ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

জাইকার অর্থায়নে শীঘ্রই ঋণচুক্তি

বঙ্গবন্ধু সেতুর অদূরে আলাদা ডাবল লাইন রেল সেতু হচ্ছে

প্রকাশিত: ০৫:৩৮, ২৫ জুন ২০১৬

বঙ্গবন্ধু সেতুর অদূরে আলাদা ডাবল লাইন রেল সেতু হচ্ছে

মশিউর রহমান খান ॥ যমুনা নদীর উপর পৃথক রেলসেতু নির্মাণ করছে সরকার। বঙ্গবন্ধু সেতুর অদূরে ডুয়েল গেজ ডাবল লাইনের এ রেলসেতু নির্মাণ করবে বাংলাদেশ রেলওয়ে। এ সেতুটি দিয়ে একই সঙ্গে পাশাপাশি দুটি ট্রেন অনায়াসে চলাচল করতে পারবে। সেতুটি নির্মাণ করা হলে এটিই হবে যমুনা নদীর ওপর দ্বিতীয় সেতু এবং দেশের বৃহত্তম রেলসেতু। জাপানী প্রযুক্তির ওয়েদার স্টিল দিয়ে এ সেতু তৈরি করা হবে বিধায় সেতুটিতে কখনও রং করতে হবে না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ আগ্রহে জাপানের প্রধানমন্ত্রীর কাছে সেতু নির্মাণের জন্য সাহায্য প্রস্তাবের প্রেক্ষিতে জাপান সরকারের অর্থায়নে এ সেতুটি নির্মাণ করা হবে। জাপান সরকার প্রদত্ত বাংলাদেশে সাহায্যের মধ্যে বিশেষ অগ্রাধিকার তালিকায় এ সেতুর অর্থ বরাদ্দ রেখেছে দেশটির সরকার। বাংলাদেশ সরকারকে সেতুটি নির্মাণে জাপানী অর্থায়নের নিশ্চয়তা দেয়ায় খুব শীঘ্রই ঋণ চুক্তি করা হবে। ইতোমধ্যে সেতুটি নির্মাণে সম্ভাব্যতা যাচাই কাজ সম্পন্ন করা হয়েছে। সেতুটি নির্মাণ করা হলে যমুনা নদীর অপর প্রান্তের কয়েক কোটি মানুষ নির্বিঘেœ কম সময়ে যাতায়াতসহ পণ্য পরিবহন করতে পারবেন। যা উক্ত এলাকার অর্থনৈতিক উন্নয়নে বিশেষ ভূমিকা রাখবে। সম্প্রতি এর প্রকল্প প্রস্তাবনাও (ডিপিপি) চূড়ান্ত করা হয়েছে। প্রায় ৫ কিলোমিটার দীর্ঘ সেতুটির নকশা প্রণয়নসহ এটি নির্মাণে ব্যয় ধরা হয়েছে ৯ হাজার ৭৪০ কোটি টাকা। জাপান আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থার (জাইকা) অর্থায়নে সেতুটি নির্মাণ করা হবে। ৪ বছরে এ সেতুটি নির্মাণ করা হবে। মূলত বর্তমানে বঙ্গবন্ধু সেতুতে চাপ কমানো এবং ট্রেন চলাচলে সক্ষমতা বাড়াতে এ পৃথক রেলসেতু তৈরি করছে রেলপথ মন্ত্রণালয়। বঙ্গবন্ধু সেতুতে ট্রেন চলাচল ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় পারাপারের সময় গতি অনেক কমিয়ে দেয়া হয়। আর ব্রড গেজ ট্রেনে পণ্য পরিবহন বর্তমানে নিষিদ্ধ। সেতুটির এ অবস্থা দেশের অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক যোগাযোগের ক্ষেত্রে বড় প্রতিবন্ধক হিসেবে কাজ করছে। এ প্রতিবন্ধকতা নিরসনেই পৃথক রেলসেতু নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে সেতুটি নির্মাণে জাইকার কাছে ৭ হাজার ৭২৪ কোটি ৩২ লাখ টাকার ঋণ প্রস্তাব করা হয়েছে। বাকি টাকা বাংলাদেশ সরকার প্রদান করবে। রেলওয়ের তথ্যমতে, চূড়ান্ত অনুমোদনের পর যমুনায় রেলসেতু নির্মাণে বিস্তারিত নকশা প্রণয়নের কাজ শুরু করা হবে। নকশা প্রণয়নে ব্যয় ধরা হয়েছে ২৩০ কোটি ৪১ লাখ টাকা। এর পর ঠিকাদার নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরুর মাধ্যমে মূল সেতুর নির্মাণ কাজ শুরু করা হবে। সেতুটি নির্মাণে সময় ধরা হয়েছে ৪ বছর। জানা গেছে, চলতি বছরের শেষে সেতুটির নির্মাণ শুরু করা গেলে আগামী ২০২০ সালের ডিসেম্বর মাসে নির্মাণকাজ শেষ হওয়ার কথা রয়েছে। নির্মিতব্য এ সেতু দিয়ে যাত্রীবাহী ট্রেনের গতিবেগ হবে ঘণ্টায় ১০০ কিলোমিটার। বর্তমানে বঙ্গবন্ধু সেতু দিয়ে ঘণ্টায় ৫ কিলোমিটার গতিতে যাত্রীবাহী ট্রেন চলাচল করে। এছাড়া ঘণ্টায় ৮০ কিলোমিটার গতিতে মালবাহী কন্টেনার ট্রেন চলবে। বর্তমানে পণ্যবাহী ও কন্টেনারবাহী ট্রেন চলাচল সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ রয়েছে। নতুন সেতু নির্মাণের মাধ্যমে ট্রেনের গতি বাড়ানো গেলে নতুন এ সেতু দিয়ে যাত্রীবাহী ট্রেনের চলাচল দৈনিক ৬০ শতাংশ বাড়ানো যাবে। আর পণ্য পরিবহন বাড়ানো যাবে ১৬০ শতাংশ। ফলে মালবাহী ট্রেনে প্রতিদিন সাড়ে ৩২ টন মালামাল পরিবহন করা সম্ভব হবে। এছাড়া জাপানী প্রযুক্তির ওয়েদার স্টিল দিয়ে এ সেতুটি তৈরি করা হবে বিধায় সেতুটিতে কখনও রং করতে হবে না। বর্তমানে সৌন্দর্য রক্ষায় দেশের বৃহত্তম রেলসেতু হার্ডিঞ্জ ব্রিজ প্রতি ৩ বছর পরপর রং করতে হয়, যা অত্যন্ত ব্যয়বহুল। রেলসূত্র জানায়, সেতুটি তৈরির জন্য ইতোমধ্যে এজন্য এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) অর্থায়নে কানাডীয় প্রতিষ্ঠান ক্যানারেল কোম্পানি লিমিটেড কর্তৃক সম্ভাব্যতা যাচাই সম্পন্ন হয়েছে। যমুনা ইকোপার্কের পাশ দিয়ে এটি বঙ্গবন্ধু সেতুর পশ্চিম অংশের রেলপথের সঙ্গে যুক্ত হবে। যমুনা রেলসেতু নির্মাণ প্রকল্পটির ডিপিপি পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হয়েছে। প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির (পিইসি) বৈঠক শেষে তা জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটিতে (একনেক) পাঠানো হবে। একনেকে পাস হওয়ার পরই সেতুর কাজ শুরু করা হবে। সম্ভাব্যতা যাচাইয়ে বলা হয়েছে, বঙ্গবন্ধু সেতুর ৩০০ মিটার উজানে ৪.৮ কিলোমিটার দীর্ঘ ডুয়াল গেজ ডাবল লাইন রেলসেতু নির্মাণ করা হবে। তবে পরবর্তীতে তা আরও বাড়তে পারে। এজন্য আলাদাভাবে নদীশাসন করতে হবে না। এছাড়া খুব বেশি জমি অধিগ্রহণ দরকার হবে না বিধায় এতে ব্যয় হবে অনেক কম। আর রেলসেতুর পূর্ব পাশে প্রায় সাড়ে ১৩ কিলোমিটার লুপ লাইনসহ নির্মাণ করতে হবে ১৩টি কালভার্ট ও দুটি সংযোগ স্টেশন। সেতু নির্মাণে মোট ছয় একর জমি অধিগ্রহণ করতে হবে। সেতুটির উভয় দিকে ভায়াডাক্ট থাকবে ৫৮০ মিটার। যমুনা ইকোপার্কের পাশ দিয়ে এটি বঙ্গবন্ধু সেতুর পশ্চিম অংশের রেলপথের সঙ্গে যুক্ত হবে। এজন্য নির্মাণ করতে হবে ৩ দশমিক ১২ কিলোমিটার রেলপথ। এর পাশাপাশি তিনটি স্টেশন বিল্ডিং, তিনটি প্লাটফর্ম ও শেড, তিনটি লেভেলক্রসিং গেট এবং ছয়টি কালভার্ট নির্মাণ করতে হবে। জানা গেছে, ঋণ চুক্তির পর বিস্তারিত নকশা প্রণয়ন ও দরপত্র প্রক্রিয়াকরণে পরামর্শক নিয়োগ করা হবে। নকশা প্রণয়ন শেষে মূল ঠিকাদার নিয়োগ করা হবে। উল্লেখ্য, ১৯৯৮ সালের জুনে উদ্বোধনের পর থেকে বঙ্গবন্ধু সেতুতে ট্রেন চলাচল করছে। তবে ছয় বছরের মাথায় সেতুটিতে ফাটল দেখা দিলে স্বাভাবিক গতিতে ট্রেন চলাচল ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পরে। পরবর্তীতে সরকারী সিদ্ধান্তে ট্রেনের গতি কমিয়ে দেয়া হয়। ফাটলের সংখ্যা ক্রমেই বাড়তে থাকায় পরে পৃথক রেলসেতু নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হয়। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সচিব মোঃ সালাউদ্দিন জনকণ্ঠকে বলেন, উত্তরাঞ্চলের সাথে দেশের অন্যান্য স্থানের রেলপথে যোগাযোগ ব্যবস্থার সর্বোচ্চ উন্নতি ঘটাতে এবং উক্ত এলাকার মানুষের পৃথক রেলসেতু তৈরির দাবির প্রেক্ষিতে সরকার যমুনা নদীর উপর নতুন একটি রেলসেতু নির্মাণ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বঙ্গবন্ধু সেতুর ৩০০ মিটার উজানে ৪.৮ কিলোমিটার দীর্ঘ ডুয়াল গেজ ডাবল লাইনে এ রেলসেতুটি নির্মাণ করা হবে। তবে পরবর্তীতে তা আরও বাড়তে পারে। ৪ বছরে এ সেতুটি নির্মাণ করা হবে। সেতুটি নির্মাণে ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ৯ হাজার ৭ শ’ ৪০ কোটি টাকা। রলপথ সচিব বলেন, জাপানী প্রযুক্তির ওয়েদার স্টিল দিয়ে এ সেতুটি তৈরি করা হবে বিধায় সেতুতে কখনও রং করতে হবে না। সেতুটি তৈরির জন্য আলাদাভাবে নদীশাসন করতে হবে না। এছাড়া খুব বেশি জমি অধিগ্রহণ দরকার হবে না বিধায় এতে ব্যয় হবে তুলনামূলকভাবে অনেক কম। আর রেলসেতুর পূর্ব পাশে প্রায় সাড়ে ১৩ কিলোমিটার লুপ লাইন নির্মাণ করতে হবে। নতুন সেতুটি দিয়ে যাত্রীবাহী ট্রেনের গতিবেগ হবে ঘণ্টায় ১০০ কিলোমিটার ও এছাড়া মালবাহী কন্টেইনার ট্রেন চলবে ঘণ্টায় ৮০ কিলোমিটার গতিতে। বর্তমানে বঙ্গবন্ধু সেতু দিয়ে ঘণ্টায় ৫ কিলোমিটার গতিতে যাত্রীবাহী ট্রেন চলাচল করে আর পণ্যবাহী ও কনটেনারবাহী ট্রেন চলাচল সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ রয়েছে। নতুন সেতু নির্মাণের মাধ্যমে ট্রেনের গতি বাড়ানো গেলে নতুন এ সেতু দিয়ে যাত্রীবাহী ট্রেনের চলাচল দৈনিক ৬০ শতাংশ বাড়ানো যাবে। আর পণ্য পরিবহন বাড়ানো যাবে ১৬০ শতাংশ। ফলে মালবাহী ট্রেনে প্রতিদিন সাড়ে ৩২ টন মাল পরিবহন করা সম্ভব হবে। যা এ অঞ্চলের পণ্য দেশের সর্বত্র পরিবহনে সহজ হবে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে রেলপথমন্ত্রী মুজিবুল হক জনকণ্ঠকে বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একান্ত আগ্রহে জাপান সরকারের অর্থায়নে যমুনা নদীর উপর বঙ্গবন্ধু সেতুর ন্যায় একটি সমান্তরাল সেতু নির্মাণ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এ সেতুটি দিয়ে একই সথে পাশপাশি দুটি ট্রেন চলাচল করতে পারবে। ইতোমধ্যে সেতুটি নির্মাণে সম্ভাব্যতা যাচাই কাজ সম্পন্ন করা হয়েছে। বর্তমানে বঙ্গবন্ধু সেতুর সাথে তৈরি করা রেললাইন দিয়ে পণ্যবাহী ট্রেন চলাচল নিষিদ্ধ রয়েছে। এছাড়া যেসব ট্রেন চলাচল করে তার গতি অত্যন্ত কম। এমনকি ঈদ বা যে কোন উৎসবে অধিক যাত্রী নিয়ে ট্রেন চলাচলেও মারাত্মক সমস্যার সৃষ্টি হয়। মূলত যাত্রীসেবা বর্তমানের তুলনায় অনেক বাড়াতে ও উত্তরাঞ্চলের যোগাযোগ ব্যবস্থার অভূতপূর্ব উন্নতি করতে সেতুটি বিশেষ কাজে লাগবে। জাপান সরকারের সহযোগী সংস্থা জাইকার অর্থায়নে সেতুটি নির্মাণ করা হবে। সেতুটি নির্মাণের যাবতীয় প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। খুব শীঘ্রই এ বিষয়ে জাপান সরকারের সঙ্গে ঋণ চুক্তি করার প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। নতুন সেতু দিয়ে যাত্রীর পাশপাশি পণ্য পরিবহন সহজ হবে। যা উক্ত অঞ্চলের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি আনতে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে।
×