ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

মূলধনী যন্ত্রপাতিতে বিদ্যমান শুল্ক সুবিধার প্রসার, পোল্ট্রি খাতের পণ্যে রেয়াত সুবিধা, ই-কমার্স ও জীবনরক্ষাকারী ওষুধে শুল্ক প্রত্যাহার ;###;তথ্য প্রযুক্তি সেবায় ১৫ শতাংশ ভ্যাট পুরোপুরি অব্যাহতি

অর্থ বিল পাস

প্রকাশিত: ০৫:৫৩, ৩০ জুন ২০১৬

অর্থ বিল পাস

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ রফতানি খাতের উৎসে কর হ্রাস, মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানিতে বিদ্যমান শুল্ক সুবিধার প্রসার, পোল্ট্রি খাতের পণ্যে রেয়াত সুবিধা, ই-কমার্স ও জীবনরক্ষাকারী ওষুধে শুল্ক প্রত্যাহারসহ বেশকিছু সুবিধা দিয়ে বুধবার জাতীয় সংসদে পাস হলো অর্থ বিল-২০১৬। এতে তৈরি পোশাকসহ সব ধরনের পণ্যে রফতানিমূল্যের ওপর প্রস্তাবিত ১.৫ শতাংশ উৎসে কর কমিয়ে শূন্য দশমিক ৭ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে। একই সঙ্গে তথ্যপ্রযুক্তি সেবায় নিয়োজিত প্রতিষ্ঠানের স্থান ও স্থাপনা ভাড়ার ওপর আরোপিত ১৫ শতাংশ ভ্যাট পুরোপুরি অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। পাশাপাশি ই-কমার্সকে পুরোপুরি ভ্যাটের আওতামুক্ত রাখা হয়েছে। অন্যদিকে তামাকজাত পণ্যের ওপর সম্পূরক শুল্ক দুই শতাংশ বাড়ানো হয়েছে। এছাড়া ভোজ্যতেল, চিনি, ডাল ইত্যাদি পণ্যে বিদ্যমান শুল্ক অব্যাহতির রেয়াত আগামী বছরও কার্যকর রাখার সুবিধাসহ বেশ কয়েকটি সংশোধনী এনে পাস করা হয়েছে অর্থ বিল-২০১৬। আগামী ২০১৬-১৭ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটের ওপর আলোচনায় অংশ নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ দুটি বিষয়সহ কয়েকটি কর প্রস্তাবে সংশোধনী আনার জন্য অর্থমন্ত্রীকে অনুরোধ জানান। প্রধানমন্ত্রীর অনুরোধকে অনুশাসন মেনে নিয়ে অর্থমন্ত্রী ওই প্রস্তাবগুলো গ্রহণ করেন এবং অর্থ বিলে অন্তর্ভুক্ত করার ঘোষণা দেন। ফলে সংশোধিত আকারে অর্থ বিল-২০১৬ সংসদে পাস হয়। বুধবার সকালে স্পীকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে সংসদের বৈঠক শুরু হয়। প্রশ্নোত্তর টেবিলে উপস্থাপনের পর বাজেটের ওপর আলোচনায় অংশ নেন বিরোধীদলীয় নেতা বেগম রওশন এরশাদ। বিরোধীদলীয় নেতার বক্তব্যের পর বাজেটের ওপর আলোচনা করেন সংসদ নেতা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রধানমন্ত্রীর প্রায় এক ঘণ্টা বক্তব্যের পর অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বাজেটের ওপর সমাপনী বক্তৃতা করেন। এর মধ্য দিয়ে বাজেটের ওপর প্রায় এক মাস ধরে চলা আলোচনার সমাপ্তি ঘটে। আলোচনা শেষে অর্থ বিল-২০১৬ পাসের প্রক্রিয়া শুরু হয়। এ সময় সংসদকার্য পরিচালনা করেন ডেপুটি স্পীকার ফজলে রাব্বী মিয়া। প্রথমেই বিরোধী দল জাতীয় পার্টির সদস্যদের অর্থ বিলের ওপর জনমত যাচাইয়ের প্রস্তাব কণ্ঠভোটে নাকচ হয়ে যায়। এর পর বিরোধী ও সরকারী দলের কয়েকজন সদস্য অর্থ বিলের ওপর সংশোধনী আনেন। বিরোধী দলের সংশোধনীগুলো নাকচ হয়ে গেলেও সরকারী দলের সদস্যের আনা সংশোধনীগুলো অর্থমন্ত্রী গ্রহণ করেন। সংশোধনী প্রক্রিয়া শেষ হলে ডেপুটি স্পীকার বিলটি বিবেচনার জন্য সংসদে উপস্থাপন করতে অর্থমন্ত্রীর প্রতি অনুরোধ জানান। অর্থমন্ত্রী অপরাহ্ন ২টা ২৬ মিনিটে বিলটি সংসদের বিবেচনার জন্য উপস্থাপন করেন। জাতীয় সংসদ অর্থ বিলটি বিবেচনা করার পর অর্থমন্ত্রী বিলটি পাসের জন্য প্রস্তাব করেন। ফলে সংশোধিত আকারে অর্থ বিল-২০১৬ জাতীয় সংসদে পাস হয়। এ সময় সংসদে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদসহ সরকারদলীয়, বিরোধীদলীয় এবং স্বতন্ত্র সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন। যে সকল পণ্যে শুল্ক বাড়ল-কমল ॥ পর্যটন শিল্প বিকাশে শিশুপার্কের রাইডস ও যন্ত্রপাতির ওপর শুল্ক কর রেয়াতি অব্যাহতি রাখা হয়েছে। রফতানিমুখী শিল্পের কাঁচামাল স্পিনিংয়ের কেমিক্যাল আমদানি শুল্ক ২৫ শতাংশ থেকে ১৫ শতাংশ ও স্পিনিং মিলের কাঁচামাল ফ্লাক্সফাইভার আমদানি শুল্ক ১০ শতাংশ থেকে ৫ শতাংশ এবং ডেনিম শিল্পের কাঁচামাল ইলাস্ট্রমেট্রিকের ওপর আমদানি শুল্ক ১০ শতাংশ থেকে হ্রাস করে ৫ শতাংশ করা হয়েছে। পোল্ট্রি শিল্পের অতিরিক্ত উপকরণের রেয়াতি সুবিধা প্রদান করা হবে। অবকাঠামো উন্নয়নের জন্য বোল্ডার স্টোনে কোন শুল্ক থাকবে না। ই-কমার্সে কোন ভ্যাট আরোপ হবে না। ওষুধ শিল্পের কতিপয় কাঁচামালের শুল্ক হ্রাস ও উৎপাদনে শুল্ক বাড়ানো হলো। জীবন রক্ষাকারী ওষুধের ওপর ৫ শতাংশ শুল্ক হার প্রত্যাহার হয়েছে। মেডিক্যাল ও সার্জিক্যাল পণ্যের আমদানি শুল্ক ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ২০ শতাংশ ধার্য করা হয়েছে। ওষুধ শিল্পের কতিপয় কাঁচামালের কর সুষম করা হয়েছে। তথ্য প্রযুক্তির জন্য স্মার্ট কার্ড, ফাইভার কার্ড তৈরি কাঁচামাল রেয়াতি সুবিধা বহাল থাকছে। এছাড়া একজন করদাতার বিনিয়োগের সীমা ২০ শতাংশের পরিবর্তে ২৫ শতাংশ এবং রেয়াতি আয়করের সীমা ১০, ১২ ও ১৫ শতাংশ করা হয়েছে। বর্তমান জুলাই থেকে জুন অর্থবছর হলেও বহুজাতিক কোম্পানির ক্ষেত্রে তা প্রযোজ্য হবে না। তারা তাদের প্যারেন্ট কোম্পানিগুলোর সঙ্গে মিলিয়ে হিসাব রাখতে পারবেন। এছাড়া যেখানে ডিস্ট্রিবিউটরদের লাভ ঘোষণা করা হয় না, সেখানে লাভের অনুষ্ঠিত কমিশন ১২ শতাংশের পরিবর্তে ৬ শতাংশ ও সিগারেটের ক্ষেত্রে উৎসে করের বর্তমান হার বহাল থাকবে। ভ্যাট এসেসমেন্টের বিরুদ্ধে ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান মামলা করার ক্ষেত্রে বিদ্যমান অর্থদ- ১০ শতাংশ পরিশোধ করতে হবে। তথ্যপ্রযুক্তি ও মেরিটেশনের জন্য স্থাপনা ভাড়ার ওপর ১৫ শতাংশ ভ্যাট প্রত্যাহার হয়েছে। মেডিক্যাল সেবায় ভ্যাট অব্যাহতি থাকছে। প্রাকৃতিক রাবারের উৎপাদন পর্যায়ে মূল্য সংযোজন কর অব্যাহতি প্রস্তাব প্রত্যাহার করা হয়েছে। অর্থাৎ ভ্যাট আরোপিত হলো। তামাক পণ্য নিরুৎসাহিত করতে ৪৫ টাকা থেকে ৭০ টাকা মূল্যের বা তার ওপরের স্তুরসমূহের সম্পূরক শুল্কের হার যথাক্রমে ২ শতাংশ হারে বাড়ানো হয়েছে। সিআরকয়েল থেকে রঙিন বিপিসি কয়েলে ১৫ হাজার ৫০০ টাকা ট্যারিফ মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে। এসএম পণ্যের অনুরূপ সিআর কয়েল বা এইচআর কয়েল থেকে সিআই শীট বা বিপিশীট বিপণনে প্রতিমেট্রিক টনে ট্যারিফ মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে ৩ হাজার ৩৩৪ টাকা। মেটাল সিমেন্টের ট্যারিফ মূল্য ৪৫ থেকে ৫৫ টাকা, চা উৎপাদনে প্রণোদনা দেয়ার লক্ষ্যে চা উৎপাদনের প্রতিকেজি ১ দশমিক ৬ মার্কিন ডলার, এককেজি তাজা ফুলের ন্যূনতম ট্যারিফ মূল্য ১ মার্কিন ডলার ও দেশে উৎপাদিত প্লাস্টিক পণ্যে ট্যারিফ মূল্য ৩৫ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৪৫ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। নির্মাণ খাতের উপকরণ, রড, বাঁশের শুল্ক বাড়ানো হয়েছে। সমাপনী বক্তব্য ॥ এর আগে সমাপনী বক্তব্যে অর্থমন্ত্রী নতুন অর্থবছরের বাজেটকে জাতির জনকের স্বপ্নপূরণের অভিযাত্রায় একটি মাইলফলক বলে অভিহিত করেন। বাজেটের সমালোচকদের উদ্দেশে বলেন, বাজেটের উচ্চাভিলাষী লক্ষ্যমাত্রা আমরা অর্জন করতে সক্ষম হব। তিনি বলেন, বাজেটের উদ্দেশ্য হচ্ছে জাতীয় আয়ের উন্নতি ও দেশের মানুষের কল্যাণ সাধন। তাই জনগণের অংশগ্রহণ ছাড়া এ বাজেট বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। বাজেটের চেয়ে বেশি সমালোচনা হচ্ছে বাজেট বাস্তবায়ন নিয়ে। তাই সকল দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ঝেড়ে ফেলে আমাদের বাজেট বাস্তবায়নে আত্মনিয়োগ করতে হবে। আশা করছি, আমরা বাজেটের সফল বাস্তবায়নে সক্ষম হব। তিনি বলেন, ‘বাজেটে আমাদের সপ্তম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা এবং এসডিজির লক্ষ্যসমূহ অর্জনে বিস্তারিত কর্মকৌশল সন্নিবেশিত করেছি। এ বাজেট হচ্ছে উন্নত ও সমৃদ্ধ জাতি গঠনের মাধ্যমে জাতির জনকের স্বপ্নপূরণে আমাদের পথচলার ক্ষেত্রে আরও একটি মাইলফলক।’ ‘উচ্চাভিলাষী’ বলে সমালোচনাটি নতুন নয় মন্তব্য করে টানা অষ্টমবার জাতীয় বাজেট প্রস্তাবকারী মুহিত বলেন, ২০২১ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের দেশ ও ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশে পরিণত হতে বাজেটের আকার ক্রমে বাড়াতে হবে। ফলে বাজেট কিছুটা উচ্চাভিলাষী হবে সেটাই স্বাভাবিক। এডিপি বাস্তবায়ন এবং বিদেশী অর্থ সহায়তা ব্যবহারের সক্ষমতা নিয়ে অনেকের সংশয়ের জবাবে তিনি সরকারের দুই মেয়াদে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচী বাস্তবায়নের সক্ষমতা বেড়ে যাওয়ার দিকে দৃষ্টি ফেরাতে বলেন। বাজেট নিয়ে ইতিবাচক ও গঠনমূলক সমালোচনাগুলোকে স্বাগত জানালেও ঢালাও কিছু অভিযোগ নিয়ে দুঃখ পাওয়ার চেয়ে বেশি ‘বিস্মিত’ হয়েছেন বলে জানান মুহিত। বক্তব্যে ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ নিয়ে আগের মতোই হতাশা প্রকাশ করে তিনি এক্ষেত্রে এখনও অনেক প্রতিবন্ধকতা থাকার কথা স্বীকার করেন। এ প্রতিবন্ধকতাগুলোর মধ্যে প্রয়োজনীয় জ্বালানি সরবরাহের অভাব, ভূমির স্বল্পতা ও যোগাযোগ অবকাঠামোর অপ্রতুলতাকে চিহ্নিত করে তিনি বলেন, এসব বাধা দূর করতে গৃহীত পদক্ষেপ বাস্তবায়ন করতে পারলে ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগে গতিশীলতা আসবে। প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ৭ দশমিক ২ শতাংশে নির্ধারণে বিভিন্ন মহলের সংশয়ের জবাবে মুহিত বলেন, বর্তমানে ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সূচকে যে ইতিবাচক পরিবর্তনের ধারা পরিলক্ষিত হচ্ছে তা আগামী অর্থবছরের প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের পূর্বাভাস দিচ্ছে। বিশেষ করে ব্যক্তি খাতে ঋণ সরবরাহ, আমদানি, রফতানি, মূলধনী যন্ত্রপাতি ও শিল্পের কাঁচামাল আমদানির ঋণপত্র খোলা ও নিষ্পত্তি, সরাসরি বিদেশী বিনিয়োগ, প্রবাসে নিয়োগ, কৃষি ও শিল্প উৎপাদন ইত্যাদি ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে। এপ্রিল মাসে ব্যক্তি খাতে ঋণ সরবরাহের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১৫ দশমিক ৬ শতাংশ, যা লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় বেশি। চলতি অর্থবছরের জুলাই-মে সময়ে রফতানি প্রবৃদ্ধি হয়েছে প্রায় ৯ শতাংশ, যা নিট রফতানি চ্যানেলে প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে বলে মনে করেন অর্থমন্ত্রী। বিদ্যমান রাজনৈতিক স্থিতিশীলতাও বিনিয়োগকারীদের আস্থা বাড়াতে ভূমিকা রাখবে বলে আশাবাদী মুহিত। তিনি বলেন, ‘এসব বিবেচনায় ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ৭ দশমিক ২ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হবে বলে আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি।’ উল্লেখ্য, গত ২ জুন জাতীয় সংসদে ২০১৬-১৭ অর্থবছরের জাতীয় বাজেটের সঙ্গে এ অর্থ বিল উত্থাপন করেছিলেন অর্থমন্ত্রী মুহিত। বৃহস্পতিবার পাস হবে ২০১৬-১৭ অর্থবছরের বাজেট। আগামী ১ জুলাই নতুন অর্থবছরের প্রথম দিন থেকে এ বাজেট কার্যকর হবে। গত ২ জুন অর্থমন্ত্রী সংসদে ২০১৬-১৭ অর্থবছরের জন্য তিন লাখ ৪৯ হাজার কোটি টাকার এ বাজেট পেশ করেন।
×