ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

মুনতাসীর মামুন

সংখ্যালঘুদের উদ্বেগ ও একরৈখিক চিন্তাভাবনা

প্রকাশিত: ০৩:৫০, ২৪ জুন ২০১৬

সংখ্যালঘুদের উদ্বেগ ও একরৈখিক চিন্তাভাবনা

(বুধবারের পর) ॥ সাত ॥ হিন্দু সম্প্রদায়ের নেতৃবৃন্দ শুধু নয়, আমরাও বারবার বলেছি, রাষ্ট্রধর্মের সঙ্গে চার মূলনীতির একটি হচ্ছে ধর্মনিরপেক্ষতা, এটা সাংঘর্ষিক। এটি কঠিন সত্য ও তাত্ত্বিক বিষয়। কিন্তু বাস্তবে কি শেখ হাসিনার পক্ষে সম্ভব এটি বাদ দেয়া? বাদ দিলে, সঙ্গে বিএনপি-জামায়াত তো বটেই, ইসলাম-পছন্দ মানুষ সব এক হবে। শুধু তাই নয়, গ্রামাঞ্চলের মানুষজনের মধ্যেও এ বিশ্বাস পোক্ত হবে যে, বর্তমান সরকার ধর্মবিরোধী সরকার। যেখানে ধর্মকে প্রাধান্য দিয়ে ঐক্যপরিষদ গঠিত হয় সেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠের সেন্টিমেন্ট কী হবে সেটিও বিবেচ্য। ধরা যাক, এটি বাদ দেয়া হলো এবং শেখ হাসিনা এই ইসলামী যোশ সামলাতে পারলেন না। তাহলে যারা ক্ষমতায় আসবে তারা কি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সমর্থকদের বাঁচতে দেবে? এটি বিবেচনার বিষয় দেখেই, সংবিধানের ১২নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে- ‘ধর্ম নিরপেক্ষতা নীতি বাস্তবায়নের জন্য ক. সর্ব প্রকার সাম্প্রদায়িকতা খ. রাষ্ট্র কর্তৃক কোন ধর্মকে রাজনৈতিক মর্যাদা দান গ. রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ধর্মীয় অপব্যবহার ও ঘ. কোন বিশেষ ধর্ম পালনকারী ব্যক্তির প্রতি বৈষম্য বা তাহার উপর নিপীড়ন বিলোপ করা হইবে।’ এসব শর্ত রাষ্ট্রধর্ম ইসলামের গুরুত্ব হ্রাস করে। আমরা যে অর্থে ‘সেক্যুলার’ হতে চাই, আজকের পৃথিবীতে তা কতটা সম্ভব হয়েছে? এটিও বিবেচনা করা উচিত। ভারত তো সংবিধান অনুযায়ী সেক্যুলার রাষ্ট্র। সরকারী নীতি কি তার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ? ফ্রিজে গো মাংস রাখা হয়েছে এ গুজবে মুসলমান পিটিয়ে মেরে ফেলা হয়। পৃথিবীর কোন দেশে সরকার নীতি প্রণয়ন করেননি কে কি খেতে পারবে কি পারবে না। এমন কী যে বাংলাদেশ ও শেখ হাসিনা সম্পর্কে এত অভিযোগ যার জন্য নরেন্দ্র মোদির কাছে ধর্ণা দিতে হয় সেখানেও এই নীতি নেই। ১৮৫১ সালে জর্জ জ্যাকব হলিওক ধর্মনিরপেক্ষতা বা সেক্যুলারিজম শব্দটি প্রথম ব্যবহার করেন। ধর্মনিরপেক্ষতা ও ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী (ংবপঁষধৎরংঃ) প্রত্যয়গুলো উনিশ শতকের মাঝামাঝি ইংরেজ মুক্তচিন্তকরা উদ্ভাবন করেন, যাতে তাদের ‘ধঃযবরংঃ’ বা ‘রহভরফবষ’ আখ্যায়িত করে শাস্তি না দেয়া হয়। উনিশ শতকের উদার সমাজে ধর্মনিরপেক্ষতার উদ্ভব হয়েছিল রাজনৈতিক ও সরকারী নীতি হিসেবে। তালাল আসাদ নৃতাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে ‘সেক্যুলার’ ও ‘সেক্যুলারিজম’ প্রত্যয় নিয়ে একটি বৃহৎ গ্রন্থ রচনা করেছেন। প্রত্যয় দুটিকে তিনি আলাদাভাবে বিচার করেছেন। তার মতে, ‘ঃযব পড়হপবঢ়ঃ ড়ভ ঃযব ংবপঁষধৎ পধহহড়ঃ ফড় রিঃযড়ঁঃ ঃযব রফবধ ড়ভ ৎবষরমরড়হ’ তিনি লিখেছেন ‘সেক্যুলার’ প্রত্যয়টি বর্তমানে ধর্ম বাদ দিয়ে বিচার সম্ভব নয়। ধর্মনিরপেক্ষতা মানে শুধু এ নয় যে, ধর্মীয় রীতিনীতি ও বিশ্বাস একটি বিশেষ স্পেসে সীমাবদ্ধ থাকবে যাতে তা রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বা ‘মুক্তচিন্তক’দের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। তাঁর ভাষায়, ‘ঝবপঁষধৎরংস নঁরষফং ড়হ ধ ঢ়ধৎঃরপঁষধৎ পড়হপবঢ়ঃরড়হ ড়ভ ঃযব ড়িৎষফ (দহধঃঁৎধষ’ ধহফ ‘ংড়পরধষ’) বহফ ড়ভ ঃযব ঢ়ৎড়নষবসং মবহবৎধঃবফ নু ঃযধঃ ড়িৎষফ’ এ নিয়ে অনেক তাত্ত্বিক বিতর্ক চলতে পারে। তালালের মন্তব্য কোন কোন অংশে সঠিক। তবে যেহেতু প্রত্যয় আমাদের আলোচনার বিষয় নয়, সেহেতু বলব, কোন রাষ্ট্রই ধর্মকে এড়িয়ে চলতে পারেনি। সমাজতান্ত্রিক দেশসমূহে এক সময় ধর্মকে পরিত্যাজ্য ঘোষণা করলেও সাধারণ মানুষ থেকে ধর্মবোধ বাদ দেয়া যায় না। সাম্প্রতিক রাশিয়া বা চীন এর উদাহরণ। তালাল দেখিয়েছেন, ‘আধুনিক সেক্যুলার রাষ্ট্রে’ ও ধর্মবোধ নিয়ে তারতম্য আছে। যেমন- ফ্রান্স প্রবলভাবে কেন্দ্রীভূত রাষ্ট্র এবং তার নাগরিকরা সেক্যুলার। ব্রিটেনে রাষ্ট্র যুক্ত এংলিকান চার্চের সঙ্গে কিন্তু নাগরিকরা ‘হড়হ ৎবষমরড়ঁং’। আমেরিকার মানুষরা ধর্মপ্রবণ কিন্তু ফেডারেল রাষ্ট্র সেক্যুলার। এরই ধারাবাহিকতায় বলতে পারি, রাষ্ট্র সেক্যুলার বা মানুষ হড়হ ৎবষরমরড়ঁং যাই হোক না কেন, বিয়ে হচ্ছে চার্চে যাজকের সামনে বা প্রায় দেশে সরকারপ্রধানরা ঈশ্বরের নামে শপথ করে ক্ষমতা গ্রহণ করেন। কূটতর্ক, তত্ত্ব সব মেনে নিলেও বাস্তব এই যে, ধর্মের আঁচ মানুষের গায়ে কোন না কোনভাবে থাকবেই। রেনেসাঁ থেকে এই ধারণার উৎপত্তি যে, রাষ্ট্র থেকে ধর্মকে আলাদা করতে হবে। সেটি কতটা সম্ভব হয়েছে, এমনকি ‘সেক্যুলার’ হিসেবে পরিচিত রাষ্ট্রে সেটিও এখন ভেবে দেখা দরকার। প্রাচীন আমলে পূর্ববঙ্গে যারা শাসন করেছেন [বা বঙ্গ] তারা ধর্ম আরোপ করেননি। রাজার ধর্ম অনেক ক্ষেত্রে প্রাধান্য পেয়েছে কিন্তু তা প্রজার ধর্ম হয়নি। ওই সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে সেটি হওয়াই বাঞ্ছনীয় ছিল। রাষ্ট্র কখনও কখনও বা শাসকদের কেউ কেউ বিশেষ ধর্মকে পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছেন, তাতে সাময়িক উত্তেজনাও হয়তো হয়েছে কিন্তু সাধারণ মানুষ সব সময় এসব বিষয় এড়িয়ে চলেছে। এবং যে ধর্মকে পৃষ্ঠপোষকতা দেয়া হয়েছে তার বিরুদ্ধেই সাধারণ মানুষ ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছে। বিভিন্ন ধর্মের মানুষ পাশাপাশি বাস করেছে, হয়তো স্বতন্ত্রভাবেও কিন্তু নিজেদের মধ্যে আদান-প্রদান বন্ধ থাকেনি। একজন অন্যজনের ধর্মের প্রতি শত্রুতামূলক আচরণ করেনি। এই ধর্মসহিষ্ণুতা বাঙালীর রাষ্ট্রগঠনের এক প্রধান উপাদান। এবং তা না থাকলে ও মানসগঠন আলাদা হলে রাষ্ট্রগঠনের লক্ষ্যে ঐক্য হতো না। পাকিস্তানের কলোনি আমলে লক্ষ্য করি ইসলামকে জীবনের সর্বক্ষেত্রে চাপিয়ে দেয়ার কারণে সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়া সত্ত্বেও মুসলমানরা এর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে। এখানে বাংলাদেশ আন্দোলনের পটভূমি নিয়ে আলোচনা করব না। কিন্তু এটা তো সত্য যে, পাকিস্তানীরা ক্রমাগত ইসলামের নাম ব্যবহার করেছে এবং বাঙালীদের যে কোন দাবি বা আন্দোলনকে ইসলামবিরোধী বলে আখ্যা দিয়েছে। ‘৬ দফা ও ১১ দফা আন্দোলনের প্রধান বৈশিষ্ট্য ধর্মনিরপেক্ষতাÑরাজনৈতিক অর্থনৈতিক প্রশ্নই এই আন্দোলনের চালিকাশক্তি, ধর্ম নয়।’ ১৯৭১-এ মুক্তিযুদ্ধের সময় এ কারণেই দেখি বাংলাদেশ সরকার যে পোস্টারটি প্রকাশ করে তার সেøাগান ছিলÑ ‘বাংলার হিন্দু, বাংলার খ্রিস্টান, বাংলার বৌদ্ধ, বাংলার মুসলমানÑ আমরা সবাই বাঙালী।’ একই কারণে, হাজার বছরে গড়ে ওঠা এই বোধের কারণে ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা যুক্ত হলো চারটি রাষ্ট্রীয় মৌলনীতির একটি হিসেবে। গত শতকে, বাংলাদেশই বোধহয় একমাত্র রাষ্ট্র যার সংবিধানে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ একটি মূলনীতি হিসেবে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছিল। এই কৃতিত্ব বাঙালী অবশ্যই দাবি করতে পারে। এই ধর্মনিরপেক্ষতা নিয়ে পরবর্তীকালে অনেক বিতর্ক হয়েছে। কেননা পাকিস্তানী ও আরোপিত ইসলামের সমর্থকরা রাষ্ট্রীয়ভাবে শক্তি সঞ্চয় করেছিল। সেটি পরবর্তীকালে আলোচিত হবে। তবে বাংলাদেশে ধর্মনিরপেক্ষতা বলতে কি হবে তা নিয়ে যখন বিভ্রান্তি সৃষ্টি হচ্ছে তখন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব এ বিষয়ে তাঁর ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন। বাস্তবে সেটিই ছিল বাঙালীর ধর্মবোধ। তিনি বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশ হবে-ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র। ধর্মনিরপেক্ষ মানে ধর্মহীনতা নয়। মুসলমান মুসলমানের ধর্ম পালন করবে। হিন্দু তার ধর্ম পালন করবে। এ মাটিতে ধর্মহীনতা নাই ধর্মনিরপেক্ষতা আছে। এর একটা মানে আছে। এখানে ধর্মের নামে ব্যবসা চলবে না। ধর্মের নামে লুট করা চলবে না। ধর্মের নামে রাজনীতি করে রাজাকার আলবদর পয়দা করা বাংলার বুকে আর চলবে না। সাম্প্রদায়িক রাজনীতি করতে দেয়া হবে না।’ এটি সঠিক ধর্মনিরপেক্ষতা কিনা সেটা নিয়ে তাত্ত্বিক বিতর্ক চলতে পারে। কিন্তু এই ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’র ভিত্তি বাস্তব অবস্থা ও অভিজ্ঞতা যার সঙ্গে মিল আছে বাঙালীর ৭০০-৮০০ বছরের বোধ ও অভিজ্ঞতার এবং যাকে ধর্মসহিষ্ণুতা বললে আরও যুক্তিযুক্ত হয়। বঙ্গবন্ধু বস্তুবাদী ছিলেন দেখে এ কথা বলেছেন। এবং বাঙালী মুসলমানদের নিজের দর্শনে নিয়ে আসতে ২৫ বছর লেগেছে। বাংলাদেশে জঙ্গীবাদের অস্তিত্ব ছিল না। গত শতকের নব্বই দশকে তা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। বিএনপি-জামায়াত নেক্সাস তাদের সেকেন্ড ফ্রন্ট হিসেবে জঙ্গী দলগুলোর সৃষ্টি করে এবং মদদ দেয়। এরপর শায়খ আবদুর রহমান, বাংলা ভাই থেকে আজকের জঙ্গী তৎপরতার ইতিহাস সবার জানা। একই সঙ্গে বিশ্বব্যাপী জঙ্গীবাদী তৎপরতা বৃদ্ধি পেয়েছে। এখানকার জঙ্গীরাও ইন্টারনেটের সাহায্যে তাদের প্রচার দেখছে, প্রভাবান্বিত হচ্ছে। তৃতীয় শক্তির মাধ্যমে সহায়তাও পাচ্ছে। এই তৃতীয় শক্তি আইএএস এটি সবার জানা। জামায়াতী নেতাদের ফাঁসির পরিপ্রেক্ষিতে পাকিস্তানের হুমকি সবার জানা। একটি কথা বলি। এই যে হেজাবি বা বিএনপি-জামায়াত বা আটকে পড়া [বাংলাদেশী] পাকিস্তানীদের নেক্সাস সেটার বিরুদ্ধে কি বাঙালী হিসেবে সবাই রুখে দাঁড়িয়েছিলেন? এখানকার মিডিয়া, ব্যবসায়ী ও এলিটদের একটি অংশ, আওয়ামী লীগ বিরোধিতাকারীরা কিন্তু সবসময় এদের পদাবলম্বন করেছে এ বলে যে, শক্তিশালী বিরোধী দল থাকা বাঞ্ছনীয়। এদের জন্য গণতান্ত্রিক স্পেস দরকার এবং মহীউদ্দীন খান আলমগীর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী থাকাকালীন প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে হেজাবিদের দমনও গোয়েন্দা সংস্থা ও আওয়ামী লীগের একাংশ সমর্থন করেনি। এই হচ্ছে বাস্তব পরিস্থিতি। এ পরিস্থিতিতে সবাই শর্ট টার্ম ব্যবস্থায় আগ্রহী। কিন্তু কোন শর্ট টার্ম ব্যবস্থা এখন আর কার্যকরী হবে না। আমরা ব্যর্থ হয়েছি শত্রু চিহ্নিত করতে। এবং বিভিন্নতা শুধু সংখ্যাগরিষ্ঠ নয় সংখ্যালঘুদের মধ্যেও সৃষ্টি হয়েছে। দুঃখের বিষয় কেউ বলেননি, এখন যা হচ্ছে তার পেছনে আন্তর্জাতিক ও জাতীয় দুটি দল আছে। যারা ধরা পড়ছে তাদের অধিকাংশ স্বীকার করছে তারা জামায়াতের সঙ্গে যুক্ত। একটি বিষয় মনে রাখা দরকার বাংলাদেশের মুসলমানদের একটি বড় অংশ তাকলিদে ইজতিহাদে [যুক্তি] নয়। সামরিক শাসক, রাজনৈতিক দল, অর্ধশিক্ষিত মানুষ, গ্রামবাসী সবার ক্ষেত্রে এটি প্রযোজ্য। সমস্যাটি এখানেই। এটি স্বাভাবিক ইজতিহাদের পথে গেলে, বিএনপি-জামায়াত বা ইসলাম ব্যবসায়ীরা ইসলাম ব্যবহার করে রাজনীতি করতে পারবে না। সে কারণে, বিভিন্ন পন্থায় তকলিদের পুনঃউৎপাদন হয়। এটি আশার কথা যে লাখ খানেক ইমাম ইজতেহাদকে উপজীব্য করে ফতোয়া দিয়েছেন জঙ্গীদের বিরুদ্ধে। এটি ইতিবাচক দিক। সরকারের এ ধরনের পদক্ষেপে পৃষ্ঠপোষকতা করা দরকার ছিল অনেক আগেই। চলবে...
×