ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

মেজর জিয়া গ্রেফতারে অভিযান

প্রকাশিত: ০৬:০২, ২৩ জুন ২০১৬

মেজর জিয়া গ্রেফতারে অভিযান

শংকর কুমার দে ॥ সেনাবাহিনী থেকে চাকরিচ্যুত মেজর জিয়াউল হক জিয়া নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গী সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের (এবিটি) জঙ্গীদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। তিনি জঙ্গীদের কাছে সাগর, ইশতিয়াক ও ইমতিয়াজ-এসব ছদ্মনামে পরিচিত। এই মেজর জিয়াকে গ্রেফতারের জন্য অভিযান চালানো হচ্ছে। মেজর জিয়াসহ আরও কয়েক দুর্ধর্ষ জঙ্গীকে ধরিয়ে দিতে শীঘ্রই পুরস্কার ঘোষণা করা হবে। এই মেজর জিয়ার কাছ থেকে প্রশিক্ষণ নিয়েই আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের জঙ্গীরা দুটি সিøপার সেলে বিভক্ত হয়ে শাহবাগে দীপন খুন ও মোহাম্মদপুরে টুটুলসহ ৩ জনকে হত্যাচেষ্টায় অংশ নিয়েছে। আনসারুল্লাহ জঙ্গী সুমন পাটোয়ারী ওরফে সাকিব ওরফে শিহাব মঙ্গলবার আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দীতে ও ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) জিজ্ঞাসাবাদে এসব তথ্য দিয়েছে। সূত্র জানায়, দীপন হত্যা ও টুটুলসহ ৩ জন হত্যাচেষ্টার ঘটনায় আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের দুটি সিøপার সেলকে প্রশিক্ষণ দিয়ে অপারেশনে পাঠানো হয়। শুদ্ধস্বর প্রকাশক টুটুল হত্যার মিশনের আগে ৪ ধাপে প্রশিক্ষণ দিয়ে অপারেশনে পাঠানো হয় ৫ আনসারুল্লাহ জঙ্গীকে। গুপ্তহত্যার চেষ্টার ঘটনায় সম্পৃক্ত ও সমন্বয়ে ছিল মোট ৮ জন। পুরস্কার ঘোষিত জঙ্গী সুমন পাটোয়ারী ওরফে সাকিব ওরফে শিহাব মঙ্গলবার আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দীতে তার জঙ্গী সংগঠনে যোগদান, প্রশিক্ষণ গ্রহণ, অপারেশন চালানো, শুদ্ধস্বরের প্রকাশক হত্যাচেষ্টাসহ চারটি ঘটনায় জড়িত ও জানার বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছে। আদালতে শিহাব স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দেয়ার পর তাকে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। শিহাব জবানবন্দীতে বলেছে, ঢাকায় পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত শরীফ (মুকুল রানা) ও তার সঙ্গে এসব ঘটনায় জড়িত ছিল। জঙ্গী শিহাব মঙ্গলবার ঢাকা মহানগর মুখ্য হাকিম আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দীতে বলেছে, বড় ভাইয়ের কাছ থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে তারা টুটুল হত্যাচেষ্টায় অংশ নেয়। আদালতে ১২ পৃষ্ঠার জবানবন্দী দেয় শিহাব। জবানবন্দীতে সে জানায়, টঙ্গীর বর্ণমালা রোডের একটি বাসায় তাদের প্রশিক্ষণ দেয়া হতো। টুটুল হত্যাচেষ্টায় সরাসরি অংশ নেয় ৫ জন। অপর একজন অপারেশনস্থলের আশপাশে অবস্থান করে পুরো বিষয়টি সমন্বয় করে। অন্য দুজন পরিকল্পনা ও প্রশিক্ষণের সঙ্গে যুক্ত। পুরো প্রক্রিয়ায় সম্পৃক্ত ছিল ৮ জন। শিহাব তাদের প্রশিক্ষণের বিষয়ে বলেছে, তাদের ধর্মীয় কথা-বার্তা বলে রিক্রুট করা হতো। অপারেশনের মানসিক প্রস্তুতি ও মোটিভেশন (প্রণোদনা) দেয়া হতো। এরপর ফিজিক্যাল (শারীরিক) ট্রেনিং। সবশেষে তাদের চাপাতি ও অস্ত্র চালানোর ট্রেনিং দেয়া হতো। শিহাব জানায়, তারা (জঙ্গীরা) যার কাছ থেকে সবচেয়ে বেশি প্রশিক্ষণ নেয় সেই বড় ভাই তাদের কাছে ইশতিয়াক নামে পরিচিত। বড় ভাই জিহাদের প্রয়োজনে সরকারী চাকরি ছেড়ে দেন বলে তাকে জানানো হয়। টুটুল হত্যাচেষ্টার অপারেশনের আগে টানা ৩ মাস টঙ্গীর বাসায় ৫ জনকে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। ওই বাসায় আরও কয়েকজন থাকলেও পরে তারা অন্যত্র চলে যায়। ম্যানুয়াল তৈরি করে ৫ জনকে বিশেষ প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। হামলার কয়েক দিন আগে টুটুলের ছবি দেখিয়ে বলা হয়, তার ওপর হামলা করতে হবে। এরপর এলাকা রেকি করতে একদিন তাকে লালমাটিয়ায় টুটুলের কার্যালয়ের আশপাশ ঘুরিয়ে আনা হয়। রেকি করতে শিহাবের সঙ্গে যান ইশতিয়াক, মুকুল ওরফে শরিফুলসহ ৪ জন। যেভাবে জঙ্গী সংগঠনে আসা ॥ জঙ্গী শিহাব জবানবন্দীতে বলেছে, গত বছর তার সঙ্গে একজনের পরিচয় হয় চট্টগ্রামে। সেখানে একটি মসজিদে প্রায়ই দেখা করতেন তারা। একদিন তাদের ইন্টারনেটে একটি আইডি খুলে দেয় ওই ব্যক্তি। ওই আইডির মাধ্যমে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ হতো। একদিন ওই ব্যক্তি ঢাকা যাওয়ার জন্য তাকে প্রস্তাব দেয়। এরপর ঢাকায় আসে সে। তারপর ৩ মাস প্রশিক্ষণ দেয়া হয় তাকে। প্রথমে একজন ওই বাসায় এসে ব্যায়াম করাত আর কোরআন পড়াত। এরপর আরেকজন এসে চাপাতি চালানো শেখায়। পরে একজন এসে পিস্তল চালানো শেখায়। একদিন মুকুল এসে এক ব্যক্তির ছবি দেখিয়ে বলে, এর নাম টুটুল। তার ওপর হামলার জন্য তাদের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। বড় ভাই ইশতিয়াক প্রায়ই বাসায় এসে বলতেন, আমরা সকলে আল্লাহর জন্য জিহাদ করছি। জিহাদ থেকে পিছপা হওয়ার সুযোগ নেই। যেভাবে অপারেশন চালানো হয় ॥ শিহাব জবানবন্দীতে জানায়, ঘটনার দিন সকালে তারা টঙ্গীর বাসা থেকে লালমাটিয়ায় শুদ্ধস্বরের কার্যালয়ের আশপাশে যায়। সেখানে প্রথমে একটি মসজিদের পাশে জড়ো হয় তারা। দুপুর সাড়ে ১২টার পর কার্যালয়ে ঢোকেন টুটুল। পৌনে তিনটার দিকে ৫ জঙ্গী মূল অপারেশন শুরু করে। প্রথমে একজন শুদ্ধস্বরের কার্যালয়ে ঢোকে। ঢোকার পথে নিরাপত্তারক্ষীকে পিস্তল ঠেকানো হয়। এরপর অন্যরা মূল অফিসে প্রবেশ করে টুটুল ও তার দুই বন্ধুর ওপর হামলা চালায়। টুটুলকে তিনটি কোপ দেয় শিহাব। অপারেশন শেষে টঙ্গীর বাসায় একত্র হয় তারা। এরপর তারা যে যার মতো পালিয়ে যায়। শিহাব ফেরত যায় চট্টগ্রামে। শিহাবের গ্রামের বাড়ি চাঁদপুরে। সে বড় হয়েছে চট্টগ্রামের হালিশহরে। আন্দরকিল্লায় একটি মেডিক্যাল ইকুইপমেন্টের দোকানে সেলসম্যানের কাজ করে আসছিল সে। শিহাব উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত লেখাপড়া করেছে। জঙ্গীদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছে যারা ॥ শিহাব জবানবন্দীতে বলেছে, আনসারুল্লাহর সামরিক শাখার আরেক সদস্য সামাদ ওরফে সুজন ওরফে রাজু ওরফে সালমান ওরফে সাদ টঙ্গীর বাসায় চাপাতি চালানোর প্রশিক্ষণ দিয়েছে তাকে। তার বাড়ি কুমিল্লায়। তবে কুমিল্লার কোথায় তা জানা নেই। রাজু জিহাদে উদ্বুদ্ধ করতে আলোচনা বা বয়ানে অংশ নিত। টুটুল হত্যাচেষ্টায় সরাসরি অংশ নেয় রাজু। দুটি সিøপার সেল অপারেশনে ছিল ॥ শিহাব জানায় টুটুলের ওপর হামলার সমন্বয়ক ছিল সংগঠনের হাদী-১ শরিফুল ওরফে সাকিব ওরফে শরিফ ওরফে সালেহ ওরফে আরিফ। বন্দুকযুদ্ধে নিহত হওয়ার পর জানা যায় তার আসল নাম মুকুল রানা। এটি ছিল একটি সিøপার সেলের অপারেশন। অপরদিকে একই দিন শাহবাগের আজিজ সুপার মার্কেটে জাগৃতির প্রকাশক ফয়সল আরেফিন দীপন খুন হন। ওই ঘটনার সমন্বয়ক ছিলেন সংগঠনের হাদি-২ সেলিম ওরফে ইকবাল ওরফে মামুন। দীপন হত্যামিশনেও অংশ নিয়েছিল ৫ জন। এভাবে পৃথক দুটি সিøপার সেল বিভক্ত হয়ে দুটি অপারেশনে অংশ নেয়। তবে সিøপার সেলের একটি গ্রুপ অপর সিøপার সেলের গ্রুপের অপারেশনের কথা জানা ছিল না। পৃথক দুটি সিøপার সেলের প্রশিক্ষণের দায়িত্বে ছিল শরিফ, সেলিম ও ইশতিয়াক। গত ১৯ মে শিহাবসহ ৬ আনসারুল্লাহ জঙ্গীকে ধরিয়ে দিতে ১৮ লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করে পুলিশ। পুরস্কার ঘোষিত শরীফ ওরফে মুকুল রানা ডিবির সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয় গত শনিবার। ডিবির কর্মকর্তা যা বলেন ॥ ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের যুগ্ম কমিশনার আব্দুল বাতেন বলেছেন, শিহাব জানিয়েছে, ডিগ্রী পড়াশোনার সময় একজন তাকে নানা ধরনের ধর্মীয় কথাবার্তা বলেছে। এরপরই সে জঙ্গী কার্যক্রমে যোগদান করেছে। উগ্রপন্থীরা যার কাছ থেকে সবচেয়ে বেশি প্রশিক্ষণ নেয় সেই বড় ভাই তাদের কাছে ইশতিয়াক নামে পরিচিত। এই ইশতিয়াকের ছদ্মনাম মেজর জিয়া বলে জানা গেছে। তার কাছ থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে টুটুলসহ ৩ জনের হত্যাচেষ্টার ঘটনাসহ জঙ্গী জগতে প্রবেশ ও গ্রেফতারের আগ পর্যন্ত ঘটনার বর্ণনা দিয়েছে শিহাব।
×