ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

উড়তা সেন্সর, কাঁচির কোপে অতিষ্ঠ টালিগঞ্জও

প্রকাশিত: ১৯:০৩, ২৮ জুন ২০১৬

উড়তা সেন্সর, কাঁচির কোপে অতিষ্ঠ টালিগঞ্জও

অনলাইন ডেস্ক ॥ স্রেফ ‘উড়তা পঞ্জাব’-এর ‘পঞ্জাব’ নয়। আর একটু হলেই কাঁচি পড়ছিল ‘সাহেব বিবি গোলাম’-এর ‘বিবি’র গায়েও। ‘উড়তা পঞ্জাব’ নাম নিয়ে আপত্তি তুলে পঞ্জাব শব্দটাই ছেঁটে ফেলার নির্দেশ ছিল বলে অভিযোগ উঠেছিল কেন্দ্রীয় সেন্সর-অধিকর্তা পহলাজ নিহালনির বিরুদ্ধে। বাংলা ছবি ‘সাহেব বিবি গোলামে’ আবার আঞ্চলিক বোর্ড ‘বিবি’র চরিত্রই বাদ দিতে বলেছিল। তাদের পরামর্শ ছিল, ছবির নাম হোক ‘সাহেব গোলাম’! পুরনো নয় কিন্তু, ২০১৬-র নতুন ‘সাহেব বিবি গোলাম’। অঞ্জন দত্ত-স্বস্তিকা মুখোপাধ্যায়-ঋত্বিক চক্রবর্তী অভিনীত ছবিটি মুক্তি পাওয়ার কথা ছিল এ বছরের ২২ জানুয়ারি। সেন্সর বোর্ডকে তুষ্ট করতে না পেরে মুক্তির দিনক্ষণ আট মাস পিছিয়ে গিয়েছে। অবশেষে দিল্লিতে ফিল্ম সার্টিফিকেশন অ্যাপেলেট ট্রাইবুনাল (এফক্যাট)-এর নির্দেশে সদ্য ছাড়পত্র পেয়েছে ছবিটি। আগামী ২৬ অগস্ট পর্দায় আসার কথা। ‘উড়তা পঞ্জাব’-এর ক্ষেত্রে মুম্বইয়ে সেন্ট্রাল বোর্ড অব ফিল্ম সার্টিফিকেশন (সিবিএফসি)-এর কমিটি ছবিতে গালাগালির আধিক্য রয়েছে এবং পঞ্জাবের বদনাম হতে পারে বলে আপত্তি তোলে। আর টালিগঞ্জের ‘সাহেব বিবি গোলাম’ নিয়ে সিবিএফসি-র আঞ্চলিক কমিটির আপত্তি ‘নৈতিক’ কারণে। প্রযোজক ফিরদৌসুল হাসানের অভিযোগ, ‘‘ছবিতে এক অসুখী গৃহবধূর দেহব্যবসায় জড়িয়ে পড়ার সিকোয়েন্স আছে। তাতে নারীজাতির অবমাননা হয়েছে বলে ওঁরা দাবি করেন। ছবি থেকে ওই মহিলার চরিত্রটাই বাদ দিতে বলা হয়।’’ হাসান জানাচ্ছেন, দরকারে ‘সাহেব বিবি গোলাম’-কে ‘সাহেব গোলাম’ নামে রিলিজের পরামর্শ অবধি দেওয়া হয়েছিল। প্রধানত সেন্সর বোর্ডের কমিটির একজন মহিলা সদস্যের আপত্তিতেই ছবিটি নিয়ে জটিলতা সৃষ্টি হয় বলে নির্মাতাদের দাবি। তাঁরা মনে করাচ্ছেন, গৃহবধূর যৌনপেশায় জড়িয়ে পড়ার বিষয়টি দেশে-বিদেশে বহু ছবিতেই এসেছে। এ দেশেও দু’দশক আগে রেখা অভিনীত ‘আস্থা: ইন দ্য প্রিজন অব স্প্রিং’-এর মতো ছবি হয়েছিল। প্রতিম ডি গুপ্ত পরিচালিত ‘সাহেব বিবি গোলাম’ কলকাতায় সেন্সর-কর্তাদের চার বার দেখাতে বাধ্য হন নির্মাতারা। প্রাথমিক এগজামিনেশন কমিটি ‘বিবি’ চরিত্রটিকে কিছুতেই ছাড়পত্র দিতে রাজি ছিল না। এর পরে কলকাতার রিভিশন কমিটি ছবিটি দেখে। সেই কমিটির চেয়ারপার্সন তথা বিজেপি-মনোনীত রাজ্যসভার সাংসদ জর্জ বেকার একটি ধর্ষণ দৃশ্য বাদ দিতে বলেন। ধর্ষণ যে সমাজের বাস্তবতা তা বোঝানোর চেষ্টা করেন প্রযোজক-পরিচালকেরা। কিন্তু ‘পাড়ার মন্টু ও সব বুঝবে না’ বলে সাংসদ অনড় থাকেন বলে নির্মাতাদের দাবি। এর পরে নিরুপায় হয়েই দিল্লিতে এফক্যাট-এর কাছে আর্জি জানাতে বাধ্য হন তাঁরা। সেখানে কিন্তু ছবিটি নিয়ে নতুন কোনও জটিলতা দেখা দেয়নি। ধর্ষণ দৃশ্যটি সামান্য ছোট করে এবং কয়েকটি সংলাপের গালাগালি ‘বিপ’ শব্দ দিয়ে চাপা দিতে বলেই ছবিটিকে ছাড়পত্র দেওয়ার সুপারিশ করে এফক্যাট। এটুকু মেনে নিতে কোনও সমস্যা হয়নি বলে জানিয়ে হাসানের বক্তব্য, ‘‘এফক্যাটের কাছে কলকাতার সেন্সর বোর্ডের আপত্তি প্রায় ধোপেই টেকেনি।’’ তা হলে কেন আপত্তি তুলেছিলেন সেন্সর বোর্ড-কর্তারা? ছবিটি নিয়ে জটিলতার সময় সিবিএফসি-র আঞ্চলিক কর্তা ছিলেন ভাস্কর গঙ্গোপাধ্যায়। তাঁর দাবি, ‘‘সিনেমাটোগ্রাফ আইন মেনেই ছবিটি আটকানো হয়েছিল। দিল্লির ট্রাইবুনাল হয়তো বিষয়টা অন্য ভাবে দেখে ছাড়পত্র দিয়েছে। এমন তো হতেই পারে!’’ সিবিএফসি-র বর্তমান আঞ্চলিক কর্তা দিব্যেন্দু দাস বিষয়টি নিয়ে মন্তব্য করতেই চাননি। জর্জ বেকারও কেন ছবিটি আটকানো হয়েছিল তা এখন মনে করে বলতে পারছেন না। তবে তাঁর বক্তব্য, ‘‘যে যাই বলুন, কিছু অন্তরঙ্গ দৃশ্য সিনেমায় দেখানো অনুচিত। বাকস্বাধীনতা থাকলেও নেতিবাচক ভাবে কিছু দেখানো ঠিক নয়।’’ অর্থাৎ? কলকাতায় সিনেমার নিয়ন্ত্রকরাও দৃশ্যত কেন্দ্রীয় সেন্সর বোর্ডের বর্তমান ঘরানার সঙ্গে তাল মিলিয়েই চলছেন! তবে এই টক্কর নতুন কিছু নয়। সিনেমাটোগ্রাফ আইনের নির্দেশিকায় দেশের সার্বভৌমত্ব, সংহতি থেকে শুরু করে নান্দনিকতা, সামাজিক মূল্যবোধ প্রমুখ শব্দগুলো বিভিন্ন সময়েই নিজেদের মতো করে ব্যাখ্যা করেন সেন্সর কর্তারা। ধর্মীয় বা রাজনৈতিক— নানা মহলের ভাবাবেগ নিয়ে স্পর্শকাতর থাকেন। তবে অনেকেরই অভিযোগ, পহলাজ নিহালনির জমানায় এই ‘স্পর্শকাতরতা’ অন্য মাত্রা পেয়েছে। এবং এ ক্ষেত্রে মুম্বইয়ের সঙ্গে ফারাক থাকছে না কলকাতার। এমনকী সেন্সরের ছাড়পত্র পেলেও সব সময় সমস্যার শেষ হচ্ছে না। ‘কসমিক সেক্স’ নামে একটি ছবি যেমন নন্দনে দেখাতে আপত্তি তোলা নিয়ে বিতর্ক চলছে এই মুহূর্তেই। বিভিন্ন সময়ে এই জাতীয় ফতোয়া নিয়ে সমস্যায় পড়েছেন পরিচালক সুমন মুখোপাধ্যায়। তিনি মনে করেন, ‘‘ভাবাবেগের দোহাই পেড়ে চলচ্চিত্রকারদের সেন্সর-হেনস্থা বন্ধ হোক। বিভিন্ন গোষ্ঠীর মদতে অশান্তি পাকানোর চেষ্টা রুখতে বরং যত্ন নিক প্রশাসন।’’ পরিচালক কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়ও একমত। তিনি বলছেন, ‘‘দরকারে ‘এ’ মার্কা ছবির ওপরেও ‘এ+’ বা ‘এ++’ তকমা দেওয়া হোক। কিন্তু সিনেমায় কী দেখানো যাবে আর যাবে না, তা নিয়ে হেডমাস্টারগিরিটা বন্ধ হোক।’’ সূত্র : আনন্দবাজার পত্রিকা
×