ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

সমাধান চাই আর কান্না চাই না

প্রকাশিত: ০৫:৫৫, ২৫ জুন ২০১৬

সমাধান চাই আর  কান্না চাই না

দেশের আবেগ উত্তেজনা সমস্যা সম্ভাবনায় প্রবাসে আমরা নীরব থাকি না। নীরব থাকা যায় না। যখনই ভালমন্দ কিছু ঘটে আমরা তাতে প্রতিক্রিয়া জানাই। এটা আমাদের জীবনবোধের অঙ্গ। অনেকে এই বলে অভিযোগ করেন আমাদের নাকি মূলস্রোতে মেশার আগ্রহ নেই। তাই আমরা দিনরাত বাংলাদেশ নিয়ে ব্যস্ত থাকতে চাই। যারা মনে করেন জীবন মানে একটি বা একাধিক বাড়ি, গাড়ি আর সপ্তাহান্তে একেকজনের বাড়ি ঘুরে দাওয়াত খাওয়া তাদের জন্য এটা সত্য। মূলধারা বলে যারা অভিবাসী জনগোষ্ঠীকে বসবাসরত দেশের সঙ্গে গুলিয়ে সরবত বানাতে চায় তাদের কাছে একটা প্রশ্ন রাখি, ইংরেজরা তো আমাদের দেশে আড়াইশ’ বছর রাজত্ব করেছিল। তারা কি মিশেছিল অখ- ভারতের মূলধারায়? না তারা আমাদের উল্টো কোট প্যান্ট টাই পরিয়ে ছেড়েছিল? কারা আমাদের শিখিয়েছিল চা পান? কারা ধরিয়ে দিয়ে গেছে ক্রিকেটের নেশা? কাদের কল্যাণে আমরা এখনও মোগলাই খেতে মরিয়া? আজ বছর বছর পর বদলে যাওয়া বাংলাদেশীরা আরেক দেশে যখন নিজেদের অস্তিত্ব নিয়ে গৌরবে বিরাজ করছে সেকি পারে না সেদেশের মূলধারায় নিজেদের স্রোত যোগ করতে? আমাদের দেশ আমাদের মা। অচলায়তন বা স্থবির বাংলাদেশ কোনভাবেই বিদেশে ইমেজ ধরে রাখতে পারবে না। আর সে কারণেই এখানকার বাংলা কাগজ মুক্তমঞ্চের আয়োজনে একটি সেমিনারে গিয়েছিলাম, যেখানে আলোচনার মূল বিষয় ছিল বাংলাদেশে চলমান সাম্প্রদায়িক উস্কানি ও বর্তমান বাস্তবতা। বলাবাহুল্য, রাখঢাক ছাড়াই বক্তারা তাদের রাগ-অভিমান-মনের বেদনা তুলে ধরেছিলেন। বাংলাদেশের এখন যে বাস্তবতা তাতে উদ্বিগ্ন হবার বিকল্প নেই। যেভাবে হোক যে কারণেই হোক দেশের ভেতর এক ধরনের সাম্প্রদায়িক বাতাস বইয়ে তার সুযোগে ফায়দা হাসিল করতে চাইছে একদল মানুষ। এখন যেটা ভয়ের সেটা হলো এদের সঙ্গে সরকারী দলের লোকজনও জড়িয়ে পড়েছে। তারা হয়ত ভাবছে সুযোগ মিস করা যাবে না। মিডিয়া খুললেই দেশের নানা প্রান্তে সংখ্যালঘুদের জমিজমা দখল, তাদের হয়রানির খবর দেখছি আমরা। বলতে দ্বিধা নেই, আওয়ামী লীগের এমন চেহারা আগে দেখা যায়নি। শীর্ষ নেতৃত্বকে আঁধারে রেখে দেশের নানা জায়গায় তাদের এসব কীর্তিকলাপের কারণে দল পড়ছে বিপাকে। গড়ে উঠছে বিরোধী মতামত। দেশের ভোটব্যাংক সংখ্যালঘুরা এতদিন আওয়ামী লীগের পকেটে থাকার কারণে অন্যদের হাতে নিগৃহীত হতো। আর সরকারে থাকা এই দলটি তাদের ভরসা যোগাত। আজ আমরা দেখছি উল্টো। এর একটা নেগেটিভ ফলাফল থাকবেই। সে কারণেই হয়ত মাঠে চলে এসেছে হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ। এরা আগেও ছিল মাঠে। মাঝে মাঝে তারা তা জানান দেয়। এবার দেখি আরও জুটেছে। সংস্কৃত বা হিন্দিতে ব্যানার লিখে মাঠে নেমেছে হিন্দু মহাজোট। এদের দেবনাগরী ভাষার ব্যানারে যাদের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা সেদেশটি আমাদের একাত্তরের পরম মিত্র হওয়ার পরও আজ দুশমন। তাদের দৃষ্টি কাড়ার চেষ্টাও অপরাধসম। সবাই মিলে একত্রে দেশটাকে ভাল ও উদার করার কাজটা বন্ধ হয়েছে অনেক আগেই। এখন দেখছি বুদ্ধিবৃত্তিও লেগেছে পেছনে। কোন পরিষদের নেতা বা নেতারা কিছু বললেই আমাদের গায়ে জ্বালা ধরছে। সমস্যার সমাধান করে সমস্যার গভীরে গিয়ে উদ্ধার নিশ্চিত করার পরিবর্তে আমরা নেমেছি নিজেদের ভেতর হানাহানিতে। এখন চলছে বাকযুদ্ধ। চলছে কলম লড়াই। এতে কারও লাভ হবে না। বিদেশে আমরা সেটাই উপলব্ধি করছি। তা নিয়ে কথা হলো সেদিনের সেমিনারে। কিন্তু আমরা তো ঠুঁটো জগন্নাথ। করার কিছু নেই আমাদের। শুধু এই সমস্যা না, আরও গভীরে গেলে দেখব অনেক ধরনের সমস্যা দানা বাঁধছে। সবসময় উত্তেজনার ভেতর থাকতে থাকতে মানুষ স্বাভাবিকতা ভুলে যায়। তার কাছে তখন সেটাই হয়ে ওঠে জীবনবোধ। বিভিন্ন দেশের বাচ্চা বা কিশোর-কিশোরীদের দিকে তাকালেও তা বোঝা যাবে। সিরিয়ার বাচ্চারা আলবত মনে করে পিস্তল বা গুলি গুলি খেলাটাই জীবন। মেসপটোমিয়ার সভ্য দেশ ইরাকে হয়ত তারা খেলে ট্যাংক বা কামান কামান খেলা। মনে আছে একাত্তরে সীমান্ত পাড়ি দেয়ার আগে বনবাসের মতো লুকিয়ে থাকার একটা ত্রৈমাসিক জীবন ছিল। গ্রামের সে জীবনে গাছের গুঁড়ির রাইফেল আর পাতার গুলি বানিয়ে আমরা যুদ্ধ যুদ্ধ খেলতাম। আপনি ইউরোপ, আমেরিকা বা অস্ট্রেলিয়ার বালক-বালিকাদের দেখবেন তারা জীবন নিয়ে খেলছে। তারা বলে ‘ফান’ করছি। আগে ভাবতাম এত ফানের কি আছে? এসব কেমন কথা? এখন মনে হয় ঠিক বলছে। যাদের জীবন রাষ্ট্রের কাছে গচ্ছিত, যারা বড় হয়ে কি হতে চায় তা নিজেরা পছন্দমতো ঠিক করতে পারে, যাদের ভাবনায় খুন, মারামারি বা হত্যার বিভীষিকা হঠাৎ থাকলেও লাগাতার না, তারা জীবনযুদ্ধকে ফান বা মজা বলতেই পারে। এবার ভাবুন আমাদের দেশের কথা। রাজনীতির নামে বিগত কয়েক দশক ধরে যা দেখছি তাতে কি আদৌ কোন ভরসা আছে? রাজনীতি কি তারুণ্য বা শিশু-কিশোরদের নিয়ে ভাবে? বুঝতে চায় কিভাবে এদের মানসিক গঠন বির্পযস্ত করা হচ্ছে? বলছিলাম উত্তেজনার কথা। এখন তো প্রায় এমন অবস্থাÑ ঘুম ভেঙ্গে যদি দু’একটা অপমৃত্যু, ধর্ষণ বা হুমকির খবর না দেখি মনে হয় দেশ আছে তো দেশের জায়গায়? এমন অস্বাভাবিক অবস্থা গা সওয়া হয়ে গেছে দেশের মানুষের। সমাজ ও রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ এভাবে রাজনীতির হাতে ছেড়ে দেয়ার কথা ছিল না। দেখবেন যেখানে যখন কোন প্রতিকূলতা বা বিপর্যয় সামাল দেয়া যায় না সবাই প্রধানমন্ত্রীর কাছে নালিশ করে, হাত পাতে বা সমাধান চায়। তিনি আমাদের সকল সমস্যার সমাধানের প্রতীকও বটে। তবে এটাও মনে রাখতে হবে তাঁর আরও কাজ আছে। তিনি দেশ চালান। আমরা তাঁকে শান্তি ও স্বস্তি দিলেই দেশ আরও ভাল চলবে। সেটাই কি চাই না আমরা? আমরা আর কোন পরিবারের কান্না চাই না। চাই যোগ্য সমাধান। সরকারের স্বার্থে। দেশের স্বার্থে। মানুষের ভাল ও শান্তির জন্য
×