ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

প্রতিক্রিয়া ॥ প্রসঙ্গ ॥ কেন বা জঙ্গী হচ্ছে, ফিরবেও বা কোন্ পথে এবং কিছু কথা

প্রকাশিত: ০৪:০৬, ৩ জুলাই ২০১৬

প্রতিক্রিয়া ॥ প্রসঙ্গ ॥ কেন বা জঙ্গী হচ্ছে, ফিরবেও বা কোন্ পথে এবং কিছু কথা

২৩ জুন ২০১৬ তারিখে দৈনিক জনকণ্ঠে প্রকাশিত স্বদেশ রায়ের ‘কেন বা জঙ্গী হচ্ছে, ফিরবেও বা কোন্ পথে’ কলামটি ব্যতিক্রমধর্মী ও সময়োপযোগী। লেখাটি পড়েছি এবং একজন সচেতন পাঠক হিসেবে আমার প্রতিক্রিয়া এই লেখায় তুলে ধরছি। আমি দীর্ঘদিন ধরে একজন নিয়মিত পাঠক হিসেবে খেয়াল করেছি, কে কী বলল, লেখল বা অন্যরা, ভিন্নমতাবলম্বীরা কোথায় কী লেখল, বলল, লেখক তার কোনটাই আমলে নেন না। এমনকি অন্যদের চিন্তাকে সমর্থন করেন কিনা বা বিরোধিতা করেন কিনা; বিরোধিতা করলে কেন তার সপক্ষে কোন যুক্তি বা লেখা কোথাও দেন না। সব সময় শুধু দেখেছি অন্যরা যাই বলে বলুক, যতই যুক্তিসঙ্গত কথা বলে বলুক, তিনি শুধু তার নিজের মতো করে লিখে গেছেন। তার লেখা পড়ে এমনটাই ধারণা করতে শুরু করেছিলাম যে, অন্যরা যা বলছে তা ভুল, শুধু তিনি যেটা বলেন সেটাই ঠিক। এতে করে আমার প্রায়ই মনে হতো, তিনি কোথাও আটকা পড়ে গেছেন; কোন স্বার্থের কাছে, কোন স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীর কাছে। তাই তিনি অনেক সত্যকে, অনেক বাস্তবকে চোখে দেখেন না বা দেখলেও চেপে যান। এটা বুদ্ধিবৃত্তিক সততা নয়, এটা মানবকল্যাণবিরোধী অবস্থান। তবে তার ২৩ জুনের লেখাটি পড়ে মনে হলো, নাহ্্ লেখকের বোধহয় চোখ কিছুটা খুলতে শুরু করেছে, সেই খোলা চোখ দিয়ে মনের কুঠুরিতে কিছুটা আলো পড়তে শুরু করেছে। আমার মনে হয়েছে, লেখকের ব্যাপক পড়াশোনা। তার অন্তর্দৃষ্টি খুলতে শুরু করেছে। তা না হলে, তিনি চলমান সব রাজনৈতিক ও আনুষঙ্গিক বিষয়কে এক রৈখিক মাইন্ডসেটের ফ্রেমে ফেলে সব সময় চিন্তা করতেন ও সে মোতাবেক লিখতেন। সেই তিনি কিভাবে এ কথা বলেন যে, ‘...সাধারণ পশ্চিমাদের দ্বারা মুসলিম মাইন্ড এনালাইসিস করা সম্ভব নয়। বিষয়টি যারা মুসলিম সমাজের অন্তর চেনে সে ধরনের মুসলিম পরিবারে জন্ম নেয়া স্কলারদের হাত দিয়ে আসতে হবে।’ তারপর লেখক আরও বলেছেন, যা অবশ্যই একটি উল্লেখ করার মতো স্বীকারোক্তি, তা হলো, ‘...তবে আমাদের মতো অর্ধশিক্ষিত ও সাধারণ সাংবাদিকদের চোখে কিছু কিছু বিষয় খুব হাল্কাভাবে আসে। গবেষকরা হয়ত এর গভীরে যেতে পারবেন।’ এ উপলব্ধিমূলক কথাগুলো দ্বারা তিনি যে বেশকিছু সত্যকে দেরিতে হলেও অনুধাবন করতে পেরেছেনÑ তা খুব পরিষ্কারভাবে বোঝা যায়। এ প্রসঙ্গে একটু বলি, তার উপরোক্ত বক্তব্য দুটির সূত্র ধরে এবং সমাজবিজ্ঞানের সরাসরি প্রাতিষ্ঠানিক ছাত্র হওয়ার সুবাদে বলতে চাই, সমাজবিজ্ঞান সমাজকে অধ্যয়ন করার জন্য যে সব গবেষণা পদ্ধতি ব্যবহার করে তার অন্যতম প্রধান দুটি পদ্ধতির নাম হলো, ‘পার্টিসিপেটরি অবজারভেশন’ (অংশগ্রহণমূলক পর্যবেক্ষণ) ও ‘ইনডেপথ এনালাইসিস’ (অন্তর্দৃষ্টিমূলক অনুধ্যান) এ দুটি গবেষণা পদ্ধতি যেমন সমাজের প্রকৃত চিত্রকে তুলে নিয়ে আসতে কার্যকর; পাশাপাশি এ কথাও বলতে হয় যে, এ দুটি পদ্ধতি প্রয়োগ করাও বেশ কঠিন। কারণ সে রকম মানের, চিন্তার ও সততার অধিকারী গবেষক না হলে কখনই এ দুটি পদ্ধতি ব্যবহার করে প্রকৃত সত্যকে তুলে আনা সম্ভব নয়। এসব কথা বলার মানে হলো, তার এ উপলব্ধি হওয়ার বিষয়টিকে হাইলাইট করার চেষ্টা করা। তিনি আর এক জায়গায় উল্লেখ করেছেন ‘...এ অবস্থা কাটানোর জন্য গোটা বিশ্বকে এক হয়ে কাজ করতে হবে এবং আইন প্রয়োগের পাশাপাশি গবেষণা করে এদের চরিত্র বদলানোর পথ খুঁজতে হবে।’ লেখক এ বিষয়টি উপলব্ধি করেছেন বলেই বলছি, হ্যাঁ, শুধু আইন প্রয়োগ, জোরজবরদস্তি, চাপাবাজি-গলাবাজি আর মাঠের সস্তা রাজনীতি দিয়ে এ সমস্যার সমাধান করা যাবে না এবং এতদিন তা করাও যায়নি। অতএব সমস্যার গোড়ায় যেতে হবে। কেন এমনটি হচ্ছে, যারা যাচ্ছে তারা কারা তারা কেন যাচ্ছে? এরা কিন্তু শুধুই কিছু নগদ প্রাপ্তির আশায় যাচ্ছে না, কোন আদর্শকে ধারণ করে যাচ্ছে? কাউকে কাউকে শাস্তি দিয়েও কেন এদের এ পথচলাকে থামানো যাচ্ছে না? তাদের এ আদর্শ কেন তাদের কাছে এত মহামূল্যবান? এ আদর্শের ভিত্তিটা কীÑ কোন্ ভিত্তির ওপরই বা দাঁড়িয়ে আছে তাদের এ আদর্শ? তো এসব প্রশ্নের উত্তর আমাদের খুঁজে বের করতে হবে। শুধু ক্রসফায়ারে ফেলে দিয়ে বা বন্দুকযুদ্ধ থিয়োরি দিয়ে এ যাত্রাকে থামানো যাবে না। শুধু বিপক্ষশক্তি বা প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার সূত্রকে মাথায় ধারণ করে সব সময় একই বুলি আওড়িয়ে এ সমস্যার সমাধান করা যাবে না। জিল্লা-হুজুগ, ছেলে ভুলানো বুলি, হুমকি ধমকি, বাঁশ প্রদান ‘৫৭ ধারা প্রবর্তন-এর কোন কিছু দিয়েই এ সমস্যার সমাধান করা যাবে না, বরং এগুলো করে সমাজকে আরও বিভক্ত, দ্বিধাগ্রস্ত, সমন্বয়হীন ও অস্থিরই করে তোলা হবে। যার দ্বারা সমস্যাকে সমাধান না করে বরং সমস্যাটিকে আরও জটিল ও বহুমুখী করে ফেলা হবে। তিনি তো এ লেখায় বলেছেন, সমাজ হচ্ছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। টিকিয়ে রাখতে হবে সুসমন্বিত, সামঞ্জস্যপূর্ণ, স্থির-নিরবচ্ছিন্ন সমাজ ব্যবস্থা তথা সমাজচলন। কারণ সমাজই মূল। কাজেই সাময়িক ফায়দা লোটার জন্য একে ধ্বংস করা যাবে না। তিনি যে এ বিষয়টা উপলব্ধি করেছেনÑ এটা যে আমাদের জন্য কত বড় একটা প্রাপ্তি তা হয়ত সময়ই বলে দেবে। কারণ অনেক গুয়ার্তুমির নিগড়ে নিমজ্জিত থাকলেও ‘জনকণ্ঠ’ এখনও দেশের একটা বিরাট বুদ্ধিবৃত্তিক চিন্তাসম্পন্ন ব্যক্তিবর্গ পড়ে। চিন্তা করেও তাদের চিন্তাকে সে মোতাবেক ধাবিত করে। কাজেই এ ধরনের উপলব্ধির প্রয়োজন ছিল এ সঙ্কটময় মুহূর্তে। এবার তার অন্যান্য লেখার কিছু খ- খ- ও বিচ্ছিন্ন পর্যালোচনা। ‘...নব্বইয়ে তখন রাজপথের আন্দোলনসহ আরও অনেক খবরের কাজ, পাশাপাশি নানা কাজে এ বিষয়টির গভীরে যাওয়ার কোন সময় পাইনি বা সম্ভবও হয়নি। শুধু মাথার ভেতরে থেকে যায়, কেন এমন পরিবার থেকে শিবিরে যাচ্ছে? অথচ তিনি বলছেন একটি রূঢ় সত্য কথা যে, নানা ব্যস্ততার তিনি বিষয়টির গভীরে যেতে পারেননি তথা বিষয়টির আপাদমস্তক জানতে পারেননি। অথচ এই তার খ- জ্ঞান, শোনা কথা, প্রচার ও তা থেকে তৈরি ‘মাইন্ডসেট’কে ব্যবহার করে দিনে দিনে ‘জনকণ্ঠ’ ও অন্যান্য জায়গায় শিবির, ছাত্রসেনা, হিযবুত তাহ্রী, জেএমবি, হুজি প্রভৃতি সম্পর্কিত কত বড় বড় লেখা লিখেছেন; একে ওকে কতভাবে, কতবার আসামির কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছেন। এ রকম অর্ধজ্ঞান ও ভাসা ভাসা ধারণা ও মাইন্ডসেট নিয়ে কত বিশাল ‘জ্ঞানগর্ভ’ লেখা লিখেছেন। এখন বলুন, এগুলো সঠিক হয়েছে, না এর মধ্যে কোন বুদ্ধিবৃত্তিক সততা রক্ষিত হয়েছে? অথবা এর দ্বারা কি সমস্যার সমাধান করা গেছে, না সমস্যার মূলে যাওয়া গেছে? না, কোনটিই হয়নিÑ যা হয়েছে তা হলো সমাজে বিভ্রান্তি, ভুল বোঝাবুঝি। ‘...তখন বার বার আমার রিপোর্টারদের বলেছি, তোমরা একটু ভাল করে খোঁজখবর নিয়ে নিউজ করার চেষ্টা কর তোÑ কেন?’ আসলে ভাল করে খোঁজখবর নিয়ে নিউজ করার কথা বলেছেন হয়ত। আবার তার পাশাপাশি হয়ত এ মেসেজটিও রিপোর্টারদের দিয়ে রেখেছিলেন যে, আমাদের পত্রিকার ভাষ্যের বা মালিক পক্ষের বক্তব্যের বিপরীতে যাতে কিছু না যায়। এর মানে হলো, খোঁজখবর নাও ঠিক আছে, কিন্তু রিপোর্ট করবা পত্রিকার সুরে। এটা অনেকটা রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর মতো। কোন ঘটনা ঘটলে রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে মাঠে নামানো হয় সত্য তুলে আনার জন্য। কিন্তু মেসেজ দেয়া থাকে, প্রতিপক্ষকে ভিলেন বানানো চাই, যদি কোন সত্য নিজেদের ত্রুটিকে বা সংশ্লিষ্টতা সামনে নিয়ে আসে তবে তা যেন কোনভাবেই ফাইনাল রিপোর্টে বা মিডিয়াতে চলে না আসে। যেমন ‘জজ মিয়া’ তদন্ত, রমনা, যশোর উদীচী, নারায়ণগঞ্জ বোমা হামলা তদন্ত, ইতালিয়ান নাগরিক হত্যা তদন্ত ইত্যাদি ইত্যাদি। লেখকের লেখায় ছাত্র রাজনীতির কথা, ডাকসু নির্বাচনের কথা এসেছে। তিনি বলেছেন, এগুলো নেই বলে অনেক অপশক্তি-অপসংস্কৃতি মাথা তুলে দাঁড়ানোর সুযোগ পেয়েছে। কিন্তু যখন বিশ্ববিদ্যালয়গুলো, হলগুলো, ভিসি অফিসগুলো, সিনেট সিন্ডিকেটগুলো, স্বৈরাচারী আমল, অগণতান্ত্রিক আমলের মতোই একের পর এক চর দখলের মতো দখল হয়ে যাচ্ছিল তখন তিনি বা তার রিপোর্টাররা কেউ কিছু বলেননি, লেখেননি। উপরন্তু কেউ লিখলে বা প্রতিবাদ করলে উল্টো জামায়াত-শিবিরের চর বলে ‘কমন’ গালি দিয়ে এসব অন্যায়কে জায়েজ করেছেন। এখন এ পর্যায়ে এসে তারা ওই সব কাজের (সব আমলের) ফল দেখে আঁতকে উঠছেন! হাস্যকর। যখনই যে সরকার ক্ষমতায় থাকে তার যুব সংগঠনের কর্মী মানেই একটি আতঙ্ক। তাদের কাজ পান দোকান থেকে শুরু করে কন্সট্রাকশন। বাস স্টেশন, অটোস্ট্যান্ড এমনি রিক্সাস্ট্যান্ড থেকেও চাঁদা আদায়। যাক, অবশেষে একটি সত্য ও নির্দলীয় বাস্তবকে চোখে দেখেছেন। এখানেও যে আগের মতো শুধু ‘কেষ্টা বেটাই চোর’ এই দৃশ্য দেখেন নাই সে জন্য ধন্যবাদ। আর সর্বশেষে সর্বশ্রেষ্ঠ উক্তি, ‘...তাই শুধু আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাহায্যে এখান থেকে চিরস্থায়ীভাবে বের হয়ে আসা যাবে না।’ এর জন্য লেখককে আবারও অভিনন্দন। আশা করি, পরবর্তীতে লেখকের লেখাগুলো হবে, সত্যনির্ভর, নির্দলীয়, গোষ্ঠী স্বার্থ নিরপেক্ষ ও অন্তর্দৃষ্টিমূলক এবং কোনভাবেই গতানুগতিক ধারণা নির্ভর নয়। সবশেষে সব কিছুর জন্য লেখককে ধন্যবাদ। [email protected]
×