ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

লাইভ সম্প্রচারের নামে টিভি চ্যানেলগুলোর নৈতিকতা নিয়ে প্রশ্ন প্রধানমন্ত্রীর

প্রকাশিত: ০৫:৪৫, ৩ জুলাই ২০১৬

লাইভ সম্প্রচারের নামে টিভি চ্যানেলগুলোর নৈতিকতা  নিয়ে প্রশ্ন প্রধানমন্ত্রীর

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ ঢাকার গুলশানে একটি স্প্যানিশ রেস্তরাঁয় অস্ত্রধারীদের হাতে জিম্মিদের উদ্ধারে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অপরাশেন লাইভ সম্প্রচার করা নিয়ে বেসরকারী টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর নৈতিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি সন্ত্রাস-জঙ্গীবাদের বিরুদ্ধে সারাদেশে প্রবল জনমত গড়ে তুলতে বেসরকারী টিভি চ্যানেলগুলোকে আরও দায়িত্বশীল ভূমিকা পালনের জন্য মালিক-কর্তৃপক্ষের প্রতিও আহ্বান জানান। শনিবার রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে ‘ঢাকা-চট্টগ্রাম এবং ঢাকা-ময়মনসিংহ’ জাতীয় মহাসড়কের চার লেনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্য রাখতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, দেশে কোন বেসরকারী টেলিভিশন চ্যানেল ছিল না। আমাদের সরকারই এত বেসরকারী টিভির লাইসেন্স দিয়েছে। মানা করা সত্ত্বেও কোন কোন টেলিভিশন চ্যানেল কী করেছে, তা আমরা মনিটরিং করেছি। তাই, এ ব্যাপারে সবারই সতর্ক থাকা দরকার। আমরা যেমন দিতে পারি আবার নিতেও পারি। তিনি বলেন, জিম্মি উদ্ধারের আগে বাধ্য হয়েই ওখানকার (গুলশান) ইন্টারনেট লাইন, কেবল লাইন, ভাইবারসহ সকল কিছু বন্ধ করে দিতে হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী এ প্রসঙ্গে আরও বলেন, আমরা যখন প্রস্তুতি নিচ্ছি (জিম্মিদের উদ্ধার) তখন টিভি চ্যানেলগুলো সরাসরি সম্প্রচারের নামে তা সব দেখিয়ে দিচ্ছে! আবার সম্প্রচারটা এমন যে, ওখানে (অপারেশন) আমাদের র‌্যাব যাবে, তারা পোশাক পরছে- সেটাও টেলিভিশন দেখাচ্ছে। র‌্যাব কোথায় গিয়ে দাঁড়াল তাও দেখাচ্ছে। ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, যেসব টেলিভিশন চ্যানেল এগুলো দেখায় তারা কী একবারও চিন্তা করে না, রেস্তরাঁর ভেতরে যে সন্ত্রাসীরা মানুষগুলোকে জিম্মি করে রেখেছে তারাও এগুলো দেখছে। তারা (সন্ত্রাসী) তো এগুলো দেখার মধ্য দিয়ে সঙ্গে সঙ্গে পরবর্তী পদক্ষেপ কী নেবে সেটাও ঠিক করে ফেলছে। তিনি বলেন, এসব কারণে কোন প্রিপারেশনই (প্রস্তুতি) নেয়া যাচ্ছিল না, সব টিভি চ্যানেলে এসে যাচ্ছিল। সব প্রস্তুতিই ফাঁস হয়ে যাচ্ছিল। ঠিক একই ঘটনা আমরা দেখেছিলাম বিজিবি অপারেশনের সময়ও। টেলিভিশনের মালিক এবং পরিচালনাকারীদের প্রতি অনুরোধ জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আপনারা দেখুন, আমেরিকায় প্রায় ৩০ জনকে মেরে ফেলা হলো। কিন্তু সিএনএন, বিবিসি কিংবা আন্তর্জাতিক কোন চ্যানেল একটা লাশ কিংবা একফোঁটা রক্তের ছবিও দেখায়নি। কিন্তু আমাদের দেশে কি হয়? ওসব ছবি দেখানোর জন্য যেন একেবারে কম্পিটিশন (প্রতিযোগিতা) পড়ে যায়। কিন্তু এটার একটা প্রভাব ছোট বাচ্চা থেকে শুরু করে অসুস্থ মানুষ, গর্ভবতী মহিলার ওপর পড়তে পারে। সেই চিন্তাটাও তো আপনাদের করা উচিত।’ প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, আমরা যখন সন্ত্রাস দমনের জন্য, কোন অপারেশনে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছি, সেটার প্রতিটি পদক্ষেপ যদি টেলিভিশন রিলে (সম্প্রচার) করতে থাকে তাহলে কি করে সেই অপারেশন সাকসেসফুল (সফল) হবে? তাই, আমরা বাধ্য হয়েছিলাম ওখানকার ইন্টারনেট কেবল লাইন, ভাইবারসহ সব কিছু বন্ধ করে দিতে। বেসরকারী টিভি চ্যানেল, বেতার, সোশ্যাল মিডিয়াসহ গণমাধ্যমের প্রতি আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, সন্ত্রাসের পথ যেন মানুষ পরিহার করে প্রয়োজনে সেই জিনিসটা প্রচার করুন। জঙ্গী-সন্ত্রাসের খারাপ দিকটা প্রচার করুন, যেন ছেলেমেয়েরা এই দিকে না যায়। অল্প বয়সের তরুণদের বিভ্রান্ত করা ও বিপথে নিয়ে যাওয়া অনেক সহজ। কাজেই তারা বিপথে যাতে না যায়, সেটা দেখা সকলেরই দায়িত্ব। সন্ত্রাস ও জঙ্গীবাদের বিরুদ্ধে সারাদেশে জনমত আরও শক্তভাবে গড়ে তুলতে সবার সহযোগিতা কামনা করে তিনি বলেন, এই ধরনের সন্ত্রাসী কর্মকা-ে যারাই জড়িত থাকবে, ওখানে জনগণকেই প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। জনগণ প্রতিরোধ গড়ে তুললেই কিন্তু এটা থামবে। এক্ষেত্রে সম্প্রতি মাদারীপুরের ঘটনা তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, মাদারীপুরে এক কলেজ শিক্ষককে হত্যা করতে গিয়েছিল বলে সাধারণ জনতা সেই আক্রমণকারীকে ধরে ফেলেছিল। কাজেই এভাবেই সকলকে সাহস নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। তিনি বলেন, বাংলাদেশকে আমরা যখন উন্নয়নের দিকে নিয়ে যাচ্ছি, দেশের উন্নয়ন করে যাচ্ছি। বিশ্বব্যাপী বাংলাদেশের সুনাম ও মর্যাদা বৃদ্ধি পেয়েছে, বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক উন্নতি হচ্ছে; ঠিক সেই সময় এসব ঘটনা প্রত্যেকটা কাজের ক্ষেত্রে হোঁচট খাচ্ছে। তিনি প্রশ্ন রেখে বলেন, যারা এ ধরনের ঘটনা ঘটাচ্ছে তাদের কী কোন দেশপ্রেম নেই? এদের কী মানুষের প্রতি কোনই ভালবাসা নেই? দায়িত্ববোধ নেই? প্রধানমন্ত্রী বলেনÑ মানুষ যাতে ভাল থাকে, দু’বেলা পেট ভরে ভাত খেতে পারে, একটু সুন্দরভাবে বাঁচতে পারে, ছেলেমেয়েরা লেখাপড়া শিখতে পারে, মানুষ চিকিৎসা সেবা পায়, মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হয়, মানুষ যাতে উন্নত জীবন পায়- সে লক্ষ্য নিয়েই দিনরাত পরিশ্রম করে যাচ্ছি। তিনি বলেন, আমরা সরকারী চাকরিজীবীদের প্রত্যেকের বেতন-ভাতা ১২৩ ভাগের মতো বৃদ্ধি করেছি। পৃথিবীর কোন দেশ তা পারেনি। বিশ্বের কোন সরকার নেই যে তারা একসঙ্গে এত বেতন বৃদ্ধি করতে পারে। কিন্তু আমরা তা করতে পেরেছি। কারণ, অথনৈতিকভাবে যত সফলতা অর্জন করতে পারব ততই আমরা এসব কাজ করতে পারব। মহাসড়কে দুর্ঘটনা রোধে সরকারের নেয়া বিভিন্ন পদক্ষেপ তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, এসব কারণে দুর্ঘটনা অনেক কমে গেছে। তবে কেউ যদি ফুটওভার ব্রিজ ব্যবহার না করে চলন্ত গাড়ির সামনে দিয়ে দৌড় দিয়ে রাস্তা পার হয় তাহলে দোষ কাকে দেবেন? নিশ্চয়ই যে দৌড় দিয়ে পার হতে যাবে, তারই। আশা করি, কেউ তা করবেন না। ফুটওভার ব্রিজ ব্যবহার করবেন। চলন্ত গাড়ির সামনে দিয়ে দৌড়াবেন না। আমি এটুকুই চাই যে, আমাদের দেশের মানুষ নিরাপদে থাকুক। মানুষের জীবন উন্নত হোক। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ গড়ার দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করে তারই কন্যা শেখ হাসিনা বলেন, ইনশাল্লাহ এই বাংলাদেশে যত বাধা-বিপত্তিই আসুক না কেন, সব চড়াই-উৎরাই পার করেই বাংলাদেশের অথনৈতিক উন্নয়নের অগ্রযাত্রা অব্যাহত থাকবে। ২০২১ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের দেশ এবং ২০৪১ সালের মধ্যে দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশ উন্নত-সমৃদ্ধশালী হয়ে গড়ে উঠবেই। অনুষ্ঠানে অন্যদের মধ্যে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল আবু বেলাল মোহাম্মদ শফিউল হকসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উর্ধতন কর্মকর্তাগণ উপস্থিত ছিলেন।
×