ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

২৬শ’ টন ওজনের স্প্যান আসছে চীন থেকে

এক সপ্তাহ বন্ধ থাকার পর পদ্মায় ফের পাইল ড্রাইভ শুরু

প্রকাশিত: ০৫:৪৫, ২৫ জুন ২০১৬

এক সপ্তাহ বন্ধ থাকার পর পদ্মায় ফের পাইল ড্রাইভ শুরু

মীর নাসিরউদ্দিন উজ্জ্বল, মাওয়া থেকে ফিরে ॥ পদ্মা সেতুর ৩৭ নম্বর পিলারের চার নম্বর পাইলটি শুক্রবার স্থাপন শুরু হয়েছে। প্রায় এক হাজার টন ওজনের পাইলটিকে (টিউব) হ্যামারের বাড়ি দিয়ে নদীর তলদেশে বসিয়ে দেয়া হচ্ছে। ২ হাজার ৪ শ’ কিলোজুল ক্ষমতার হ্যামারটি প্রায় এক সপ্তাহ পাইল ড্রাইভ করেনি। এই উচ্চ ক্ষমতার বিশ্বের একমাত্র এই হ্যামারের মেরামত করতে হয়েছে। চীনা প্রকৌশলীরা বলছেন, এটি হ্যামারের রেগুলার মেন্টেন্যান্স। এদিকে চীনে তৈরি হওয়া পদ্মা সেতুর স্প্যান এখন পাঠানোর প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। বিশাল এই স্প্যান তৈরির পর পরই চলছে প্যাকেটিং এবং পোর্টে ডাম্পিংয়ের কাজ। জুলাইয়ের শেষেদিকে তিনটি স্প্যান সাগরপথে রওনা হবে। বাংলাদেশে এসে পৌঁছতে সময় লাগবে প্রায় এক মাস। স্প্যানবাহী মাদার ভেসেল কুতুবদিয়া চ্যানেলে পৌঁছবে। এখানে কাস্টমস প্রক্রিয়া শেষে জাহাজে এই স্প্যান আসবে প্রকল্প এলাকায়। সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীলরা বলেছেন, সেপ্টেম্বরের প্রথম দিকেই স্প্যান প্রকল্প এলাকায় পৌঁছবে। এর পরই আসবে চার হাজার টন ওজনের বিশেষ ক্রেন । এই ক্রেনে করেই প্রায় ২ হাজার ৬শ’ টন ওজনের স্প্যান (গার্ডার) বসিয়ে দেয়া হবে পিলারের ওপর। কম্পিউটারাইজ এই ক্রেন নিখুঁতভাবে এই স্প্যান এমনভাবে বসাবে যে মিলিমিটারে মিলানো হবে এবং টেনশনিং করা হবে। এমন ধরনের কাজ দেশে এটিই প্রথম। তাই এই কাজের ক্ষেত্রেও বাংলাদেশীরা নতুন অভিজ্ঞতা অর্জন করবে। এই স্প্যান বসানোর পরই পদ্মা সেতুর অবয়ব চোখে পড়বে। সেতুর জাজিরা প্রান্তের ৩৯, ৩৮, ৩৭ ও ৩৬ নম্বর পিলারে বসবে এই স্প্যান। প্রতিটি পিলারের দূরত্ব ১৫০ মিটার। তবে পরিবহন এবং ফিটিংয়ের সুবিধার্থে স্প্যানগুলো আসবে কয়েকটি খ-ে। এদিকে এই স্প্যান আসার আগেই পিলারের কাজ এগিয়ে নেয়া হচ্ছে। ৩৯ ও ৩৮ নম্বর পিলারে ৩টি করে পাইল স্থাপন করা হয়েছে। ৩৬ নম্বর পিলারে স্থাপন হয়েছে দুটি পাইল। ৩৭ নম্বর পিলারে এখন পাইল স্থাপনের কাজ চলছে। এই পিলারে ৩টি পাইল স্থাপনের পর হ্যামার যাবে ৩৬ নম্বর পিলারে। এই পিলারে আরও একটি পাইল স্থান করবে। প্রতিটি পিলারে ছয়টি করে পাইল স্থাপন করলেও প্রথম দফায় তিনটি করে ৭০ মিটারের পাইল বসেছে। তবে এর পরই বসবে বাকি তিনটি পাইল এবং পাইলের উপরের অংশ। জাজিরা প্রান্তে ৮টি পাইল স্থাপন হয়েছে। তবে এর আগেই মাওয়া প্রান্তে ৬ ও ৭ নম্বর পিলারে বসেছে আরও ৬টি পাইল। সব মিলে এখন পদ্মায় ১৪টি পাইল বসেছে। টেস্ট পাইলের কাজও এগিয়ে চলছে। ২৫টি টেস্ট পাইলের মধ্যে ২১টি পাইল সম্পন্ন হয়ে গেছে। এখন পদ্মার মাঝে চলছে টিডি ৪ নম্বর টেস্ট পাইলের কাজ। বাকি টিডি৩’র এ, বি ও সি এই তিনটি টেস্ট পাইল এখনও হয়নি। তবে শীঘ্রই এগুলো সম্পন্ন করা হবে বলে প্রকৌশলীরা জানিয়েছেন। সেতুর কর্তৃপক্ষ সূত্র শুক্রবার জানায়, এ পর্যন্ত মূল সেতুর কাজ প্রায় ২৬ শতাংশ সম্পন্ন হয়েছে। তবে এই সময়ে এই কাজ প্রায় ৩১ শতাংশ সম্পন্ন হওয়ার কথা ছিল। নদীর তলদেশে মাটির স্তরসহ কিছু সিদ্ধান্তে কিছুটা বিলম্ব, হ্যামার সঙ্কট এবং চ্যালেঞ্জের কারণে এই বিলম্ব হয়েছে। তবে আগামী অক্টোবরে ২ হাজার কিলোজুল ক্ষমতার আরেকটি হ্যামার আসছে। একই সঙ্গে আগামী ১৪, ১৫ ও ১৬ জুলাই প্যানেল অব এক্সপার্টদের সভা বসছে প্রকল্প এলাকায়। তিন দিনব্যাপী এই সভায়ই সকল পেন্ডিং বিষয়ে সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করা হবে। টেস্ট পাইলের রিপোর্টের ভিত্তিতে যাবতীয় সিদ্ধান্ত দেয়া হবে। আর এই সিদ্ধান্তের জন্য বার বার তাগাদা দিচ্ছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না মেজর ব্রিজ কোম্পানি। পদ্মায় পানি ক্রমেই বাড়ছে। সেই সঙ্গে বাড়ছে স্রোত। মাওয়ায় পদ্মার পানি ৪ দশমিক ২ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে বইছে। এখানে এখন কিছু ফেলা হলে প্রতিসেকেন্ডে ১ মিটার দূরে চলে যাচ্ছে। তবে এখানে প্রতিসেকেন্ডে ৫ মিটার গতির স্রোতও ছিল। এই স্রোতেই কাজ চলেছে। তাই পদ্মার বৈচিত্র্যতার মধ্যেই চলছে সেতু তৈরির কর্মযজ্ঞ। নানা কারণেই পদ্মা সেতুর এখনও আলোচনার কেন্দ্র হ্যামার। পদ্মায় ব্যবহৃত বিশ্বের সবচেয়ে বেশি ক্ষমতার হ্যামারটি পরিচালানয়া দক্ষতা বেড়ে গেেেছ। আগে বিকল হলে সচল করতে বেশি সময় ব্যয় হতো। জার্মান থেকে বিশেষ বিশেষজ্ঞ তলব করতে হতো। এখন সারিয়ে নিতে সময় কম লাগছে। জার্মানিতে তৈরি হ্যামারটির ইলেক্ট্রনিক ডায়াগ্রাম রয়েছে সেখানে। সেখান থেকেই সম্ভাব্য ত্রুটির ব্যাপারে আগাম সতর্ক করা হচ্ছে। এছাড়া জার্মানির যে প্রকৌশরীরা এটি পারিচালনা করছেন তারাও এখন ছোটখাটো সমস্যা সমাধান করতে পারছেন। এটির সঙ্গে রয়েছে এক হাজার টন ক্ষমতার ক্রেন। এই উচ্চ ক্ষমতার ক্রেন এর আগে বাংলাদেশে ব্যবহৃত হয়নি। যমুনা সেতুতে ব্যবহার হয়েছে ৫শ’ টন ক্ষমতার ক্রেন। কাঁঠালবাড়ি পর্যন্ত পদ্মা সেতুর এ্যাপ্রোচ রোড খুলে দেয়ার প্রক্রিয়া এগোচ্ছে। এতে শিমুলিয়ার (মাওয়া) সঙ্গে ফেরি রুট কাওড়াকান্দি থেকে কাছে সরে আসছে কাঁঠালবাড়িতে। এতে ফেরি রুটটির অন্তত ৫ কিলোমিটার পথ কমবে। ১৩ কিলোমিটারের এই ফেরিপথ কমে আসবে প্রায় ৮ কিলোমিটারে। আগামী ডিসেম্বরে এটি সম্পন্ন করা হবে বলে সংশ্লিষ্টরা আবারও নিশ্চিত করেছেন। পদ্মায় নদী শাসনের কাজও চলছে পুরোদমে। মাওয়া প্রান্তে এখন নদী শাসনের কাজ নেই। জাজিরা প্রান্তে নদী শাসনের কাজ চলছে এখন। এখানে ড্রেজিং পুরোদমে শুরু হয়েছে। উচ্চ ক্ষমতার দুটি ড্রেজার রাতদিন বালু কাটছে। এই বালুর স্তূপ করা হচ্ছে দু’স্থানে- জাজিরা নদীর পার ঘেঁষে সেতু বরাবর ট্রায়াল সেকশন এবং মাওয়া চরের ব্লক-১ এ রাখা হচ্ছে এই বালু। কাওড়াকান্দি ড্রেজিংয়ের বালু সরিয়ে নেয়া হচ্ছে ব্লক-১২ শিবচরের পদ্মার চরে। এদিকে নদী শাসনের জন্য পদ্মার তীর ধরে মাঝিকান্দি থেকে কাওড়াকান্দি পর্যন্ত ১৩ কিলোমিটার দীর্ঘ সড়ক তৈরি সম্পন্ন হয়েছে। এ্যাপ্রোচ রোডসহ পদ্মা সেতুর সব কটি প্যাকেজেই চলছে কাজ আর কাজ। পদ্মা সেতুর এই নির্মাণকর্ম ছড়িয়ে রয়েছে চারদিকে। নদীতে নদীর তীরে এসব কাজ চোখে পড়ে। গত বর্ষার সঙ্গে এবারের বর্ষায় প্রকল্প এলাকায় চিত্র বেশ ফারাক। তাই দিন যত যাচ্ছে ততই চিত্র পাল্টে যাচ্ছে। স্থানীয় সংসদ সদস্য অধ্যাপক সাগুফতা ইয়াসমিন এমিলি বলেন, সেতুর ক্রমবর্ধমান কাজ পুরো এলাকায় ইতিবাচক প্রভাব ফেলছে। সেতু ঘিরে আর্থ-সামাজিক অবস্থার পরিবর্তন ঘটতে শুরু করেছে। এদিকে রেলের জমি অধিগ্রহণের কাজও দ্রুত এগিয়ে চলছে বলে জানান মুন্সীগঞ্জের জেলা প্রশাসক মোঃ সাইফুল হাসান বাদল।
×