ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

বিশ্বব্যাংকের পর্যালোচনা

অর্থনৈতিক অবস্থা অনুকূল, আরও বড় বাজেট দেয়া যেত

প্রকাশিত: ০৫:৫৯, ২৩ জুন ২০১৬

অর্থনৈতিক অবস্থা অনুকূল, আরও বড় বাজেট দেয়া যেত

অর্থনৈতিক রিপোর্টার ॥ ২০১৬-১৭ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট পেশ করায় অর্থমন্ত্রীর কল্যাণকামী নানা উদ্যোগের প্রশংসা করে বিশ্বব্যাংক বলছে, সামষ্টিক অর্থনীতির বেশিরভাগ সূচকের অনুকূল অবস্থার সুযোগ নিয়ে আরও বড় বাজেট দেয়া যেত। তবে বাজেটের ঘাটতি মেটাতে উচ্চসুদে সঞ্চয়পত্র বিক্রি করে দেশীয় উৎস থেকে অর্থ সংগ্রহ শেষ পর্যন্ত সরকারের জন্য গলার কাঁটা হতে পারে বলে শঙ্কা বিশ্বব্যাংকের। এর বদলে কম সুদে বিদেশী অর্থায়নের সুযোগ নেয়া উচিত বলে মনে করছে ব্যাংকটি। প্রবৃদ্ধি সঞ্চারে নতুন মাত্রা নামে বাজেট বক্তৃতায় দশ মেগা প্রকল্প অর্থনীতিতে গতি আনবে বলেও বিশ্লেষণ বিশ্বব্যাংকের। তবে পদ্মা সেতু এবং রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুত কেন্দ্র বাদে অন্য প্রকল্পগুলোর ধীরগতি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে বিশ্বব্যাংক। বিশ্বব্যাংক বলছে, স্থিতিশীল রাজনীতি সব সময় বিনিয়োগ সহায়ক। তাই দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা থাকলেও এখনও অনিশ্চয়তা কাটেনি। তাই রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার চেয়ে অবকাঠামো উন্নয়ন, বিদ্যুত ও জ্বালানি নিশ্চিত এবং প্রশাসনিক সংস্কার করা গেলে বাজেট বাস্তবায়ন কঠিন কিছু নয় বলে মনে করে বিশ্বব্যাংক। বুধবার রাজধানীর আগারগাঁওয়ে বিশ্বব্যাংক কার্যালয়ে আয়োজিত ২০১৬-১৭ অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত বাজেট পর্যালোচনায় বিশ্বব্যাংকের পক্ষ থেকে এ অভিমত তুলে ধরা হয়। বাজেট পর্যালোচনা তুলে ধরেন বাংলাদেশে বিশ্বব্যাংকের কান্ট্রি ডিরেক্টর চিয়ামাও ফান, ভারপ্রাপ্ত আবাসিক প্রতিনিধি রাজশ্রী পারালকার এবং সংস্থাটির প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন। বিশ্বব্যাংকের বাজেট পর্যালোচনা বলা হয়েছে, রাজস্ব আদায় বড় উচ্চাকাক্সক্ষা। কিন্তু বার বার রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ব্যর্থ হলে কর্তৃপক্ষের ওপর বিশ্বাস নষ্ট হয়। তাই আদায়যোগ্য রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করতে হবে। পর্যালোচনায় উল্লেখ করা হয়েছে, দেশে করদাতার সংখ্যা ১২/১৫ লাখে উন্নীত করতে প্রশাসনিক দক্ষতা বাড়াতে হবে। প্রস্তাবিত বাজেটে এ দক্ষতা বাড়ানোর টার্গেট রাখা হয়েছে, তবে তা কবে পূর্ণ হবে তার দিনক্ষণ নেই। পর্যালোচনায় বিশ্বব্যাংক জানিয়েছে, ভ্যাট আইন বাস্তবায়ন এক বছর পেছানোর সিদ্ধান্ত সঠিক। তাই এই সময়ের মধ্যে আইনের সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করা হোক। তা না হলে আইন বাস্তবায়ন বড় চ্যালেঞ্জিং হবে। আর প্যাকেজ ভ্যাট তুলে দেয়ার সিদ্ধান্তে বিশ্বব্যাংক একমত হলেও আগামী এক বছরে এর পরিমাণ দ্বিগুণ করায় ব্যবসায়ীদের ওপর চাপ সৃষ্টি করবে। অনুন্নয়ন খাতে ব্যয় বাড়ছে উল্লেখ করে বিশ্বব্যাংকের পর্যালোচনায় বলা হয়, এডিপি বাস্তবায়ন চ্যালেঞ্জ হলেও শিক্ষা খাতে বরাদ্দ বৃদ্ধি সুখবর। কিন্তু ব্যয়ের তিন নম্বরে থাকা সুদ পরিশোধ বড় দুশ্চিন্তার বিষয়। তাই সুদ হার পলিসির সংস্কার প্রয়োজন। এডিপির আকার বড় হলেও বাস্তবায়নযোগ্য নয়। কারণ প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে নীতিমালা পরিষ্কার নয়। বর্তমানে ১২শ’ প্রকল্প বাস্তবায়নাধীন রয়েছে। অগ্রাধিকার প্রকল্পের বরাদ্দ পর্যাপ্ত নয় উল্লেখ করে পর্যালোচনায় বলা হয়, বরাদ্দ কম থাকায় প্রকল্প বাস্তবায়নের সময়ের লক্ষ্যমাত্রা ব্যর্থ হবে। এছাড়া কৃষি খাতের ভর্তুকিসহ সরকারের নানামুখী সহায়তা সঠিক স্থানে পৌঁছানো বড় চ্যালেঞ্জ। পর্যালোচনায় আরও বলা হয়, প্রাথমিক শিক্ষার নতুন স্তর নতুন চ্যালেঞ্জ শিক্ষক নিয়োগ ও দক্ষতা বাড়াতে হবে। বিদ্যুত ও জ্বালানি খাতের পলিসিতে অনেক বিনিয়োগ প্রয়োজন। জ্বালানি মূল্য পলিসির সংস্কার প্রয়োজন। আর ভর্তুকি দরিদ্রবান্ধব হতে হবে। বাজেট বাস্তবায়নে পরিবহন খাত বড় চ্যালেঞ্জ উল্লেখ করে পর্যালোচনায় বলা হয়, সড়ক নির্মাণ করলেই হবে না, তা রক্ষাণাবেক্ষণ ও দক্ষ ব্যবস্থাপনা ঠিক রাখতে হবে। বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা বলয় বাড়ানোর উদ্যোগের প্রশংসা করে পর্যালোচনায় বলা হয়, এ বলয় সঠিক মানুষের কাছে পৌঁছাচ্ছে কিনা তা চিহ্নিত করতে হবে। এক টাকার সেবা দিতে কত খরচ হয় তা মূল্যায়ন করা জরুরি। তা না হলে জনগণ সুবিধা পাবে না। ড. জাহিদ হোসেন বলেন, বাজেটে কিছু বিষয় স্থায়ী হয়ে গেছে যেমনÑ ভর্তুকি, বেতন-ভাতা ও সুদ। এ বিষয়গুলো স্থায়ীভাবে বাজেটে ঠাঁই করে নিয়েছে। আসলে গতানুগতিক বিষয়গুলো তেমন কোন উন্নয়ন করতে পারে না। বাজেটে বৈচিত্র আনতে হবে। এ লক্ষ্যে বাজেটের সংস্কার প্রয়োজন। বাজেটের আকারের দিকে না তাকিয়ে ফলাফলের দিকে নজর দিতে হবে। বাজেটের টাকা যে সড়কে বরাদ্দ দিলাম, তা ভাল মানের কিনাÑ সে চিন্তা করতে হবে। বাজেটে শুধু নতুন নতুন প্রকল্প নিলাম, এতে কোন উন্নতি হবে না। এর আগে চলমান পুরনো প্রকল্পের সংস্কার আনতে হবে। রাজনীতি ও বিনিয়োগ প্রসঙ্গে জাহিদ হোসেন বলেন, স্থিতিশীল রাজনীতি সব সময় বিনিয়োগ সহায়ক। বর্তমানে রাজনীতি স্থিতিশীল আছে, কিন্তু অনিশ্চয়তা কাটেনি। এর মধ্যেই বিনিয়োগ বেড়েছে বিশেষ করে বিদ্যুত ও পোশাক খাতে। বাজেটে বিনিয়োগের পরিমাণ ৩৮ থেকে ৪০ শতাংশ করতে হলে রাজনীতিতে অনিশ্চয়তা দূর করতে হবে। তবে ২২ থেকে ২৫ শতাংশ বিনিয়োগের আশা করলে যেমন আছে তেমনটি থাকলেই চলবে। পরিবহন খাত প্রসঙ্গে জাহিদ হোসেন বলেন, পরিবহন খাতে অনেক প্রকল্প রয়েছে। তবে নিরাপদ কোন সড়ক নেই। শুধু প্রকল্পের সংখ্যা বাড়ালেই হবে না, মানও নিশ্চিত করতে হবে। বাজেটে জিডিপির ফোরকাস্টিংয়ে (পূর্বানুমান) গলদ আছে বলেও মন্তব্য করেন জাহিদ হোসেন। তিনি বলেন, জিডিপির যে সংখ্যা নির্ণয় করা হয়েছে, তা সঠিকভাবে হয়নি। এ নিয়ে বিতর্ক আছে। তবে সংখ্যা নিয়ে যতই বিতর্ক থাক, গত কয়েক বছরে আমাদের অর্জন ভাল। পাইপলাইনে যে বৈদেশিক সহায়তা আছে, যদি তা সঠিকভাবে ব্যবহার করা যায়, তবে বাজেট বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে বলেও মন্তব্য করেন তিনি। বাজেটে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টিতে আরও সুস্পষ্ট পদক্ষেপ দরকার ছিল। রাজস্ব আয়ের যে টার্গেট ধরা হয়েছিল তা অনেক উচ্চাভিলাষী। তবে করের টাকা কোন খাতে কিভাবে ব্যয় হবে তা নিশ্চিত করতে হবে। উন্নয়নের নামে যে বিনিয়োগ হচ্ছে তার মান নিশ্চিত করতে হবে। শিক্ষার বিনিয়োগ থেকে মানসম্মত শিক্ষা আসছে কিনা তাও দেখতে হবে। ড. জাহিদ আরও বলেন, প্রবৃদ্ধি বাড়াতে হলে বিনিয়োগকে বেগবান করতে হবে। সেটা করতে হলে যোগান বাড়িয়ে, জ্বালানি বাড়িয়ে, কর্মসংস্থানের মাধ্যমে প্রবৃদ্ধি বাড়াতে নারীদের অংশগ্রহণ বৃদ্ধি ও শ্রম শক্তির দক্ষতা বাড়াতে হবে। তিনি বলেন, ৩৭.৫ শতাংশ রাজস্ব অর্জন করা সম্ভব হবে না। বাজেটে টার্গেট অর্জনের সুযোগ আছে, তবে পাইপলাইনে অর্থছাড়ের পরিমাণ বাড়াতে হবে। গত মার্চ পর্যন্ত ছাড় হয়েছে মাত্র ১৫.৪ শতাংশ। এ ধারাতে হলে সম্ভব না। আর বাস্তবায়নের হার না বাড়ালে ছাড়ও কম হবে। পর্যালোচনা সভায় চিয়ামাও ফান বলেন, বাজেটে শিক্ষার বরাদ্দ ও সামাজিক নিরাপত্তা বলয় বাড়ানোর উদ্যোগ সঠিক পদক্ষেপ। বাজেটটি আরও উন্নত হতে পারত, কিন্তু তা হয়নি। তিনি আরও বলেন, বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশের বিভিন্ন সূচকের যে মূল্যায়ন করেছিল তা সঠিক হয়েছে। যেমন বিশ্বব্যাংক বলেছিল জিডিপি প্রবৃদ্ধি বাড়বে এবং মূল্যস্ফীতি ও রেমিটেন্স কমবে। চিয়ামাও ফান বলেন, বাজেটে বিভিন্ন সংস্কারের বিষয়ে পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। তবে তা বাস্তবায়নের সঠিক দিনক্ষণ নির্ধারণ করা হয়নি এবারের বাজেটে। এগুলো নির্ধারণ করা প্রয়োজন। বাংলাদেশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি ধরে রাখতে পেরেছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, বাংলাদেশের রেমিটেন্স কমলেও রফতানি বৃদ্ধি পাওয়ায় অর্থনীতিতে কোন নৈতিবাচক প্রভাব পড়বে না। এবারের বাজেটে অনেক নতুন প্রকল্প যুক্ত করা হয়েছে। ফলে এডিপি বাস্তবায়ন চ্যালেঞ্জিং হবে বলেও জানান তিনি। পাশাপাশি কর্মসংস্থানে নারীর অংশগ্রহণ বাড়ানোর পরামর্শ দেন চিয়ামাও ফান। তিনি আরও বলেন, আর্থ-সামাজিক উৎপাদনশীলতা ঠিক রাখতে ডিজিটালাইজেশন ও ব্যবস্থাপনা দক্ষতা বাড়াতে হবে। ঋণের বোঝা নিয়ে চিন্তার কোন কারণ নেই উল্লেখ করে চিয়ামাও ফান বলেন, বৈদেশিক ঋণ প্রাপ্তি কোন কঠিন বিষয় নয়। কারণ পাইপলাইনে ২০ বিলিয়ন ডলার রয়েছে। তবে এসব অর্থ ছাড় করাতে প্রকল্প বাস্তবায়নের গতি বাড়াতে হবে।
×