ফিরোজ মান্না ॥ সারাদেশে ২৪ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয় নির্মাণের দায়িত্ব পাচ্ছে গণপূর্ত অধিদফতর (পিডব্লিউডি) এমন প্রস্তাব করা হয়েছিল ২০১৪-১৫ অর্থবছরে। এই প্রস্তাব বাস্তবায়ন করার জন্য পিডব্লিউডির উচ্চপর্যায়ের কয়েকজন কর্মকর্তা সারাদেশে কর্মরত নির্বাহী প্রকৌশলীদের কাছ থেকে প্রায় ১০ কোটি টাকা তুলে নেন। কথা ছিল প্রাথমিক বিদ্যালয় নির্মাণ কাজ পিডব্লিউডির অধীনে না এলে টাকা ফেরত দেয়া হবে। শেষ পর্যন্ত প্রাথমিক বিদ্যালয় নির্মাণ কাজ এলজিইডির হাতেই থেকে যায়। কিন্তু ওই টাকা আর ফেরত দেয়া হয়নি। এ ঘটনায় পিডব্লিউডির মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের মধ্যে চরম অসন্তোষ বিরাজ করছে। বিষয়টি নিয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনে অভিযোগ করা হয়েছে। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) এ ঘটনার তদন্তে নেমেছে।
সূত্র জানিয়েছে, গত বছর সারাদেশে ৩৬ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয় ভবন নির্মাণের জন্য গণপূর্ত মন্ত্রণালয় স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব পাঠায়। এই প্রস্তাবের পর স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় পিডব্লিউডিকে ২৪ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয় নির্মাণের দায়িত্ব দেয়া যেতে পারে এমন একটি সুপারিশ করে পরিকল্পনা কমিশনে। পরিকল্পনা কমিশন পরবর্তীতে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের সুপারিশ বাতিল করে প্রাথমিক বিদ্যালয় নির্মাণের দায়িত্ব এলজিইডির ওপরই রেখে দেয়। কিন্তু এর মধ্যে পিডব্লিউডির মাঠ পর্যায়ের নির্বাহী প্রকৌশলীদের কাছ থেকে হাতিয়ে নেয়া হয়েছে প্রায় ১০ কোটি টাকা। অভিযোগ উঠেছে এই টাকা হাতিয়ে নেয়ার মূল হোতা ছিলেন তৎকালীন প্রধান প্রকৌশলী কবীর আহমেদ ভূঞা। তার হয়ে টাকা হাতিয়ে নেয়ার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন ঢাকা জোন-১ এর বর্তমান অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী রফিকুল ইসলাম ও পিডব্লিউডি বিসিএস কর্মকর্তা সমিতির সাধারণ সম্পাদক প্রকৌশলী একেএম মনিরুজ্জামান। বর্তমান প্রধান প্রকৌশলী হাফিজুর রহমান মুন্সি ও কর্মকর্তা সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক আব্দুল কাদের চৌধুরী অভিযোগের সত্যতা স্বীকার করেছেন।
বিষয়টি নিয়ে তৎকালীন প্রধান প্রকৌশলী কবীর আহমেদ ভূঞার সঙ্গে কথা হলে তিনি জনকণ্ঠকে জানান, ১০ কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়ার কোন ঘটনা ঘটেনি। ২৪ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয় নির্মাণের জন্য একটা প্রস্তাব মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়ে ছিলাম। এটা প্রায় অনুমোদনও হয়েছিল। কিন্তু পরবর্তী সময়ে পরিকল্পনা কমিশন তা বাতিল করে দিয়েছে। যে কাজ হয়নি তা থেকে কিভাবে টাকা নেয়া যায়। আমি অবসরে যাওয়ার পর থেকেই পিডব্লিউডিতে একটি গ্রুপ (বর্তমান প্রধান প্রকৌশলী) পিছনে লেগে আছে। আমাকে তারা হেয় করার জন্যই এ কাজটি করে যাচ্ছে। তবে তিনি স্বীকার করেন বিষয়টি নিয়ে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) তদন্ত করছে। দুদক তদন্ত করলেও আমার বিরুদ্ধে কোন অনিয়ম তারা পাবে না। অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী রফিকুল ইসলামের সঙ্গে কথা বলার জন্য তার দফতরে এশাধিক দিন গিয়েও কথা বলা সম্ভব হয়নি। সব দিনই তার স্টাফ অফিসার একেএম সোহরাওয়ার্দী পরে দেখার সময় জানাবেন বলে দেন। এরপর তার সঙ্গে মোবাইলে যোগাযোগ করা হলে তিন এ বিষয়ে কোন কথা বলবেন না বলে জানিয়ে দেন।
তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (পরিকল্পনা) মনিরুজ্জামান বলেন, টাকা আত্মসাতের অভিযোগ অবান্তর। পিডব্লিউডিতে প্রধান প্রকৌশলীর পদ দখল নিয়ে দুই পক্ষের দ্বন্দ্বের জের হিসেবে এ বিষয়টি বেশি প্রচার করা হয়েছে। তবে প্রাথমিক বিদ্যালয় নির্মাণের বিষয়ে সারাদেশের নির্বাহী প্রকৌশলীদের কাছ থেকে টাকা আদায়ের কথা শুনেছি। যত টাকার কথা বলা হচ্ছে আসলে এত টাকা হবে না।
পিডব্লিউডির সূত্র জানিয়েছে, যখন প্রাথমিক বিদ্যালয় নির্মাণের প্রস্তাব করা হয় তখন, প্রধান প্রকৌশলীসহ কয়েকজন কর্মকর্তার নামে টাকা সংগ্রহ করা হয়। মাঠ কর্মকর্তাদের থেকে কয়েক কোটি টাকা আদায় ও আত্মসাতের অভিযোগ পাওয়া গেছে। প্রধান প্রকৌশলী থাকা অবস্থায় কবীর আহমেদ ভূঞা গত ২০১৪ ও ২০১৫ যে কোন মূল্যে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের প্রায় ২৪ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয় ভবন নির্মাণ কাজ সংস্থাটির অধীনে আনার উদ্যোগ নেন। বিভিন্ন সরকারী ভবন নির্মাণের দায়িত্ব গণপূর্ত অধিদফতর পালন করে থাকে। প্রাথমিক বিদ্যালয় ভবন নির্মাণের কাজ করে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতর (এলজিইডি)। গত বছর পিডব্লিউডি কাজটি না পেলেও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনস্ত শিক্ষা প্রকৌশল অধিদফতর (ইইডি) কাজটির অংশ বিশেষ নির্মাণের দায়িত্ব পায়। প্রাথমিক বিদ্যালয় নির্মাণের কাজটি পিডব্লিউডির কাছে আনার জন্য মাঠ পর্যায়ের নির্বাহী প্রকৌশলীদের কাছ থেকে টাকা আদায় করার উদ্যোগ থেমে ছিল না। এই উদ্যোগে মাঠ পর্যায় থেকে ১০ কোটি টাকা কয়েক ধাপে প্রধান কার্যালয়ের কয়েক কর্মকর্তার হাতে চলে আসে। কথা ছিল প্রাথমিক বিদ্যালয় নির্মাণ কাজ আনতে না পারলেও টাকা ফেরত দেয়া হবে। শেষ পর্যন্ত প্রাথমিক বিদ্যালয় নির্মাণ কাজ পিডব্লিউডির কাছে আসেনি। এরপরও মাঠ পর্যায় থেকে সংগ্রহ করা টাকা তাদের ফেরত না দিয়ে আত্মসাত করা হয়েছে।
বর্তমান প্রধান প্রকৌশলীর দায়িত্ব গ্রহণের পর সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে কর্মকর্তা পরিষদের পক্ষ থেকে সারাদেশ থেকে টাকা সংগ্রহের বিষয়টি উত্থাপন করা হয়। তারা দাবি জানান, আদায় করা টাকার হিসাবসহ তা সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের ফিরিয়ে দেয়ার। এরপর ছয় মাস পার হয়ে গেলেও আত্মসাতকৃত টাকা ফেরত দেয়া হয়নি। বিসিএস কর্মকর্তা সমিতির সভাপতি ও ঢাকা জোন-১ এর অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী রফিকুল ইসলাম এবং সাধারণ সম্পাদক একেএম মনিরুজ্জামান ওই টাকা নির্বাহী প্রকৌশলীদের ফিরিয়ে দেয়ার কোন উদ্যোগ নেননি।
পিডব্লিউডির উচ্চ পর্যায়ের একজন কর্মকর্তা বলেন, সাবেক প্রধান প্রকৌশলী কবীর আহমেদ ভূঞা মন্ত্রণালয়ের উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের বিভিন্ন ম্যানেজ করে জ্যেষ্ঠ সাতজন কর্মকর্তাকে ডিঙ্গিয়ে প্রধান প্রকৌশলীর পদে বসেন। এরপর সাড়ে চার বছর দায়িত্ব পালন করেন। তিনি যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযমের ভাগ্নে। ২০০৭ সালে কুমিল্লা থেকে তিনি বদলি হয়ে প্রধান কার্যালয়ে আসেন। বর্তমান সরকারের সময় ছাত্র জীবনে তিনি বুয়েটে ছাত্রলীগ করতে এমন কথা বলতে শুরু করেন। অথচ আমি যখন আহসানউল্লাহ হলের ছাত্রলীগের সভাপতি তখন কবীর আহমেদ ছাত্রশিবিরের রাজনীতিকে সমর্থন করতেন। পরবর্তীতে তিনি জাসদ ছাত্রলীগ করেছেন। এরপরও বর্তমান সরকার তাকে সাড়ে বছর পিডব্লিউডির মতো প্রতিষ্ঠানে প্রধান প্রকৌশলীর দায়িত্ব পালন করেছেন। এটাই সবচেয়ে দুঃখজনক বিষয়। অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী রফিকুল ইসলামের বিরুদ্ধেও একই অভিযোগ রয়েছে।
ওই কর্মকর্তা বলেন, অভিনব কায়দায় আত্মসাতকৃত টাকার বিষয়ে দুদক তদন্ত শুরু করেছে। তদন্তের মধ্য দিয়েই বের হয়ে আসবে কি পরিমাণ টাকা আত্মাসত করা হয়েছে।