ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

ড. আবদুল মান্নান চৌধুরী

জাহানারা ইমাম এবং নির্মূল কমিটির পথচলা

প্রকাশিত: ০৩:৫৩, ২৪ জুন ২০১৬

জাহানারা ইমাম এবং নির্মূল কমিটির পথচলা

জাহানারা ইমামের অনেক পরিচয়ের মাঝে একটি পরিচয় তিনি মুক্তিযুদ্ধে শহীদ রুমীর মা এবং সেই সুবাদে মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে মা বলে পরিচিত। তবে তার বড় পরিচয় ও কৃতিত্ব হচ্ছে তিনি দুরারোগ্য ব্যাধি ক্যান্সার দেহে বহন করে ৬৩ বছর বয়সেও মুক্তিযুদ্ধের ঘাতক দালাল যুদ্ধাপরাধী অর্থাৎ সামগ্রিক বিচারে মানবতাবিরোধীদের বিচার দাবিতে এক অনন্য আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। গণআদালত গঠন করে ঘাতক শিরোমণি গোলাম আযমের প্রতীকী বিচারের চেয়ারপার্সনের দায়িত্ব পালন করেন তিনি। গণআদালত সংগঠনের পর তিনি ও তার সহকর্মীরা রায় কার্যকর করার জন্য দেশে-বিদেশে দুর্বার আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন। অন্যান্য যুদ্ধপরাধীকে চিহ্নিতকরণ ও বিচারের স্বপ্ন নিয়ে তিনি গণতদন্ত কমিশনও গঠন করেন। সেই লক্ষ্যে ১০১ নাগরিকের সমন্বয়ে গঠিত ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির আহ্বায়কের দায়িত্ব নিয়েছিলেন। এই কমিটিতে দেশের বরেণ্য নাগরিক, শিক্ষাবিদ, সাংবাদিক, সাহিত্যিক, আইনজীবী, অবসরপ্রাপ্ত বিচারক, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, ছাত্রনেতা, আলেম ওলামা, নারী, যুব ও সাংস্কৃতিক কর্মীরা যুক্ত হলেও তিনি কোন রাজনৈতিক দলের নেতাদের এর সঙ্গে সম্পৃক্ত করেননি। এমনকি সংগঠনের নাম ’৭১ এর ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি রেখে তাতে বঙ্গবন্ধুসহ অন্যান্য বরেণ্য নেতা ও মুক্তিযোদ্ধা হত্যার বিচারের অবকাশ রাখেননি। তার দিক চক্রবাল ছিল সন্নিকটে অর্থাৎ তার প্রধান লক্ষ্য ছিল জীবদ্দশায় কিছু ঘাতকের প্রতীকী বিচার সম্পন্ন করা এবং তার বাস্তবায়ন স্বচক্ষে দেখে যাওয়া। তার নেতৃত্বে ঘাতক নির্মূলের কার্যক্রমের সূচনা হলেও সেই ১৯৯২ সালের জানুয়ারি মাসে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী চক্র প্রতিরোধ মঞ্চ নামে আর একটি সংগঠনের আবির্ভাব ঘটে। মুক্তিযোদ্ধা সংসদের বিদ্রোহী অংশ আহাদ-আজিজের নেতৃত্বে এবং আবদুর রাজ্জাক, কাজী আরেফ, আবদুল মান্নান চৌধুরী ও নুরুল ইসলাম নাহিদের পৃষ্ঠপোষকতায় এই কমিটিতে মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের সব রাজনৈতিক দল ও তাদের অঙ্গ ছাত্র, নারী, যুব ও সাংস্কৃতিক সংগঠন, ধর্মীয় সংগঠন, সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংগঠন এর সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে যায়। দুটো ধারার কার্যক্রম সমান্তরাল চলার এক পর্যায়ে এরশাদবিরোধী আন্দোলনের ছাত্র নেতারা দুটো ধারাকে একত্র করে ঘাতকবিরোধী আন্দোলনকে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনে রূপ দিতে একটি মোর্চা গঠনের সিদ্ধান্ত নেন। ইত্যবসরে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী চক্র প্রতিরোধ মঞ্চের নতুন নামকরণ করা হয় মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন কমিটি ও তার আহ্বায়ক রাখা হয় অধ্যক্ষ আহাদ চৌধুরীকে। একটি সমন্বয় কমিটি আসন্ন জেনে আমি দুটো কমিটি মিলিয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন ও ’৭১-এর ঘাতক দালাল নির্মূল জাতীয় সমন্বয় কমিটি সংক্ষেপে জাতীয় সমন্বয় কমিটি নামকরণের প্রস্তাব করি। এই প্রস্তাব গৃহীত হওয়ার পরই ১৯৯২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি জাহানারা ইমামকে আহ্বায়ক করে ঐক্য কমিটি গঠিত হলেও জাতীয় সমন্বয় কমিটির পূর্ণাঙ্গ কমিটি ১৪ ফেব্রুয়ারি গঠিত হয়। জাতীয় সমন্বয় কমিটির ৭ সদস্যের স্টিয়ারিং কমিটি গঠিত হলে সেখানে জাহানারা ইমাম, সৈয়দ হাসান ইমাম, আমি ছাড়াও আবদুর রাজ্জাক, কাজী আরেফ, আহাদ চৌধুরী ও নুরুল ইসলাম নাহিদ পরিস্থিতির কারণে এবং ভবিষ্যত চিন্তা নিয়ে স্টিয়ারিং কমিটিতে স্থান করে নেন। তারপরই জাতীয় সমন্বয় কমিটিতে ঢাকা মহানগর শাখা গঠিত হলে যেখানে আহ্বায়ক হলেন আওয়ামী লীগের মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া ও সদস্য সচিব হলেন সাবেক ছাত্রলীগ নেতা মনিরুল হক মনি। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন কমিটির আহ্বায়কও নির্বাচিত হলেন মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া এবং সদস্য সচিব জাসদের আমিনুল হক মন্টু। কেন্দ্রীয় কমিটি, স্টিয়ারিং কমিটি, ঢাকা নগর কমিটি গঠনের পর জাতীয় সমন্বয় কমিটির সাংগঠনিক কাঠামো সম্পর্কে সবাই একটি ধারণা পেয়ে গেল। পূর্বে গঠিত কমিটিগুলো পুনর্গঠিত হলো এবং আদলটা কেন্দ্রীয় আদলে। এই আন্দোলনে স্বল্প সময়ে ১৩৩৮টি কমিটি গঠিত হয়েছিল। দেশের সীমানা ছাড়িয়ে বিদেশেও একই আদলে কমিটি হতে লাগল। নির্মূল কমিটির অনিচ্ছা সত্ত্বে¡ও বলতে গেলে প্রতিটি কমিটির আহ্বায়ক বা সদস্য-সচিব হলেন আওয়ামী লীগের কেউ কিংবা কাজী আরেফের কোন জাসদ নেতা, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট, কমিউনিস্ট পার্টি, মুক্তিযোদ্ধা বা উদীচীর কোন নেতা অর্থাৎ ক্রমেই আন্দোলনটা রাজনীতির রং লেগে গেল। এই বিষয়টা সদস্য সচিব হিসেবে আমি, আবদুর রাজ্জাক ও কাজী আরেফ সমর্থন করলাম এবং তারা পৃথক ও সংবলিতভাবে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের পাশাপাশি ইনডেমনিটি বাতিল আন্দোলনে শেখ হাসিনার সঙ্গে থাকবেন বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। ইতোপূর্বে গোলাম আযমসহ যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে সমর্থন জানিয়ে সংসদের বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনা ৯৯ জন সদস্য নিয়ে সংসদের ভেতরে ও বাইরে তোলপাড় ফেলে দিলেন। জাতীয় সমন্বয় কমিটির কাঠামোগত বিন্যাসের কারণে এবং জাহানারা ইমামের দৃঢ়তা ও কৌশলী নেতৃত্বের কারণে আন্দোলনে বাঁধ ভাঙ্গা জোয়ার সৃষ্টি হলো, প্রতিরোধও সৃষ্টি হলো। জাহানারা ইমামের দৃঢ়তা, স্টিয়ারিং কমিটি সদস্যের দ্ব্যর্থহীন সমর্থন ও শেখ হাসিনার লাশের দায়িত্ব নেয়ার পর গণআদালত অনুষ্ঠানের কার্যক্রম শেষপর্যন্ত বলবত রইল। খালেদা জিয়া সরকারের প্রচ- ভয়ভীতির মাঝেও শেখ হাসিনার ভরসায় আন্দোলনে দৃঢ়তা বজায় রইল। গণআদালতের সফলতা আন্দোলনকারীদের মনোবল এমন চাঙ্গা করে যে সারাদেশ এমনকি বিশ্বের বাংলাভাষী অধ্যয়িত এলাকায় এই আন্দোলন স্বল্প সময়ে বিস্তৃতি লাভ করে। গণআদালতের পরেই বিএনপি সরকার তার আসল চেহারা নিয়ে আবির্ভূত হয়। গণআদালতের উদ্যোক্তাদের প্রতিহত করতে তাদের উদ্যোক্তা কিংবা পৃষ্ঠপোষকতায় ভারতীয় দালাল প্রতিরোধ কমিটি, যুবকমান্ড, কতল বাহিনী গঠন এবং রাজাকার, আলবদর ও আলশামস বাহিনী পুনর্জীবিত ও পুনর্গঠন করা হয়। ২৬ এপ্রিল ১৯৯২ সালে জাহানারা ইমাম গোলাম আযমের বিরুদ্ধে রায় কার্যকর করাসহ চার দফা আন্দোলনের কর্মসূচী পেশ করেন। এই চার দফার ভিত্তিতে দেশের প্রতিটি অঞ্চলে এবং বিদেশে বিশেষত আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর নেতৃত্বে তীব্র আন্দোলন গড়ে ওঠে। এ সময় কয়েকটি সংবাদপত্র যথা- জনকণ্ঠ, আজকের কাগজ, সংবাদ, রূপালী, খবর, লালসবুজ, বাংলার বাণী, আল-আমিন, ভোরের কাগজ এবং তাদের সম্পাদক ও সাংবাদিকবৃন্দ আন্দোলনকারীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হলে আন্দোলনের তীব্রতা ছড়িয়ে পড়ে। সংসদে তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনা এই আন্দোলন তীব্র করেন। এবার তারই নেতৃত্বে গোলাম আযমের বিচার ও বরেণ্য ২৪ নাগরিকের মামলা থেকে অব্যাহতিসহ ৪ দফা দাবিতে সরকারের সঙ্গে চুক্তি হয়। যদিও এসব চুক্তি শেষ পর্যন্ত চুক্তিতেই সীমাবদ্ধ থাকে। ওই বছরের শেষ ভাগে সরকার ও জামায়াতের প্রত্যক্ষ পৃষ্ঠপোষকতায় দাঙ্গা শুরু করা হয়। এই সময়ে জাতীয় সমন্বয় কমিটি বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনাকে নিয়ে দাঙ্গা দমন ও জাতীয় সমন্বয় কমিটির আন্দোলনের বার্তা দেশের কৌশলগত স্থানগুলোতে পৌঁছাতে থাকে। ১৯৯৩ সালে গণআদালতের প্রথম বার্ষিকী পালনের ব্যাপক প্রস্তুতি গৃহীত হলে বিএনপি সরকার সম্পূর্ণ ফ্যাসিস্ট কায়দায় জাতীয় সমন্বয় কমিটির বিশিষ্ট নেতা ও উপদেষ্টা বিশিষ্ট নাগরিকদের ২৬ মার্চ ও ২৮ মার্চ রাজপথে শারীরিক নির্যাতন করে। জাহানারা ইমামসহ অনেকে আহত ও লাঞ্ছিত হন। এসব ঘটনা আগুনে ঘি ঢালার মতো রূপ নেয়। ফলে প্রতিদিন দেশের কোথাও না কোথাও জাতীয় সমন্বয় কমিটি কিংবা শাখা কমিটি কিংবা সহযোগী কমিটির উদ্যোগে জনসভা, মিছিল, ঘরোয়া আলোচনা, মানববন্ধন, হরতাল, ধর্মঘট, অবরোধ জাতীয় কর্মসূচী পালিত হয়। বছরের কোন এক সময়ে আলোর মিছিল জাতীয় অভিনব কর্মসূচীরও প্রবর্তন করা হয়। এই সময় কর্মসূচীতে গণতদন্ত কমিশন গঠন সংযোজিত হয়। পরে বেগম সুফিয়া কামালকে আহ্বায়ক করে তারই সমমর্যাদার ১০ জন বিশিষ্ট নাগরিককে সদস্য করে ১১ সদস্যের গণতদন্ত কমিশন গঠন করা হয়। উদ্দেশ্য গণতদন্ত কমিশন ’৭১ এর ঘাতক দালাল ও যুদ্ধাপরাধীদের ক্রমান্বয়ে চিহ্নিত করে পর্যায়ক্রমে তাদের গণআদালতে সোপর্দ করবে এবং রায় কার্যকর করার জন্য সরকারের কাছে দাবি অব্যাহত রাখবে। ইতোমধ্যে সরকার বৈরিতার চরমে পৌঁছে আন্দোলনের প্রধান টার্গেট হিসেবে নিজেদের চিহ্নিত করে ফেলেছে। আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত সরকার সমর্থক বা আন্দোলন থেকে কেটে পড়া এমনকি আন্দোলনকারী রাজনৈতিক দলের কিছু নেতা গণতদন্ত কমিশনের ধারণাকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিলে কিংবা তার কার্যক্রমে অসহযোগিতা করলে জাহানারা ইমাম তথা জাতীয় সমন্বয় কমিটি কতিপয় নেতা ও ব্যক্তির দৃঢ়তা কর্মকুশলতা, তেজোদীপ্ততা ও কর্মের ফল হিসেবে জীবদ্দশায় জাহানারা ইমাম জনসভার ৮ জন যুদ্ধাপরাধীকে চিহ্নিত করে ঘোষণা দিতে সমর্থ হয়েছিলেন। বেঁচে থাকা অবস্থায় তিনি আরও ৮ জনের নাম ঘোষণা করেছিলেন। কিন্তু এসব করতে গিয়ে তিনি মারণব্যাধি ক্যান্সারকে ক্রমেই অবজ্ঞা করেছেন এবং নিজেই মৃত্যুর দিকে ধাবিত হয়েছেন। জাহানারা ইমাম ১৯৮১ সাল থেকে ক্যান্সারের সঙ্গে বসবাস শুরু করেন। তার চোয়াল অপারেশন করতে হয়। কেমোথেরাপির কারণে তার চুলগুলো পড়ে গিয়েছিল। চোয়ালে অপারেশন এমনভাবে করতে হলো যে তিনি মুখশ্রী রক্ষা দূরের কথা সঠিকভাবে কথা বলতে পারতেন না। এক সময় শক্ত খাবার খাওয়ার শক্তি হারিয়ে ফেলেন। তার মুখে কথা আটকে যেত। তবুও তার মধ্যে ক্লান্তি ছিল না। তিনি অদম্য উৎসাহ-উদ্দীপনা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিলেন। এসব করতে গিয়ে তার চিকিৎসা বিঘিœত হচ্ছিল এবং ক্যান্সার যে তাকে কাবু করতে যাচ্ছে তা তিনি বুঝে গিয়েছিলেন। ১৯৯৪ সালে শেষবারের মতো তিনি ক্যান্সার চিকিৎসার জন্য যুক্তরাষ্ট্র গেলেন। ২১ জুন তার শেষ অপারেশন হলো কিন্তু ২৬ জুন তিনি সকলকে কাঁদিয়ে পৃথিবী ছেড়ে চলে গেলেন। মৃত্যুর সময় তার বেদনা ছিল প্রচ-। তারপরও তিনি আশাবাদী ছিলেন তাঁর সূচিত আন্দোলনের জনআকাক্সক্ষা একদিন পূর্ণ হবেই। তিনি পরিপূর্ণ বিশ্বাস করতেন, একদিন এই বাংলার মাটিতে ঘাতক দালাল ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হবেই। তার কাছে আন্দোলনের সহযাত্রীরা প্রতিশ্রুত ছিলেন। অন্যতম সহযাত্রী শেখ হাসিনা স্টিয়ারিং কমিটি সদস্যদের সামনেই এ ব্যাপারে তাকে আশ্বস্তও করেছিলেন। ইতিহাস সাক্ষী সেসময় জামায়াতকে বিএনপি থেকে বিচ্ছিন্ন করতে ও জনতার মঞ্চ তৈরিতে প্রাথমিক ভূমিকাটি পালন করেছিল সমন্বয় কমিটি এবং তার নেতৃবৃন্দ বিশেষত কাজী শাহেদ, হাসান ইমাম, কবীর চৌধুরী, শাহরিয়ার কবির, মুনতাসীর মামুন ও আমি। তার সূচনা হয়েছিল কাজী শাহেদের আজকের কাগজ পত্রিকায়। কাজী শাহেদ আত্মগোপনে চলে যেতে বাধ্য হলে সমন্বয় কমিটি শেখ হাসিনার জ্ঞাতসারে ও সম্মতিতে আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দু শহীদ মিনারে স্থানান্তর করা হয়। প্রথম দিকে জনতার মঞ্চে বুদ্ধিজীবী ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিদের অধিক দেখা গেলেও এক পর্যায়ে শেখ হাসিনার পরামর্শে রাজনৈতিক নেতৃত্বকেও মঞ্চে সংযুক্ত করা হয়। আন্দোলনের তীব্রতা সৃষ্টির লক্ষ্যে সচিবালয়ে সরকারবিরোধী আন্দোলন দাঁড় করানো হয় এবং তাদের রাজপথে টেনে আনার স্বার্থে প্রেসক্লাবের সামনে মঞ্চ তৈরির সিদ্ধান্ত হয়। অবিলম্বে শেখ হাসিনা তার নেতা ও কর্মী বাহিনী দিয়ে জনতার মঞ্চ শহীদ মিনার থেকে প্রেসক্লাবের সামনে নিয়ে এলেন। তারপর এই জনতার মঞ্চই বিএনপির স্বৈরাচার সরকারের পতনে অনন্য ভূমিকা পালন করে। খালেদা সরকারের পতনের পর জনতার মঞ্চ তার কর্মকা- গুটিয়ে নির্বাচনী কর্মকা-ে ব্যাপৃত হলো। ১৯৯৬-২০০০ সাল পর্যন্ত জাতীয় সমন্বয় কমিটির পৃথক কর্মকা- কমই পরিলক্ষিত হয় কিন্তু তার বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীরা বিভিন্ন মঞ্চে মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে গঠিত জনমতকে ধরে রাখার প্রচেষ্টা চালিয়ে যায়। ২০০২-২০০৭ পর্যন্ত আন্দোলনকারীরা কোনক্রমে নাক জাগিয়ে বেঁচে থাকেন। তবে কেউ কেউ যেমন শাহরিয়ার কবির ও মুনতাসীর মামুন সরকারী রোষানলে পড়ে দুঃসহ জীবনযাপন করেন। ২০০৭ সালে আবারও সকলের সোজা হয়ে দাঁড়াবার সময়। জাতীয় সমন্বয় কমিটির আহ্বায়কের অনুপস্থিতিতে নতুন করে কমিটি গঠন এবং আন্দোলন সম্ভব হয়নি। অবশ্য তখন আন্দোলন যেখানে এসে দাঁড়িয়েছিল, তাতে যুদ্ধাপরাধীদের চিহ্নিত করার পর গণতদন্ত ক্রিয়াশীল রাখা সমীচীন হতো কিনা সন্দেহ। ১৯৯৩-’৯৪ সালে গণতদন্ত কমিশনের কাজকর্মের অভিজ্ঞতায় এই প্রত্যয় জন্মেছিল যে, এ কাজে হাত দেয়া হবে এক ধরনের হঠকারিতা বা আত্মহনন। গণআদালতের রায় কার্যকর করা বা পরবর্তীতে আরও ঘাতকদের চিহ্নিত করার কাজটা জনগণ অর্থাৎ জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধির হাতে দিতে হবে। জাহানারা ইমাম তার জীবনের শেষ চিঠিতে এমন প্রত্যাশা ব্যক্ত করেছিলেন। তার সহযোদ্ধারা প্রদত্ত প্রতিশ্রুতি ভুলে না গিয়ে একটা শুভদিনের প্রতীক্ষায় থাকেন। ২০০৮ সালের নির্বাচনের পূর্বে আওয়ামী লীগ ও তার ১৪ দলীয় জোট তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে ঘোষণা করে, যাতে একটি দফায় ঘাতক দালাল যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দ্ব্যর্থহীন ঘোষণা স্থান পায়। নির্বাচনে প্রার্থী বাছাইয়ের কালে শেখ হাসিনা এক ধরনের ব্যতিক্রমী মুনশিয়ানার স্বাক্ষর রাখেন যাকে দূরদর্শিতা ও বিশ্বাসের প্রতি একনিষ্ঠতা হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। নির্বাচনে তিন শ’ প্রার্থীর মধ্যে প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ এমন ব্যক্তিটিকে মনোনয়ন দেয়া হয় যারা কোন না কোন ভাবে ঘাতক দালাল নির্মূল জাতীয় সমন্বয় কমিটির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তাদের মধ্যে কেউ সমন্বয়ের কেন্দ্রীয় নেতা ছিলেন। যেমন আবদুর রাজ্জাক এবং নুরুল ইসলাম নাহিদ ও কেন্দ্রের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কিত শেখ হাসিনা নিজে, সাজেদা চৌধুরী, মতিয়া চৌধুরী, মোহাম্মদ নাসিম, শেখ ফজলুল করিম সেলিম, আমির হোসেন আমু, তোফায়েল আহমেদ, হাসানুল হক ইনু, রাশেদ খান মেনন, মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া প্রমুখ। যার ফলে সংসদের প্রথম অধিবেশনে অতিশয় স্বচ্ছন্দে ও নির্বিঘেœ ১৯৭১ এর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে আইন সংশোধনের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে গঠন দ্রুত সম্ভব হয়। এসব ব্যাপারে যিনি মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করছিলেন তিনি সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমদ গণআদালতের অন্যতম বিচারক ছিলেন। পরবর্তীতে বর্তমান আইনমন্ত্রীর পিতা এ্যাডভোকেট সিরাজুল হক সমন্বয়ের আন্দোলনে বিশিষ্ট ভূমিকা রেখেছেন। এসব কারণে পরবর্তী প্রয়োজনীয় সংশোধনী কার্যক্রম স্বাচ্ছন্দ্যে চালানো সম্ভব হয়েছিল। ঘাতক দালাল যুদ্ধাপরাধীদের কৃতকর্মকে মানবতাবিরোধী আখ্যায়িত করে অপরাধের ভিত্তিকে বিস্তৃত করা হয়। শত প্রতিকূলতার মাঝে বিশেষত কতিপয় পররাষ্ট্র ও পরাসংগঠনের চরম বিরোধিতা এবং ভয়ভীতিকে উপেক্ষা করে গণআদালতে চিহ্নিত অপরাধী গোলাম আযম ও গণতদন্তে চিহ্নিত প্রায় সকলকে বিচারের আওতায় আনা হয়। পাশাপাশি ট্রাইব্যুনালের অধীনস্থ তদন্ত কমিটি দূর-দূরান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা, লুকিয়ে থাকা কিংবা ভুলে থাকা শীর্ষ মানবতাবিরোধীদের চিহ্নিত করে ট্রাইব্যুনালে সোপর্দ করতে থাকে। তারপর একাত্তরের ঘাতকদের বিচার প্রক্রিয়া সবাই দেখছে। জাহানারা ইমাম যাদের কাছে আন্দোলন আমানত রেখেছিলেন তারা তাকে হতাশ করেননি। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে ২০১৯ সাল অর্থাৎ এই সরকারের বর্তমান মেয়াদ শেষে দেশে তেমন কোন ঘৃর্ণিত মানবতাবিরোধীদের বিচার অসমাপ্ত থাকবে না। বিষয়টি জীবিত আন্দোলনকারীদের জন্য সুখবর এবং পরলোকে থেকে যারা আমাদের দেখছেন তাদের জন্য আনন্দদায়ক। জাহানারা ইমামের মূল লক্ষ্য অর্জিত হতে যাচ্ছে। জীবদ্দশায় তিনি তার আয়ুর সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে সজাগ ছিলেন বলেই দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা অর্থাৎ মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন অপেক্ষা স্বল্প মেয়াদী ঘাতক নির্মূল আন্দোলনকে প্রাধান্য দিয়েছেন। ঘাতক নির্মূলের কাজে যারা ব্যাপৃত আছে অর্থাৎ জনমত সৃষ্টিতে কার্যত আবদ্ধ, তাদের জন্য অচিরে নতুন চ্যালেঞ্জ উপস্থিত হবে। ঘাতক ও মানবতাবিরোধীদের বিচারের পাশাপাশি এখন মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন আন্দোলনকে আরও বেগবান করতে হবে। তা করতে ব্যর্থ হলে মানবতাবিরোধীদের উত্তরসূরিরা মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারে না, তারা এযাবত অর্জিত সফলতাকে ভ-ুল করতে চেষ্টা করবে। আমার ধারণা, জাহানারা ইমাম এ বিষয়টি দৃশ্যপটে রেখেই আমাদের ছেড়ে গেছেন। ঘাতক নির্মূল আন্দোলনটি শুরু করা হয়েছিল অরাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব দিয়ে, তার সমাপ্তি টানতে হয়েছে রাজনৈতিক ব্যক্তি দিয়ে। তেমন করে চেতনা বাস্তবায়ন আন্দোলন ও অরাজনৈতিক কিন্তু সব মহলে গ্রহণ যোগ্য কারও নেতৃত্বে শুরু করলে তা দীর্ঘ মেয়াদী সুফল বয়ে আনবে। লেখক : মুক্তিযোদ্ধা ও শিক্ষাবিদ
×