ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

ঈদের কেনাকাটা

রাজধানীর ঈদ বাজারে ‘ফিক্সড প্রাইস’ ও ‘বিশাল ছাড়’ প্রতারণা

প্রকাশিত: ০৬:০১, ২৮ জুন ২০১৬

রাজধানীর ঈদ বাজারে ‘ফিক্সড প্রাইস’ ও ‘বিশাল ছাড়’ প্রতারণা

রহিম শেখ ॥ দূরত্ব মাত্র তিন কিলোমিটার। কিন্তু পণ্যের দামে ব্যবধান ২৫ হাজার টাকা! রাজধানীর বসুন্ধরা শপিংমলে যে শাড়ির দাম ৪০ হাজার টাকা, সেই একই শাড়ি গুলিস্তানের পাইকারি বাজারে ১৫ হাজার টাকায় পাওয়া যাচ্ছে। এভাবেই রাজধানীর ঈদ বাজারে চলছে ‘ফিক্সড প্রাইস’ বা ‘একদর’ প্রতারণা। নগরীর অধিকাংশ মার্কেট ঘুরে দেখা গেছে, প্রকৃত মূল্যের চেয়ে পোশাকের গায়ে তিনগুণ-চারগুণ বেশি মূল্য লিখে ট্যাগ ঝোলানো হয়েছে। বড় বড় মার্কেট থেকে শুরু করে ফুটপাথের পণ্যেও ‘একদাম’ ট্যাগ লাগানো। এছাড়া পণ্যের দাম বাড়িয়ে ‘শতাংশ’ জুড়িয়ে দিয়ে চলছে ‘বিশাল ছাড়’ নামক প্রতারণা। ক্রেতাদের অভিযোগ, একদাম লেখা পণ্যগুলোতে যে দাম নির্ধারণ করা হয়েছে সেই একই পণ্য অন্য দোকানে আরও কম দামে বিক্রি হচ্ছে। অন্যদিকে বিক্রেতারা জানালেন, দাম কম হলে ক্রেতা ভাবে জিনিস ভাল নয়। তাই কাপড়ের দাম বেশি লেখা হয়। গত রবিবার বসুন্ধরা সিটির চতুর্থ তলায় একটি শাড়ির দোকানে গিয়ে দেখা গেল, ক্রেতার কাছে একটি টিস্যু শাড়ির দাম চাওয়া হলো ৪২ হাজার টাকা। কিন্তু সকালবেলার ক্রেতা বলে কিছুটা ‘সম্মান’ করার প্রস্তাব দিলেন দোকানের বিক্রেতা। কিন্তু কতটা সম্মান করা হবে? এ প্রশ্নে জানালেন, দুই হাজার টাকা ‘সম্মান’ করবেন। এই শাড়ি কিছুতেই ৪০ হাজার টাকার কমে দেয়া সম্ভব নয় বলে বিক্রেতা জানিয়ে দিলেন। দাম বেশি হওয়ায় ঐ ক্রেতাও শেষ পর্যন্ত শাড়িটি কিনতে চাইলেন না। ওই একই ধরনের শাড়ির খোঁজে গুলিস্তান বঙ্গবাজারের পাইকারি শাড়ির দোকানে গিয়ে দেখা গেল, একই রঙ এবং একই নক্সায় ডিজাইন করা শাড়িটি ভারত থেকে আমদানি করা ‘টিস্যু’ শাড়ি। গুলিস্তানের অন্যতম বৃহৎ শাড়ির পাইকারি বিক্রেতারা জানালেন, এখানে মূলত পাইকারি দরে শাড়ি বিক্রি করা হয়। তবে খুচরাও বিক্রি হয়। ওই শাড়ির দাম জানতে চাইলে বিক্রেতারা জানালেন, টিস্যু শাড়ির দাম ১৪ হাজার ৪০০ টাকা। বসুন্ধরায় পিংকি স্টোরে বাচ্চাদের একটি পোশাকের গায়ে দাম লেখা আছে চার হাজার টাকা। ধানম-ির মাহবুবা ইসলাম তার মেয়ের জন্য দরকষাকষি করে পোশাকটি কিনে নিলেন আড়াই হাজার টাকায়। একই দোকানে আজিমপুরের মনির হোসেন ‘ফিক্সড প্রাইস’ ট্যাগ দেখে চার হাজার টাকাতেই আরেকটি পোশাক কিনলেন। একদাম লেখার পর দরদাম করার ব্যাপারে জানতে চাইলে পিংকি স্টোরের ম্যানেজার শফিউল্লাহ বলেন, কিছু করার নেই, দাম বেশি না হলে ক্রেতা আকর্ষণ করানো যায় না। তাই দাম বেশি লিখে রাখা হয়। দাম কম হলে ক্রেতা ভাবে জিনিস ভাল নয়। তাই কাপড়ের দাম বেশি লেখা হয়। রাজধানীর বিভিন্ন মার্কেট ঘুরে দেখা গেছে, প্রকৃত মূল্যের চেয়ে পোশাকের গায়ে তিনগুণ-চারগুণ বেশি লিখে ট্যাগ ঝোলানো হয়েছে। বড় বড় মার্কেট থেকে শুরু করে ফুটপাথের পণ্যেও ‘একদাম’ ট্যাগ লাগানো। এমন দোকানের কয়েকটিতে একদাম লেখার পরও দরদাম করতে দেখা যায়। ক্রেতাদের অভিযোগ, একদাম লেখা পণ্যগুলোতে যে দাম নির্ধারণ করা হয়েছে সেই একই পণ্য অন্য দোকানে আরও কম দামে বিক্রি হচ্ছে। হাবিবুল্লাহ মিজান ধানম-ির রাপা প্লাজার একদামের দোকান থেকে জুতা কিনেছেন ১২০০ টাকা দিয়ে। একই জুতা সায়েন্স ল্যাবের মার্কেটগুলোতে ৭০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে দেখে ক্ষুব্ধ হন। তিনি জানান, একদামে বিক্রি করা খারাপ না। সেক্ষেত্রে ঝামেলা কম থাকে। কিন্তু কিছু অসাধু ব্যবসায়ী এই মাধ্যমটাকে প্রতারণার কৌশল হিসেবে ব্যবহার করছেন। একদাম বললে ক্রেতাদের সঙ্গে দরদাম করার প্রয়োজন হয় না এবং সে সুযোগে পণ্যের গায়েও অতিরিক্ত দামের ট্যাটু লাগিয়ে দেয়া যায়। গাউছিয়া, নিউমার্কেট, চাঁদনীচকের অধিকাংশ দোকান ফিক্সড প্রাইসের। তবে এমন কোন দোকান পাওয়া যাবে না, যেখানে দরদাম চলে না। সোমবার বিকেলে নিউমার্কেট, গাউছিয়া, ধানম-ি হকার্স, কোহিনুর মার্কেট, চাঁদনীচকের বিভিন্ন বিপণিবিতানগুলোতে সরেজমিনে ক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, একদর লিখে রাখলেও অনেক বিক্রেতাই ছাড় দিয়ে পোশাক বিক্রি করেন। মানুষ বুঝে একেক জনের কাছ থেকে একেক রকম দাম নিয়ে থাকে বিক্রেতারা। বসুন্ধরার অধিকাংশ দোকানে ঈদ উপলক্ষে ‘বিশাল ছাড়’ দেয়া হয়েছে। তা এক ধরনের প্রতারণা। একটি বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে কর্মরত আফজাল হোসেন জানান, মাসখানেক আগে এই মার্কেটে যে পণ্যের গায়ে ৫০০ টাকা লেখা ছিল, সেই পণ্যের দাম বাড়িয়ে এক হাজার টাকা করে ৫০ শতাংশ ছাড়ে ৫০০ টাকাতেই বিক্রি করা হচ্ছে। গাউছিয়া মার্কেটের একটি বিপণিবিতানে পোশাকের দোকানে থ্রিপিসের দামাদামি করছেন মহিলা ক্রেতা আর বিক্রেতা। দোকানে প্রতিটি পোশাকের ওপর কাগজে ‘একদর’ লিখে রাখা হয়েছে। বিক্রেতা বলছেন, ‘ম্যাডাম এই থ্রিপিসের একদাম ১ হাজার ৬শ’ টাকা। তবে আপনার জন্য এটার দাম রাখব ১ হাজার ২শ’ টাকা। বিক্রেতার কাছ থেকে পোশাকের দাম শুনে ক্রেতার উত্তর, ‘আমি ভাই এক হাজারের বেশি দিতে পারব না।’ এক পর্যায়ে ১ হাজার টাকা দিয়েই পোশাকটি বিক্রি করেন বিক্রেতা। এ সম্পর্কে জানতে চাইলে গাউছিয়া মার্কেটের বিক্রেতা আবদুল কাশেম বলেন, একদাম লিখে রাখলে ক্রেতাদের সঙ্গে বেশি কথা বলতে হয় না। অনেক ক্রেতা দামাদামি না করেই পোশাক কিনে নিয়ে যায়। কিছু কাস্টমার আছে যারা দামাদামি করে। তাদের হয়ত কিছু ছাড় দিয়ে পোশাক বিক্রি করতে হয়। সেখানকার এক ক্রেতা সাফিনা রহমান বলেন, একদর লেখা থাকলেও দামাদামি করেই পোশাক কিনতে হয়। বিক্রেতারা লোক বুঝে দাম চান। একেক জনের কাছ থেকে এক এক রকম দাম নেন। তিনি বলেন, বিষয়টি অনেকে বোঝেন অনেকে বোঝেন না। যারা বোঝেন না তাদের কাছ থেকে এরা বড় ধরনের লাভ করে থাকে। এটা এক ধরনের প্রতারণা। কারণ একই পোশাকের দাম একজনের কাছে বিক্রি করা হচ্ছে এক রকম দামে, অন্যজনের কাছ থেকে আবার তার থেকে বেশি দাম নেয়া হচ্ছে। আসলে এক দামের নামে এরা এক ধরনের প্রতারণা করছে। চাঁদনীচকের বর্ণালী ফ্যাশনের বিক্রেতা ফারুক বলেন, এখন ক্রেতা কম তাই দামাদামি করে কিছুটা ছাড় দিয়ে বিক্রি করছি। ক্রেতা বাড়লে একদামে বিক্রি করি। তাছাড়া সবার সঙ্গে তো দামাদামি করি না। এক দরের ক্রেতারা আলাদাই থাকে। কোহিনুর মার্কেটের আবরণী শাড়ি হাউসের এক বিক্রেতা শফিকুল ইসলাম বলেন, একদাম লিখে রাখা হয় যাতে করে কাস্টমারদের সঙ্গে বেশি দামাদামি না করতে হয়। একদাম লেখা না থাকলে হয়ত আমরা বলি ২ হাজার টাকা ক্রেতারা দাম করে ১ হাজার টাকা। একদাম লিখে যদি কোন কাপড়ের দাম ৩ হাজার টাকা লেখা থাকে তাহলে ক্রেতারা দাম বলে ২ হাজার ৫শ’ টাকা। এতে করে পোশাক বিক্রি করতে সহজ হয়। এটা কি তাহলে কাপড় বিক্রির কৌশল এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, কৌশল বলতে পারেন। বেচা-বিক্রি নাই। কি করব। দোকানের অনেক ভাড়া। বিক্রি তো করতে হবে। আসলেও ‘একদাম’ এর কোন পোশাক কি আপনাদের এখানে আছে? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আছে। এক দরের পোশাকও আছে। সেই পোশাকগুলোর চাহিদা খুব কম। তবে সে পোশাকগুলো একদরেই আমরা বিক্রি করি। এসব বিষয়ে জানতে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের মহাপরিচালক (অতিরিক্ত সচিব) আবুল হোসেন মিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, নির্ধারিত দামে পণ্য বিক্রির নিয়ম থাকলেও দাম কী হবে তা বিক্রেতারাই নির্ধারণ করেন। এ কারণেই অধিদফতরের কিছু করার থাকে না। কনজিউমারস এ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি ও দুদকের সাবেক চেয়ারম্যান গোলাম রহমান বলেন, ক্রেতাকেই সচেতন হতে হবে। এছাড়া আর উপায় নেই। বাইরে থেকে এসে কারও পক্ষে তো দাম নির্ধারণ করে দেয়া সম্ভব নয়।
×