ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

লিপি হালদার

একাকীত্ব জয়ে নারী

প্রকাশিত: ০৬:৫২, ২৪ জুন ২০১৬

একাকীত্ব জয়ে নারী

প্রত্যেক মানুষই নিজের ভেতরে একা বা শূন্যতা অনুভব করেন। এটি মানুষের একটি সাধারণ অনুভূতি হলেও কারও কারও ভেতরে এই শূন্যতা অস্বাভাবিকভাবে জেঁকে বসে। নাগরিক জীবনও দিনকে দিন মানুষকে যেন করে দিয়েছে আরও একা। সন্ত্রাস, ব্যক্তিস্বাধীনতার অগ্রযাত্রা পশ্চিমা দেশের মতো বাংলাদেশের জনজীবনেও এনে দিয়েছে অবিশ্বাস, সন্দেহ। আগে খুব সহজেই যেখানে একজন মানুষ, অপরজনকে বিশ্বাস করতেন, ঘরে নিয়ে আসতেন, একা অনুভব করলে আশপাশের বাড়িতে গিয়ে আড্ডা দিতেন, সেই সংস্কৃতি আজ যেন বিলীন হতে চলেছে। পরিবর্তে একক পরিবার এবং নিজে নিজের মতো থাকাই প্রাধান্য পেয়েছে। এমনকি নিজের ঘরে নিজের সন্তানও থাকতে চান একা, তার নিজের মতো। নিজের মতো একা একা থাকতে থাকতে, কোন না কোন সময় মানুষ হয়ে পড়ছে একা। কেউ সামলে নিচ্ছেন, কেউ হোঁচট খাচ্ছেন, কেউবা যন্ত্রণায় ভুগছেন। পশ্চিমা বিশ্বের স্বাস্থ্যসেবায় কাউন্সিলিং সহজতর হলে বাংলাদেশে এখনও তা অপ্রতুল। অবশ্য গ্রামে একাকীত্বের সমস্যা ততটা প্রকট নয় যতটা শহরে। বাংলাদেশের সমাজ যে স্রোতে এগোচ্ছে, অনেক আগেই বিলেতের সমাজে সেই একাকীত্বের জীবনের পা দিয়ে, একাকীত্ব জয় করবার চেষ্টা করেছে। এমন একা মানুষ সমগ্র উন্নত বিশ্ব জুড়েই চোখে পড়ে। বহু মানুষের ছেলে, মেয়েরাই যখন নিজেদের জীবন বেছে নেন, মা বাবা হয়ে পড়েন একা। উন্নত বিশ্বে পরিবার ভাঙ্গনের সংখ্যাও তুলনামূলক অনেক বেশি। আবার অনেকে একাকী জীবনকেই সঙ্গী করে পথ চলেছেন। আমার অনেক রোগিণীই বিভিন্ন বয়সের এবং অনেকেই একা। এর আগে ৯৩ বেডের বয়স্ক একটি কেন্দ্রে কাজ করতাম, সেখানেও বৃদ্ধ বয়সে মানুষ যারা বিভিন্ন কারণে একা। কাজের পাশাপাশি অধিকাংশের গল্প একটু একটু করে জানার চেষ্টায় শুনেছি, কিভাবে এই আশি নব্বই বছরেও এতো প্রাণ প্রাচুর্যে একাকীত্বকে জয় করছেন। একেক জনের গল্প একেক রকম হলেও একাকীত্ব কাটানোর গল্প প্রায় সবারই এক। অধিকাংশই নারীই এলাকার কোন না কোন হেলথ ক্লাবের সদস্য, পালাইটিস, ইয়োগা করেন অথবা জিম এ যান। পাশাপাশি টেনিস, ব্যাডমিন্টন খেলেন অথবা উল বুনে, বই পড়ে সময় কাটান। এছাড়াও সামাজিক বিভিন্ন কাজে অংশগ্রহণের মাধ্যমে নিজেকে নিয়োজিত রাখেন স্বউদ্যোগেই। সঙ্গে ঘুরে বেড়ান বন্ধু বান্ধবীর বাসায়, অথবা সমুদ্রে বা অন্য কোথাও, ম্যাসাজ নিয়ে শরীর এভাবেই নিজের জীবনকে খাপ খাইয়ে নিয়ে হেসে, গেয়ে, নেচে রং বেরঙের পোশাকে বাইরে ঘুরে বেড়াচ্ছেন একাকী সব মানুষেরা। পারকিনসন রোগে যাদের হাত পা একটু একটু কাঁপছে তারাও নিজেরা গাড়ি চালিয়ে এসে চিকিৎসা নিয়ে যাচ্ছেন হাসি খুশি ভাবে। একাকী জীবনকে ভয় না পেয়ে সহজভাবে, সাবলীল গতিতে এগিয়ে যাচ্ছেন সামনের দিকে। এদেরকে যত দেখি তত নিজের কাজ নিজে করার সাহসিকতার সঙ্গে সঙ্গে, নিজেকে ব্যস্ত রেখে একাকীত্ব জয় করার বিভিন্ন পন্থা খুঁজে পাই একেক জনের জীবনে। বাংলাদেশের সামাজিক প্রেক্ষাপটে একাকীত্বকে জয় করা সহজ কাজ না হলেও, অসম্ভব নয়। চাই আগ্রহ এবং ইচ্ছাশক্তি। যাদের একটু সামর্থ্য আছে তারা বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক কাজে, সংগঠনে যুক্ত হতে পারেন। দেশেও এখন ম্যাসাজ পার্লার, জিম রয়েছে সেখানে সপ্তাহে, মাসে একবার যেতে পারেন। ছবি, গানের অনুষ্ঠান, এক্সিবিশন, খেলা, নাটকসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যোগ দিতে পারেন। যারা একাকীত্বে ভোগেন তারা সাধারণত অন্যদেরকে এড়িয়ে চলে নিভৃতে থাকতে চান। এই অবস্থা থেকে নিজেকেই বের করে আনতে হবে এবং নতুন নতুন সংযোগ সম্পর্ক গড়ে তোলাতে গুরুত্ব দিতে হবে। ঘরোয়া অনেক গানের আসর, সাহিত্য আড্ডার আসর খুঁজে নিতে পারেন। সামাজিক মাধ্যম যেমন ফেসবুকও একাকীত্ব¡ কাটিয়ে উঠতে একটি ভাল ভূমিকা পালন করে। তবে যে কারণে আপনি একাকীত্ব অনুভব করছেন সেই কারণ খুঁজে বের করে সেই চিন্তাকে নিরুৎসাহিত করে, এগিয়ে যাবার আত্মবিশ্বাস বাড়াতে হবে। অন্যের সঙ্গে তুলনা করা কমিয়ে আনতে হবে, একই সঙ্গে নিজের অবস্থানে থেকেই সন্তুষ্টি খুঁজে বের করতে হবে। অন্যেরা কিভাবে একাকীত্বকে জয় করছে সে বিষয়ে পড়াশোনা, তথ্য সংগ্রহ একটি ভাল ভূমিকা রাখতে পারে একাকীত্বকে কাটিয়ে উঠতে। বাংলার নারীর জীবন বহু ঘাত প্রতিঘাতের, বহু সংগ্রামের। সেই সংগ্রামের জীবন পাড়ি দিয়ে যে নারী নয় মাস গর্ভ ধারণের পরে যন্ত্রণায় জন্ম দিতে একটি নবজাতক শিশুর একটি নতুন প্রাণের, একাকীত্বের শিকল ভেঙ্গে সেই নারী এগিয়ে যাবে এটাই প্রত্যাশার, সেটাই স্বাভাবিক। প্রত্যেকের জীবন অমূল্য তাই অন্যের জীবনে বিনিয়োগ না করে, নিজের জীবনে বিনিয়োগ করুন, নিজের প্রতি যতœশীল হোন।
×