ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

বৈদেশিক বাণিজ্য ও অভিবাসন প্রত্যাশীদের ওপরই প্রভাব পড়বে বেশি

ব্রেক্সিট ত্রিমুখী সঙ্কট সৃষ্টি করবে বাংলাদেশে

প্রকাশিত: ০৫:৩৭, ২৫ জুন ২০১৬

ব্রেক্সিট ত্রিমুখী সঙ্কট সৃষ্টি করবে বাংলাদেশে

রশিদ মামুন ॥ ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) থেকে যুক্তরাজ্য বেরিয়া যাওয়ায় দেশে ত্রিমুখী সঙ্কট সৃষ্টির আশঙ্কা করা হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রভাব পড়বে দেশের বৈদেশিক বাণিজ্যে। বিশেষ করে ক্ষতিগ্রস্ত হবে তৈরি পোশাক শিল্পখাত। একই সঙ্গে যুক্তরাজ্যে অভিবাসন প্রত্যাশীদের নতুন সঙ্কটের মুখে পড়তে হবে। ইউর কাছ থেকে পাওয়া আর্থিক সহায়তার পরিমাণ ঠিক থাকা নিয়েও সংশয় থেকে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে ইউরোপীয় ইউনিয়নে (ইইউ) থেকে যুক্তরাজ্যের থাকা না থাকা নিয়ে গণভোটের ফলাফলে ব্যাপক প্রভাব পড়েছে দেশটির মুদ্রা পাউন্ডের ওপর। নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে পুঁজিবাজারেও। গণভোটের ফলাফলে শুধু ইউরোপেই নয়, ধস নেমেছে এশিয়ার পুুঁজি বাজারেও। ইতোমধ্যে যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন পদত্যাগের ঘোষণা দিয়েছেন। ইউরোপের প্রধান শক্তিধর দেশটি বিশ্বের সর্ববৃহৎ অর্থনৈতিক জোট ত্যাগ করার খবরে ইউরোপ জুড়েই অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। ইরোপের বিভিন্ন দেশের উগ্র জাতীয়তাবাদীরা এর মধ্যেই নিজ নিজ দেশে যুক্তরাজ্যের মতো গণভোট আয়োজনের পক্ষে কথা বলতে শুরু করেছেন। অর্থনৈতিক পূর্বাভাস বলছে, এই জোটে বড় রকমের ফাটল ধরলে মন্দা ছড়িয়ে পড়তে পারে দেশে দেশে। এই বিভক্তি অভিবাসন, অর্থনৈতিক সঙ্কট এবং বৈশ্বিক সন্ত্রাসবাদের হুমকিতে থাকা ইউরোপের জন্য একটি অশনি সঙ্কেত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সৃষ্টি হওয়া ঐক্যবদ্ধ ইউরোপের স্বপ্নে বড় ধরনের ফাটল হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে বিষয়টিকে। এই বিভক্তিতে মার্কিন ডলারের বিপরীতে পাউন্ডের দাম সর্বোচ্চ পরিমাণ কমে গেছে। পাউন্ডের দাম কমতে কমতে এক পর্যায়ে এসে এক দশমিক ৩৩০৫ ডলারে ঠেকেছে। এই পতনের হার ১০ শতাংশের বেশি। গত ৩১ বছর অর্থাৎ ১৯৮৫ সালের পর এত নিচে আর কখনও নামেনি পাউন্ডের দাম। অর্থনৈতিক সঙ্কট ২০০৮ সালেও দেশটির এই অবস্থা তৈরি হয়নি। অন্যদিকে বিভক্তির প্রভাব পড়েছে দেশটির শেয়ারবাজারে। শুক্রবার লন্ডন স্টক এক্সচেঞ্জে এফটিএসই ১০০ সূচক খোলার মুখেই ৮ শতাংশ ধস নামে। এর প্রভাব শুধু যুক্তরাজ্যেরই নয়, জাপানের টোকিও শেয়ারবাজারেও পড়েছে। সেখানে নিক্কেই ২২৫ সূচক ৮ শতাংশের বেশি কমে যায়। জাপানী মুদ্রা ইয়েনের দাম পাঁচ শতাংশ বেড়েছে। সোনার দামও বাড়ছে লাফিয়ে লাফিয়ে। বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা বলছেন, এর প্রভাব পড়বে বাংলাদেশের রফতানি বাণিজ্যে। যুক্তরাষ্ট্রের পর ইউরোপীয় ইউনিয়ন বাংলাদেশ থেকে বেশি পণ্য আমদানি করে। এ ক্ষেত্রে মোট রফতানি বাণিজ্যের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র ১৮ দশমিক ৫৪ শতাংশ। জার্মানিতে সাড়ে ১৪ শতাংশর পরেই রয়েছে যুক্তরাজ্যের অবস্থান। তৃতীয় অবস্থানে থাকা দেশটিতে ১১ দশমিক ১৪ শতাংশ রফতানি করে বাংলাদেশ। বিভক্তিতে প্রায় আড়াই বিলিয়ন ডলারের বিশাল এই বাজারে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। পাউন্ডের দর কমে যাওয়ায় দাম চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে। জনসাধারণের ক্রয়ক্ষমতা কমে গেলে রফতানি কমে যাবে। জানতে চাইলে তৈরি পোশাক রফতানিকারকদের সংগঠন বিজেএমইএ এর প্রেসিডেন্ট সিদ্দিকুর রহমান বলেন, অবশ্যই এতে তৈরি পোশাক শিল্পে এক ধরনের প্রভাব পড়বে। তবে এই প্রচারণা থাকলেও আমরা ভাবতে পারিনি এটা ঘটে যাবে। দেশটির সরকার যেভাবে কথা বলছিল তাতে মনে হচ্ছিল না এমন কিছু ঘটবে। ইতোমধ্যে ডলারের বিপরীতে পাউন্ডের দাম কমে যাওয়ায় আমাদের শঙ্কা তৈরি হয়েছে বলে জানান তিনি। যুক্তরাজ্যের ইইউ ত্যাগের ফলে ইইউভুক্ত অন্য দেশে কাজ করতে গেলে যুক্তরাজ্যের নাগরিকদের বিশেষ অনুমতির দরকার হবে কি না তা নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে। এখন ইইউর সঙ্গে যুক্তরাজ্যের নতুন চুক্তির ওপরই বিষয়টি নির্ভর করছে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন। এক্ষেত্রে একক বাজারব্যবস্থা টিকে থাকলে যুক্তরাজ্যের নাগরিকরা অন্য দেশগুলোতে সরাসরি যেতে পারবেন। অন্যদেশের জনগণও ব্রিটেনে আসতে পারবেন। তবে বিভক্ত হওয়ার পরও এই নীতিতে চলার বিষয়টি ব্রিটেনের জনগণ না মানতে চাইলে সঙ্কট ঘনীভূত হবে। সঙ্কট বাড়বে যুক্তরাজ্যের অর্থনীতিতেও। বাংলাদেশ এক্সপোর্টার এ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট সালাম মুর্শেদী জনকণ্ঠকে বলেন, বাংলাদেশের রফতানি বাণিজ্যের তৃতীয় দেশ ব্রিটেন। এখানে অর্থনৈতিক যে কোন ধাক্কায় আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হবো। আমাদের রফতানি বাড়বে না কমতে পারে কোন কোন ক্ষেত্রে। পাউন্ডের দাম কমলে সেখানে মুদ্রাস্ফীতি বৃদ্ধি পাবে। এই পরিস্থিতিতে তারা আমদানি সঙ্কোচন নীতি গ্রহণ করলে আমরা বিপাকে পড়ব। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এর বাইরে যুক্তরাজ্যে অভিবাসন একটি বড় সঙ্কটময় পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে। তবে বিশেষজ্ঞদের মতে এই বিভক্তির ফলে যুক্তরাজ্যে দক্ষজনশক্তির অভিবাসন সুবিধা পাওয়া সহজ হবে। অন্যদিকে অদক্ষ জনশক্তির জন্য কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। একই সঙ্গে বাংলাদেশের কোন নাগরকি অবৈধভাবে যুক্তরাজ্যে অবস্থান করলে বৈধ হওয়ার প্রক্রিয়া দীর্ঘ হবে। যেহেতু অভিবাসন বিষয়টিতে তারা বিভিন্নভাবে গুরুত্ব দিচ্ছে তাই অবৈধ অন্যদেশের নাগরিকদের বিষয়ে নতুন সিদ্ধান্ত নিতে পারে যুক্তরাজ্য। তবে এখনও বিষয়টি নির্ধারিত হয়নি। উদারপন্থী সিদ্ধান্তে নতুন মোড়ও নিতে পারে অভিবাসন ব্যবস্থা। তবে সম্প্রতি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের সঙ্গে দেখা করে ইইউর একটি প্রতিনিধি দল ইউ থেকে অবৈধ বাংলাদেশীদের বের করে দেয়া হবে বলে জানিয়ে গেছে। সাবেক পররাষ্ট্র সচিব হুমায়ুন কবীর এ প্রসঙ্গে জনকণ্ঠকে বলেন, আমাদের সঙ্গে যুক্তরাজ্যের যে রফতানি বাণিজ্য ছিল তা হয়ত বজায় থাকবে। তবে ইইউ যেসব পণ্যের শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার দিয়েছিল তা ব্রিটেন দেবে না কি সেবিষয়ে দেশটিকে সিদ্ধান্ত জানাতে হবে। তবে আমূল সংস্কার না করলে যুক্তরাজ্য এই প্রথা বজায় রাখবে বলে মনে করেন তিনি। এক্ষেত্রে একটি নতুন চুক্তি করলেই চলবে। এখন বিভিন্ন দেশে দক্ষ জনশক্তির দিকে নজর দিয়েছে। তাদের অভিবাসনের ক্ষেত্রে যতটা সহজ হবে ঠিক একই ভাবে কঠিন হয়ে পড়বে অদক্ষ জনশক্তির অভিবাসন। এখানে আমাদের জনশক্তির একটি বড় অংশই অদক্ষ। বিষয়টি আমাদের জন্য চিন্তার কারণ হতে পারে। এর বাইরে বৈদেশিক সহায়তার ক্ষেত্রে ডিএফআইডির মাধ্যমে ব্রিটেন পৃথকভাবেই সহায়তা করে থাকে। এখন ব্রিটেন বের হয়ে যাওয়ায় ইইউর সহায়তা প্রদানের হার কমে যায় কী না সেই শঙ্কা রয়েছে। তবে আশার কথা হচ্ছে গণভোটের পরও সংস্কার করে ইইউর বাইরে ব্রিটেন একলা চলার নীতি কার্যকর হতে অন্তত দুই বছরের মতো সময় প্রয়োজন হবে। এই দুই বছরে নানা সংস্কারের ফলে অর্থনীতি তার গতি ফিরে পেতে পারে। যা ব্রিটেনের পাশাপাশি বাংলাদেশের জন্য শুভ ফলাফল বয়ে আনতে পারে।
×