেসেজ পাঠিয়েছিল সে বিদেশ যাচ্ছে। তারও কিছুদিন আগে সিঙ্গাপুরে ধরা পড়ে সে দেশে প্রশিক্ষণ নেয়া বেশ কজন জঙ্গী। পাকিস্তান বা আফগানিস্তান নয়। জঙ্গীদের অভয়ারণ্য এখন সিঙ্গাপুর- মালয়েশিয়া। তাদের কাগজপত্র রেডি থাকে। ঘটনা ঘটিয়েই চট্টগ্রাম থেকে জাহাজে চড়ে বসে তারা। আমার মনে হয় এদের শেকড় উপড়াতে এই জায়গাগুলোতেই নজরদারি এবং গোয়েন্দা তৎপরতা বাড়ানো জরুরী...। নিরাপত্তা বিশ্লেষক ব্রিগেডিয়ার (অব) সাখাওয়াত হোসেন বলছিলেন, জঙ্গীবাদে পারিবারিক সম্পর্ক বড় ইস্যু। ছেলেমেয়ের সঙ্গে অভিভাবকদের সম্পর্ক কেমন, ছেলেমেয়েরা অভিভাবকদের থেকে কেমন পথনির্দেশনা পায়, পরিবারের পরিবেশ- এসব বিষয় সন্তানের জীবনে প্রভাব বিস্তার করে। বর্তমানে পরিবারে নৈতিক শিক্ষার প্রচলন নেই বললেই চলে। আমরা ভিনদেশী সংস্কৃতি অনুসরণ করছি। এগুলো আভিজাত্যের প্রতীক মনে করে আমরা প্রাচ্যের ধ্যান-ধারণায় বড় হচ্ছি। এ ছাড়া আমরা সামাজিক মূল্যবোধ সম্পর্কেও সচেতন নই। ফলে সামাজিক মূল্যবোধ সম্পর্কিত শিক্ষার অবক্ষয় ঘটছে। এসব কারণেই কোমলমতি ছেলেমেয়েরা জঙ্গীবাদের মতো জঘন্য কর্মকা-ে যুক্ত হচ্ছে। জঙ্গীবাদের এই অপবিস্তার রোধে অবশ্য পরিবার থেকেই প্রতিটি সন্তানকে নৈতিক শিক্ষা দিতে হবে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধুরী বলছিলেন, আমাদের ধারণা ছিল, দারিদ্র্যপীড়িত, যারা অন্য কিছু করার সুযোগবঞ্চিত, যারা সব কিছু ফ্রি পাওয়ার চিন্তা করে, তাদের অনেককে সন্ত্রাসবাদে ব্যবহার করা হয়। কিন্তু এখন সেই ধারণা পাল্টে গেছে। দেখা যাচ্ছে, মধ্যবিত্ত ছাড়িয়ে উচ্চবিত্তের ঘরে হানা দিয়েছে মূল্যবোধের অবক্ষয়। এতদিন মাদকে অবক্ষয়ের কথা জেনেছি। এখন জঙ্গীগোষ্ঠীর সঙ্গে এসব পরিবারের সন্তান সম্পৃক্ত হচ্ছে। শিক্ষা আমাদের পরিশুদ্ধ করে। কিন্তু সম্প্রতি যে ছেলেটি জঙ্গী হিসেবে মারা গেল, তার বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী থেকে দেয়া তথ্যে রীতিমতো হতবাক আমি। আমার মনে হয়, সামাজিক মূল্যবোধের অভাব শুধু নয়, কোথাও যেন একটা গলদ আছে। এই গলদের প্রথমেই আছে আমাদের পরিবার। এসব ছেলে, যারা জঙ্গীগোষ্ঠীর সঙ্গে সম্পৃক্ত, তারা কেউ ভাত-কাপড়ের জন্য সেখানে যায়নি। তাদের ব্রেনওয়াশ বা মগজধোলাই করা হয়েছে। প্রযুক্তির অপব্যবহার করে তাদের মগজধোলাই করা হয়েছে। কিন্তু এসব জেনেবুঝেও এর প্রতিরোধে আমরা কিছু করতে পারছি না, অথবা পাশ কাটিয়ে যাচ্ছি বা দেখেও না দেখার ভান করছি।
×