ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে ব্রিটেন ;###;গণভোটে ইইউ ছাড়ার পক্ষে ৫২ শতাংশ, থাকার পক্ষে ৪৮ শতাংশ ভোট;###;৪৩ বছরের সম্পর্কের অবসান

ঐতিহাসিক বিচ্ছেদ

প্রকাশিত: ০৫:৩৬, ২৫ জুন ২০১৬

ঐতিহাসিক বিচ্ছেদ

জনকণ্ঠ ডেস্ক ॥ শেষ পর্যন্ত ইউরোপীয় ইউনিয়ন ছাড়ার পক্ষে রায় দিল ব্রিটেনবাসী। বৃহস্পতিবার অনুষ্ঠিত ঐতিহাসিক গণভোটে ইইউ ছাড়ার পক্ষে ভোট পড়েছে ৫২ শতাংশ; আর থাকার পক্ষে ভোট পড়েছে ৪৮ শতাংশ। ছাড়ার পক্ষে প্রায় সাত লাখ ভোট বেশি পড়ে। গণভোটের ফল প্রকাশের পর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় পদত্যাগের ঘোষণা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন। ৩১ বছরের মধ্যে এই প্রথম ডলারের বিপরীতে শুক্রবার পাউন্ডের দাম পড়ে যায়। মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রিপাবলিকান দলীয় প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছেন, ব্রিটেনের জনগণই এখন নিজেদের শাসন করবে। গণভোটের এই ফলে উল্লাস প্রকাশ করেছেন লন্ডনের সাবেক মেয়র বরিস জনসনও। এ গণভোটকে বিবেচনা করা হচ্ছে ব্রিটেনের রাজনৈতিক ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত হিসেবে। ইইউ থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পক্ষে বেশিরভাগ ভোট পড়ে ইংল্যান্ড ও ওয়েলসে। অন্যদিকে লন্ডন, স্কটল্যান্ড ও উত্তর আয়ারল্যান্ড ইইউতে থাকার পক্ষে বেশির ভাগ মানুষ রায় দেয়। বিরোধী ইউকিপ পার্টির নেতা নাইজেল ফারাজ গণভোটের ফলাফলে আনন্দ প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেছেন, যুক্তরাজ্যের স্বাধীনতা দিবস; তবে সব মিলিয়ে ইইউ সমর্থকদের জন্য দিনটি ছিল এক ‘বিপর্যয়’। এর মধ্য দিয়ে ব্রিটেন ইইউর সঙ্গে ৪৩ বছরের সম্পর্কের অবসান ঘটাল। ব্যালট পেপারে ভোটারদের প্রতি প্রশ্ন রাখা হয়Ñ ‘যুক্তরাজ্যের ইইউর সদস্য হিসেবে থাকা উচিত, নাকি ইইউ ত্যাগ করা উচিত?’ প্রত্যেক ভোটারকে থাকা না-থাকার যেকোন একটি ঘরে টিক চিহ্ন দিতে হয়। মোট নিবন্ধিত ৪ কোটি ৬৫ লাখ ভোটারের মধ্যে ৭১ দশমিক ৮ শতাংশ বা তিন কোটির কিছু বেশি ভোটার গণভোটে অংশ নেন। এ গণভোটে ইংল্যান্ড, স্কটল্যান্ড, ওয়েলস ও উত্তর আয়ারল্যান্ডের পাশাপাশি স্পেন উপকূলের অদূরে ব্রিটিশ শাসিত ক্ষুদ্র ভূখ- জিব্রাল্টারের অধিবাসীরাও তাদের মত জানানোর সুযোগ পায়। যুক্তরাজ্যকে ৩৮২টি এলাকায় ভাগ করে ফলাফল গণনা করা হয়। সাম্প্রতিক সময়ে অন্য যে কোন নির্বাচনের চেয়ে বৃহস্পতিবারের গণভোটে বেশি লোক অংশ নেয়। শুক্রবার এ প্রতিবেদন তৈরি করার সময় পর্যন্ত গণভোটের ফল আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করা হয়নি। ঐতিহাসিক গণভোটের ফল আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করা হবে ম্যানচেস্টার টাউন হলে। এ উপলক্ষে হলের দরজা নিয়ন আলোয় সাজানো হয়েছে। শুক্রবারই গণভোটের প্রভাব বিশ্ববাজারে পড়তে শুরু করে। ১৯৮৫ সালের পর এই প্রথম ডলারের বিপরীতে পাউন্ডের দর ১০ শতাংশ পড়ে যায়। লেবার দলের ছায়া চ্যান্সেলর জন ম্যাকডানেল বলেন, পাউন্ডকে চাঙা করতে ব্যাংক অব ইংল্যান্ডকে ভূমিকা রাখতে হবে। সুন্ডারল্যান্ডে প্রাথমিক ফলাফলে বিপক্ষের ভোট বেশি পড়ার কয়েক মুহূর্ত পরেই পাউন্ডের পতন হয়েছে ৩ শতাংশ। এর কিছুক্ষণ পর ইউরোর বিপরীতে পাউন্ডের ৬.৫ শতাংশ পতন হয়। গণভোটে ব্রিটেনের ইইউ ছাড়ার পক্ষে সংখ্যাগরিষ্ঠে রায় আসার পর স্কটল্যান্ডের মুখ্যমন্ত্রী নিকোলা স্টার্জেন বলেছেন, তারা যুক্তরাজ্য থেকে বেরিয়ে আসতে স্বাধীনতা ইস্যুতে একটি গণভোট আয়োজনের প্রস্তুতির কাজ শীঘ্রই শুরু করবেন। গণভোটের এই ফলের পর এখন ইউনাইটেড কিংডম অব গ্রেট ব্রিটেন বা যুক্তরাজ্যও টিকে থাকবে কিনাÑ তা নিয়েই সংশয় তৈরি হয়েছে। ইংল্যান্ড ছাড়া যুক্তরাজ্যের অংশ অন্য তিনটি রাজ্য স্কটল্যান্ড, উত্তর আয়ারল্যান্ড এবং ওয়েলসেরও একটা অংশের ভোটাররা ইইউতে থাকার পক্ষে ভোট দিয়েছে। তা সত্ত্বেও প্রশ্ন উঠেছে, ভোটের এ ফলাফলের পর তারা যুক্তরাজ্যের অংশ থাকবে কিনা। বিশেষ করে স্কটল্যান্ডে দুই বছর আগে স্বাধীনতা প্রশ্নে এক গণভোটে ১০ শতাংশ ভোটের ব্যবধানে যুক্তরাজ্যে থাকার পক্ষের অংশ জয়ী হয়েছিল। উত্তর আয়ারল্যান্ড বহু দশক ধরে স্বাধীনতার দাবিতে সশস্ত্র সংগ্রাম করছে। নিকোলা বলেন, দুই বছর আগে যে পরিস্থিতিতে প্রথম গণভোট হয়েছিল সেই পরিস্থিতি এখন পাল্টে গেছে। তাই এখন স্বাধীনতার প্রশ্নে নতুন গণভোট দরকার। উত্তর আয়ারল্যান্ডের সবচেয়ে বৃহৎ জাতীয়তাবাদী দল শিন ফেইনও বলেছে, আইরিশ প্রজাতন্ত্রের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার প্রশ্নে একটি গণভোট করার পক্ষে এখন শক্ত যুক্তি পাওয়া গেছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রিপাবলিকান পার্টির সম্ভাব্য প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প এ ফলকে স্বাগত জানিয়েছেন। স্কটল্যান্ডে তার নিজের গলফ কোর্স দেখতে আসা ট্রাম্প বলেছেন, এটা একটা দারুণ ব্যাপার যে যুক্তরাজ্যের জনগণ তাদের ‘নিজ দেশকে ফিরে পেয়েছে।’ রুশ পররাষ্ট্র মন্ত্রী সের্গেই লাভরভ বলেছেন, এটা ব্রিটিশ জনগণের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার। তাকে যখন প্রশ্ন করা হয় যে ব্রিটেন ইইউ থেকে বেরিয়ে যাক, এটাই ক্রেমলিন চাইছিল কিনাÑ এ নিয়ে তিনি কোন মন্তব্য করতে অস্বীকার করেন। ইউরোপীয় ইউনিয়নের থাকা না থাকার এই ভোট, যাকে ব্রেক্সিট হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছিল, তাতে ইংল্যান্ড এবং ওয়েলসের বেশিরভাগ মানুষ ইউরোপ ছাড়ার পক্ষে রায় দিয়েছেন। অন্যদিকে রাজধানী লন্ডন, স্কটল্যান্ড আর উত্তর আয়ারল্যান্ডে জোটে থাকার পক্ষেই বেশি ভোট পড়েছে । ব্যাংক অব ইংল্যান্ড জানিয়েছে, আর্থিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে সব ধরনের ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। ইউরোপের শেয়ারবাজারগুলোতে প্রতিক্রিয়া হয়েছে ব্যাপক। লন্ডনের মূল শেয়ার সূচক দিনের শুরুতেই সাত শতাংশ পড়ে গেছে। এশিয়াতেও শেয়ারের দাম পড়েছে। টোকিওতে সূচক পড়েছে আট শতাংশ। অনেকেই বলছেন, ২০০৮ সালের আর্থিক সঙ্কটের পর বাজারের এ ধরনের অস্থিতিশীলতা তারা আর লক্ষ্য করেননি। ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী ফিলিপ হ্যামন্ড বলেছেন, ভোটাররা পরিষ্কার ভাষায় তাদের মতামত জানিয়েছেন। জার্মান পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াল্টার স্টেইনমিয়ের গণভোটের ফলাফলকে ‘ইউরোপ ও ব্রিটেনের জন্য একটি দুঃখের দিন’ হিসেবে বর্ণনা করে ইইউ প্রশ্নে ব্রিটিশদের মধ্যে যে গভীর বিভক্তি ছিল এই গণভোট সেটাই তুলে ধরেছে। বিরোধী লেবারদলীয় নেতা করবিন অবশ্য চেয়েছিলেন ব্রিটেন ইইউ জোটে থাকুক। তিনি ইইউ সমর্থক অংশের হেরে যাওয়ার জন্য দুর্বল প্রচারাভিযানকে দায়ী করেছেন। তিনি মনে করেন, ভোটারদের কাছে বিষয়টির গুরুত্ব ঠিকমতো তুলে ধরা হয়নি। করবিন মনে করেন, সামনে কঠিন সময় আসছে। ক্যামেরন তড়িঘড়ি পদত্যাগ করবেন সেটাও তিনি চাননি। ইইউ ছাড়তে আগ্রহীদের নেতৃত্ব দিয়েছেন যারা তাদের মধ্যে অন্যতম সুপরিচিত নেতা হলেন লন্ডনের সাবেক মেয়র জনসন ও কনজারভেটিভ পার্টির মাইকেল গাভ। এরাও গণভোটের একদিন আগে চিঠি লিখে ক্যামেরনকে বলেছিলেন, ফলাফল যাই হোক তিনি যেন পদত্যাগ না করেন। গণভোটের ফল নিয়ে উৎকণ্ঠিত লেবার দলের সাবেক ইউরোপবিষয়ক মন্ত্রী কেইথ ভাজ। তিনি মনে করেন, এটি কেবল ব্রিটেন বা ইউরোপীয় ইউনিয়ন নয় বরং পুরো বিশ্বের জন্য একটি বিপদ সঙ্কেত। তবে ইইউ ছাড়তে সমর্থক কনজারভেটিভ পার্টির এমপি লিয়াম ফক্স ভোটারদের সাহসের প্রশংসা করেছেন। ভোটাররা ইতিহাসের ধারা পাল্টে দেয়ার মতো গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেয়ার মতো ঝুঁকি নিয়েছে বলে তিনি মন্তব্য করেন। গণভোটের রায়ে বেশিরভাই ইইউর নেতৃবৃন্দ হতাশ হয়েছেন। অনেকে মনে করেন ইইউ সংস্কার এখন সময়ের দাবি। ইইউ নেতারা এক সপ্তাহের মধ্যে জরুরী বৈঠকে বসছেন। জার্মানির চ্যান্সেলর এ্যাঞ্জেলা মেরকেল ও ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ফ্রাঁসোয়া ওলাঁদ গণভোটের পর নিজ দেশে ইইউবিরোধী মনোভাব গড়ে উঠতে পারে বলে তাদের উদ্বেগের কথা জানিয়েছেন। ইউরোপীয় কমিশনের প্রধান জ্যঁ ক্লদ জাঙ্কার বলেন, পরিস্থিতি দ্রুত খারাপের দিকে যেতে পারে। নেদারল্যান্ডসের প্রধানমন্ত্রী মার্ক রিচা যুক্তরাজ্যের ইইউ ছাড়ার সিদ্ধান্তে হতাশা ব্যক্ত করেছেন। তিনি বলেন, এটি ব্রাসেলসকে নিজেদের সংস্কারে উৎসাহিত করবে। ইইউ তাদের সংস্কারে উৎসাহিত হবে। হাঙ্গেরির প্রধানমন্ত্রী ভিক্টর অরবান বলেন, ইইউ ছাড়ার পক্ষে ব্রিটেনের গণভোটের রায় এটা প্রমাণ করে যে ব্রাসেলসকে অবশ্যই জনগণের কণ্ঠ শুনতে হবে। গণভোটে অভিবাসন ইস্যু অন্যতম প্রভাব ফেলেছে বলে অরবান মন্তব্য করেন। (আরও খবর ৫-এর পাতায়)
×