ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

মাহফুজা হিলালী

রবীন্দ্রনাথের জাপানযাত্রার একশো বছর

প্রকাশিত: ০৭:০২, ২৪ জুন ২০১৬

রবীন্দ্রনাথের জাপানযাত্রার একশো বছর

আজকে আমরা বাংলা ১৪২৩ সালে দাঁড়িয়ে। ঠিক একশো বছর আগে বাংলা ১৩২৩ সালের ২০ বৈশাখ প্রথমবার জাপানের উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। সে দিন রবীন্দ্রনাথের সাথে ছিলেন অ্যানড্রুজ, পিয়ার্সন ও মুকুল দে। তিনি একটি জাপানি জাহাজে রওনা দিয়েছিলেন- জলে ভাসতে ভাসতে; জাহাজের নাম ‘তোসামারু জাহাজ’। তিনি লিখেছেনÑ “জাহাজ ছেড়ে দিলে। মধুর বহিছে বায়ু, ভেসে চলি রঙ্গে।” নিজের এই ‘ভেসে চলা’ সম্পর্কে বলেছিলেনÑ “বাহিরের বিশ্বের রূপধারার দিকেও আমি যেমন তাকাতে তাকাতে চলেছি, আমার অন্তরের চিন্তাধারা ভাবধারার দিকেও আমি তেমনি চিত্তদৃষ্টি দিয়ে তাকাতে তাকাতে চলেছি।”- রবীন্দ্রনাথ যতক্ষণ জেগে থাকতেন, দেখা, চিন্তা করা, ভাবের সঞ্চার এবং লেখা সচেতনভাবে করেছেন। তাই জাপানযাত্রায়ও এর ব্যতিক্রম হয়নি। তবে রবীন্দ্রনাথের প্রথমবার জাপানযাত্রা বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। কারণ তখন প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলছিল, রবীন্দ্রনাথ মানবতার বাণী প্রচারে গিয়েছিলেন। ১৯১৩ সালে ব্রিটিশ শাসিত ভারতবর্ষের বাঙালি কবি রবীন্দ্রনাথ পেলেন নোবেল পুরস্কার। সে সময় পৃথিবীর অনেক দেশই বাংলা ভাষা এবং সাহিত্য সম্পর্কে আগ্রহী হলো। জাপানও এর ব্যতিক্রম নয়। নোবেলবিজয়ী রবীন্দ্রনাথকে প্রথম জাপানে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন জাপানের বিখ্যাত ব্যবসায়ী ও শিল্পপতি এইইচি শিবুসাওয়া। জাহাজ থেকেই তিনি জাপানের স্বাদ পেতে শুরু করেন। ২৪ বৈশাখ জাহাজ ঝড়ের কবলে পড়ে। এ সময় জাপানি মাল্লাদের মনোবল দেখে তিনি অবাক হয়েছিলেন; জাপানি মাল্লারা ছুটোছুটি করছিল কিন্তু তাদের মুখে হাসি লেগে ছিল। তিনি লিখেছিলে, “তাদের ভাব দেখে মনে হয়, সমুদ্র যেন অট্টহাস্যে জাহাজটাকে ঠাট্টা করছে মাত্র।” জাপানিদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য তাঁকে আরো বেশি আগ্রহী করে তোলে। তিনি দেখতে পান জাপানিদের প্রত্যেকের যেমন জানার আগ্রহ রয়েছে, তেমনি কেউ তাদের কাছে কিছু জানতে চাইলে শিখাতেও তারা সমান আগ্রহী। তাছাড়া জাপানিরা গম্ভীর এবং দাম্ভিক নয়, তারা মিশুক এবং আনন্দপ্রিয়। জাহাজ রেঙ্গুন, পিনাং বন্দর, সিঙ্গাপুর, হংকং ছুঁয়ে দীর্ঘ ছাব্বিশ দিন পর ১৬ জ্যৈষ্ঠ জাপানের ‘কোবে’ বন্দরে পৌঁছায়। রবীন্দ্রনাথ পা রাখেন জাপানে। সাংবাদিকদের প্রশ্ন আর ক্যামেরা তাঁকে আচ্ছন্ন করে। সেখানে এসে উপস্থিত হন ভারতীয় বণিকরা, আসেন জাপানের বিখ্যাত চিত্রকর টাইক্কন, চিত্রকর কাট্স্টাক, এক সময়ের শান্তিনিকেতনের জুজুৎসু ব্যায়ামের শিক্ষক সানো, আরো এলেন কাওয়াগুচি। এই সময় সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ রসিকতা করেছেন এভাবেÑ “দেশ ছাড়বার মুখে বঙ্গসাগরে পেয়েছিলুম বাতাসের সাইক্লোন, এখানে জাপানের ঘাটে এসে পৌঁছেই পেলুম মানুষের সাইক্লোন।” কোবেতে তিনি ছিলেন গুজরাটি বণিক মোরারজির বাড়িতে। এরপর তিনি এলেন টোকিও। টোকিও-তে তাঁর বন্ধু চিত্রকর য়োকোয়ামা টাইক্কানের বাড়িতে আশ্রয় নেন। এখানেই তিনি পান জাপানের ‘অন্তরে’র পরিচয়। জাপানের বাড়ি-ঘর-দোর দেখে মুগ্ধ রবীন্দ্রনাথ বর্ণনা করেছেন এভাবেÑ “প্রথমেই জুতো জোড়াটাকে বাড়ির দরজার কাছে ত্যাগ করতে হল। বুঝলুম, জুতো জোড়াটা রাস্তার, পা জিনিসটাই ঘরের। ধুলো জিনিসটাও দেখলুম এদের ঘরের নয়, সেটা বাইরের পৃথিবীর। বাড়ির ভিতরকার সমস্ত ঘর এবং পথ মাদুর দিয়ে মোড়া, সেই মাদুরের নীচে শক্ত খড়ের গদি; তাই এদের ঘরের মধ্যে যেমন পায়ের ধুলো পড়ে না তেমনি পায়ের শব্দও হয় না। দরজাগুলো ঠেলা দরজা, বাতাসে যে ধড়াধ্বড় পড়বে এমন সম্ভবনা নেই। ...আর একটা ব্যাপার এইÑ এদের বাড়ি জিনিসটা অত্যন্ত অধিক নয়। দেয়াল, কড়ি, বরগা, জানলা, দরজা, যতদূর পরিমিত হতে পারে তাই। ... ঘরের দেয়াল-মেঝে সমস্ত যেমন পরিস্কার তেমনি ঘরের ফাঁকটুকুও যেন তক্তক্ করছে; তার মধ্যে বাজে জিনিসের চিহ্নমাত্র পড়ে নি। মস্ত সুবিধে এই যে, এদের মধ্যে যাদের সাবেক চাল আছে তারা চৌকি টেবিল একেবারে ব্যবহার করে না। ... এখানে ঘরের মেঝের উপরে মানুষ বসে, সুতরাং যখন তারা চলে যায় তখন ঘরের আকাশে তারা কোনো বাধা রেখে যায় না। ঘরের একধারে মাদুর নেই, সেখানে পালিশ-করা কাষ্ঠখ- ঝক্ঝক্ করছে, সেইদিকের দেয়ালে একটি ছবি ঝুলছে, এবং সেই ছবির সামনে সেই তক্তাটির উপর একটি ফুলদানির উপরে ফুল সাজানো। ঐ যে ছবিটি আছে ওটা আড়ম্বরের জন্যে নয়, ওটা দেখাবার জন্যে। সেইজন্যে যাতে ওর গা ঘেঁষে কেউ না বসতে পারে, যাতে ওর সামনে যথেষ্ট পরিমাণে অব্যাহত অবকাশ থাকে, তারই ব্যবস্থা।” শুধু ঘরই নয় জাপানিদের সমগ্র ব্যবস্থা রবীন্দ্রনাথকে মুগ্ধ করেছিল। তাঁর কাছে মনে হয়েছিল এরা সৌন্দর্যপ্রিয় জাতি, কোথাও কোনো অলসতা বা অনাদর নেই। একেবারে পরিপূর্ণতার সাধনা করে তারা জীবনযাপন করে। নৃত্য, বাগান করা, ফুল সাজানো, চা তৈরি করাÑ সব কিছুতেই সাধনার নিষ্ঠা দেখেছেন তিনি। নৃত্য দেখে তাঁর মনে হয়েছে দেহভঙ্গির সঙ্গীত। তাঁর আরো মনে হয়েছে ভঙ্গিবৈচিত্র্যের পরস্পরের মাঝখানে কোনো ফাঁক নেই কিংবা কোথাও জোড়ের চিহ্ন দেখা যায় না; সমস্ত দেহ পুষ্পিত লতার মতো একসঙ্গে দুলতে দুলতে সৌন্দর্যের পুষ্পবৃষ্টি করছে। জাপানিদের নাচকে তিনি পরিপূর্ণ নাচ বলেছেন। তাঁর নিজের ভাষায়, “... সজ্জার মধ্যেও লেশমাত্র উলঙ্গতা নেই। অন্য দেশের নাচে দেহের সৌন্দর্যলীলান সঙ্গে দেহের লালসা মিশ্রিত। এখানে নাচের কোনো ভঙ্গির মধ্যে লালসার ইশারামাত্র দেখা গেল না। আমার কাছে তার প্রধান কারণ এই বোধ হয় যে, সৌন্দর্যপ্রিয়তা জাপানির মনে এমন সত্য যে তার মধ্যে কোনোরকমের মিশেল তাদের দরকার হয় না এবং সহ্য হয় না।” তবে, জাপানিদের গান সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ ঠিক সন্তুষ্ঠ হতে পারেননি। সে একশো বছর আগের কথা। এখন সে কথা খাঁটবে কি না জানি না। তিনি বলেছিলেনÑ “এদের সংগীতটা আমার মনে হল বড়ো বেশি দূর এগোয় নি। বোধ হয় চোখ আর কান, এই দুইয়ের উৎকর্ষ একসঙ্গে ঘটে না। মনের শক্তি¯্রােত যদি এর কোনো একটা রাস্তা দিয়ে অত্যন্ত বেশি আনাগোনা করে তা হলে অন্য রাস্তাটায় তার ধারা অগভীর হয়। ছবি জিনিসটা হচ্ছে অবনীর, গান জিনিসটা গগনের। অসীম যেখানে সীমার মধ্যে সেখানে ছবি, অসীম যেখানে সীমাহীনতায় সেখানে গান।” বাগান তাঁকে মুগ্ধ করেছিল সবচেয়ে বেশি। এদের বাগান দেখে তিনি বুঝতে পারেন বাগান জিনিসটা আসলে কী। এ সব বাগানের সৌন্দর্য এবং শান্তি তাকে আচ্ছন্ন করে। জাপানের রীতি-নীতি দেখে রবীন্দ্রনাথ মুগ্ধ হয়ে এদের রীতি-নীতি বাঙালিদের শিখে নিতে বলেছিলেন। তিনি বলেছিলেন এ সব শিওখ নিতে পারলে বাঙালিদের ঘরদুয়ার এবং ব্যবহার শুচি হত, সুন্দর হত, সংযত হত। জাপান এ সব ভারতবর্ষ থেকেই পেয়েছে, কিন্তু ভারতবর্ষ এ সব রীতি পালন করে না। এটাই রবীন্দ্রনাথের বড়ো লজ্জার ছিল। বাংলাদেশের শিল্পীদেরকে রবীন্দ্রনাথ জাপানে আহ্বান করেছিলেন জাপানিদের কাছে শিল্পকলার শিক্ষা গ্রহণ করার জন্য। বাঙালি এবং জাপানির মেলবন্ধনও রচনা করেছেন তিনি; বলেছেন, “ভারতবর্ষের মধ্যে বাঙালির সঙ্গে জাপানির এক জায়গায় যেন মিল আছে। আমাদের এই বৃহৎ দেশের মধ্যে বাঙালিই সব প্রথমে নূতনকে গ্রহণ করেছে, এবং এখনো নূতনকে গ্রহণ ও উদ্ভাবন করবার মতো তার চিত্তের নমনীয়তা আছে।” জাপানে রবীন্দ্রনাথের ঞযব ঘধঃরড়হ, ঞযব ঝঢ়রৎরঃ ড়ভ ঔধঢ়ধহ ভাষণের জন্য জাপান সরকার অসন্তুষ্ট হয়েছিল। দেশসুদ্ধ সরকারীভাবে তা ছড়িয়েও দেওয়া হয়েছিল। তবু সাধারণ মানুষ, শিল্পী-সাহিত্যিক ছিলেন তাঁর পাশে। তবে, তাঁর ভাষণ বৃথা যায়নি। জাপানিরা পরে হলেও এর যথার্থতা বুঝতে পেরেছিলেন। আনন্দের আরাধ্য কবি রবীন্দ্রনাথ জাপানের জাতিগত বোধ সম্পর্কে বলেছিলেন, “এ দেশে আসবামাত্র সকলের চেয়ে বড়ো বাণী যা কানে এসে পৌঁছায় সে হচ্ছে, “আমার ভালো লাগলো, আমি ভালোবাসলুম।” এই কথাটি দেশসুদ্ধ সকলের মনে উদয় হওয়া সহজ নয়, এবং সকলের বাণীতে প্রকাশ হওয়া আরো শক্ত। এখানে কিন্তু প্রকাশ হয়েছে। প্রত্যেক ছোটো জিনিসে, ছোটো ব্যবহারে সেই আনন্দের পরিচয় পাই। সেই আনন্দ ভোগের আনন্দ নয়, পূজার আনন্দ। সুন্দরের প্রতি এমন আন্তরিক সম্ভ্রম অন্য কোথাও দেখি নি।” জাপান দেখে রবীন্দ্রনাথ যেমন মুগ্ধ হয়েছিলেন, তেমনি জাপানিরা আজও মুগ্ধ রবন্দ্রিনাথের প্রতি। তাই গীতাঞ্জলি জাপানি ভাষায় এগারো বার অনুদিত হয়েছে। অধ্যাপক কাজুও আজুমার উদ্যোগে এবং ৎসুশো বিয়োদোর নেতৃত্বে শান্তিনিকেতনে ‘নিপ্পন ভবন’ প্রতিষ্ঠিত হয়। রবীন্দ্রনাথ এবং রবীন্দ্রসাহিত্যই বাংলাভাষা সম্পর্কে জাপানকে আগ্রহী করে। তারই ফলস্বরূপ জাপানের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক দৃঢ় হয়েছে।
×