ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

জাকারিয়া স্বপন

ব্রেক্সিট ও কিছু অবিবেচক মানুষের গল্প

প্রকাশিত: ০৩:৪৯, ২৭ জুন ২০১৬

ব্রেক্সিট ও কিছু অবিবেচক মানুষের গল্প

পুরো পৃথিবীর লেখাপড়া জানা মানুষ যখন ব্রেক্সিট ব্রেক্সিট করে জপ করছে, তখন খুবই মজার তথ্য প্রকাশ করেছে গুগল। গণভোট শেষে ফলাফল বের হওয়ার পরও ব্রিটেন থেকে গুগলে সবচেয়ে বেশিবার যেসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজা হয়েছে সেগুলো হচ্ছেÑ ক. ইউরোপীয় ইউনিয়ন কী? খ. ব্রেক্সিট কী? গ. ইউরোপীয় ইউনিয়নে কয়টা দেশ আছে, সেগুলা কী কী? ঘ. কিভাবে ভোট দেব? ইত্যাদি। এর অর্থ কী? ভোটের পর ইংল্যান্ডের মানুষ যত কিছু সার্চ করেছে তার মধ্যে সবচে জনপ্রিয় সার্চের তালিকার দ্বিতীয় স্থানে ছিল ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন জিনিসটা কি! সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন উঠেছে, এই মানুষগুলো কি না জেনেই ভোট দিয়েছিল? গুগল না থাকলে আমাদের হয়ত এমন দারুণ মজার বিষয়গুলো জানাই হতো না। কিন্তু যে দেশে একটি গণভোটে শতকরা ৭২ ভাগ মানুষ অংশ নিয়েছে, সেই দেশের মানুষ হয়ত না বুঝেই ভোট দিয়ে এসেছে! ব্যাপারটা ভীষণ গোলমেলে, নাকি ভোটের প্রকৃতিই হলো এই? হয়ত পৃথিবীর সকল দেশের বেলাতেই এটা প্রযোজ্য। হয়ত বেশিরভাগ মানুষই হুজুগে ভোট দিয়ে আসে। প্রকৃত অর্থে সেই ফলাফল তাকে কিভাবে প্রভাবিত করবে, সেটা আর বিচার করার মতো বুদ্ধি বেশিরভাগেরই থাকে না। এই যদি হয় গণতন্ত্র এবং মানুষের ভোটের অধিকার, তাহলে তো নতুন করে পুরো বিষয়টি নিয়ে ভাবতে হবে। একটি দেশের বেশিরভাগ মানুষ কি আসলেই সেই দেশের ভাল চাইতে পারে? কিংবা চাওয়ার মতো যোগ্যতা রাখে? আমার এক সহকর্মী শোয়েব আহমেদ এটা নিয়ে বেশ কঠিন একটি মন্তব্য করেছেন, যা পাঠকদের সঙ্গে শেয়ার না করে পারছি না। তার মতে, গণতন্ত্রে সবার ভোটাধিকার থাকা উচিত নয়। যারা ‘কেন ভোট দিচ্ছি’ আর সেই ‘ভোটের ফলাফল কী হবে’ সেটা সম্পর্কে পূর্ণ ধারণা রাখবে, তারাই শুধু ভোট দিতে পারবে। কারণ, এসব অল্প সংখ্যক অবিবেচক মানুষের কারণে সবাইকে খারাপ ফল ভোগ করতে হয়। শোয়েবের মতো অসংখ্য মানুষ ভাবছে, এটা কী হলো! গণতন্ত্রের প্রকৃত রূপ যদি এই হয়, তাহলে ধরে নিতে হবে সাধারণ মানুষ আসলে দেশের সার্বিক ভাল-খারাপ বিষয়টি সব সময় বুঝতে সক্ষম নয়। তাদের যা বোঝানো হয়, তারা সেভাবেই পরিচালিত হয়। সেই বিচারে বাংলাদেশেও নির্বাচন এবং জনগণের রায়ে প্রকৃত নেতৃত্ব উঠে আসে কি-না, সেই প্রশ্ন গণতন্ত্রের স্কুলে পড়ানো যেতে পারে। ব্রেক্সিটের ফলে পুরো পৃথিবীর মানচিত্র ভিন্ন হতে চলেছে। এর অর্থনৈতিক চাপ হবে সাংঘাতিক এবং বেশি ক্ষতি হবে ইংল্যান্ডেরই। তার প্রভাব ইতোমধ্যেই পড়তে শুরু করেছে। হাইটেক শিল্পেও এর ব্যতিক্রম নয়। পুরো পৃথিবী যেখানে এখন বর্ডারলেস হয়ে যাচ্ছে, সেখানে ইংল্যান্ডের এই নতুন বর্ডার নীতিমালা কতটা ভাল বয়ে আনবে তা সময়ই বলে দেবে। বিল গেটস এবং জেফ ব্যাজসের আর্থিক ক্ষতি এই গণভোটে আমাদের মতো চুনোপুঁটিদের সরাসরি ক্ষতির পরিমাণ এখনও পরিলক্ষিত না হলেও ধনী লোকদের যে বিশাল ক্ষতি হয়েছে তার হিসাব-নিকাশ প্রকাশিত হতে শুরু করেছে। বিশ্বের ৪০০ ধনী মানুষ একদিনেই মাত্র ক্ষতির মুখোমুখি হয়েছেন ১২৭.৪ বিলিয়ন ডলারের। সেই তালিকায় রয়েছেন মাইক্রোসফটের বিল গেটস এবং এমাজন.কমের প্রতিষ্ঠাতা জেফ ব্যাজস। তারা প্রত্যেকেই একদিনে মাত্র এক বিলিয়ন ডলারের বেশি হারিয়েছেন। এই তথ্য প্রকাশ করেছে ব্লুমবার্গ। তারা আরও জানিয়েছে, ব্রিটেনের ১৫ জন ধনী ব্যক্তি ওইদিন ৫.৫ বিলিয়ন ডলার হারিয়েছেন। এই গণভোটের সরাসরি ফলাফল হলো, পাউন্ডের মূল্য সেই মার্গারেট থ্যাচারের (৩১ বছর আগের) সময়ের মূল্যে নেমে গেছে। এই আর্থিক ক্ষতি তারা কিভাবে কাটিয়ে উঠবে সেটাই এখন দেখার বিষয়। ভাল করেছে বিটকয়েন এই গণভোটের ফলাফলের পর আমেরিকার হাইটেক স্টক মার্কেট প্রায় সর্বনিম্ন অবস্থানে চলে গিয়েছে। অন্যদিকে সোনার দাম বেড়ে গিয়েছে। আর বিভিন্ন দেশের মুদ্রার মান সাগরের ঢেউয়ের মতো ওঠানামা করছে। এমন অস্থির অবস্থায় একটি মুদ্রা খুব ভাল করেছে- সেটা হলো বিটকয়েন। যারা বিটকয়েন সম্পর্কে জানেন না, তাদের জন্য একটু তথ্য দেয়া যেতে পারে। বিটকয়েন হলো ভার্চুয়াল টাকা, যার কোন দৃশ্যমান অস্তিত্ব নেই। এটা ছাপানো কোন মুদ্রা নয়। পুরোটাই হলো এক ধরনের ক্রিপ্টোগ্রাফিক-মুদ্রা যার তথ্য বিভিন্ন মানুষের কাছে ছড়ানো-ছিটানো অবস্থায় থাকে। এর পুরোটাই ডিজিটাল টাকা এবং ব্যাংকের সঙ্গে কোন সম্পর্ক নেই। দু’জন মানুষ চাইলেই নিজেদের ভেতর এই টাকা আদান-প্রদান করতে পারেন, যেখানে ব্যাংক কিংবা তৃতীয় কোন প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তির প্রয়োজন নেই। এই বিটকয়েন বিগত কয়েক বছর ধরে বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। এটা এখন এত বেশি শক্তিশালী মুদ্রা হয়ে দাঁড়িয়েছে যে, স্বর্ণের পরেই মানুষ এটাকে নিরাপদ মনে করছে। তাই বড় বড় বিনিয়োগকারীরা বিভিন্ন স্টকে বিনিয়োগ না করে বিটকয়েন কিনে বসে থাকেন। এটাকে তারা অনেক বেশি নির্ভরযোগ্য ভাবছেন এবং এই ব্রেক্সিটের ডামাডোলের সময়ও বিটকয়েন মানুষের আস্থার জায়গা নিয়ে ফেলেছে। এই বছরের জুন মাসের প্রথম দিকে বিটকয়েনের দাম উঠে গিয়েছিল প্রায় ৭৭০ ডলার এবং ১৬ জুনের দিকে এটা অনেক নিচে নেমে যায়। কিন্তু গণভোটের পর থেকেই এর দাম বাড়তে শুরু করে। বৃহস্পতিবার দিনের শেষে এটা হয়ে যায় ৫৮৫ ডলার এবং শুক্রবার সেটা বেড়ে হয়ে যায় ৬৬৭ ডলার। একদিনে ৮২ ডলার বাড়ার অর্থ হলো এক ধাক্কায় শতকরা ১৪ ভাগ বেড়ে যাওয়া। এর মূল কারণ হলো বিনিয়োগকারীরা। বিনিয়োগকারীরা বুঝতে পারছেন না এই অবস্থার পরিণতি কী! ইংল্যান্ড যেহেতু ইউরোপিয়ান ইউনিয়নে থাকছে না এবং এর পরবর্তী পরিস্থিতি কী হবে সেই অনিশ্চয়তায় তারা বিটকয়েন কিনে রেখেছেন। বর্তমান সময়ে মার্কিন ডলারের দাম বাড়তে শুরু করেছে। বিনিয়োগকারীরা স্বর্ণের চেয়েও বিটকয়েনকে আরও বেশি নিরাপদ মনে করছেন। জয় হোক ডিজিটাল টাকার! তথ্যপ্রযুক্তি খাতে চ্যালেঞ্জ ব্রেক্সিটের ফলে অন্যান্য খাতের মতো একটু ভিন্ন রকমের ঝামেলায় পড়বে ইংল্যান্ড। ইউরোপের স্টার্টআপ কোম্পানিগুলোর হাব ছিল ইংল্যান্ড। ইউরোপের বিভিন্ন দেশের ছেলেমেয়েরা গিয়ে ওখানে নতুন নতুন উদ্ভাবনীর চেষ্টা করে থাকে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বের হয়ে যাওয়ায় এখন নতুন ধরনের ভিসা এবং অন্যান্য জটিলতার চেয়েও বড় ধাক্কা লাগবে গবেষণা ফান্ডে। ইংল্যান্ডের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নতুন নতুন গবেষণা হয়। তার বেশিরভাগ ফান্ডিং আসত ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলো থেকে। এর মাধ্যমে হাই-স্কিল জনবল তৈরি করতে পারত ইংল্যান্ড, যারা হাইটেক শিল্পে কাজে লাগতে পারত। কিন্তু এখন ওই ফান্ডিং বন্ধ হয়ে যাবে এবং ব্রিটেনকে নিজের পকেট থেকে ওই অর্থ যোগাড় করতে হবে। যদি সেই অর্থ যোগাড় করা না যায় তাহলে বেশ বড় ধরনের ঝামেলায় পড়বে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। এর প্রভাব পড়বে মূল হাইটেক প্রতিষ্ঠানগুলোতেও। আমেরিকার বড় বড় হাইটেক প্রতিষ্ঠানগুলো মূলত ব্রিটেনে অফিস খুলে অপারেট করত। তারা তখন পুরো ইউরোপের ট্যালেন্টপুলকে আকৃষ্ট করতে পারত। কিন্তু এই দুর্ঘটনা ঘটার পর বাকি ২৭টি দেশ থেকে এখন আর সহজেই লোক পাবে না ওই প্রতিষ্ঠানগুলো। এখন তাদের আলাদা করে ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোর ভেতর থেকে আরেকটি দেশকে বেছে নিতে হবে, যা সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। পাশাপাশি ইংল্যান্ডে কাজের সুযোগ কমে আসবে এবং অনেক ভাল হাইটেক কর্মী ইংল্যান্ড ছেড়ে আমেরিকায় চলে যাবে। ঝামেলা আরও আছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোর গ্রাহকদের তথ্য হাইটেক কোম্পানিগুলো আইনগতভাবে সংগ্রহ করতে পারত। এই বিভক্তির ফলে ব্রিটেন আর অন্যান্য দেশের গ্রাহকের তথ্য ইন্টারনেটের মাধ্যমে সংগ্রহ এবং সংরক্ষণ করতে পারবে না। ডাটা প্রাইভেসি আইনে সেটা আটকা পড়ে যাবে। ব্রিটেনকে নতুন করে সেই আইনের সূত্রগুলো মেনে চলতে হবে, যা অন্যান্য দেশের জন্য প্রযোজ্য। একই সঙ্গে ই-কমার্স সাইটগুলো নতুন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হবে। ইইউতে থাকার সুবিধার্থে ইংল্যান্ডে বসেই পুরো ইউরোপে তাদের কার্যক্রম চালাতে পারত। এখন নতুন ট্যাক্স এবং পরিবহন খরচ যোগ হতে পারে। সেক্ষেত্রে ইংল্যান্ড তার বাজার হারাতে পারে। স্থানীয় অন্যান্য ই-কমার্স সাইট সেই জায়গা দখল করতে পারে। বাংলাদেশ প্রেক্ষাপট বাংলাদেশের সফটওয়্যার খাতে ইংল্যান্ড কিংবা আমেরিকার চেয়ে ইউরোপের অন্যান্য দেশের বিনিয়োগ বেশি। তাদের বেশ কয়েকটি মাঝারি আকারের সফটওয়্যার প্রতিষ্ঠান রয়েছে বাংলাদেশে। তারা মূলত ইউরোপের বড় প্রতিষ্ঠানগুলোর আউটসোর্সিংয়ের কাজ করে থাকে। সেই হিসেবে ব্রেক্সিট তাদের ওপর কোন প্রভাব হয়ত ফেলবে না। তাছাড়া বাংলাদেশের সফটওয়্যার শিল্প এখনও তেমন বড় কিছু নয় যে, সেটা সামগ্রিক কোন পরিবর্তন আনবে। হাতেগোনা কিছু প্রতিষ্ঠান এই ধরনের কাজে যুক্ত। তবে অনেকেই ছোট ছোট অফিস নিয়ে কিংবা ঘরে বসে ফ্রিল্যান্সিং কাজ করে থাকেন, যাদের বড় একটি কাস্টমার হলো ইংল্যান্ড। এখন সেই প্রতিষ্ঠানগুলো যদি হুমকির মুখে পড়ে তাহলে ফ্রিল্যান্সিং বাজারেও একটু ধাক্কা লাগতে পারে বৈকি! তবে নতুন এই মেরুকরণে নতুন সম্ভাবনার দুয়ারও খুলে যেতে পারে। নতুন পৃথিবীর অপেক্ষায় ২০১৬ সালটি নিঃসন্দেহে পৃথিবী নামের এই গ্রহের জন্য একটি কঠিন সময়। বছরের মাঝামাঝি সময়ে গ্রেট ব্রিটেন আলাদা হয়ে গেল এবং সঙ্গে সঙ্গে নিজেদের অস্তিত্ব ধরে রাখাই প্রশ্নবোধক হয়ে দেখা দিয়েছে। এখন স্কটল্যান্ড এবং আয়ারল্যান্ড যদি গ্রেট ব্রিটেনকে ছেড়ে যায় (যা নিয়ে এখন প্রচুর কথা হচ্ছে), তাহলে গ্রেট ব্রিটেন আর গ্রেট থাকল না; তারা পরিণত হবে খুব ছোট একটি দেশে, যা দেখতে এই গ্রহের আরও অনেক দেশের মতোই। কিন্তু মাঝখান দিয়ে ভীষণ এক ধাক্কা দিয়ে যাবে অর্থনীতি এবং রাজনীতিকে। গল্প এখানেই শেষ নয়। বছরের শেষ দিকে (নবেম্বরে) আসছে আমেরিকার নির্বাচন। সেই নির্বাচনের ফলাফলের ওপর নির্ভর করবে কিভাবে ঘুরবে আমেরিকার চাকা। এই দুই পরাশক্তির নতুন মেরুকরণে আমরা বাকিরা তাকিয়ে আছি চীন আর ভারতের দিকে। ভারত যেভাবে আকাশে উপগ্রহ ওড়াচ্ছে আর চীন যেভাবে সুপার কম্পিউটার বানাচ্ছে, তাতে করে এই গ্রহের তাবত ভরকেন্দ্র এই দুই দেশে এসে ঠেকবে। তার মূল কারণই হলো, তাদের নিজেদের বিশাল জনসংখ্যা এবং বাজার। উল্টোদিকে ইংল্যান্ড তাদের বিশাল বাজার থেকেই বের হয়ে গেল। এই গ্রহ ঠিক কোন্দিকে মোড় নেবে তা দেখার জন্য আমাদের নবেম্বর পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। ২৫ জুন, ২০১৬ লেখক : তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ ুং@ঢ়ৎরুড়.পড়স
×