ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

বেনাপোল দিয়ে কাপড় আমদানি শূন্যের কোটায় নেমে এসেছে

প্রকাশিত: ০৪:১৩, ২৪ জুন ২০১৬

বেনাপোল দিয়ে কাপড় আমদানি শূন্যের কোটায় নেমে এসেছে

আবুল হোসেন, বেনাপোল থেকে ॥ দেশের প্রধান স্থলবন্দর বেনাপোল দিয়ে ভারত থেকে কাপড় জাতীয় পণ্য আসা শূন্যের কোঠায় নেমে এসেছে। এর ফলে যে দেশী কাপড় শিল্প বিকশিত হচ্ছে, তা নয়। বরং আমদানিকারকরা নানা ধরনের সুবিধা পাওয়ায় চলে গেছেন অন্য বন্দরে। আবার অনেক ব্যবসায়ী চোরাচালান সিন্ডিকেটের সঙ্গে যোগসাজশে চোরাই পথে আসা পণ্য বিক্রি করছেন। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, গত একমাসে বেনাপোল স্থলবন্দর দিয়ে মাত্র দশ কনসাইনমেন্ট কাপড় জাতীয় পণ্য ভারত থেকে আমদানি হয়েছে। বেনাপোল কাস্টমস হাউজ কর্তৃপক্ষ আমদানিকৃত পণ্য চালানের অতিরিক্ত মূল্যে শুল্কায়ন ও জরিমানা আদায় করার ফলে এ জাতীয় পণ্য অন্য বন্দরে চলে গেছে। এছাড়া আমদানির ঝামেলা এড়িয়ে চোরাই পথে ঘরে বসে পণ্য পাওয়ায় অসাধু ব্যবসায়ীদের অনেকেই চোরাচালানের দিকে ঝুঁকছেন। গত আটমাসে (অক্টোবর ১৫ থেকে মে ১৬) বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) যশোরের ২৬ ব্যাটালিয়ন সদস্যরা চোরাই পথে আসা ১৮ হাজার ৮৯২ পিস শাড়ি, ১২ হাজার ৮৪৩টি থ্রিপিস, ৪০ হাজার ৯৪৯ পিস তৈরি পোশাক, পাঁচ হাজার ৭৫৮ মিটার থান কাপড়, ৩৫০টি নাইট ড্রেস, ৩৫টি লেহেঙ্গা, ৪৮টি পাঞ্জাবি আটক করেছেন। ব্যবসায়ীদের অনেকেই যে চোরাচালানের দিকে ঝুঁকছেন, এ তথ্য তার প্রমাণ দিচ্ছে। কাস্টমস, আমদানিকারক, সিএ্যান্ডএফ এজেন্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ঈদকে সামনে রেখে যশোরসহ দেশের সীমান্ত অঞ্চল দিয়ে শাড়ি, থ্রিপিস, থান কাপড়ের চোরাচালান বেড়ে গেছে। একটি সূত্র জানায়, এক ট্রাকে ৯০ বেল শাড়ি, থ্রি পিস থাকে। ৯০ বেল কাপড়ের দাম এক কোটি টাকার কিছু কম বা বেশি। আর এ পণ্যের আমদানি শুল্ক ৩০ থেকে ৪০ লাখ টাকা। কলকাতা থেকে বৈধভাবে ওই পণ্য আমদানি করতে প্রায় একমাস লেগে যায়। তাছাড়া বৈধ পথে আমদানি করলেও কাস্টমস কর্তৃপক্ষ এসব পণ্যের উচ্চমূল্য দিয়ে শুল্কায়ন করায় পণ্যের মূল্য দ্বিগুণ হয়ে যায়। কিন্তু চোরাচালান সিন্ডিকেট মাত্র দশ লাখ টাকা খরচ করে ওই পণ্য কলকাতা থেকে বাংলাদেশের নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছে দেয়। আর এক্ষেত্রে সময় লাগে মাত্র তিন থেকে চারদিন। সূত্র জানায়, চোরাচালান সিন্ডিকেটগুলো বাকিতেও পণ্য সরবরাহ করে। গুদাম ঘরে পণ্য পৌঁছে দেয়ার পর টাকা পরিশোধ করলেই হলো। এছাড়া ভারতীয় মহাজনরাও বাকিতে কোটি কোটি টাকার শাড়ি, থ্রিপিস সরবরাহ করছে। এমন অবস্থায় বৈধভাবে যারা ব্যবসা করতে চান, তারা পড়েছেন বিপাকে। সূত্র জানায়, আগে বেনাপোল কাস্টমসে আমদানিকৃত বিভিন্ন পণ্যের মধ্যে শাড়ি, থ্রিপিস, লেহেঙ্গা, ওড়না এবং নানা ধরনের কাপড় (ফেবিক্স) জাতীয় পণ্য আসতো শত শত কনসাইনমেন্ট। অন্যান্য আমদানিকৃত পণ্যের পরীক্ষণ ও শুল্কায়নে বিলম্ব হলেও বিশেষ ব্যবস্থায় এ জাতীয় পণ্যের পরীক্ষণ ও শুল্কায়ন প্রক্রিয়া খুব দ্রুততার মধ্যে সম্পন্ন করে তা খালাস দেয়া হতো। আর এ কাজটি করতেন হাতেগোনা কয়েকজন সিএ্যান্ডএফ এজেন্ট। কাস্টম হাউসের বর্তমান কমিশনার এএফএম আব্দুল্লাহ, অতিরিক্ত কমিশনার ফিরোজ উদ্দিন ও যুগ্ম কমিশনার মোস্তাফিজুর রহমানের তৎপরতায় এখন কোন আমদানিকারক ও সিএ্যান্ডএফ এজেন্ট সেই সুবিধা পান না। ফলে তারা চলে গেছেন অন্য বন্দরে। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বর্তমানে বেনাপোল কাস্টম হাউসে প্রতিপিস নিম্নমানের শাড়ি শুল্কায়ন হচ্ছে সাড়ে চার মার্কিন ডলারে। আর উন্নতমানের শাড়ির শুল্কায়ন হচ্ছে ১৮ মার্কিন ডলারে। এরপর কাস্টমস খরচ, বন্দর চার্জ, ট্রাক ভাড়া, সিএ্যান্ডএফ কমিশনসহ আরও ২৫০ টাকা যোগ হয়ে একপিস শাড়ির মূল্য দাঁড়ায় এক হাজার ৯০ থেকে তিন হাজার ৬০০ টাকা। অনুরূপভাবে প্রতিপিস থ্রিপিসের শুল্কায়ন মূল্য তিন থেকে পাঁচ মার্কিন ডলারে। যা বাংলাদেশী টাকায় ২৪০ থেকে ৪০২ টাকা। আনুসঙ্গিক খরচ দিয়ে একটি থ্রিপিসের মূল্য দাঁড়ায় ৬৫০ থেকে এক হাজার ৫০ টাকা। থান কাপড় শুল্কায়ন হচ্ছে প্রতিকেজি ২.৪৫ মার্কিন ডলার থেকে ৫.১৫ মার্কিন ডলারে। যা বাংলাদেশী মুদ্রায় ১৯৫ থেকে ৪১০ টাকা। শুল্ক, কাস্টমস খরচ, বন্দর চার্জ, ট্রাক ভাড়া, সিএ্যান্ডএফ কমিশনসহ প্রতিকেজি থান কাপড়ের মূল্য দাঁড়ায় ৪০০ থেকে ৮৫০ টাকা। এসব শুল্কায়ন করা হয় নিম্ন, মধ্যম ও উন্নতমানের ক্যাটাগরিতে। দফায় দফায় শুল্কমূল্য বাড়ানোর কারণে ২০১৫ সালের এপ্রিল থেকে বেনাপোল বন্দর দিয়ে এ জাতীয় পণ্য আসা কমে যায় বলে জানান কাস্টমসের একজন কর্মকর্তা। বেনাপোল সিএ্যান্ডএফ এজেন্ট এ্যাসোসিয়েশনের সিনিয়র সহ-সভাপতি আলহাজ নূরুজ্জামান জানান, বেনাপোল স্থলবন্দর দিয়ে যেসব পণ্য ইতিপূর্বে বৈধভাবে আমদানি হয়ে আসতো বর্তমানে সেসব পণ্য চোরাপথে আসছে। আমদানিকৃত পণ্য চালানের ওপর বেনাপোল কাস্টমস কর্তৃপক্ষ অতিরিক্ত লোড চাপানোর ফলে ব্যবসায়ীরা এখন বৈধ পথে না গিয়ে অবৈধ পথে মালামাল আমদানি করছে। বিজিবির কর্মকর্তারা আরও বলেন, বেনাপোল কাস্টম হাউস থেকে শাড়ি, থ্রিপিস, থান কাপড়, ইমিটেশন, মোটর পার্টস যে মূল্যে শুল্কায়ন করা হয় তা অনেক কম। এ ব্যাপারে যোগাযোগ করা হলে বেনাপোল কাস্টম কমিশনার এএফএম আব্দুল্লাহ খান বলেন, ‘আমি এখানে যোগ দেয়ার পর থেকে এ জাতীয় পণ্য আসা ৯০ ভাগ কমে গেছে। সেটা কি কারণে কমেছে তা বলতে পারব না। তবে বর্তমানে যে সামান্য পণ্য (এ জাতীয়) আসছে সেগুলো স্পেশাল এ্যাসাইনমেন্ট গ্রুপ (স্যাগ) দিয়ে একজন সহকারী কমিশনারের নেতৃত্বে পরীক্ষা করে পণ্য চালান শুল্কায়ন করা হয়। অন্যান্য কাস্টম হাউস ও শুল্ক স্টেশন থেকে আমরা উচ্চমূল্যে শুল্কায়ন করে থাকি। পণ্য চালানে কোন অনিয়ম হলে আমরা জরিমানা আদায় করে পণ্য চালান খালাস দিয়ে থাকি। তিনি বলেন, ‘শুল্ক ফাঁকির ঘটনা ধরতে পারলে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়ে থাকি। যার মধ্যে রয়েছে লাইসেন্স বাতিল, মামলা, অর্থদ-সহ বিভিন্ন শাস্তিমূলক ব্যবস্থা।’
×