ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

এ্যাড. দেবাহুতি চক্রবর্তী

মাহফুজা খাতুন স্বপ্না ॥ অপরাজিতা এক নারী

প্রকাশিত: ০৬:৫১, ২৪ জুন ২০১৬

মাহফুজা খাতুন স্বপ্না ॥ অপরাজিতা এক নারী

জীবনে জয় পরাজয়ের হিসাবটা অনেকটাই আপেক্ষিক। তেমনি আপেক্ষিক সাধারণ-অসাধারণ বিচারের মাপকাঠি। মাহফুজা খাতুন স্বপ্নার চেহারা, বেশভূষা, চলন-বলন, নিত্যদিনের জীবনযাপন কোন ক্ষেত্রেই বাড়তি কোন বিশেষত্ব নেই। অর্থাৎ আপাত দৃষ্টিতে নিতান্তই সাধারণ। কিন্তু সাধারণ এই নারীর মন মানসিকতা যে কতটা অসাধারণ তা তার কাছে না এলে, তার সম্পর্কে না জানলে বুঝা সম্ভব নয়। স্বপ্না কর্মজীবনে রাজবাড়ী জেলার পাংশা উপজেলার পাইলট উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। তিরিশোর্ধ বছর এই বিদ্যালয়ে। এক সময় এলএলবি পাস করে আইনজীবী জীবন সঙ্গীর সঙ্গে কর্মক্ষেত্রে ও পাশাপাশি থাকার ইচ্ছে হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত পারেননি। নিজের তিন সন্তানের মতোই বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা তার এতোই আপন যে তাদের মায়া কাটানো সম্ভব হয়নি। বিদ্যালয়ের সবুজ চত্বরে চারপাশে ফল আর ফুলের বাগান করানো, নিজে সেই বাগানের পরিচর্যা করা স্বপ্নার দারুণ শখের বিষয়। এখন আর সেভাবে পারে না। শুধু ফুল আর ফলের যে গাছগুলো বৃক্ষ হিসেবে পরিচিত হয়েছে, সেই গাছগুলোর দিক তাকিয়ে ভাবে ওই সব সবুজ পাতার আন্দোলনে ওর নিজের অস্তিত্ব চিরদিন জড়ানো থাকবে। যখনই ওর কাছে গেছি, কনকচাঁপার আগডালে ফুটে থাকা ফুল পাড়িয়ে মুঠো ভরে উপহার দিয়েছে। কনকচাঁপার মিষ্টি সুগন্ধ নিতে নিতে ভেবেছি ফুলের মতই সজীব স্বপ্নার মনের কোরক। স্বপ্নার কাছে আসা-যাওয়ার সূত্রটা ছিল সাংগাঠনিক। দুজনেই আমরা বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সঙ্গে সম্পর্কিত। স্বপ্না দীর্ঘ সময় ধরে পাংশা উপজেলায় সংগঠনের মুখ্য ভূমিকবায় রয়েছেন। সদা হাসিখুশি ফুলের মতো কোমল এই মানুষটি আবার নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে নারীর মানবাধিকার আন্দোলন, অসাম্প্রদায়িক-গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়ার সংগ্রামে ঘরে-বাইরে অত্যন্ত কঠিন বলিষ্ঠ পদক্ষেপে সংগঠনকে উজ্জীবিত করেছেন। আপন গতিতে স্বপ্নার স্বচ্ছন্দ চলায় ধাক্কা আসে ২০০৯ সালে। প্রথমে ব্রেস্ট ক্যান্সার, এরপর ইউট্রাস-ওভারি, বর্তমানে লাং ক্যান্সারে ভুগছেন। কয়েক দফা অপারেশন থেরাপির পর থেরাপি এখন যেন আর কোন কিছুই তেমনভাবে কাজ করছে না। কথা বলতে খুব কষ্ট হয় স্বপ্নার। দীর্ঘ সাত-আট বছর এই লড়াইয়ে একবার সিঙ্গাপুর ছিলেন, বাকি চিকিৎসা ঢাকাতেই চলছে। আনুমানিক হিসাবে ন্যূনতম দেড় কোটি খরচ ইতোমধ্যেই পেরিয়েছে। এককভাবে এই ব্যয় বহন কোনদিন সম্ভব ছিল না। ছেলেমেয়েদের উচ্চশিক্ষার সময় পরিবারের অন্যান্য খরচ স্বপ্না আর তার স্বামীর জন্যে সামলিয়ে অসম্ভবই ছিল বলতে হয়। কিন্তু স্বপ্নার পরিবার-পরিজন, আত্মীয়স্বজন, বিশেষ করে স্বপ্নার বন্ধুরা স্বপ্নার পাশে দাঁড়িয়েই আছে শর্তহীনভাবে। ২০১৩ সালের শেষ দিক আমি সাত মাস মুম্বাই টাটা মেমোরিয়াল ক্যান্সার হাসপাতাল থেকে চিকিৎসা নিয়ে দেশে ফিরি। স্বপ্নার ফুসফুস তখনই আক্রান্ত। শরীর ভাল নয়। তবু স্বপ্না আমাকে দেখতে আসেন। ‘সঙ্গে দুটো প্রশ্ন। প্রশ্নগুলো চিকিৎসাধীন অবস্থায় আমাকেও তাড়া করেছে। সঙ্গে ক্যান্সার, ক্যান্সারের সঙ্গে’ বইটায় আমি বিষয়টা উল্লেখ করার চেষ্টা করেছি। স্বপ্নার প্রশ্ন সরাসরি এক, আমাদের মতো শিক্ষিত মেয়েরা ও ক্যান্সারের আক্রমণ সম্পর্কে প্রথমেই সজাগ হতে পারি না কেন? দুই, সাধারণ পরিবারে পাশে দাঁড়ানোর যাদের কেউ নেই তার এই বিশাল ব্যয়ভার বহন করতে না পেরে শুধুই কি ভাগ্যের হাতে নিজেকে সমর্পণ করবে? দুজনে প্রশ্ন দুটো নিয়ে অনেকটা সময় আলোচনা করি। স্বপ্না শুধু আলোচনায় থেমে গেলেন না। নিজ সাধ্যমতো ‘আপন বুকের পাঁজর জ্বালিয়ে’ মাঠে নামলেন। সঙ্গে সংগঠনের কিছু প্রিয় সহকর্মী। পাংশা উপজেলার বিভিন্ন প্রান্তে তৃণমূলে নারী পুরুষদের নিয়ে সভা বা উঠানবৈঠক শুরু“হলো। বিশটির মতো অনুষ্ঠান ইতোমধ্যে হয়েছে। ক্যান্সার সম্পর্কে সাধারণের বিশেষত নারীদের সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে। স্বপ্নার অনুরোধে স্থানীয় চিকিৎসকরাও এই মহান কাজে সামিল হয়েছেন। ব্যক্তি অভিজ্ঞতা বর্ণনা ছাড়াও পাশাপাশি প্রচারপত্র তৈরি করে হাতে হাতে বিলি করছেন। এ সবই স্বপ্নার একক উদ্যোগের সঙ্গে সংগঠনের সহযোগিদের নিজস্ব খরচে ও আন্তরিকতায় সম্পন্ন হচ্ছে। ক্যান্সার সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টির উদ্যোগ বিশেষত আমাদের প্রান্তিক এলাকায় নিঃসন্দেহে একটা বড় কাজ। পাশাপাশি আরও একটা উদ্যোগ নিয়ে স্বপ্না নীরবে কাজ করে যাচ্ছে। নিজেদের মাঝ থেকে অর্থ তুলে সাধ্যমতো ক্যান্সার আক্রান্ত সংগঠনের সদস্য নারী বা তার পরিবারের সহায়তা করা। নিজের কথা তুললেই বলে, ‘আমার জন্য তো অনেকে ভাবছেÑ আমার ভাবনাটা না হয় অন্যদের জন্যেই তোলা থাক।’ এখন ভাবনার ক্ষেত্রটা আরও বড় হয়েছে। সংগঠনের সদস্যদের কেউ কোন কঠিন ব্যাধিতে আক্রান্ত হলে তাৎক্ষণিক সহায়তার জন্য একটা স্থায়ী ফান্ড গঠনের দরকার। ওর এই উদ্যোগ কতটা সফল হবে বা হবে না, সেটা প্রশ্ন নয় সংগঠনের বিভিন্ন ধারাবাহিক কাজের সঙ্গে সঙ্গে এই সমাজকল্যাণমূলক কাজের তাগিদটা স্বপ্নার আন্তরিক উপলব্ধিজাত। যে ভগ্ন শরীর নিয়ে সঙ্গীদের উদ্বুদ্ধ করে তিনি কাজ করে যাচ্ছেন তার পরিধির বিস্তৃতিটা দেখার নয়, গভীরতাই পরিমাপের। স্বপ্নার এই উপলব্ধির উৎসে রয়েছে আরও একটি ব্যাখ্যা- স্বাস্থ্যসেবার ক্ষেত্রে আমাদের রাষ্ট্রের দায়িত্ব নেই বললেই চলে। বিত্তশালী ক্ষমতাধর পেশাজীবী সমাজসেবীরা প্রচার সংস্কৃতির বিশাল বাজারে সেখানেই এগিয়ে আসে যেখানে মহানুভবতা দেখানো তাদের কোন না কোন মূলধন হিসেবে প্রসারিত হয়। বিভিন্ন রাজনৈতিক বা তথাকথিত বড় বড় পেশাজীবী সংগঠনে ও একজন সাধারণ সদস্যকর্মী বা সংগঠকের আদর বা কদর ততক্ষণই, যতক্ষণ তাকে কাজে লাগে। সামাজিক বা সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোর অবস্থাও অনেকটা একই রকম। মুখে বলা হয়, সংগঠনের সবাই এক পরিবারভুক্ত। বাস্তব চিত্রটা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই শুধুই আনুষ্ঠানিক। দীর্ঘমেয়াদী বা ব্যয়বহুল চিকিৎসার সব খরচ বহন সম্ভবপর নয়। কিন্তু সাধ্যমতো পাশে দাঁড়ানোর আন্তরিকতাটুকু না থাকলে ‘সকলের তরে সকলে আমরা; প্রত্যেকে আমরা পরের তরে’ কথাটা বলা যায় কী? এক্ষেত্রে ওর মতে শ্রমজীবী সংগঠনের সদস্যরা তুলনামূলকভাবে মানবিক। স্বপ্নার সঙ্গে এসব ক্ষেত্রে যুক্তিতে কখনই পেরে উঠেনি। বিস্ময় ভরা দৃষ্টিতে দেখি, শারীরিক যন্ত্রণা উপেক্ষা করে নিজের জন্যে নয়, পরিবারের জন্য নয়, শুধু সমাজের জন্যে কতটা সেবামূলক কাজ একজন করতে পারে। মনে মনে অনুভব করি, পারে, তখনই যখন সে সত্যিকার অর্থে মানবিক। স্বপ্নার আর একটা বড় কৃতিত্ব তার এই সামাজিক মানবিক মূল্যবোধ সংগঠনের অন্তত কয়েকজনের মাঝে সঞ্চারিত করতে পেরেছেন। সম্প্রতি ঢাকার একটি সেবামূলক সংস্থা স্বপ্নাকে আনুষ্ঠানিক সম্মাননা দিয়েছে। সেই মঞ্চেও স্বপ্না একা ওঠেননি। সঙ্গে নিয়েছেন তার কাজের নিত্য সহযোগী বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ পাংশা উপজেলার সভাপতি সাহিদা রহমান আর তাহমিনা কাকলীকে। একা কোন বড় কাজ করা যায় না; এ তার অভিজ্ঞতা; তার বিশ্বাস। সংগঠনের ধারাবাহিক কাজের পাশাপাশি মিলিতভাবেই স্বপ্নার উদ্যোগে, নেতৃত্বে নীরবে নিভৃতে একটা সুন্দর সেবামূলক কাজের ধারা এই এলাকায় তৈরি হয়েছে। নিজের যন্ত্রণা নিয়ে বিব্রত না থেকে সদা হাস্যোজ্জ্বল এই নারী নিঃশব্দে মানুষের জন্যে কাজ করে যাচ্ছেন। মানুষের সেবায় আসতে পারাই তার আনন্দ। আমার কাছে স্বপ্না পেশাগত জীবনেই শুধু শিক্ষক নন। এই অচেতন, অর্ধচেতন সমাজের জন্যে তার জীবনবোধ, মানবিকবোধ নিয়ে সকলের জন্যে এক অনুসরণীয় মহৎ শিক্ষকও বটে। দিন ক্রমশই সংক্ষিপ্ত হয়ে আসছে। ক্যান্সারের কাছে জয়-পরাজয়ের হিসাবটা এখন শুধু সময়ের হাতে তোলা। ক্যান্সারে কারও মৃত্যুর খবর স্বপ্নাকে এখন খুব উদ্বিগ্ন করে, আতঙ্কিত করে। জীবনে অনেক কাজ যে এখনও বাকি। সব কাজ কোনদিনই শেষ হবে না। স্বপ্নার স্বপ্ন পূরণের দায় অন্যদের থেকেই যাবে। সে দায় আমরা কে কতটুকু বহন করব আদৌ করব কিনা জানি না। বাজার সংস্কৃতির এই রমরমা যুগে আজকাল অনেক আশা, বিশ্বাসকেই ভঙ্গুর মনে হয়। আজ তাই শুধু তার জীবনের সদা কম্পমান শিখার দিকে তাকিয়ে বলি, মাহফুজা খানম স্বপ্নার উদ্দেশ্যেই বলি, তুমি আমার শুধু ভালবাসার নিকটজন নও, আমার একান্ত শ্রদ্ধার মানুষও বটে। তোমার জন্যে আমার শেষ চাওয়া এটুকুই- ‘দিন অন্তে অপরাজিত চিত্তে,/মৃত্যুতরণ তীর্থে কর স্নান।’
×