ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

মিতু হত্যা ক্লু ২০ দিনেও উদ্ঘাটন হয়নি, জনমনে ক্ষোভ

প্রকাশিত: ০৫:৪৩, ২৫ জুন ২০১৬

মিতু হত্যা ক্লু ২০ দিনেও উদ্ঘাটন হয়নি, জনমনে ক্ষোভ

মাকসুদ আহমদ, চট্টগ্রাম অফিস ॥ চট্টগ্রামে পুলিশ পরিবারের নিরীহ গৃহবধূকে প্রকাশ্যে ও ব্যস্ততম সড়কে হত্যার ২০ দিন পরও পুলিশ কোন কিছুই বলতে পারছে না। সিএমপি কমিশনার মিডিয়াকে শুধু বলেই যাচ্ছেন, ‘আরেকটু ধৈর্য ধরুন, আমরা ভাল কিছু দিতে পারব।’ সিএমপির এমন ডায়ালগ এখন কথার কথা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (অপরাধ ও অভিযান) দেবদাস ভট্টাচার্য শুধু বলছেন, এ বিষয়ে ‘নো কোশ্চেন, নো এ্যানসার’। সুতরাং প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়েছে সিএমপির গোয়েন্দা বিভাগের তুখোড় কর্মকর্তার স্ত্রী খুনের ক্লু উদঘাটন প্রক্রিয়া। তবে সিএমপির বাতাসে শুধু এসপি বাবুল আক্তারের স্ত্রী মাহমুদা খানম মিতু হত্যার রহস্য উদঘাটনে গোয়েন্দা পুলিশের ব্যস্ততার বিষয়টি উঠে আসছে। বাকি হত্যাকা-গুলোর তদন্ত নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, সিএমপিতে পাঁচ কমিটির ৩৫ কর্মকর্তা মিলে গত ১২ জুনের পর থেকে ২৪ জুন পর্যন্ত আরও ১২ দিন পার করে দিয়েছেন ক্লু উদ্ঘাটনের নামে ‘হাতড়িয়ে বেড়ানো নাটক’ মঞ্চায়নে। কিন্তু ২০ দিনের ফল এখনও গোড়ায়ই রয়েছে। সন্দেহভাজনদের জিজ্ঞাসাবাদের তালিকাও পেরিয়েছে অর্ধশত। রিমান্ডেও জিজ্ঞাসাবাদ হয়েছে তিনজনকে। তবে সিএমপির একটি বিশেষ সূত্রে জানা গেছে, কারও কাছ থেকে কোন ক্লু উদ্ঘাটন হয়নি। কিন্তু সিএমপি নিশ্চিত হয়েছে কারা এ হত্যাকা-ের ঘটনা ঘটিয়েছে। কোন এক কারণে এ ঘটনার ক্লু উদ্ঘাটন ধামচাপা পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। জানা গেছে, ২০০৮ সালের আগে হত্যাকা-ের ঘটনাস্থল থেকে হত্যাকারীদের কোন না কোন কিছু কুড়িয়ে পাওয়ার মধ্য দিয়ে হত্যাকা-ের ক্লু উদ্ঘাটন অনুশীলন শুরু হতো। সিএমপিতে ২০০৮ সালে কোতোয়ালি থানার সহকারী কমিশনার ছিলেন বাবুল আক্তার। তখন থেকে হত্যাকা-ের ক্লু উদ্ঘাটনের ধরন পাল্টে গেল সিএমপিতে। ঘটনাস্থল থেকে হত্যাকারীদের ব্যবহৃত কোন কিছু কুড়িয়ে নেয়ার পাশাপাশি মোবাইল ট্রেকিংয়ের আধুনিকতায় পা রাখল সিএমপি। কিন্তু একের পর এক প্রশিক্ষণ নিলেন সিএমপির কয়েক কর্মকর্তা। সেই সঙ্গে কৌশল বাগিয়ে নিলেন সিএমপির একাধিক কর্মকর্তা। মোবাইল ট্রেকিংয়ের মাধ্যমে অপরাধীদের ধরে আনার নানা কৌশল। এরপর সিএমপিতে ১৪০ সিসি ক্যামেরা স্থাপনের মধ্য দিয়ে অপরাধী শনাক্তকরণের নতুন পথের উদ্ভাবন করলেন বাবুল আক্তার। কোতোয়ালি জোন থেকে হাটহাজারী সার্কেলের এএসপি হিসেবে যোগদানের পর বাবুল আক্তার অপরাধের ওপর বিভিন্ন ওয়েবসাইটে যেমন তল্লাশি চালিয়েছেন তেমনি অপরাধীদের দমনে তীক্ষè বুদ্ধির পরিচয় দিয়েছেন। একপর্যায়ে হাটহাজারী এলাকায় একটি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী জঙ্গীদের উপর নাটকীয় অভিযানের বিষয়টি প্রকাশ পায়। পুলিশী হস্তক্ষেপের বাইরে হওয়ায় এ ঘটনা ধামাচাপা পড়ে যায়। ২০১১ সালের পরবর্তীতে প্রায় সাড়ে ৩ বছর হাটহাজারী সার্কেলে বিভিন্ন উপজেলায় কাজ করার পর এক পর্যায়ে পদোন্নতি পেয়ে তিনি কক্সবাজারের এডিশনাল এসপি। ঘুরে ফিরে বাবুল আক্তার এডিসি গোয়েন্দা হিসেবে সিএমপিতে ফিরে এলে টনক নড়ে সন্ত্রাসীদের। সেই সঙ্গে জঙ্গী, হরকত-উল-জিহাদ, হিযুবত তাহরীর ও শহীদ হামজা ব্রিগেডসহ নগরীর বিভিন্ন স্থানে গড়ে ওঠা মাদ্রাসার নামে বোমা তৈরির কারখানা উদ্ঘাটনে তৎপর বাবুল আক্তার সন্ত্রাসীদের টার্গেট হয়ে যান। বিভিন্ন অভিযানে পিস্তল, বন্দুক, গোলাবারুদ, ধারালো অস্ত্র, সেনাবাহিনীর পোশাক, গ্রেনেড, বিভিন্ন ধরনের বোমা উদ্ধারসহ নানা জিহাদী বই আটকের অভিযানে নেতৃত্ব দিয়েছেন বাবুল আক্তার। কিন্তু দেশ গড়ার এ কারিগরকে দফায় দফায় বদলি করে পরিবারের নিরাপত্তা বিনষ্ট করার অভিযোগ উঠেছে খোদ প্রশাসনের বিরুদ্ধেই। অথচ যারা সিএমপিতে বছরের পর বছর কাটিয়ে দিচ্ছে তাদের কোন বদলি নেই। এর মূল কারণ হচ্ছে ‘বদলি ঠেকাতেও উৎকোচ’ লাগে উর্ধতন কর্মকর্তাদের খুশি করতে। অথচ সিএমপির অসাধু কর্মকর্তাদের অনেকেই ঘুরেফিরে বিভিন্ন দফতর দাবড়ে আবারও সিএমপির গোয়েন্দা বিভাগ কিংবা থানায় কালের পর কাল থেকে গেলেও বদলির বালাই নেই। জঙ্গী অভিযানকে কেন্দ্র করে অনেক উড়ো চিঠি আর চিরকুটে বাবুল আক্তারসহ কয়েকজনকে হত্যা পরিকল্পনার হুমকি এলেও নিরাপত্তা জোরদারের বিষয়টি জানানো হয় কয়েক সিএমপি কমিশনারকে। কিন্তু নিরাপত্তার নামে রানার আর কনস্টেবল ছাড়া কিছুই ছিল না এ কর্মকর্তার। এমনকি ও আর নিজাম রোড আবাসিক এলাকার ভাড়া বাসার অনতিদূরে থাকা সিসি ক্যামেরাগুলো উপড়ে ফেলে সিটি কর্পোরেশন। ফলে হত্যাকা- ঘটেছে নীরবে ও প্রকাশ্যে। যার পরিণামে গত ৫ জুন এসপি বাবুল আক্তারের স্ত্রী মাহমুদা খানম মিতু হত্যার ঘটনা। আরও অভিযোগ রয়েছে, ঘটনার পর মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ, পিবিআই, সিআইডি ও র‌্যাবসহ বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা মিতু হত্যার ক্লু উদ্ঘাটনে নানা ধরনের তথ্য নিয়ে এগিয়েছে। কয়েকটি গোয়েন্দা সংস্থাও কাজ করেছে কিন্তু তাতে মিতু হত্যার কোন ক্লু উদ্ঘাটন তো হয়নি বরং ঘটনার প্রেক্ষাপট পাল্টে যাওয়ার আশঙ্কা ছিল বলে অভিযোগ উঠেছে। তবে পুলিশ নিশ্চিত হলেও এ ঘটনার মূল অপরাধীদের আদৌ পাকড়াও করবে কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে সিএমপিতে। এর পেছনে মূল কারণ হচ্ছে জঙ্গীদের কাছ থেকে নানা ধরনের উপকরণ উদ্ঘাটনে গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর দায়িত্বহীনতার পরিচয়। গত ৫ জুন থেকে ২৪ জুন পর্যন্ত দীর্ঘ প্রায় ২০ দিনে পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদে এনেছে আর ছেড়েছে অর্ধশত। রিমান্ডেও নিয়েছে শাহ জামান রবিন, আবু নসর গুন্নু ও ঘটনার সময় কারাবন্দী জেএমবির সেকেন্ড ইন কমান্ড বুলবুলকে। যে চিরকুট লিখে তার সহোদর গ্রেনেড বিস্ফোরণে নিহত জাবেদকে হত্যার প্রতিশোধে হুমকি দিয়েছিল এই বাবুল আক্তারসহ কয়েকজনকে। পুলিশ প্রত্যেকেরই পৃথক ৭ দিন করে রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। কিন্তু কোন ক্লু উদ্ঘাটন হয়নি। তবে ঘটনাস্থল থেকে পুলিশ ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার একটি উৎস খুঁজে পেলেও তা নিয়ে বেশি গবেষণা চালায়নি। তবে পুলিশের গবেষণায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছিল বেশ কয়েকজন। তাদেরকে আদৌ জিজ্ঞাসাবাদ করেনি পুলিশ। পুলিশ বলছে ঘটনার রহস্য অনেকটাই উদ্ঘাটিত হয়েছে। মিডিয়ার কাছে বলা এখন সময়ের ব্যাপার। গত ৫ জুন জিইসি মোড়ে অতিনিকটে ও আর নিজাম রোড আবাসিক এলাকা থেকে বেরিয়ে আসা পুলিশ পরিবারের গৃহবধূ মিতু হত্যার ঘটনায় চট্টগ্রাম এসেছিলেন পুলিশ প্রধান এ কে এম শহিদুল হক। দামপাড়া পুলিশ লাইনে শুটিং ক্লাবের মিলনায়তনে সুধী সমাবেশে গত ১২ জুন আইজিপি বলেছেন, দেশে ছয়টি জঙ্গী সংগঠন রয়েছে। এর মধ্যে দুটি কার্যকর। একটি হচ্ছে জেএমবি। অপরটি আনসারুল্লাহ বাংলা টিম বা আনসারুল ইসলাম। পুলিশের মনোবল দুর্বল করতেই এ হত্যাকা-ের বিষয়টি তিনি নিশ্চিত করলেও দীর্ঘ ২০ দিনে কোন ক্লুই উদঘাটিত হয়নি। তবে সিএমপির সভাকক্ষে এ ঘটনার ক্লু উদ্ঘাটনে তিনি পুলিশ কর্মকর্তাদের কড়া নির্দেশ দিয়েও কোন ফল দেখাতে পারেননি। মিতু হত্যার ক্লু উদ্ঘাটনে পাঁচটি কমিটির আওতায় ৩৫ জনকে তালিকাভুক্ত করে নামসর্বস্ব চৌকস টিমের উদাহরণ সৃষ্টি করা হলেও গোয়েন্দা বিভাগের এই পাঁচটি আদৌ কোন ফল দিতে পারেনি। শুধু বলছেন, তদন্ত চলছে, আমরা এগোচ্ছি, অচিরেই কিছু একটা পাওয়া যাবে, আপনারা ধৈর্য ধরুন, আমরা ভাল কিছু দিতে পারব। গৎবাঁধা এ উক্তিগুলো সিএমপির মুখপাত্র হিসেবে প্রতিনিয়ত দিয়ে যাচ্ছেন সিএমপি কমিশনার ও অতিরিক্ত সিএমপি কমিশনার। এক্ষেত্রে মুখ বন্ধ রাখতে বলা হয়েছে সিএমপির গোয়েন্দা বিভাগের এডিসি ও মুখপাত্র পাবলিক রিলেশন কর্মকর্তাকেও। শুধু তাই নয়, মামলার তদন্ত কর্মকর্তা গোয়েন্দা বিভাগের ইন্সপেক্টর রাকিব উদ্দিনকে বাদ দিয়ে নতুন তদন্ত কর্মকর্তা ও সহকারী কমিশনার কামরুজ্জামানকে দায়িত্ব অর্পণের মধ্য দিয়ে সিএমপি দায়িত্বহীনতার আরও একটি দ্বার খুলে দিয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। গত ৫ জুন মিতু হত্যার ঘটনায় বাদী হয়ে মামলা দায়ের করেছেন নিহতের স্বামী ও পুলিশ সুপার বাবুল আক্তার। আগ্রাবাদে নিজগৃহে দিবালোকে মা-মেয়ে খুন, মতিঝর্ণায় চট্টগ্রামের ডিআইজির বাংলোর এক পুলিশ কনস্টেবলকে খুনের ঘটনা, খোয়াজনগর, আমানবাজারসহ বিভিন্ন স্থানে জঙ্গীদের পাশাপাশি শিবির অধ্যুষিত চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হলে ও শিবির ক্যাডারদের আস্তানায় অভিযান পরিচালনার ঘটনা উদ্ঘাটন করেছেন বাবুল আক্তার। শেষ পর্যন্ত বাদীকেই তার স্ত্রী হত্যাকা-ের ক্লু উদ্ঘাটন করতে হয় কিনা তা নিয়ে কৌতূহল রয়েছে।
×