ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

ইউনিয়ন পরিষদের কাজের গতি ফিরেছে যে কারণে ॥ সমন্বিত উদ্যোগের ফল

প্রকাশিত: ০৬:০১, ২৯ জুন ২০১৬

ইউনিয়ন পরিষদের কাজের গতি ফিরেছে যে কারণে ॥ সমন্বিত উদ্যোগের ফল

আরাফাত মুন্না, বরিশাল থেকে ফিরে ॥ বরিশাল সদর উপজেলার রায়পাশা-কড়াপুর ইউনিয়ন। এই ইউনিয়নে রাস্তা ঘাটের কোন সমস্যা নেই। ব্রিজ-কালভার্ট নির্মিত হওয়ায় যোগাযোগের কোন সমস্যা নেই। নেই নিরাপদ খাবার পানির অভাব। ইতোমধ্যেই ইউনিয়ন পরিষদ অর্জন করেছে শতভাগ স্যানিটেশন লক্ষ্যমাত্রা। ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নুরুল আমীন জনকণ্ঠকে বলেন, সফলতার মূলে কাজ করেছে এলজিএসপি-২ এর বিভিন্ন প্রাতিষ্ঠানিক আয়োজনের সমন্বিত উদ্যোগ। তিনি বলেন, এলজিএসপি’র প্রাতিষ্ঠানিক আয়োজনে তৃণমূলে রয়েছে ইউনিয়নের ৯টি ওয়ার্ডের প্রতিটিতে সংশ্লিষ্ট ইউনিয়ন পরিষদ সদস্যের নেতৃত্বে গঠিত ওয়ার্ড কমিটি। এ কমিটি স্কিমের প্রক্কলন তৈরি করে এবং সরকারের ক্রয় নীতি অনুসরণ করে স্কিম বাস্তবায়নের জন্য ঠিকাদার নিয়োগ দেয়। ঠিকাদার সঠিকভাবে কাজ করছে কিনা তা দেখভাল করার জন্য ওয়ার্ড পর্যায়ে কাজ করছে ‘স্কিম সুপারভিশন কমিটি’। চেয়ারম্যান বলেন, তার ইউনিয়নে তৃণমূলের এ কমিটিসমূহ দক্ষতার সাথে কাজ করেছে। ফলে কাজের মান খুব ভাল হয়েছে। আর এ কারণেই তিনি বরিশাল জেলার মধ্যে একাধিকবার শ্রেষ্ঠ চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন। তিনি বলেন, এলজিএসপি-২ আওতায় পরিচালিত অডিট কার্যক্রম তাদের আর্থিক ব্যবস্থাপনা ও ক্রয় পদ্ধতি সম্পর্কে যথেষ্ট দক্ষতা বৃদ্ধি করেছে। অডিটরগণ প্রতিটি স্কিম পরিদর্শন করছে এবং কাজেন গুণগতমান সরেজমিনে পর্যবেক্ষণ করছে এবং পাশাপাশি সকল কাগজপত্র ও রেজিস্ট্রার খুটে খুটে দেখছে। এর ফলে ইউনিয়ন পরিষদের কাজে আর ভুল থাকার আশঙ্কা থাকে না। রায়পাশা-কড়াপুর ইউনিয়নের ২ নং ওয়ার্ডের সদস্য ও ওয়ার্ড কমিটির সভাপতি বেল্লাল হোসেন নিজের কাজের অভিজ্ঞতা বর্ণনা দিয়ে জনকণ্ঠকে বলেন, ওয়ার্ডে মোট ভোটারের কমপক্ষে ৫% এর উপস্থিতিতে ওয়ার্ড সভায় স্থানীয় জনগণ বিভিন্ন স্কিমের প্রস্তাব করেন এবং সভায় সমর্বসম্মতিক্রমে প্রস্তাবিত স্কিমের অগ্রাধিকার তালিকা তৈরি করা হয়। এ তালিকার আলোকে ইউনিয়ন পরিষদ খসড়া বাজেট তৈরি করে তা ইউনিয়ন পরিষদের উন্মুক্ত বাজেট সভায় উপস্থাপন করে। এই ইউনিয়নের ২ নং ওয়ার্ডে স্কিম সুপারভেশন কমিটির সভাপতি মোঃ এনামুল হক চাকলাদার নিজের অভিজ্ঞাতার কথা জানিয়ে জনকণ্ঠকে বলেন, একটি ব্রিজ নির্মাণ কাজের তত্ত্বাবধানে তিনি দায়িত্ব পালন করেছেন। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার একজন প্রতিনিধি এ কমিটিতে ছিলেন। তিনি তাদের টেকনিক্যাল সহায়তা দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘ব্রিজের কাজ কি ভাবে হয়েছে, সঠিকভাবে হচ্ছে কিনা, তা আমরা দেখা শুনা করেছি। পরে কাজ শেষে আমরা চেয়ারম্যান বরাবরে প্রত্যয়নপত্র দিয়েছি কাজের বিষয়ে।’ এলজিএসপি-২ বাস্তবায়নে কেন্দ্রীয় পর্যায়ে প্রজেক্ট ম্যানেজন্টে ইউনিট (পিএমইউ) কাজ করছে। একজন জাতীয় প্রকল্প পরিচালক, দুজন উপ-প্রকল্প পরিচালক ও প্রয়োজনীয় সংখ্যক বিশেষজ্ঞ কাজ করছেন। স্থানীয় সরকার বিভাগের সচিবের নেতৃত্বে রয়েছে প্রজেক্ট স্টিয়ারিং কমিটি। এ কমিটি প্রয়োজনীয় নীতি নির্ধারণী সিদ্ধান্ত প্রদান করে থাকে। এলজিএসপি-২ এর প্রাতিষ্ঠানিক আয়োজন সম্পর্কে প্রকল্পের উপ-প্রকল্প পরিচালক মোহাম্মদ ইয়াহিয়া ভূইয়া জনকণ্ঠকে বলেন, তৃণমূল থেকে কেন্দ্র পর্যন্ত প্রতিটি স্তরে প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো রয়েছে। এ প্রসঙ্গে তিনি ইউনিয়ন পর্যায়ে ওয়ার্ড কমিটি, স্কিম সুপারভিশন কমিটি; উপজেলা পর্যায়ে বিজিসিসি এবং ইউআরটি, জেলা পর্যায়ে জেলা সমন্বয় সভার কথা উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, কেন্দ্রীয় পর্যায়ে প্রকল্প ব্যবস্থাপনা ইউনিটে উপ-প্রকল্প পরিচালক, ফিল্ড অপারেশন মাঠপর্যায়ে সার্বিক কর্মকা-ের সমন্বয় করেন। কেন্দ্রীয় পর্যায়ে প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো প্রসঙ্গে মোহাম্মদ ইয়াহিয়া বলেন, প্রকল্প অফিসে একটি অত্যাধুনিক এমআইএস ইউনিট কাজ করছে যার মাধ্যমে ‘রিয়াল টাইমে’ ইউনিয়ন পরিষদ থেকে তথ্য পাওয়া যায়। সকল ইউনিয়ন পরিষদে এক যোগে অডিট করার জন্য অডিট ফার্ম নিয়োগ দেয়া হয়। পাশাপাশি এলজিএসপি-২ সম্পর্কে ব্যাপক জনগোষ্ঠীকে অবহিত করার জন্য পায়াক্ট নামে একটি প্রতিষ্ঠান তে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। এ প্রষ্ঠিানটি প্রতিটি জেলায় অবহিতকরণ কর্মশালা আয়োজন করেছে এবং রেডিও টেলিভশনে বিজ্ঞাপন প্রচারের মাধ্যমে সমাজের সর্বস্তরের জনগণকে এলজিএসপি সম্পর্কে ধারণা প্রদান করেছে। তিনি কলেন, এলজিএসপি-২ প্রকল্পের একটি বিশেষত্ব হলো এ প্রকল্পের অর্থের ছাড় দুই কিস্তিতে হয়ে থাকে এবং অর্থবছর শেষে জুন মাসের মধ্যে বরাদ্দ খরচ করতে না পারলে তা পরবর্তী বছরে নিয়ে যাওয়ার বিধান রয়েছে। সাধারণত: সরকারের অন্যান্য প্রকল্পের অর্থ ৪ কিস্তিতে ছাড় হয় এবং অর্থবছরের মধ্যে টাকা খরচ করতে না পারলে তা সরকারী কোষাগারে জমা দিতে হয়। অন্যান্য প্রাতিষ্ঠানিক আয়োজন সম্পর্কে তিনি ইউনিয়ন পরিষদ হেলপ লাইন, ইউনিয়ন ডিজিাটল সেন্টার, বিশ্ব ব্যাংকের তত্ত্বাবদানে পরিচালিত গ্লোবাল পার্টনারশিপ (জিপিএসএ) এর মাধ্যমে সামাজিক দায়বদ্ধতার মাত্রা নিরূপণের জন্য তৃতীয় পক্ষ মনিটরিং কার্যক্রমের কথা উল্লেখ করেন। মোহাম্মদ ইয়াহিয়া মনে করেন এলজিএসপি মানে নিয়মের শাসন যেখানে প্রতিটি কাজের ক্ষেত্রে জনগণের কাছে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চত করতে হয়। এলজিএসপি-২ এর কাজের গুণগতমান বজায় রাখার জন্য উপজেলা পর্যায়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার নেতৃত্বে কাজ করছে ‘ব্লক গ্রান্ড কো-অর্ডিনেশন কমিটি (বিজিসিসি)’ এবং ‘উপজেলা রিসোর্স টিম (ইউআরটি)’ কাজ করছে। বরিশাল সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মুহাম্মদ আবদুর রউফ মিয়া জনকণ্ঠকে বলেন, বিজিসিসি ইউনিয়ন পরিষদের গৃহীত স্কিমসমূহ পর্যবেক্ষণ করে এবং বিশেষ করে এলজিএসপি-২ এর আওতায় যেসকল স্কিম নেয়া যাবে না সেকল প্রকল্প নেয়া হয়েছে কিনা, নারীর ক্ষমতায়নকে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে কিনা, কারও পক্ষ থেকে কোন আপত্তি আছে কিনা তা পর্যালোচনা করে পর্যবেক্ষণসহ ইউনিয়ন পরিষদে বাস্তবায়নের জন্য প্রেরণ করে। তিনি বলেন, “উপজেলা রিসোর্স টিমের (ইউআরটি) মাধ্যমে ইউনিয়ন পরিষদের সংশ্লিষ্টদের প্রশিক্ষণ প্রদান করে থাকি। এলজিএসপি-২ এর মাঠপর্যায়ে সার্বিক কার্যক্রম মনিটরিং করার জন্য উপ-পরিচালক স্থানীয় সরকার (ডিডিএলজি) কাজ করছেন। তাঁর কাজে সহায়তা করার জন্য প্রকল্প থেকে প্রতি জেলায় একজন করে ডিস্ট্রিক ফ্যাসিলেটর নিয়োগ দেয়া হয়েছে। এ বিষয়ে বরিশাল জেলার দায়িত্বপ্রাপ্ত ডিডিএলজি মোঃ আবুল কালাম আজাদ জনকণ্ঠকে বলেন, এলজিএসপি-২ প্রকল্প আসার আগে ইউনিয়ন পরিষদের বরাদ্দ খুব বেশি ছিল না। পরে সরকার স্থানীয় সরকারকে শক্তিশালী করতে এলজিএসপির কাজ শুরু করে। সাধারণভাবে আমরা দেখি ইউনিয়ন পরিষদ কালভার্ট, রাস্তাঘাট, স্কুল ইত্যাদি প্রকল্প নেয়। এ কাজসমূহ প্রকল্পের নিয়ম অনুসারে হচ্ছে কিনা তা আমরা জেলা পর্যায় থেকে মনিটরিং করি। এ কাজে ডিস্ট্রিক ফ্যাসিলিটেটর নিবিড়ভাবে সহায়তা করেন। পাশাপশি, এলজিএসপি’র সার্বিক কার্যক্রম পর্যালোচনা করার জন্য সংশ্লিষ্ট সকলের উপস্থিতে জেলা প্রশাসক মহোদয়ের নেতৃত্বে জেলা সমন্বয় সভা আয়োজন করা হয়। বরিশাল জেলার ডিএফ মোঃ মিজানুর রহমান সেলী হাওলাদার জনকণ্ঠকে বলেন, “আমি বিজিসিসি কমিটিতে নিয়মিত অংশগ্রহণ করি এবং নেতিবাচক প্রকল্প গ্রহণ করা হলে সে বিষয়ে পর্যবেক্ষণ প্রদান করি। একই সাথে ইউনিয়ন পর্যায়ে মনিটরিং করার সময়ে পরিষদকে প্রয়োজনীয় পরামর্শ প্রদান করে থাকি। ফলে এ জেলায় এলজিএসপি-২ এর কাজে অডিট আপত্তি অনেক কমে গেছে।” ১৮৭০ সালে চৌকিদারি পঞ্চায়েত হিসেবে ইউনিয়ন পরিষদের যাত্রা শুরু হয়। বিবর্তনের ধারায় চৌকিদারি পঞ্চায়েত ১৮৮৫ সালে ইউনিয়ন কমিটি, ১৯১৯ সালে ইউনিয়ন বোর্ড, ১৯৫৯ সালে ইউনিয়ন কাউন্সিল এবং ১৯৭২ সালে ইউনিয়ন পঞ্চায়েত রূপ নেয়। ইউনিয়ন পঞ্চায়েত ১৯৭৩ সালে তিন বছর মেয়াদী ইউনিয়ন কাউন্সিলে পরিণত হয়, যার মেয়াদ ১৯৮৩ সালে পাঁচ বছর করা হয়। বর্তমানে ইউনিয়ন পরিষদ আইন, ২০০৯ অনুসারে ইউনিয়ন পরিষদ পরিচালিত হচ্ছে। ইউনিয়ন পরিষদের সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য বাংলাদেশ সরকারের স্থানীয় সরকার বিভাগ ইউএনডিপি’র সহায়তায় ২০০০ সালে পাঁচ বছর মেয়াদী সিরাজগঞ্জ লোকাল গবর্ন্যান্স ডেভেলপমেন্ট ফান্ড প্রজেক্ট বাস্তবায়ন করে। এ প্রকল্পের মাধ্যমে পরীক্ষামূলকভাবে ইউনিয়ন পরিষদকে সরাসরি আর্থিক বরাদ্দ দিয়ে জনঅংশগ্রহণে স্কিম বাস্তবায়নের দায়িত্ব দেয়া হয়। এ প্রকল্পের সফলতার আলোকে সরকার বিশ্ব ব্যাংকের সহায়তায় ২০০৬ সাল থেকে পাঁচ বছর মেয়াদী লোকাল গবর্ন্যান্স সাপোর্ট প্রজেক্ট-১ এবং জুলাই ২০১১ সাল থেকে পুনরায় পাঁচবছর মেয়াদী লোকাল গবর্ন্যান্স সাপোর্ট প্রজেক্ট-২ বাস্তবায়ন করছে।
×