ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

লাভ-লোকসানের চুলচেরা বিশ্লেষণ করছে বাংলাদেশ

ব্রেক্সিটের ধাক্কা লাগতে পারে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক অন্যান্য জোটে

প্রকাশিত: ০৬:০২, ২৬ জুন ২০১৬

ব্রেক্সিটের ধাক্কা লাগতে পারে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক  অন্যান্য জোটে

তৌহিদুর রহমান ॥ ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে যুক্তরাজ্য বেরিয়ে গেলে বিশ্বের বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক জোটে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। ইউরোপের ২৮ দেশের এই জোটকে বিশ্বের বিভিন্ন ফোরাম মডেল হিসেবে গ্রহণ করে আসছে। যুক্তরাজ্য এই জোট থেকে বেরিয়ে আসার ফলে বিশ্বের বিভিন্ন জোট বড় ধরনের ধাক্কা খেতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এদিকে ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে যুক্তরাজ্য বেরিয়ে যাওয়ার বিষয়টি সতর্কভাবে পর্যবেক্ষণ করছে বাংলাদেশ। বিশ্বের অনেক জোটই ইউরোপীয় ইউনিয়নকে মডেল হিসেবে মনে করে। অনেক জোটেরই ইউরোপীয় ইউনিয়নের মতো এক ভিসা ও এক মুদ্রা চালুর আগ্রহ রয়েছে। বিশেষ করে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ১০টি আঞ্চলিক দেশের জোট আসিয়ান ইতোমধ্যেই ইউরোপীয় ইউনিয়নকে মডেল হিসেবে গ্রহণ করেছে। এই দেশগুলো ২০৩০ সালের মধ্যে চতুর্থ বৃহৎ অর্থনৈতিক জোট হিসেবে গড়ে ওঠার ঘোষণা দিয়েছে। এছাড়া ইউরোপীয় ইউনিয়নের মতো জোট গড়তে দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক জোট সার্কের শীর্ষ নেতাদেরও স্বপ্ন রয়েছে। এছাড়া বঙ্গোপসাগরীয় অঞ্চলের জোট বিমসটেক, পাঁচ জাতির অর্থনৈতিক জোট ব্রিকস, যুক্তরাজ্যের শাসন থেকে বেরিয়ে যাওয়া দেশের জোট কমনওয়েলথও বড় ধরনের ধাক্কা খেতে পারে। ১৯৬৭ সালে এ্যাসোসিয়েশন অব সাউথ ইস্ট এশিয়ান নেশনস (আসিয়ান) গঠিত হয়। আসিয়ানভুক্ত ১০টি দেশ হলো মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপিন্স, সিঙ্গাপুর, ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, লাওস, মিয়ানমার, ব্রুনেই, দারুসসালাম ও থাইল্যান্ড। জোটের পক্ষ থেকে নিজেদের মধ্যে অর্থনৈতিক ও পারস্পরিক সম্পর্ক বাড়াতে ‘আশিয়ান ২০২৫ : একসঙ্গে এগিয়ে চলা’ নামে ঘোষণাও দেয়া হয়েছে। সে ঘোষণা বাস্তবায়নে এই জোট কাজ করছে। এই জোট ইতোমধ্যেই ইউরোপীয় ইউনিয়নকে মডেল হিসেবে ধরে সামনে এগিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখছে। আসিয়ানভুক্ত দেশগুলো এক ভিসা ও এক মুদ্রা চালুর উদ্যোগ নিয়েছে। এছাড়া ২০২০ সালে আসিয়ানভুক্ত দেশগুলোর সম্মিলিত মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) আকার হবে প্রায় ৫ ট্রিলিয়ন বা ৫ লাখ কোটি ডলার। তবে কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছে যুক্তরাজ্যের ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্তে এই জোটে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক জোট সার্ক এই অঞ্চলের ৮ দেশের অর্থনীতি, বাণিজ্য, যোগাযোগ, সংস্কৃতি বিকাশে কাজ করছে। সার্ক অঞ্চলের জনগণের মধ্যে স্বপ্ন রয়েছে এই অঞ্চলের দেশগুলো একদিন ইউরোপীয় ইউনিয়নের মতো হবে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের আদলে সার্কের দেশগুলোর মধ্যে সহযোগিতা বাড়াতে এই সংস্থার ৮ দেশের বিভিন্ন ফোরামের চাপ অব্যাহত রয়েছে। সার্কের একাধিক মহাসচিবও বিভিন্ন সময়ে আশা প্রকাশ করেছেন, সার্ককে আগামী দিনে ইউরোপীয় ইউনিয়নের আদলে গড়ে তোলা হবে। সূত্র জানায়, ইউরোপীয় ইউনিয়নের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে বিশ্বের অনেক ফোরামই গড়ে উঠেছে। বিশ্বের একাধিক এসব ফোরাম ইউরোপীয় ইউনিয়নকে মডেল হিসেবে গ্রহণ করে আগামী দিনে সামনে এগিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। তবে যুক্তরাজ্যের ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্তে এসব জোটের মধ্যে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। এদিকে ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে যুক্তরাজ্য বেরিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্তে ফ্রান্স, ইতালি, ডেনমার্ক, সুইডেন, নেদারল্যান্ডস ইত্যাদি দেশেও গণভোটের আওয়াজ তোলা হচ্ছে। এসব আওয়াজ ধীরে ধীরে প্রবল হলে এর ফলাফল হবে সুদূরপ্রসারী। এর মধ্যে দিয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নের বিলুপ্তিও ঘটতে পারে। বঙ্গোপসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলো নিয়ে গঠিত জোট বিমসটেক ইতোমধ্যেই মুক্তবাণিজ্য অঞ্চল ঘোষণার উদ্যোগ নিয়েছে। বিমসটেকের সদস্য দেশগুলো এখন মুক্তবাণিজ্যের দিকে ঝুঁকছে। ১৯৯৭ সালের ৬ জুন বাংলাদেশ, ভারত, শ্রীলঙ্কা ও থাইল্যান্ড ইকোনমিক কো-অপারেশন (বিসটেক) নামে নতুন উপ-আঞ্চলিক জোট গঠন হয়। পরে মিয়ানমার, নেপাল ও ভুটান এতে যোগ দিলে ২০০৪ সালে ব্যাংককে অনুষ্ঠিত শীর্ষ সম্মেলনে নাম পরিবর্তন করে ‘বিমসটেক’ করা হয়। ১৯৯৭ সালে সহযোগিতার ছয়টি ক্ষেত্র নিয়ে যাত্রা শুরু হলেও পরবর্তীতে আরও আটটি নতুন ক্ষেত্র যোগ হওয়ায় বিমসটেক এখন উন্নয়ন এবং অভিন্ন স্বার্থ সংশ্লিষ্ট চৌদ্দটি খাতের ওপর জোর দিচ্ছে। এই খাতগুলো হলো-বাণিজ্য ও বিনিয়োগ, প্রযুক্তি, জ্বালানি, পরিবহন ও যোগাযোগ, পর্যটন, মৎস্য, কৃষি, সাংস্কৃতিক সহযোগিতা, পরিবেশ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, জনস্বাস্থ্য, জনগণের মধ্যে যোগাযোগ, দারিদ্র্য দূরীকরণ, সন্ত্রাসবাদ ও আঞ্চলিক অপরাধ দমন এবং জলবায়ু পরিবর্তন। তবে ইউরোপীয় ইউনিয়নের ভাঙনের সুরে এই জোটের শীর্ষ নেতাদের মধ্যে হতাশা আসতে পারে। এদিকে ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে যুক্তরাজ্যের বের হয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের ওপর কোন বিরূপ প্রভাব ফেলবে কিনা তা নিয়ে আলোচনা শুরু হয়ে গেছে। শুরু হয়েছে লাভ-লোকসানের হিসাব। বাংলাদেশ সরকারের নীতি নির্ধারকরা এখন এ নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ করছেন। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে ব্রেক্সিটের (ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে যুক্তরাজ্যের বেরিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত) কী প্রভাব পড়বে তা বুঝতে আরও সময় লাগবে। কারণ, এর ফলে যদি যুক্তরাজ্য বা ইইউর প্রবৃদ্ধি বা অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তাহলে বাংলাদেশও ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এ বিষয়ে লন্ডনে বাংলাদেশ দূতাবাসের মুখপাত্র নাদিম কাদির জানিয়েছেন, যুক্তরাজ্যে, বিশেষ করে লন্ডনে বাংলাদেশী কমিউনিটি ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে যুক্তরাজ্যের বের হয়ে যাওয়ার ব্যাপারে দ্বিধা বিভক্ত ছিল, এখনও আছে। যারা ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বের হওয়ার পক্ষে ছিলেন তারা মনে করছেন এখন এখানে কাজের সুযোগ বাড়বে, দেশ থেকে আত্মীয়-স্বজনকে আনা যাবে, পড়াশোনার সুযোগ বাড়বে। আর যারা এর বিরোধিতা করেছেন তারা বলছেন এরফলে জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়বে, সামাজিক নিরাপত্তা কমবে। এটা বাংলাদেশের জন্য ভয়ের ব্যাপার বলে মন্তব্য করেন তিনি। নাদিম কাদির জানান, বিষয়টি যুক্তরাজ্যের জন্যই স্বস্তির নয়। তারাও একটি জটিল সময় পার করছে। আগামী তিন মাসে আরও অনেক বিষয় স্পষ্ট হবে। নতুন প্রধানমন্ত্রী হবে। আমাদেরও এই সময়টি খেয়াল রেখে এগোতে হবে। গণভোটের আগে বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত যুক্তরাজ্যের এমপি রুশনারা আলী জানিয়েছিলেন, ব্রেক্সিট হলে পাঁচ লাখ বাংলাদেশীর চাকরি হারানোর আশঙ্কা রয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে গেলে অর্থনৈতিক দুরবস্থার কারণে বাংলাদেশীসহ এথনিক মাইনোরিটির লোকজনরাই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। উল্লেখ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়ন গঠনের পর যুক্তরাজ্যই প্রথম দেশ, যারা ২৮ জাতির এই জোট ছেড়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। বৃহস্পতিবার অনুষ্ঠিত গণভোটের ফল আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণার আগেই বিচ্ছেদপন্থীদের জয় স্পষ্ট হয়ে যায়। ইউরোপের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশটির গণভোটের রায় ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাকি ২৭ দেশের শীর্ষ নেতাদেরও দুশ্চিন্তায় ফেলে দিয়েছে।
×