ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

নেতাকর্মীদের আশঙ্কা

খালেদা বা তারেকের সাজা হলে বিএনপি নেতৃত্ব সঙ্কটে পড়বে

প্রকাশিত: ০৬:০১, ৩০ জুন ২০১৬

খালেদা বা তারেকের সাজা হলে বিএনপি নেতৃত্ব সঙ্কটে পড়বে

তপন বিশ্বাস ॥ বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বেশ কয়েকটি মামলা চূড়ান্ত পর্যায়ে। দলের দ্বিতীয় ব্যক্তি তারেক রহমানের অবস্থান প্রবাসে। বর্তমান পরিস্থিতিতে তার দেশে ফেরার কোন সম্ভাবনাই নেই। তারেক রহমানের বিরুদ্ধেও রয়েছে কয়েকটি মামলা। দু’জনের মামলারই যে কোন সময় নিষ্পত্তি হতে পারে বলে আইনজীবীদের ধারণা। এইসব মামলায় খালেদা জিয়া কিংবা তারেক রহমানের সাজা হলে বিএনপি চরম নেতৃত্ব সঙ্কটে পড়বে বলে দলের নেতাকর্মীরা আশঙ্কা প্রকাশ করছেন। দলের একাধিক সূত্র দাবি করছে, ভবিষ্যত নেতৃত্বের অনিশ্চয়তায় কাউন্সিল করেও দলের গতি ফিরাতে পারেননি খালেদা জিয়া। উপরন্তু মাঠ পর্যায়ে চরম হতাশায় দলের সাংগঠনিক কাঠামো আরও দুর্বল হয়ে পড়েছে। সংগঠন চাঙ্গা করার লক্ষ্যে ইউপি নির্বাচনে শেষ পর্যন্ত লড়ে গেলেও ফল কিছু হয়নি। নির্বাচনে বিপর্যয়কর ফল এবং নির্বাচনকে কেন্দ্র করে অভ্যন্তরীণ কোন্দল, মনোনয়ন বাণিজ্যের অভিযোগে সংগঠন চাঙ্গা হওয়ার পরিবর্তে বরং ক্ষতিই হয়েছে বেশি। কেন্দ্রীয় কাউন্সিলের দীর্ঘ দিন পরও পূর্ণাঙ্গ কমিটি করতে না পারার কারণে মাঠ পর্যায়ে নেতাকর্মীদের কাছে অশুভ বার্তা যাচ্ছে। দলের সিনিয়র জুনিয়র দ্বন্দ্ব, তারেক রহমান অনুসারীদের দৌরাত্ম্য এবং সর্বোপরি মামলা মোকদ্দমার ঝক্কিতে সাংগঠনিক কার্যক্রম নেই বললেই চলে। শুধু কেন্দ্রীয় কমিটি নয়, আহ্বায়ক, যুগ্ম আহ্বায়ক নির্বাচিত করেও দীর্ঘ সময় ধরে ঢাকা মহানগর কমিটি করতে না পারার কারণে আন্দোলনকারী নেতাকর্মীদের মধ্যেও হাতাশা। সব মিলিয়ে দলের বিপর্যস্ত অবস্থার মধ্যে যুক্ত হয়েছে শীর্ষ দুই নেতার মামলা নিয়ে দুশ্চিন্তা। অদূরভবিষ্যতে খালেদা জিয়া এবং তারেক রহমান সাজাপ্রাপ্ত হলে কে ধরবেন দলের হাল এ নিয়ে দলের মধ্যে আলোচনা শুরু হয়েছে। সম্প্রতি এক ইফতার মাহফিলে প্রধান অতিথির বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে উদ্দেশ করে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া বলেন, ক্ষমতায় আসার পর প্রধানমন্ত্রী (শেখ হাসিনা) ১৫টি মামলা থেকে মুক্ত হয়েছেন। অথচ আমার একটি মামলাও প্রত্যাহার হয়নি। উপরন্তু একের পর এক মিথ্যা মামলা দিয়ে আমাকে নিয়ে টানাহেঁচড়া চলছে। খালেদা জিয়ার এই বক্তব্যে দলের নেতাকর্মীরা আরও নিশ্চিত হয়ে গেছেন, শীঘ্রই তারা নেতৃত্ব সঙ্কটের মুখে পড়ছেন। স্বাভাবিকভাবেই জল্পনা কল্পনা ডালপালা গজাচ্ছে। জানা গেছে, এমন পরিস্থিতিতে বিএনপির হাল ধরবেন কে এনিয়ে এখনই আলোচনা শুরু হয়েছে। বিএনপির এখনই দুই গ্রুপ বেশ স্পষ্ট। তারেক রহমানের অনুসারী তরুণ একটি গ্রুপ সব সময়ই সক্রিয়। দলের প্রবীণ নেতারা রয়েছেন অন্য দিকে। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক রাজনীতির কারণে তারা তারেক রহমানের নেতৃত্ব পছন্দ করেন না। এনিয়ে দলের মধ্যে প্রায়ই নানা ঘটনা ঘটে। দলের নব নিযুক্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে দুই কুল রক্ষা করতে গিয়ে দীর্ঘ সময় ভারপ্রাপ্তই থেকে যেতে হয়েছিল। দুই দিকের টানাটানিতে কোন রকমে সমন্বয় রক্ষা করে চলেছেন খালেদা জিয় নিজে। মামলায় শাস্তি হয়ে গেলে এই সমন্বয় ভেঙ্গে পড়বে এটি নিশ্চিত। এ কারণে এখন থেকেই অনেক নেতা দল ছেড়ে অন্য দলে আশ্রয় নেয়ার পথ খুঁজছেন। কেউ কেউ রাজনীতি ছেড়ে দেয়ারও চিন্তা ভাবনা করছেন বলে জানা গেছে। খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে যত মামলা ॥ বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে মোট ১৯টি মামলা রয়েছে। এর মধ্যে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) করা মামলা হচ্ছে পাঁচটি। বাকিগুলো ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন থানায় করা সহিংসতা, নাশকতা, রাষ্ট্রদ্রোহ ও মানহানির পিটিশন মামলা। মামলাগুলো যেভাবে দ্রুতগতিতে চলছে, তাতে মনে হয় খালেদা জিয়ার সাজা হওয়া সময়ের ব্যাপার মাত্র। ফলে দলের নেতা-কর্মীদের মধ্যে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বেড়েই চলেছে। খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে শুধুমাত্র দুর্নীতির অভিযোগে রয়েছে পাঁচটি মামলা। বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট সরকার ক্ষমতা ছাড়ার পর সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) এ মামলাগুলো দায়ের করে। এর মধ্যে জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলা, জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলা ও নাইকো দুর্নীতি মামলা সচল রয়েছে। জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি ॥ জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তার পুনরায় সাক্ষ্য জেরা এবং কেস ডকেট চেয়ে করা আবেদন খারিজের আদেশের বিরুদ্ধে খালেদা জিয়ার আপীল শুনানি ১ আগস্ট অনুষ্ঠিত হবে। গত বৃহস্পতিবার এ সংক্রান্ত এক আবেদনের শুনানি শেষে আপিল বিভাগের চেম্বার জজ আদালতের বিচারপতি মির্জা হোসেন হায়দার শুনানির জন্য এ দিন ধার্য করেন। এর আগে ১৫ মে হাইকোর্ট খালেদা জিয়ার দুটি আবেদন খারিজ করে আদেশ দেয়। ওই খারিজ আদেশের বিরুদ্ধে ২৬ মে আপীল করেন খালেদা জিয়া। উল্লেখ্য, সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান চ্যারিটেবল ট্রাস্টের নামে অবৈধভাবে আর্থিক লেনদেনের অভিযোগে খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে ২০১১ সালের ৮ আগস্ট রাজধানীর তেজগাঁও থানায় এ মামলাটি করে দুদক। ২০১২ সালের ১৬ জানুয়ারি খালেদা জিয়াসহ চারজনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেয়া হয়। জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি ॥ জিয়া অরফানেজ ট্রাস্টের ২ কোটি ১০ লাখ ৭১ হাজার ৬৪৩ টাকা আত্মসাতের অভিযোগে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ও সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানসহ ছয়জনের বিরুদ্ধে ২০০৮ সালের ৩ জুলাই রমনা থানায় মামলাটি করে দুদক। ২০১০ সালের ৫ আগস্ট আদালতে অভিযোগপত্র দেয়া হয়। মামলার অন্য আসামিরা হলেন সাবেক সংসদ সদস্য কাজী সালিমুল হক কামাল, ব্যবসায়ী শরফুদ্দিন আহমেদ, সাবেক সচিব কামাল উদ্দিন সিদ্দিকী ও মমিনুর রহমান। রাজধানীর বকশিবাজারে কারা অধিদফতরের প্যারেড মাঠে স্থাপিত তৃতীয় বিশেষ জজ আবু আহমেদ জমাদারের অস্থায়ী আদালতে এই মামলার বিচারিক কার্যক্রম চলছে। গত ১৬ জুন তিনজন সাক্ষী সোনালী ব্যাংকের কুমিল্লা কর্পোরেট শাখার ডিজিএম হারুন অর রশিদ, প্রাইম ব্যাংকের গুলশান শাখার ভাইস প্রেসিডেন্ট ইকবাল হোসেন এবং প্রাইম ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ের ভাইস প্রেসিডেন্ট মাসুদ বিন করিমকে জেরা শেষ করে আসামিপক্ষ। প্রধান আসামি বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার পক্ষে এ্যাডভোকেট আব্দুর রেজ্জাক খান, খালেদা জিয়ার বড় ছেলে বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের পক্ষে বোরহান উদ্দিন এবং মাগুরার সাবেক এমপি কাজী সালিমুল হক কামাল ওরফে ইকোনো কামাল ও ব্যবসায়ী শরফুদ্দিন আহমেদের পক্ষে রেজাউল করিম সরকার পর্যায়ক্রমে তাদের জেরা করেন। এরপর নতুন আরও চারজন সাক্ষী প্রাইম ব্যাংকের কর্মকর্তা আফজাল হোসেন, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের হিসাবরক্ষক মাজেদ আলী, প্রশাসনিক কর্মকর্তা আলফা সানি ও মোখলেছুর রহমানের জবানবন্দী সাক্ষ্যগ্রহণ করেন আদালত। নাইকো দুর্নীতি ॥ আগামী ১১ জুলাই বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াসহ ১১ জনের বিরুদ্ধে নাইকো দুর্নীতি মামলায় চার্জ শুনানি রয়েছে। গত ৭ জুন ঢাকার ৯ নম্বর বিশেষ জজ মোঃ আমিনুল ইসলাম সময়ের আবেদন মঞ্জুর করে এই তারিখ ধার্য করেন। নাইকো রিসোর্স কোম্পানিকে অবৈধভাবে কাজ পাইয়ে দেয়ার অভিযোগে ২০০৭ সালের ৯ ডিসেম্বর মামলা করে দুদক। বড়পুকুরিয়া দুর্নীতি ॥ খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে দায়ের করা বড়পুকুরিয়া কয়লাখনি দুর্নীতি মামলা। ঠিকাদারি কাজে ক্ষমতার অপব্যবহার এবং আর্থিক দুর্নীতির অভিযোগে ২০০৮ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি শাহবাগ থানায় মামলাটি করে দুদক। মামলায় খালেদা জিয়াসহ ১৬ জনকে আসামি করা হয়। খালেদা জিয়ার আইনজীবী সগীর হোসেন লিওন জানান, হাইকোর্টে মামলাটির শুনানি শেষে রায় ঘোষণা করা হয়। রায়ের বিরুদ্ধে আপীল করা হয়েছে। গ্যাটকো দুর্নীতি ॥ কনটেনার হ্যান্ডলিংয়ের জন্য গ্যাটকো লিমিটেডকে ঠিকাদার হিসেবে নিয়োগ দিয়ে রাষ্ট্রের এক হাজার কোটি টাকা ক্ষতির অভিযোগে খালেদা জিয়া ও তার ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকোসহ ১৩ জনকে আসামি করে ২০০৭ সালের ২ সেপ্টেম্বর তেজগাঁও থানায় মামলা করে দুদক। হাইকোর্টে মামলাটির শুনানি শেষে রায় ঘোষণা করা হয়। খালেদা জিয়ার আইনজীবী সগীর হোসেন লিওন জানান, রায়ের বিরুদ্ধে আপীল করা হয়েছে। সহিংসতা, নাশকতা, রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা ॥ এ ছাড়া খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে সহিংসতা ও নাশকতার অভিযোগে ঢাকাসহ দেশের থানায় বিভিন্ন মামলা রয়েছে। এর মধ্যে রাজধানীর গুলশান থানায় ১টি, কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম থানায় ২টি, খুলনা সদর থানায় ১টি এবং রাজধানীর যাত্রাবাড়ী থানার ৩টি রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা উল্লেখযোগ্য। এর মধ্যে গুলশান, কুমিল্লা ও খুলনার মামলাগুলো তদন্তাধীন। তবে যাত্রাবাড়ী থানার মামলাগুলোর অভিযোগপত্র দেয়া হয়েছে। এ ছাড়া রাষ্ট্রদ্রোহ ও মানহানির অভিযোগে চারটি পিটিশন মামলা রয়েছে। এসব মামলাও তদন্তাধীন আছে বলে জানা গেছে।
×