ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

অধ্যাপক হাসান আবদুল কাইয়ূম

পবিত্র লায়লাতুল কদর ॥ এক মহিমান্বিত রজনী

প্রকাশিত: ০৩:৫৩, ২ জুলাই ২০১৬

পবিত্র লায়লাতুল কদর ॥ এক মহিমান্বিত রজনী

পবিত্র লায়লাতুল কদরকে ফারসীতে বলা হয় শব-ই-কদর। লায়লাতুল কদর এক মহিমান্বিত রজনী। এই রাত মহিমাময় হয়েছে কুরআন নাযিলের কারণে। আমরা জানি, প্রিয় নবী হযরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম পঁচিশ বছর বয়সে হযরত খাদীজাতুল কুবরা রাদিআল্লাহু তা’আলা আনহাকে শাদি করেন। তারপর থেকে এক অজানা আকর্ষণে তিনি হেরা গুহায় গিয়ে অধিকাংশ সময় অতিবাহিত করতেন এবং গভীর মুরাকাবায় নিমগ্ন থাকতেন। ৪০ বছর বয়সে উপনীত হলে ৬১০ খ্রিস্টাব্দের রমাদান মাসের শেষের দিকে এক গভীর রাতে তিনি লক্ষ্য করলেন দূর আসমান থেকে অতি দ্রুতবেগে এক নূর তাঁর দিকে ছুটে আসছে। দেখতে না দেখতেই একটা অনিন্দ্যসুন্দর শুভ্রপোশাক পরিহিত অচেনা একজন তাঁর সামনে এসে দাঁড়িয়ে একটা নূর চমকানো সোনালি হরফে লেখা পুস্তক তাঁর সামনে তুলে ধরে বললেন : আপনি পাঠ করুন। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম বললেন : আমি তো পড়তে জানি না। তখন সেই নূরানী চেহারার আগন্তুক তাঁকে এমন জোরে আলিঙ্গন করলেন যে, তাঁর মনে হচ্ছিল তিনি এ চাপে বিদীর্ণ হয়ে যাবেন। এভাবে তিনবার করার পর প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলায়হি ওয়া সাল্লাম ওই কিতাব থেকে পাঁচখানি আয়াতে কারীমা আত্মস্থ করলেন। এই পাঁচখানি আয়াতে কারীমা হচ্ছে : ইকরা বিইসমি রব্বিকাল্লাযী খালাক, খালাকাল ইনসানা মিন ‘আলাক, ইকরা ওয়া রব্বুকাল আকরামুল্লাযী’ আল্লামা বিল কালাম, ‘আল্লামাল ইনসানা মালাম ইয়া’লাম।Ñ পাঠ কর, তোমার রবের নামে যিনি সৃষ্টি করেছেন, সৃষ্টি করেছেন মানুষকে আলাক হতে। পাঠ কর আর তোমার রব্ মহামহিমান্বিত, যিনি কলমের সাহায্যে শিক্ষা দিয়েছেন, শিক্ষা দিয়েছেন মানুষকে যা সে জানত না। (সূরা আলাক : আয়াত ১-৫)। মূলত কুরআন মজীদ লওহে মাহফুজে সংরক্ষিত রয়েছে। এ সম্পর্কে ইরশাদ হয়েছে : বালহুয়া কুরআনুম মাজীদ, ফী লাওহিম্ মাহ্ফুজÑ বরং এ সম্মানিত কুরআন রয়েছে লওহে মাহফুজে (সূরা বুরুজ : আয়াত ২১-২২)। ৬১০ খ্রিস্টাব্দের রমাদান মাসের শেষ দশকের কোন এক বেজোড় রাতে অধিকাংশের মতে ২৭ রমাদান রাতে অর্থাৎ ২৬ রমাদান দিবাগত রাতে এই কুরআন মজীদ পৃথিবীতে হযরত মুহম্মাদুর রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের নিকট নাযিল করার জন্য সিদরাতুল মুনতাহা মকামে হযরত জিবরাঈল ‘আলায়হিস সালামকে দেয়া হয়। তিনি ওই কিতাব নিয়ে হেরা গুহায় অবতরণ করেন। তা থেকে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম পাঁচখানি আয়াতে কারীমা আত্মস্থ করলে তা পৃথিবীর আসমানে বায়তুল ইজ্জতে রাখা হয় এবং তেইশ বছর ধরে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ঘটনা অথবা অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে এর থেকে প্রয়োজনীয় অংশ কখনও একটা সূরা, কখনও একখানি কিংবা একাধিক আয়াত আবার কখনও একটি আয়াতের অংশবিশেষ আকারে নাযিল হয়। এই খ-ে খ-ে কুরআন কেন নাযিল হলো সে সম্পর্কে আল্লাহ্ জাল্লা শানুহু ইরশাদ করেন : (হে রসূল) আমি কুরআন নাযিল করেছি খ- খ-ভাবে যাতে আপনি তা মানুষের নিকট পাঠ করতে পারেন ক্রমে ক্রমে এবং আমি তা ক্রমশ অবতীর্ণ করেছি (সূরা বনী ইসরাঈল : আয়াত ১০৬)। কুরআন মজীদ লওহ মাহফুজ থেকে প্রথম যে রাতে নাযিল হয় সেই রাতটিকে আল্লাহ্ জাল্লা শানুহু লায়লাতুল কদর নামে অভিহিত করেছেন এবং রাতের মাহাত্ম্যও ব্যক্ত করেছেন। আল্লাহ্ জাল্লা শানুহু ইরশাদ করেন : নিশ্চয়ই আমি তা (আল কুরআন) নাযিল করেছি লায়লাতুল কদরে। আপনি কি জানেন, লায়লাতুল কদর কী? লায়লাতুল কদর সহস্র মাস অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ। এ রাতে ফেরেস্তাগণ ও রুহ নাযিল হয় প্রত্যেক কাজে তাদের রবের অনুমতিক্রমে, শান্তি বিরাজ করে এই রাতে ঊষার আবির্ভাব পর্যন্ত (সূরা কদর : আয়াত ১-৫)। এই সূরা কদর নাযিল হওয়ার শানে নুযুল হচ্ছে : একবার সাহাবায়ে কেরামকে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম বনী ইসরাঈলের শামউন নামক এক আবিদ ও যাহিদের আখলাক সম্পর্কে বলেছিলেন যে, সেই আবিদ-যাহিদ লোকটি হাজার মাস বিরতিহীনভাবে সারারাত জেগে ইবাদত-বন্দেগী, যিকর-আযকার করতেন এবং সারাদিন সিয়াম পালন করতেন ও আল্লাহর রাস্তায় লড়াই করতেন। সাহাবায়ে কেরাম এই আবিদ-যাহিদের বৃত্তান্ত শুনে নিজেদের স্বল্প আয়ুর কথা ভেবে আফসোস করছিলেন। এমন সময় সূরা কদর নাযিল হলো এবং তাতে ইরশাদ হলো : লায়লাতুল কাদরি খায়রুম মিন আলফি শাহ্র- হাজার মাস অপেক্ষা শ্রেয় হচ্ছে লায়লাতুল কদর। অর্থাৎ একটি মাত্র রজনী না ঘুমিয়ে সারা রাত ইবাদত-বন্দেগী, যিকর-আযকার, মুরাকাবা-মুশাহাদার মধ্যে অতিবাহিত করতে পারলে হাজার মাস অর্থাৎ ৮৩ বছর চার মাস লাগাতার রাতদিন ইবাদত করলে যে সওয়াব লাভ হতো তার চেয়েও অনেক বেশি সওয়াব লাভ হয়। এই রাত সম্পর্কে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, যে ব্যক্তি লায়লাতুল কদরে ইমানের সঙ্গে সওয়াব লাভের অভিলাষে দ-ায়মান হয় (ইবাদত-বন্দেগীতে রত হয়) তার পূর্ববর্র্তী গুনাহসমূহ ক্ষমা করে দেয়া হয় (বুখারী শরীফ)। এই রাতে অজস্র্র ধারায় আল্লাহর রহমত বর্ষিত হয়। এই রাতে আল্লাহর ফেরেশতাগণ এবং ফেরেশতাদের নেতা হযরত জিবরাঈল আলায়হিস সালাম পৃথিবীতে অবতরণ করে ইবাদতরত সব মানুষের জন্য খাসভাবে দু’আ করতে থাকেন। এই রাতে এত অধিক সংখ্যায় রহমতের ফেরেশতা পৃথিবীতে অবতরণ করে যে, সকাল না হওয়া পর্যন্ত এক অনন্য শান্তি বিরাজ করতে থাকে। ২৭ রমাদান রাতেই যে লায়লাতুল কদর এ সম্পর্কে পর্যালোচনা করে দেখা গেছেÑ সূরা কদরে লায়লাতুল কদর তিনবার উল্লিখিত হয়েছে। আরবীতে লায়লাতুল কদর লিখতে নয়টি হরফ লাগে। এ নয়কে তিন দিয়ে গুণ করলে ২৭ হয়, যা ২৭ রমাদানকে প্রমাণ করে। এছাড়াও রমাদানের জন্য খাস তারাবীহ্্র সালাত প্রতিদিন কুড়ি রাক’আত পড়তে হয়। যাতে লায়লাতুল কদরে গিয়ে কুরআন মজীদের এক খতম হয় সেদিকে লক্ষ্য রেখে হযরত উসমান (রা)-এর খিলাফতকালে কুরআন মজীদ ৫৪০ রুকুতে বিন্যাস করা হয়। কুড়ি রাক’আতের এক এক রাক’আতে এক এক রুকু করে তিলাওয়াত করলে প্রতিদিন ২০ রাক’আতে কুড়ি রুকু হয়, ফলে ২৭ রমাদানে গোটা কুরআন মজীদ সমাপ্ত হয়। অর্থাৎ ৫৪০ রুকু পড়া হয়ে যায়। হাদীস শরীফে আছে যে, হযরত আয়িশা রাদিআল্লাহু তা’আলা আন্্হা প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামকে জিজ্ঞাসা করলেন : ইয়া রসূলুল্লাহ্্! আমি যদি লায়লাতুল কদর পাই তখন আমি কি করব? তিনি বললেন : তুমি বলবে, আল্লাহুম্মা ইন্নাকা আফউবুন, তুহিব্বুল আফওয়া ফা’ফুআন্নীÑ হে আল্লাহ্ নিশ্চয়ই আপনি ক্ষমাশীল, আপনি ক্ষমা করতে ভালবাসেন, অতএব আমাকে ক্ষমা করুন। লায়লাতুল কদরের ফায়দা হাসিল করার চেষ্টা সবার করা উচিত। এ রাতে না ঘুমিয়ে বেশি বেশি কুরআন তিলাওয়াত, যিকর-আযকার, মুরাকাবা-মুশাহাদা, দু’আ-দরুদ, তওবা-ইসতিগফার, মিলাদ মাহফিল, সওয়াব রিসানির মধ্য দিয়ে কাটানো উচিত। এই রাতে নফল সালাত আদায়ের মধ্যেও অশেষ সওয়াব রয়েছে। লায়লাতুল কদরে সালাত দু’রাকআত করে যত পারা যায় পড়া যায়। এই সালাতের নিয়ত হচ্ছে : নাওয়াইতুআন্্ উসাল্লিয়া লিল্লাহি তা’আলা রাক’আতাই সালাতিল লায়লাতিল কাদ্রি মুতাওয়াজ্জিহান ইলা জিহাতিল কা’বাতিশ শারীফাতি আল্লাহু আকবার। এই সালাতে সূরা ফাতিহার পরে সূরা কদর এবং অন্য রাক’আতে সূরা ফাতিহার পরে সূরা ইখ্লাস পড়া যেতে পারে। এই মহিমান্বিত রজনী আল্লাহ্্ তা’আলা আমাদের প্রতি বিশেষ দয়া করে দান করেছেন। এই সুযোগ গ্রহণ করা থেকে আমরা যেন নিজেদের বঞ্চিত না করি। এক বর্ণনায় আছে যে, এই রাতে গাছপালা, তরু-লতা পর্যন্ত আল্লাহ্কে সিজ্্দা করে। এই মহিমান্বিত রজনীতে সবারই উচিত জাগ্রত থেকে ইবাদতের মাধ্যমে কাটানো। হযরত ইমাম গাযালী (র) লিখেছেন : এই রাতে নূরের প্রাচুর্য থাকে, অফুরন্ত তাজাল্লীর বিভা বিভাসিত হয় এবং উর্ধ জগতের নানা মহিমা বিচ্ছুরিত হয়। যুগশ্রেষ্ঠ সুফী হযরত মওলানা শাহ্্ সুফী আলহাজ তোয়াজউদ্দীন আহমদ রহমাতুল্লাহি আলায়হি বলেছেন : শব-ই-কদরে আল্লাহ্র রহমতের জ্যোতি সমস্ত পৃথিবীকে আচ্ছাদিত করে। লেখক : পীর সাহেব, দ্বারিয়াপুর শরীফ, উপদেষ্টা ইনস্টিটিউট অব হযরত মুহম্মদ (সা.), সাবেক পরিচালক ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ
×