ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

মাহে রমজান

প্রকাশিত: ০৫:৪১, ২৫ জুন ২০১৬

মাহে রমজান

অধ্যাপক মনিরুল ইসলাম রফিক ॥ ৬১৯ খ্রিস্টাব্দ ২০ রমজান ওফাতপ্রাপ্ত হয়েছিলেন আমাদের প্রিয় নবী হুজুরে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রিয়তম স্ত্রী হযরত খাদীজা (রাঃ)। তিনি নারী-পুরুষের মধ্যে প্রথম ইসলাম ধর্ম গ্রহণকারী, ইসলামের একেবারে শুরুর যুগে ধনসম্পদ ও মূল্যবান পরামর্শ দিয়ে অবিস্মরণীয় ও বরণীয় হয়ে আছেন। প্রিয় নবী (সাঃ) যখন বিবি খাদীজার সঙ্গে (রাঃ) বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন তখন রাসূলুল্লাহর (সাঃ) বয়স পঁচিশ এবং খাদীজা (রাঃ) তাঁর চেয়ে পনেরো বছরের বড়। বিয়ের পনেরো বছর পর হযরত নবী করীম (সাঃ) নবুওয়াত লাভ করেন, শুভ সূচনা হয় পবিত্র কোরান নাযিলের। মুহাম্মদুর রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তখন চব্বিশÑপঁচিশ বছরের যুবক। এর মধ্যে চাচা আবু তালিবের সঙ্গে বা একাকী কয়েকটি বাণিজ্য সফরে গিয়ে ব্যবসা সম্পর্কে যথেষ্ট অভিজ্ঞতা অর্জন করে ফেলেছেন। সবার কাছে তিনি তখন ‘আল-আমিন’। তাঁর সুনামের কথা খাদীজার (রাঃ) কানেও পৌঁছেছে। বিশেষত তার ছোট ভাইবউ সাফিয়্যার কাছে ‘আল-আমিন’ মুহাম্মদ (সাঃ) সম্পর্কে বহু কথাই শুনে থাকবেন। এ সময় তৎকালীন মক্কার ধনাঢ্য ব্যবসায়ী হযরত খাদীজা (রাঃ) সিরিয়ায় পণ্য পাঠাবার চিন্তা করলেন। রাসুলুল্লাহ (সাঃ) যখন পঁচিশ বছরে পদার্পণ করেছেন তখন তার চাচা আবু তালিব একদিন তাঁকে ডেকে বললেন : ‘ভাতিজা! আমি একজন বিত্তহীন মানুষ, সময়টাও আমাদের জন্য খুব সঙ্কটজনক। মারাত্মক অভাবের কবলে আমরা। তোমার গোত্রের একটি বাণিজ্য কাফিলা সিরিয়ায় যাচ্ছে। খাদীজা তার পণ্যের সঙ্গে পাঠানোর জন্য কিছু লোকের খোঁজ করছে। তুমি যদি তার কাছে যেতে, হয়তো তোমাকে সে নির্বাচন করতো, যদিও তোমার সিরিয়া যাওয়া আমি পছন্দ করিনে এবং ইহুদীদের পক্ষ থেকে তোমার জীবনের আশঙ্কা করি। জবাবে রাসূল (সাঃ) বলেন, সম্ভবত সে নিজেই লোক পাঠিয়ে প্রস্তাব দেবে। আবু তালিব বললেন : হয়তো অন্য কাউকে সে নিয়োগ দিয়ে ফেলবে। চাচা-ভাতিজার এ সংলাপের কথা খাদীজার কানে গেল। তিনি রাসূলুল্লাহর (সাঃ) নিকট লোক পাঠিয়ে বললেন : অন্য লোকে আপনাকে যে পারিশ্রমিক দিবে, আমি তার দ্বিগুণ দিব। অবশেষে হযরত তার ম্যানেজার নিয়োগ হন। খাদীজার (রাঃ) পণ্যসামগ্রী নিয়ে তাঁর বিশ্বস্ত দাস মায়সারাকে সঙ্গে করে মুহাম্মদ (সাঃ) সিরিয়ার দিকে বেরিয়ে পড়লেন। কাফিলা সিরিয়া পৌঁছলো। পথে এক গির্জার পাশে একটি গাছের ছায়ায় বসে আছেন তিনি। মায়সারা গেছেন একটু দূরে। গির্জার পাদ্রি এগিয়ে গেলেন মায়সারার দিকে। জিজ্ঞেস করলেন : ‘গাছের নিচে বিশ্রামরত লোকটি কে?’ মায়সারা বললেন: ‘মক্কার হারামবাসী কুরাইশ গোত্রের একটি লোক।’ পাদ্রি বললেন : ‘এখন এ গাছের নিচে যিনি বিশ্রাম নিচ্ছেন তিনি একজন নবী ছাড়া আর কেউ নন।’ পাদ্রি আরও জানতে চান : ‘তাঁর চোখ দুইটি কি লালচে?’ মায়সারা বললেন : হ্যাঁ। এই লাল আভা কখনও দূর হয় না। পাদ্রি বললেন : তিনি নবী। তিনিই আখিরুল আম্বিয়া। মক্কায় ফিরে খাদীজার (রাঃ) পণ্যসামগ্রী বিক্রি করলেন। ব্যবসায়ে এবার দ্বিগুণ অথবা দ্বিগুণের কাছাকাছি মুনাফা হলো। দাস মায়সারা অত্যন্ত সততা ও বিশ্বস্ততার সঙ্গে সফরে রাসূলুল্লাহর (সাঃ) যাবতীয় কর্মকা-, পাদ্রির মন্তব্য, ফিরিশতার ছায়াদান, দ্বিগুণ মুনাফা ইত্যাদি বিষয়ের একটি বিস্তারিত রিপোর্ট মনিব খাদীজার (রাঃ) নিকট পেশ করেন। যাই হোক, পাত্র-পাত্রী উভয়পক্ষের লোকদের উপস্থিতিতে রাসূলুল্লাহর (সাঃ) চাচা আবু তালিব আনুষ্ঠানিকভাবে বিয়ের খুতবা পাঠ করেন। বিয়ের পনেরো বছর পর হযরত নবী করীম (সাঃ) নবুওয়াত লাভ করেন। সহীহ বুখারীর ‘ওহীর সূচনা’ অধ্যায়ে একটি হাদিসে বিষয়টির বিস্তারিত বিবরণ এসেছে। হযরত আয়িশা (রাঃ) বর্ণনা করেছেন : ‘রাসূলুল্লাহর (সাঃ) প্রতি প্রথম ওহীর সূচনা হয় ঘুমে সত্য স্বপ্নের মাধ্যমে। স্বপ্নে যা কিছু দেখতেন তা সকাল বেলার সূর্যের আলোর ন্যায় প্রকাশ পেত। তারপর নির্জনে থাকতে ভালোবাসতেন। খানাপিনা সঙ্গে নিয়ে আবার গুহায় চলে যেতেন। সেখানে কয়েকদিন ইবাদাতে মশগুল থাকতেন। খাবার শেষ হয়ে গেলে আবার খাদীজার কাছে ফিরে আসতেন। এ অবস্থায় একদিন তাঁর কাছে সত্যের আগমন হলো (সময়টি পবিত্র মাহে রমজানের ২৬তম রজনী লাইলাতুল ক্বদরে)। ফিরিশতা এসে তাঁকে বললেন : আপনি পড়–ন। তিনি বললেন : আমি তো পড়ালেখার লোক নই। ফিরিশতা তাঁকে এমন জোরে চেপে ধরলেন যে, তিনি কষ্ট অনুভব করলেন। ছেড়ে দিয়ে আবার বললেন : পড়–ন। তিনি আবারও বললেন : আমি তো পড়ালেখার লোক নই। ফিরিশতা দ্বিতীয় ও তৃতীয় বারও তাঁর সঙ্গে প্রথমবারের মতো আচরণ করলেন। অবশেষে বললেন : পড়ুন আপনার প্রতিপালকের নামে। যিনি সৃষ্টি করেছেন। যিনি সৃষ্টি করেছেন মানুষকে জমাট রক্তপি- থেকে।’ (সূরা‘আলাক) রাসূল (সাঃ) ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে ঘরে ফিরলেন। খাদীজাকে ডেকে বললেন : ‘আমাকে কম্বল দাও, কম্বল দিয়ে ঢেকে দাও।’ তিনি ঢেকে দিলেন। তাঁর ভীতি কেটে গেল। তিনি খাদীজার নিকট পুরো ঘটনা খুলে বললেন এবং নিজের জীবনের আশঙ্কার কথা ব্যক্ত করলেন। খাদীজা বললেন : না, তা কক্ষণো হতে পারে না। আল্লাহর কসম! তিনি আপনাকে লাঞ্ছিত করবেন না। আপনি আত্মীয়তার বন্ধন সুদৃঢ়কারী, গরিব-দুঃখীর সাহায্যকারী, অতিথিপরায়ণ ও মানুষের বিপদে সাহায্যকারী। অতঃপর খাদীজা (রাঃ) রাসূলুল্লাহকে (সাঃ) সঙ্গে করে তাঁর চাচাতো ভাই ওয়ারাকা ইবন নওয়াফিলের নিকট নিয়ে যান। সেই জাহেলী যুগে তিনি খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করেছিলেন। হিব্রু ভাষায় ইনজিল কিতাব লিখতেন। তখন তিনি বৃদ্ধ ও দৃষ্টিহীন। খাদীজা বললেন : ‘শুনুন তো আপনার ভাতিজা কি বলে।’ তিনি জিজ্ঞেস করলেন : ‘ভাতিজা তোমার বিষয়টি কি?’ রাসূলুল্লাহ (সাঃ) পুরো ঘটনা বর্ণনা করলেন। সব কথা শুনে ওয়ারাকা বললেন : এ তো সেই ‘নামুস’ বা খোদার দূতÑআল্লাহ যাকে মূসার (আঃ) নিকট পাঠিয়েছিলেন। আফসোস! সেদিন যদি আমি জীবিত ও সুস্থ থাকতাম, যেদিন তোমার দেশবাসী তোমাকে দেশ থেকে বের করে দিবে।’ সুতরাং, বিবি খাদিজার জীবনের সঙ্গে মাহে রমজানে কোরান নাযিলের পুণ্যস্মৃতি ওতোপ্রতোভাবে জড়িত। আসুন বিস্তারিতভাবে জানার জন্য আমরা এ মহীয়সী মহিলার বিভিন্ন জীবনীগ্রন্থ সংগ্রহ করি।
×