ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

ঈদে ঘরে ফেরা

বেশিরভাগ মহাসড়কই ভাল, তবে টাঙ্গাইলে যানজটের শঙ্কা

প্রকাশিত: ০৫:৫৫, ৩০ জুন ২০১৬

বেশিরভাগ মহাসড়কই ভাল, তবে টাঙ্গাইলে যানজটের শঙ্কা

রাজন ভট্টাচার্য ॥ এবারের ঈদ মৌসুমে দেশের বেশিরভাগ মহাসড়কের অবস্থা অন্য বছরগুলোর তুলনায় ভাল। খুশির ঈদে এটাই সবচেয়ে বড় স্বস্তির সংবাদ। অর্থাৎ অধিকাংশ সড়ক-মহাসড়কে শান্তিপূর্ণ ঘরে ফেরার সম্ভাবনা রয়েছে। তবে সড়ক ও মহাসড়ক বিভাগের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, এ বছর জাতীয় মহাসড়কের ৭১ ভাগই যানবাহন চলাচলের উপযোগী। তবুও ঢাকা-উত্তরবঙ্গের পথে ভোগান্তির কারণ হতে পারে টাঙ্গাইল মহাসড়কের যানজট। এই সড়কে চলতি মাসে অন্তত ২০ দিনই দীর্ঘ যানজট ছিল। তবে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদসহ যানবাহন চলাচলে বেশ কয়েকটি বিকল্প সড়কের কথা বলা হলেও পরিবহন মালিকদের দুশ্চিন্তা কাটছে না। তাছাড়া জয়দেবপুর চৌরাস্তায় বিভিন্ন পরিবহনের অবৈধ টার্মিনাল, বাসে যাত্রী ওঠানো ও পণ্যবাহী ট্রাকসহ ওয়াগনের কারণে বৃহত্তর ময়মনসিংহের যাত্রীদের যানজটের ভোগান্তি হতে পারে। ভোগড়া পয়েন্ট নিয়েও যানজটের চিন্তা কাটছে না। ঢাকা সিলেট ও চট্টগ্রাম মহাসড়কের চিত্র ভাল। তবে কোন মহাসড়কের পাশ থেকেই হাট-বাজার, টার্মিনালসহ অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ হয়নি। ঈদ মৌসুমে সড়ক মহাসড়কে থাকে বাড়তি গাড়ির চাপ। ফলে বাড়ে সড়ক দুর্ঘটনা। দুর্ঘটনাকবলিত গাড়ির কারণে দীর্ঘ যানজটের সৃষ্টি হয়। তাই পরিবহন মালিকদের দাবি, দুর্ঘটনা রোধে মহাসড়কে নিষিদ্ধ যানবাহন চলাচল একেবারেই বন্ধ করতে হবে। সকল মহাসড়কে দুর্ঘটনাকবলিত গাড়ি দ্রুত সরিয়ে নিয়ে প্রয়োজনীয় সংখ্যক রেকার রাখার বিকল্প নেই। পাশাপাশি মহাসড়কে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য মোতায়েন থাকলে যানজট এড়ানো অনেকটাই সম্ভব হবে। সড়ক পরিবহনমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের জানিয়েছেন, যানজটমুক্ত মহাসড়ক নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। ঢাকায় ১৪টি প্রবেশ পয়েন্টে যানজটপ্রবণ এলাকায় মোতায়েন থাকবে এক হাজার স্বেচ্ছাসেবক। দুর্ঘটনাকবলিত গাড়ি দ্রুত সরিয়ে নিতে মহাসড়কে থাকবে সেনাবাহিনীর রেকার। পরিবহন নেতা খন্দকার এনায়েত উল্লাহ জানিয়েছেন, ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়ক ছাড়া অন্য সড়কগুলো নিয়ে এবার যানজটের খুব একটা চিন্তা নেই। অন্য বছরের তুলনায় এ বছর রাস্তার অবস্থা সবচেয়ে ভাল বলেও জানান তিনি। তিনি বলেন, সরকারী ছুটি বেশি হওয়ার কারণে পরিবহনের চাপ কম থাকবে। আগে ভাগেই বাড়ি যাওয়ার প্রস্তুতি অনেকের। এছাড়া গার্মেন্টসও ছুটি হবে পালাক্রমে। তিনি জানান, সিটিতে চলা ও লক্কর ঝক্কর গাড়ি এবছর কোন অবস্থাতেই যেন মহাসড়কে উঠতে না পারে সেজন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। এ ব্যাপারে পরিবহন মালিকদের সমিতির পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিক চিঠি দেয়া হয়েছে। প্রতিটি টার্মিনালে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, বিআরটিএ, মন্ত্রণালয়, মালিক ও শ্রমিকদের সমন্বয়ে ভিজিলেন্স টিম থাকবে। কেন্দ্রীয় ভাবে তা পর্যবেক্ষণেরও ব্যবস্থা রয়েছে বলে জানান তিনি। ভোগান্তির কারণ হতে পারে ঢাকা-টাঙ্গাইল ॥ চলতি মাসের পরিসংখ্যান বলছে, প্রায় প্রতিদিনই এই মহাসড়কে যানজট ছিল। কোনদিন ৩০ কিলোমিটার। কখনও এরও বেশি। আবার ১০ কিলোমিটার যানজটের খবর ছিল কোন কোন দিন। রাজধানী থেকে চট্টগ্রাম-ময়মনসিংহ ফোর লেন প্রকল্পের কাজ শেষ হয়েছে। সিলেটের অবস্থা ভাল। ফোর লেন প্রকল্পের কাজ চলছে টাঙ্গাইল মহাসড়কে। তুলনামূলকভাবে এই গুরুত্বপূর্ণ মহাসড়কটি সবচেয়ে চাপা। গাড়ির চাপ যথেষ্ট। ভাঙাচোরা সড়ক, নির্মাণ সামগ্রীর স্তূপ, স্বল্প গতির যানবাহন, লোকাল গাড়ির আধিক্য, অবৈধ পার্কিং ও টার্মিনাল, রাস্তার দু’পাশে বাজারসহ নানা কারণে ঢাকা-টাঙ্গাইল আড়াই ঘণ্টার রাস্তা পাড়ি দিতে সময় লাগছে অন্তত ৬ থেকে ৮ ঘণ্টা। পরিবহন চালক ও মালিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ঢাকা-উত্তরবঙ্গ পথের ভোগান্তির মূল জায়গা এখন গাজীপুর-টাঙ্গাইল অংশ। অথচ এই সড়ক দিয়ে প্রায় ২০ জেলার যানবাহন নিয়মিত চলাচল করছে। এবার পবিত্র ঈদ-উল-ফিতর ও ঈদ-উল-আযহায় ঘরমুখী মানুষের যাতায়াত নির্বিঘœ করতে ২ জুন রাজধানীর রমনা রেস্তরাঁয় সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের সভাপতিত্বে আন্তঃমন্ত্রণালয় সভা হয়। সভায় হাইওয়ে পুলিশ ভুলতা উড়ালসড়ক ও গাজীপুর-টাঙ্গাইল অংশের মহাসড়কে ভোগান্তির আশঙ্কা প্রকাশ করে। সড়কের অবস্থা ও ঈদ প্রস্তুতি সম্পর্কে জানতে চাইলে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব এম এ এন সিদ্দিক সংবাদ মাধ্যমকে জানান, এখন পর্যন্ত যে অবস্থা, আশা করি, এবার সড়কের দুরবস্থার কারণে ঈদ মাটি হবে না। তবে অতি বর্ষা যদি অব্যাহত থাকে, কিছুটা সমস্যা হতে পারে। গাজীপুর-টাঙ্গাইল ও ভুলতা উড়ালসড়ক এলাকার যানজটের বিষয়ে তিনি বলেন, এই জায়গাগুলোতে সড়ক সম্প্রসারণ করা হয়েছে। ঈদে এই দুটি স্থানসহ যানজট-প্রবণ এলাকাগুলোতে এক হাজার স্বেচ্ছাসেবক নিয়োগ দেয়া হবে। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্লাহ জানান, ঢাকা থেকে উত্তরবঙ্গে চলাচলকারী যাত্রীবাহী বাসের সংখ্যাই প্রায় এক হাজার। ঈদ উপলক্ষে এর সংখ্যা আরও বাড়বে। তিনি জানান, ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কের গাজীপুর এবং টাঙ্গাইলের বিভিন্ন স্থানে রাস্তার দুই ধারে অসংখ্য হাট-বাজার, স্কুল-কলেজ, বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠানের কারণে পথচারীদের অবাধ চলাচল দুর্ঘটনা বাড়িয়ে দেয়। এছাড়া প্রায়শই বিভিন্ন কারখানার শ্রমিকদের অবরোধ ও দুর্ঘটনার পরে অবরোধ, ফিটনেসহীন গাড়ি অকেজো হয়ে যান চলাচলে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। কোন কোন সময় ঢাকার প্রবেশ মুখ থেকে যমুনা সেতু পর্যন্ত সৃষ্টি হয় যানজট। এসব সমস্যার কারণে ঢাকা থেকে উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন জেলা কিংবা উত্তরবঙ্গ থেকে ঢাকা পৌঁছাতে দ্বিগুণ থেকে তিনগুণ সময় লাগছে এ পথে। যমুনা সেতুর পূর্ব স্টেশন থেকে কালিহাতী উপজেলা এবং মির্জাপুর এলাকায় দুর্ঘটনা ঘটে সবচেয়ে বেশি। এরমধ্যে মির্জাপুরের ইচাইল, ডুবাইল, মিয়াপুর ও সোহাগপাড়া, কালিহাতির চরভাবনা, বাসাইলের বাইখোলা, ঘাটাইলের কালিদাসপাড়া এবং সদর উপজেলার করটিয়া দুর্ঘটনাপ্রবণ এলাকা হিসেবে চিহ্নিত। এসব এলাকায় ঈদ উপলক্ষে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার দাবি সংশ্লিষ্টদের। ২৯ ভাগ জাতীয় মহাসড়ক খারাপ ॥ প্রায় এক দশকের বেশি সময়ে এবারই দেশের সড়ক মহাসড়কের চিত্র সবচেয়ে ভাল বলা চলে। ঈদ সামনে রেখে প্রতি বছরের বিভিন্ন জেলায় গুরুত্বপূর্ণ মহাসড়কে বেহাল অবস্থার কারণে হইচই শুরু হয়। সড়ক ও জনপথ অধিদফতরের (সওজ) সমীক্ষা বলছে, ২৯ শতাংশ খারাপ ও বেহাল সড়কের অংশই ভারি বর্ষা, অত্যধিক গাড়ির চাপ কিংবা দুর্ঘটনায় মানুষকে ভোগান্তিতে ফেলতে পারে। এমন আশঙ্কা থেকেই তা দ্রুত সংস্কারের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে সড়ক বিভাগের পক্ষ থেকে। সওজের আওতাধীন গুরুত্বপূর্ণ মহাসড়ক ও সড়কের অবস্থা প্রতিবছরই সমীক্ষা করে সংস্থাটির মহাসড়ক ব্যবস্থাপনা বিভাগ (এইচডিএম)। গত মার্চে প্রকাশিত এইচডিএমের সর্বশেষ সমীক্ষায় দেখা গেছে, জাতীয় মহাসড়কের ২৪ দশমিক ৬৪ শতাংশ ভাল। ৪৬ দশমিক ৬৭ শতাংশ সড়ক চলনসই। খারাপ সড়কের পরিমাণ ২২ দশমিক ৯১ শতাংশ। বেহাল সড়ক ৩ দশমিক ৫৬ শতাংশ বা ১৩৪ কিলোমিটার। খুবই বেহাল সড়কের পরিমাণ ২ দশমিক ২১ শতাংশ বা প্রায় ৮৭ কিলোমিটার। এই সমীক্ষা ধরে জাতীয় মহাসড়ককে দুই ভাগে ভাগ করলে দেখা যায়, দেশের ৩ হাজার ৭৫৯ কিলোমিটার জাতীয় মহাসড়কের ৭১ দশমিক ৩১ শতাংশ ভাল ও চলনসই। বাকি প্রায় ২৯ শতাংশ মহাসড়ক খারাপ ও বেহাল। জাতীয় মহাসড়কের বাইরে সওজের অধীন পিচঢালা আঞ্চলিক মহাসড়ক ও জেলা সড়ক আছে প্রায় সাড়ে ১৫ হাজার কিলোমিটার। জাতীয় মহাসড়ক, আঞ্চলিক মহাসড়ক ও জেলা সড়ক এই তিন শ্রেণীর সড়কের মধ্যে ভাল ও চলনসই ৫৬ দশমিক ৯৩ শতাংশ। বাকি ৪৩ দশমিক শূন্য ৭ শতাংশ সড়ক খারাপ, বেহাল ও খুব বেহাল। জয়দেবপুর চৌরাস্তা এবারও দুশ্চিন্তার কারণ ॥ ঢাকা-ময়মনসিংহ রুটে ভোগড়া বাইপাস হলো যানজটের দিক থেকে বিষফোঁড়া হিসেবে খ্যাত। আবার জয়দেবপুর চৌরাস্তার সমস্যা পুরোটাই সমাধান যোগ্য। ঢাকা থেকে ছেড়ে যাওয়া গাড়িগুলো জয়দেবপুরে চৌরাস্তার তিন থেকে পাঁচ কিলোমিটার আগে থেকেই যানজটে পড়ে। এই সামান্য রাস্তাটুকু পাড়ি দিতে সময় লাগে কখনও দুই ঘণ্টা। অথচ মহাখালী থেকে ময়মনসিংহ যেতে এখন সময় লাগে দুই ঘণ্টা! পরিবহন মালিক ও শ্রমিকরা বলছেন, জয়দেবপুর চৌরাস্তার চারপাশ জুড়েই পরিবহনের অরাজততা। সিটি সার্ভিসগুলোগুলো এখানে ঘুরানো হয়। রাখা হয় এলোপাথাড়ি করে। এরপর লেগুনা, অটোরিক্সা, ম্যাক্সি,অটো, ব্যাটারিচালিক রিক্সার অবৈধ টার্মিনাল বানানো হয়েছে চৌরাস্তার স্কুলের সামনে। পণ্যবাহী পরিবহনগুলো রাখা হয় রাস্তার ওপর। ঢাকা থেকে ছেড়ে যাওয়া লোকাল বাসগুলোও রাস্তায় থামিয়ে ইচ্ছেমতো যাত্রী তোলা হয়। সব মিলিয়ে গোটা রাস্তায় মহা যানজটের সৃষ্টি হয়। স্থানীয় পুলিশের বক্তব্য, ঈদের আগেই সব অবৈধ টার্মিনাল উচ্ছেদ করতে হবে। প্রয়োজনীয় সংখ্যক পুলিশ মোতায়েন করে চৌরাস্তা এলাকায় কোন পরিবহন দাঁড়াতে না দিলেই যানজটের সমস্যা হবে না। জয়দেবপুর থেকে ময়মনসিংহ পর্যন্ত প্রায় ৯০ কিলোমিটার সড়ক চার লেনে উন্নীত হয়েছে গত বছর। যান চলাচলও করছে। কিন্তু ভালুকা অংশে ১১ কিলোমিটার সময়মতো শেষ করেনি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান প্রজেক্ট বিল্ডার্স লিমিটেড। আরও কিছু স্থানে সাইন-সিগন্যাল ও সড়ক বিভাজকের কাজ বাকি। ফলে এখানেও পুরো চার লেনের সুফল মিলছে না। তবে অবৈধ যানবাহন চলাচল বন্ধ ও টার্মিনাল উচ্ছেদ করা সম্ভব হলে যানজটের দুর্ভোগ এড়িয়ে চলা সম্ভব।
×