ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

ডেভিড ক্যামেরন ও গণতন্ত্র

প্রকাশিত: ০৩:৫৫, ২৭ জুন ২০১৬

ডেভিড ক্যামেরন ও গণতন্ত্র

সুনীতি, বিনয়, ভদ্রতা ও সৌজন্যবোধÑ সভ্য মানুষের আভরণ। রাজনীতিতে এই চারটি গুণের দেখা সহজে মেলে না। মিললে আমরা বিস্মিত হই। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির প্রশংসা করি। ইইউতে যুক্তরাজ্যের থাকা না-থাকা নিয়ে গণভোটে ত্যাগে ইচ্ছুক জনতার জয়লাভের পর নির্বাচনী ফলাফলের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা আসার আগেই যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন পদত্যাগের ঘোষণা দেন। তার পদত্যাগ কেউ দাবি করেনি। ব্রিটিশ প্রেসে এমন জল্পনাও ছিল না যে ব্রেক্সিট জিতে গেলে তাকে বিদায় নিতেই হবে। যুক্তরাজ্যের একজন নেতা হিসেবে তিনি অনুধাবন করতে পেরেছিলেন যে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে থাকা এবং না থাকার মধ্যে ব্যবধান কতটা। সে জন্য তিনি কিছু সংস্কারও চেয়েছিলেন। ব্রিটেনের অর্থনীতিকে দৃঢ় ভিত্তি দানের জন্য ইউরোপীয় ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত থেকেই কয়েকটি শর্তের রদবদলের প্রচেষ্টা নিয়েছিলেন। কাজ হয়নি। শেষমেশ গণভোটে হলেন পরাস্ত। তার পরও চাইলে ব্রিটিশ এমপিদের পক্ষে ইইউ থেকে ব্রিটেনের বেরিয়ে যাওয়ার বিষয়টি পার্লামেন্টে আইনগতভাবে রুখে দেয়াও সম্ভব। ক্যামেরন সেই সুযোগটিও নাকচ করে দিলেন। কারণ গণতন্ত্রের মূল কথাই হলো সংখ্যাগরিষ্ঠের মত। সেই মতের প্রতি সম্মান জানানোর জন্য প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে নিজের সরে দাঁড়ানোই সমীচীন বলে জ্ঞান করেছেন ক্যামেরন। এখানেই তার রাজনৈতিক দূরদর্শিতা ও মহানুভবতা। ডেভিড ক্যামেরনকে বলা চলে দৃঢ় নীতিবোধসম্পন্ন একজন প্রধানমন্ত্রী, সপ্রতিভও বটে। লক্ষণীয় হলো তার নিজের সিদ্ধান্তের বিপক্ষে থাকা টোরি দলের ৯ মন্ত্রী ও ১৩৭ সাংসদের ‘ফ্লোর ক্রসিং’ বিষয়ে তিনি গণভোটের আগেই পরিষ্কার করেন। ক্যামেরন বলেছিলেন, ভিন্ন মতের কারণে কেউ শাস্তি পাবেন না। তাদের কোন অসুবিধা হবে না। এই গণভোটকে একটা পরীক্ষা হিসেবে নিয়েছিলেন ক্যামেরন। ভেবেছিলেন এই পরীক্ষার মাধ্যমে নিজের রাজনৈতিক দল কনজারভেটিভ পার্টিকেও ঐক্যবদ্ধ করতে পারবেন। কিন্তু গণভোটে অংশগ্রহণকারী যুক্তরাজ্যের ৫২ শতাংশ নাগরিক ইইউ ত্যাগ করার পক্ষে মত দিয়েছেন। ইতিহাসের পাতায় চোখ রাখলে আমরা দেখতে পাবÑ ২০১০ সালের সাধারণ নির্বাচনের পর ক্যামেরন যুক্তরাজ্যে ২০০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে কম বয়সী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেন। এ সময় তার সরকারের পূর্ণ সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছিল না। মধ্যপন্থী লিবারেল ডেমোক্র্যাটদের সমর্থন নিয়ে কনজারভেটিভ পার্টি ওই সরকার গঠন করেছিল। তবে ২০১৫ সালের মে মাসের নির্বাচনে দলটি নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় আসে। এর আগের বছরও দেশটিতে একটি গণভোটের পরীক্ষা হয়, তবে সেই বাধা উতরে যায় কনজারভেটিভ পার্টির সরকার। সেই গণভোটে যুক্তরাজ্যের সঙ্গে থাকার পক্ষে মত দেয় স্কটল্যান্ড। গণভোটের পর শুক্রবার ডেভিড ক্যামেরন যে ভাষণ দেন সেটিও সে দেশের এই ঐতিহাসিক মুহূর্তে কম তাৎপর্যপূর্ণ নয়। ভাষণে তিনি বলেছেন : ‘আমি ছয়টি বছর এ দেশের প্রধানমন্ত্রী ছিলাম, আর এতেই আমি অত্যন্ত গর্বিত এবং অতীব সম্মানিত। আমি আর ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী হব না। আমার স্বদেশ একটি বিশেষ দেশ; বিশ্ব শ্রদ্ধাশীল আমাদের সংসদীয় গণতন্ত্রের কার্যকরিতায়, বিজ্ঞান, শিল্পকলা ও সৃজনশীলতায়।’ হ্যাঁ, তিনি যথার্থই বলেছেন। বিশ্ববাসী তার পদত্যাগের সিদ্ধান্তের ভেতর দিয়ে আবারও প্রত্যক্ষ করল ব্রিটিশ গণতন্ত্রের সৌন্দর্য ও মহিমা। ১০ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিট থেকে অক্টোবরে তার বিদায় নেয়ার কথা। কিন্তু ইতিহাসের পালাবদলের কালে স্বেচ্ছায় যিনি বিদায় নিচ্ছেন, তিনি অনন্য এক দৃষ্টান্ত রেখে গেলেন বিশ্ব রাজনীতিতে। দেশপ্রেমিক নেতা হিসেবে নিজ দেশের কল্যাণের জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে দেশবাসীর মতামতকে মাথা পেতে নিয়ে বিদায় গ্রহণের মধ্যে যে সৌজন্য ও সৌন্দর্যের প্রকাশ ঘটল, শুধু ব্রিটেনবাসী নয়, তা বিশ্ববাসী নিশ্চয়ই স্মরণে রাখবে।
×