ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

নারায়ণগঞ্জে সড়ক-মহাসড়কগুলো এখন মৃত্যুফাঁদ!

প্রকাশিত: ০৬:১৪, ২৫ জুন ২০১৬

নারায়ণগঞ্জে সড়ক-মহাসড়কগুলো এখন মৃত্যুফাঁদ!

মোঃ খলিলুর রহমান, নারায়ণগঞ্জ থেকে ॥ রাজধানী ঢাকার সীমান্তবর্তী জেলা নারায়ণগঞ্জের শহর, থানা-উপজেলার সড়ক-মহাসড়কগুলোতে সড়ক দুর্ঘটনা বেড়েই চলেছে। এখানকার সড়ক ও মহাসড়কগুলো এখন মৃত্যুফাঁদে পরিণত হয়েছে বলে স্থানী বাসিন্দারা অভিযোগ করেছেন। সড়ক দুর্ঘটনার মৃত্যুর মিছিলে প্রতিনিয়ত যোগ দিচ্ছে বিভিন্ন পেশার লোকজন। বাদ পড়ছেন না প্রভাষক, ছাত্র-ছাত্রী, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনী র‌্যাব ও পুলিশ সদস্যরাও। অনেকেই পুঙ্গত্ব বরণ করছে। এতে সড়ক দুর্ঘটনায় পতিত হওয়া পরিবারগুলো একেবারেই নিঃস্ব হয়ে পড়ছে। অথচ সড়ক দুর্ঘটনা রোধকল্পে কেউ এগিয়ে আসছে না। সর্বশেষ গত ১৫ জুন একই দিনে পৃথক দু’টি সড়ক দুর্ঘটনায় ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের সোনারগাঁয়ের ব্যস্ততম কাঁচপুর বাসস্ট্যান্ডে বাস ও ট্যাঙ্কলরির চাপায় পুলিশের এক এসআই ও মা-মেয়েসহ ৬ নিহত ও কমপক্ষে ২০ আহত হয়। জানা যায়, রাজধানীর ঢাকার সীমান্তবর্তী পূর্ব-দক্ষিণে নারায়ণগঞ্জ জেলার অবস্থান। এ জেলার উপজেলা ও থানা আওতাধীন ঢাকা-চট্টগ্রাম, ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক, ঢাকা বাইপাস সড়ক, ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিঙ্করোড, ঢাকা-পাগলা-নারায়ণগঞ্জ পুরাতন সড়ক, ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ-মুন্সীগঞ্জ সড়ক, নারায়ণগঞ্জ-আদমজী-ডেমরা, মদনপুর-মদনগঞ্জ সড়ক, ঢাকা-আড়াইহাজার সড়কসহ অসংখ্যা আঞ্চলিক সড়ক রয়েছে। গত জানুয়ারি মাস থেকে জুন পর্যন্ত সড়ক, মহাসড়ক ও আঞ্চলিক সড়কগুলোতে আশঙ্কাজনক হারে সড়ক দুর্ঘটনা বেড়েছে বলে স্থানীয় লোকজন অভিযোগ করেন। অবশ্য একটি সংস্থার সূত্র থেকে জানা যায়, নারায়ণগঞ্জে ১৮টি দুর্ঘটনাপ্রবণ স্থান রয়েছে বলে তারা চিহ্নিত করেন। তাদের মতে দুর্ঘটনাপ্রবণ স্থানগুলো হলো- শহরের চাষাঢ়া মোড়, পঞ্চবটি, ইসদাইর, শিবু মার্কেট, জালকুড়ি, ভূঁইঘর, সাইনবোর্ড, সানারপাড়, শিমরাইল, আদমজী, কাঁচপুর, তারাব বিশ্বরোড, বরপা, ভুলতা, গাউছিয়া, গোলাকান্দাইল, আধুরীয়া, সাওঘাট সিএনজি পাম্প ও কাঞ্চন বাজার। খবর নিয়ে জানা গেছে, গত ১৫ জুন ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কাঁচপুর বাসস্ট্যান্ড এলাকায় রাত সাড়ে ৮টায় একটি যাত্রীবাহী বাস চাপায় মোটরসাইকেল আরোহী পুলিশের এসআই কামরুল ইসলাম (২৫), পথচারী আলী আহম্মেদ (৫৫), আঃ হালিম (৩৫) ও খোরশদে (৩৫) নিহত হয়। আহত হয় আরও ২০ জন। একই দিন বিকেলে একই স্থানে ট্যাঙ্কলরির চাপায় মা সুমা আক্তার (২৫) ও তিন মাসের শিশু কন্যা নুসরাত নিহত হয়। গত ১১ জুন ফতুল্লার মুসলিমনগর এলাকায় ব্যাটারিচালিত অটোরিক্সার চাপায় খাদিজা আক্তার (৫) নামে এক শিশু নিহত হয়। আবার গত ১৬ মে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের বন্দরের কেওঢালা এলাকায় একটি যাত্রীবাহী বাসের চাকায় পিষ্ট হয়ে নিপু মিয়া (২৫) নামে এক গার্মেন্টস কর্মী নিহত হয়। গত ২৬ এপ্রিল ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ পুরাতন সড়কের শহরের মাসদাইর এলাকায় সিমেন্টভর্তি একটি কাভার্ডভ্যান একটি মোটরসাইকেলকে চাপা দিলে মোটরসাইকেল চালক এইচএসসি পরীক্ষার্থী ইয়াছিন আরাফাত (২২) নিহত ও সিয়াম (২১) নামে মোটরসাইকেল আরোহী গুরুতর আহত হয়। আবার গত ১৬ মার্চ ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের সোনারগাঁ উপজেলার আষাঢ়িয়ার চর এলাকায় একটি অজ্ঞাতনামা একটি গাড়ি একটি মোটরসাইকেলকে ধাক্কা দিয়ে মোটরসাইকেল আরোহী রফিকুল ইসলাম (৪৩) নিহত হয়। গত ১১ মার্চ ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের সোনারগাঁওয়ে মোগরাপাড়া চৌরাস্তায় একটি যানবাহনের চাকায় পিষ্ট হয়ে আব্দুল আউয়াল (৪৮) নামে সোনারগাঁ ডিগ্রী কলেজের এক সিনিয়র প্রভাষক নিহত হন। গত ১ ফেব্রুয়ারি আড়াইহাজার উপজেলার হাইজাদী ইউনিয়নের কলাগাছিয়া নামক স্থানে নসিমন চাপায় মিনারা (৩০) নামে এক ইট ভাঙ্গার মহিলা শ্রমিক নিহত হয়। গত ২৯ জানুয়ারি ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের আড়াইহাজারের পুরিন্দা বাজার এলাকায় সুতা ভর্তি ট্রাকের সঙ্গে র‌্যাবের একটি টহল পিকআপ ভ্যানের মুখোমুখি সংর্ঘষে ভ্যানটি দুমড়ে-মুচড়ে গেলে ঘটনাস্থলেই র‌্যাব-১১-এর আদমজী দফতরের সার্জেন্ট মনসুর (৩৪) ও হাসপাতালে কনস্টেবল (চালক) সোহেল (৩০) নিহত হন। এভাবেই বেড়েছে বহু সড়ক দুর্ঘটনা। সড়ক দুর্ঘটনার মৃত্যুর মিছিলে যোগ দিচ্ছে নানা পেশার মানুষ। অথচ সড়ক দুর্ঘটনা রোধকল্পে কেউ এগিয়ে আসছে না। এতে ক্ষোভ প্রকাশ করেছে সড়ক দুর্ঘটনায় হতাহতের পরিবারের সদস্যরা। নারায়ণগঞ্জ ট্রাফিক বিভাগের সার্জেন্ট সাইফুল ইসলাম জানান, নারায়ণগঞ্জে যানবাহনের রং পার্কিং, ওভার লোডিং ও কাগজপত্র ঠিক না থাকাসহ বিভিন্ন কারণে প্রতিদিন গড়ে প্রায় ২০-২২টি মামলা হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে জরিমানা করা হচ্ছে ১শ’ টাকা থেকে ৫ হাজার টাকা পর্যন্ত। তিনি আরও জানান, প্রাইভেটকার ও মাইক্রোবাস রাস্তায় চলাচলের সময় রেজিস্ট্রেশন সার্টিফিকেট, ট্যাক্স টোকেন, ইন্স্যুরেন্স, ফিটনেস সার্টিফিকেট ও ড্রাইভিং লাইসেন্স থাকতে হবে। অপরদিকে মোটরসাইকেল হলে রেজিস্ট্রেশন সার্টিফিকেট, ট্যাক্স টোকেন, ইন্স্যুরেন্স ও ড্রাইভিং লাইসেন্স থাকতে হবে। বাস-মিনিবাস, ট্রাক, কাভার্ডভ্যানসহ গণপরিবহনে রেজিস্ট্রেশন সার্টিফিকে, রুট পারমিট, ট্যাক্স টোকেন, ইন্স্যুরেন্স, ফিটনেস সার্টিফিকেট ও ড্রাইভিং লাইসেন্স অবশ্যই থাকতে হবে। নারায়ণগঞ্জ সচেতন মহল জানান, এখানার অনেক যানবাহনেরই কোন বৈধ কাগজপত্রই নেই তবুও চলছে রাস্তায়। এখানকার অনেক যানবাহনের ফিটনেস সার্টিফিকেট ও চালকের ড্রাইভিং লাইসেন্স না থাকায় অনেক যানবাহন সড়ক দুর্ঘটনায় পতিত হচ্ছে। ইদানীং বিভিন্ন সড়কে অদক্ষ ও প্রাপ্ত বয়স ছাড়াই ড্রাইভিং করতে দেখা যাচ্ছে। সরেজমিন অনুসন্ধানকালে বিভিন্ন পেশার লোকজন জানান, ওভারটেকিং, পাল্টাপাল্টি প্রতিযোগিতা, অদক্ষ চালক, ট্রাফিক পুলিশের গাফলতি, যত্রতত্র গাড়ি পার্কিং, বাসস্ট্যান্ডগুলোতে রাস্তা পারাপারের জন্য ফুটওভার ব্রিজ না থাকা, জেব্রা ক্রসিং না থাকা, পরিকল্পিতভাবে গতিরোধক না থাকা, লক্কড়-ঝক্কড় যানবাহন চলাচল, এখনও মহাসড়কে সিএনজিসহ ব্যাটারিচালিত অটোরিক্সা চলাচলসহ বিভিন্ন কারণেই সড়ক দুর্ঘটনা বেড়ে গেছে। কাঁচপুর এলাকার বাসিন্দা আব্দুল কাদির জানায়, কাঁচপুর বাসস্ট্যান্ডটি অত্যন্ত ব্যস্ততম একটি বাসস্ট্যান্ড। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কাঁচপুর পয়েন্ট থেকেই ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক শুরু হয়েছে। অথচ এখানে পথচারীদের জন্য এখনও ফুটওভারব্রিজ নির্মাণ করা হয়নি। যাত্রীদের জন্য তৈরি করা হয়নি যাত্রী ছাউনি। ফলে যাত্রীরা যাত্রী ছাউনির অভাবে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকায় যাত্রীরা সড়ক দুর্ঘটনায় অকালে মৃত্যুর বরণ করছে। সাইনবোর্ড এলাকার বাসিন্দা আলী আকবর জানান, সাইনবোর্ড এলাকায় ফুটওভারব্রিজ ও যাত্রী ছাউনি না থাকায় অনেকেই সড়ক দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছেন। মদনপুরের বাসিন্দা মহিউদ্দিন জানান, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের মদনপুর বাসস্ট্যান্ড থেকে ঢাকা বাইপাস সড়ক ও মদনপুর-মদনগঞ্জ সড়ক শুরু হয়েছে। তাই বাসস্ট্যান্ডটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু এখানে পথচারীদের জন্য ফুটওভারব্রিজ তৈরি করা হয়নি। ফলে রাস্তা পার হতে গিয়ে অনেকেই সড়ক দুর্ঘটনায় পতিত হচ্ছে। ইদানীং এখানকার সড়ক ও মহাসড়কগুলো মৃত্যুফাঁদে পরিণত হয়েছে। শিমরাইল মোড়ে কর্মরাত ট্রাফিকের ইন্সপেক্টর তাসলিম জানান, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের শিমরাইল মোড়ে দু’টি ফুটওভারব্রিজ থাকা সত্ত্বেও নিচ দিয়ে (সড়ক দিয়ে) রাস্তা পার হতে গিয়ে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হচ্ছেন। লোকজন সচেতন না হলে নিচ দিয়ে সড়ক পারাপার ঠেকানো যাচ্ছে না। এ বিষয়ে নারায়ণগঞ্জ জেলার সহকারী পুলিশ সুপার (ট্রাফিক) বদরুল আলম জানান, কাঁচপুর থেকে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কটি দু লেনে রয়েছে। ঢাকার যাত্রাবাড়ী থেকে চার লেনের মহাসড়কটি কাঁচপুরে এসে দুই লেনে থাকায় লোকজন সড়ক দুর্ঘটনা পড়ছে। এদিকে ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে ডিভাইডার না থাকায় সড়ক দুর্ঘটনা বাড়ছে। এছাড়াও আরও অনেক কারণেই সড়ক দুর্ঘটনা ঘটছে।
×