ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী আজ

প্রকাশিত: ০৫:৫৯, ২৩ জুন ২০১৬

আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী আজ

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ আজ ২৩ জুন। ১৭৫৭ সালের এই দিনে ভাগীরথী নদীর তীরে অস্তমিত হয়েছিল বাংলার স্বাধীনতার সূর্য। ১৯২ বছর পর একই দিনে বাংলার মানুষের মুক্তি আর অধিকার আদায়ের জন্য গঠিত হয় বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ। পুরান ঢাকার বিখ্যাত রোজ গার্ডেনে এ দলটির জন্মলাভের মধ্য দিয়েই রোপিত হয়েছিল বাঙালীর হাজার বছরের লালিত স্বপ্ন স্বাধীনতা সংগ্রামের বীজ। বঙ্গবন্ধু-আওয়ামী লীগ-স্বাধীনতা এই তিনটি শব্দ অমলিন, অবিনশ্বর। ইতিহাসে এই তিনটি শব্দ একই সূত্রে গাঁথা। গৌরব ও ইতিহাসের নানা বাঁক পেরিয়ে আজ ৬৮ বছরে পা দিল হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মওলানা ভাসানী আর বঙ্গবন্ধুর হাতে গড়া আওয়ামী লীগ। ঢাকার স্বামীবাগের রোজ গার্ডেন আর ১৫০ নম্বর মোগলটুলির শওকত আলীর বাসভবন। আওয়ামী লীগের জন্মসূত্রের সঙ্গে এ দুটি স্থানের সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য। কলকাতা থেকে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী একটি মামলা পরিচালনার জন্য ঢাকায় এলে তিনি শওকত আলীকে মুসলিম লীগ ছেড়ে ভিন্ন একটি রাজনৈতিক সংগঠন গড়ে তোলার পরামর্শ দেন। এ পরামর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে পূর্ববঙ্গ কর্মীশিবিরের নেতৃবৃন্দকে নতুন সংগঠন গড়ে তুলতে উদ্বুদ্ধ করেন তিনি। ১৫০ নম্বর মোগলটুলির শওকত আলীর বাসভবন ও কর্মীশিবির অফিসকে ঘিরে বেশ কয়েক মাসের প্রস্তুতিমূলক তৎপরতার পর ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন স্বামীবাগের রোজ গার্ডেনে আওয়ামী লীগের (পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ) জন্ম হয়েছিল। গণতান্ত্রিকভাবে জন্ম নেয়া গণমানুষের সেই প্রিয় দল আওয়ামী লীগের আজ ৬৭তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। বাংলাদেশের গড় আয়ু ৭০ বছর। আর ৬৬ বছর হলে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে বার্ধক্য। বাংলাদেশের সংবিধান ও আইন অনুযায়ী কেউ ৬০ বছর পেরুলেই তিনি ‘সিনিয়র সিটিজেন’-এর মর্যাদা পান। সেই হিসেবে আওয়ামী লীগ এ দেশের সিনিয়র রাজনৈতিক দল। শুধু এটি বললে কম হবে, বাঙালী জাতির মুক্তির মূলমন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে গণতান্ত্রিকভাবে জন্ম নেয়া আওয়ামী লীগ উপমহাদেশে প্রাচীনতম ও ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক দলও বটে। ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, দলটির জন্ম মোটেই সুখকর ছিল না। ১৯৪৯ সালের ২৩ ও ২৪ জুন স্বামীবাগের রোজ গার্ডেনে নতুন দল গঠন করা হচ্ছে। বিষয়টি জানাজানি হলে তৎকালীন সরকার ভীত হয়ে পড়ে। ওই সম্মেলনকে কেন্দ্র করে মওলানা ভাসানীকে গ্রেফতার করার সম্ভাবনা দেখা দেয়। তখন নতুন সংগঠন গড়ে তোলার কারিগররা মওলানা ভাসানীকে আত্মগোপনে রাখার ব্যবস্থা করেন এবং সম্মেলনের অন্তত দু’দিন আগে তাকে রোজ গার্ডেনে নিয়ে আসা হয়। মওলানা ভাসানীকে বোরকা পরিয়ে (মতান্তরে কম্বল জড়িয়ে) ঘোড়ারগাড়িতে করে রোজ গার্ডেনে নিয়ে যান সংগঠনটি দাঁড় করানোর অনুঘটক শওকত আলী। এরপর আতাউর রহমান খানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সম্মেলনে সর্বসম্মতিক্রমে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীকে সভাপতি, শামসুল হককে সাধারণ সম্পাদক এবং কারাবন্দী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে যুগ্মসম্পাদক করে নতুন রাজনৈতিক দল আত্মপ্রকাশ করে। সম্মেলনে দলের নাম দেয়া হয় আওয়ামী মুসলিম লীগ। পরদিন ২৪ জুন ঢাকার আরমানিটোলা ময়দানে প্রকাশ্য জনসভার মাধ্যমে আওয়ামী লীগের যে আন্দোলনের কর্মসূচী শুরু হয়, দীর্ঘ ৬৬ বছরে তার বিরাম নেই। বহু ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্যে কখনও বিরোধী দলে, কখনও সরকারে থেকে দেশ গঠনে অনন্য অবদান রেখে চলেছে মাটি ও মানুষের রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগ মানেই বাঙালী জাতীয়তাবাদের মূলধারা। আওয়ামী লীগ মানেই সংগ্রামী মানুষের প্রতিচ্ছবি। বাংলাদেশের কাদা-মাটি গায়ে মাখা খেটে খাওয়া মানুষের কাফেলা। অতীতের মতো বাংলাদেশের ভবিষ্যত ও আওয়ামী লীগের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যভাবে যুক্ত। স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতা, সর্বশেষ সামরিক স্বৈরশাসন থেকে গণতন্ত্রে উত্তরণের প্রতিটি অর্জনের সংগ্রাম-লড়াইয়ে নেতৃত্বদানকারী একটিই রাজনৈতিক দল, তা হচ্ছে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। বাঙালী জাতির প্রতিটি অর্জনেরও দাবিদার প্রাচীন ও সুবিশাল এ রাজনৈতিক দলটি। আজ কোথায় দাঁড়িয়ে আওয়ামী লীগ? ॥ ৬৭তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর এই দিনে এ প্রশ্ন মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী সকল বাঙালীর। এ মুহূর্তে বেশ নির্ভার আওয়ামী লীগ। সরকারে বড় ধরনের দুশ্চিন্তাও নেই। তবে পরিস্থিতি আপাতত শান্ত থাকলেও যে কোন সময় আবারও অশান্ত হওয়ার আশঙ্কাকে উড়িয়ে দিচ্ছেন না রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। এ ব্যাপারে আওয়ামী লীগ নিজেদের কিভাবে প্রস্তুত করছে? এর উত্তরটা খুব একটা সুখকর নয়। রাষ্ট্র পরিচালনায় আওয়ামী লীগ পূর্ণ এক মেয়াদের পর দেশের ইতিহাসে এই প্রথম টানা দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসার সফলতার মুখ দেখলেও অসীম ত্যাগ ও আদর্শনির্ভর এ রাজনৈতিক দলটি স্বাধীন স্বকীয়তা ধরে রাখতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে। আওয়ামী লীগ নামের বাতিঘরের উজ্জ্বল আলো এখন খানিকটা হলেও নিষ্প্রভ। টানা দু’বারের ক্ষমতার সাড়ে ৭ বছরে সরকার ও আওয়ামী লীগ যেন একাকার হয়ে গেছে। এক সময় আওয়ামী লীগ বলতে জাতির সমৃদ্ধি আর সম্ভাবনার স্বর্ণালী দিন বোঝাত। সেই আওয়ামী লীগ মহাবিজয় নিয়ে পূর্ণ মেয়াদে ক্ষমতায় থাকার পর দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় এলেও প্রবল শক্তিশালী সাংগঠনিক কাঠামো ধরে রাখতে পারেনি দলটি। সরকার হিসেবে আওয়ামী লীগের সাফল্য অভাবনীয় হলেও সাংগঠনিকভাবে তেমনি বিশৃঙ্খল। কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের গা-ছাড়া ভাবের কারণে দলটির সাংগঠনিক অবস্থা ভেতরে ভেতরে যেমন দুর্বল হয়ে পড়েছে, সেই সঙ্গে দেখা দিয়েছে সাংগঠনিক দুর্বলতাও। দু’বারের ক্ষমতার সাড়ে ৭ বছরে মন্ত্রী-এমপি-নেতাদের সঙ্গে দলটির তৃণমূল নেতাদের এখন যোজন যোজন দূরত্ব। অভ্যন্তরীণ কোন্দল-দ্বন্দ্ব আর গ্রুপিংয়ের কারণে ক্ষতবিক্ষত দলটি। যার প্রমাণ মিলেছে সম্প্রতি শেষ হওয়া ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে। কোন্দল-দ্বন্দ্ব আর বিদ্রোহী প্রার্থীর কর্মী-সমর্থকদের সঙ্গে মূল প্রার্থীর প্রাণঘাতী সংঘর্ষে বিপুলসংখ্যক নেতাকর্মীর মৃত্যু আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে তৃণমূলে দলটির প্রকৃত অবস্থার কথা। দলের সাংগঠনিক কর্মকা-ের চেয়ে দলটির নেতা-মন্ত্রী-এমপিদের প্রধান লক্ষ্য হয়েই যেন দাঁড়িয়েছে আত্মীয়-পরিজন বেষ্টিত হয়ে ক্ষমতার প্রতিপত্তি ধরে রাখতে নিজস্ব বলয় সৃষ্টি, নিজস্ব ব্যবসা-বাণিজ্য আর সরকারী লাভজনক কাজ নিজের করায়ত্ত করার নগ্ন প্রতিযোগিতা। আর মন্ত্রী-নেতা-এমপিদের এমন আদর্শহীন কর্মকা-ের প্রভাব পড়েছে দলের সহযোগী ও ভাতৃপ্রতীম সংগঠনগুলোতেও। নিজেদের মধ্যে মারামারি, খুনোখুনী, দখল, টেন্ডারবাজি ইত্যাদি এন্তার অনৈতিক কর্মকা-ে লিপ্ত হয়ে হরহামেশাই উপমহাদেশের প্রচীন ও ঐতিহ্যবাহী দল আওয়ামী লীগকে জনগণের কাঠগড়ায় দাঁড় করাচ্ছে। নেতাকর্মীদের দৃষ্টিতে, সরকার কাঠামোর সঙ্গে নিজেদের একাত্ম করে ফেলেছে আওয়ামী লীগ। শত ষড়যন্ত্র, ভয়াল সহিংসতা-নাশকতা ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করে ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের মাধ্যমে সাংবিধানিকভাবে দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় এলেও কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের ব্যর্থতার কারণে তৃণমূলে অনেকটাই শ্রীহীন হয়ে পড়েছে দলটি। তবে দলটির প্রধান কা-ারী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রজ্ঞা ও সাহসিকতার ওপর ভর করে দক্ষতার সঙ্গে পরিস্থিতি সামাল দিয়ে দেশের পরিস্থিতি সম্পূর্ণ স্বাভাবিক করতে সক্ষম হন। দেশকে টেনে তুলেছেন উন্নয়নের মহাসড়কে। তবে সবকিছু ছাপিয়ে মাটি ও মানুষের দল আওয়ামী লীগের কাছেই জনগণের প্রত্যাশা অনেক। সে প্রত্যাশা পূরণে কতটা এগোতে পারছে দলটিÑ এ জিজ্ঞাসা সবার। এ প্রেক্ষাপটেই আজ কোটি নেতাকর্মী, সমর্থক ও শুভানুধ্যায়ী আওয়ামী লীগের ৬৭তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদযাপন করছে। ভাষা আন্দোলন, গণআন্দোলন, স্বাধিকার আন্দোলন, স্বাধীনতা যুদ্ধ- স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাসের পাতার পরতে পরতে একটিই নাম আওয়ামী লীগ। সব পর্যায়ে বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগের হার না মানা নেতৃত্ব। এই দলের নেতাকর্মীদের ত্যাগ তিতিক্ষা ও অঙ্গীকারদীপ্ত সংগ্রামী ভূমিকা ইতিহাসবিদিত। স্বভাবতই বাংলাদেশ নামক জাতিরাষ্ট্রের নির্মাতা আওয়ামী লীগের কাছে মানুষের প্রত্যাশা অনেক। সামান্য বিচ্যুতি কিংবা ব্যর্থতায় ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন তারা। যে মহান নেতার হাতে গড়া ত্যাগ ও আত্মোৎসর্গের আদর্শের বলিয়ান আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে লাখো বাঙালী হাসতে হাসতে জীবন বিলিয়ে দিয়েছেন দেশমাতৃকার জন্য, প্রতিষ্ঠার ৬৭ বছর পর স্বভাবতই মানুষের প্রশ্ন জাগে সেই আদর্শ ও ত্যাগের মহিমা কী এখনও জাগ্রত আছে দলটির কোটি কর্মী-সমর্থকদের মাঝে? নাকি সময়ের বিবর্তনে আদর্শ থেকে অনেকটাই বিচ্যুতি ঘটেছে? এত বছর পর উপমহাদেশের প্রাচীন ও বৃহত এই ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক দলটির নীতি-আদর্শ, সাফল্যে-ব্যর্থতার হিসাব মেলাচ্ছেন দেশের মানুষ। তবে প্রায় ৩৫ বছর ধরে নিরবচ্ছিন্ন নেতৃত্ব দিয়ে, মৃত্যুভয়কে ছিন্ন করে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা অসাম্প্রদায়িক ও গণতান্ত্রিক ভাবধারার আস্থার প্রতীকে পরিণত হয়েছেন এবং আওয়ামী লীগকে কোটি কোটি মানুষের প্রাণের সংগঠনে পরিণত করতে সক্ষম হয়েছেন। গণমানুষের ভাব-ভাবনার ধারক আওয়ামী লীগ ॥ ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন ঢাকার স্বামীবাগের বিখ্যাত রোজ গার্ডেনে জন্ম হয়েছিল এই প্রাচীন রাজনৈতিক দলটির। এই দলের জন্মলাভের মধ্য দিয়েই রোপিত হয়েছিল বাঙালীর হাজার বছরের লালিত স্বপ্ন স্বাধীনতা সংগ্রামের বীজ। জন্মলগ্ন থেকেই দেশের মাটি ও মানুষের প্রতি দলটির নেতাকর্মীদের অঙ্গীকার ও ত্যাগ-তিতিক্ষার মধ্য দিয়ে শুরু হয় পাকিস্তানী ঔপনিবেশিক শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে বাঙালি জাতির গৌরবোজ্জ্বল সংগ্রামের ইতিহাস। জনগণের অকুণ্ঠ ভালবাসা ও সমর্থন নিয়েই এই দলটি বিকশিত হয়। যার ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটির ভূ-খ-ের সীমানা পেরিয়ে এ উপমহাদেশের অন্যতম বৃহৎ এবং জনসমর্থনপুষ্ট অসাম্প্রদায়িক, প্রগতিশীল, গণতান্ত্রিক, মানব কল্যাণকামী রাজনৈতিক দল হিসেবে নিজেদের পরিচিতি অর্জনে সক্ষম হয়েছে। বাঙালীর ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, ভাষা, বাঙালীর আত্মনিয়ন্ত্রণ, স্বায়ত্তশাসন সর্বশেষ স্বাধীনতার মূলমন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে গড়ে ওঠা আওয়ামী লীগ তার আদর্শ এবং উদ্দেশ্যে অটল থেকেও সময়ের বিবর্তনে বৈজ্ঞানিক কর্মসূচীর মাধ্যমে একটি আধুনিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে আজ প্রতিষ্ঠিত। রোজ গার্ডেনে দলটি প্রতিষ্ঠা লাভ করেছিল ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ’ নামে। ১৯৫৬ সালে ময়মনসিংহে অনুষ্ঠিত দলীয় কাউন্সিলে ‘মুসলিম’ শব্দটি বাদ দিয়ে ‘বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ’ নামকরণের মাধ্যমে দলটি অসাম্প্রদায়িক বৈশিষ্ট্যম-িত হয়। এক কথায় বলতে গেলে, বাঙালী জাতির সকল মহতী অর্জনের নেতৃত্বে ছিল জনগণের প্রাণপ্রিয় সংগঠন আওয়ামী লীগ, যার মহানায়ক ছিলেন রাজনীতির মহামানব সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি ও স্বাধীন বাংলাদেশের মহান স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। দীর্ঘ রাজনৈতিক পথ পরিক্রমায় অনেক ঘাত-প্রতিঘাত, চড়াই-উতরাই ও প্রাসাদসম ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করে দলটি আজ এ দেশের গণমানুষের ভাব-ভাবনার ধারক-বাহকে পরিণত হয়েছে। অসাম্প্রদায়িক ও গণতান্ত্রিক ভাবধারার আস্থার প্রতীকে পরিণত হয়েছে দলটি। জন্মের পর থেকে অর্ধশতাব্দীরও বেশি সময় ধরে ঐতিহ্যবাহী দলটি বেঁচে আছে দেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক দল হিসেবে। জন্মলাভের পর ইতিহাসের রেকর্ড ভঙ্গ করে টানা দ্বিতীয়বারের মতো তিন-চতুর্থাংশেরও বেশি আসনে বিজয়ী হয়ে আওয়ামী লীগ এখনও রাষ্ট্রক্ষমতায় প্রায় আড়াই বছর পার করেছে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু বাঙালী জাতিকে উপহার দিয়েছেন মহামূল্যবান স্বাধীনতা। তাঁরই কন্যা শেখ হাসিনা ভূমিধস বিজয় নিয়ে গতবার ক্ষমতায় এসে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সুখী-সমৃদ্ধ সোনার বাংলা বিনির্মাণে নিরলসভাবে কাজ করে যাওয়ার পাশাপাশি পিতার মতোই ভারত ও মিয়ানমারের সঙ্গে আইনী লড়াইয়ের মাধ্যমে ঐতিহাসিক সমুদ্র বিজয়ের মাধ্যমে বাঙালী জাতিকে উপহার দিয়েছেন গভীর সমুদ্রে বাংলাদেশের সমপরিমাণ আরেকটি বাংলাদেশ। টানা দু’দফায় ক্ষমতায় থেকে জাতিকে উপহার দিয়েছেন উন্নয়ন-অগ্রগতি ও ডিজিটালাইজড নতুন প্রজন্মের উপযুক্ত বাংলাদেশ। সর্বশেষ ভারতের সঙ্গে ঐতিহাসিক স্থলসীমান্ত চুক্তি সম্পাদনের মাধ্যমে দীর্ঘ ৬২ বছর পর ছিটমহলবাসীকে দিয়েছেন স্বাধীনতার স্বাদ। আওয়ামী লীগের জন্মলাভের পর মহান ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ’৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের নির্বাচন, ’৬৬ সালের ঐতিহাসিক ছয় দফা, ’৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান এবং ’৭০ সালের নির্বাচনের মাধ্যমে এই দলের নেতৃত্বে বাঙালী জাতি ক্রমশ এগিয়ে যায় স্বাধীনতার দিকে। এই দলের নেতৃত্বেই ১৯৭১ সালে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করে। বিশ্ব মানচিত্রে স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ নিজেদের স্থান দখল করে। আর এসব আন্দোলনের পুরোধা ও একচ্ছত্র নায়ক ছিলেন ইতিহাসের মহানায়ক জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৭৫ সালে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর দীর্ঘ ২১ বছর বিরোধী দলে অবস্থান করে আওয়ামী লীগ। এরপর ১৯৯৬ সালের ২৩ জুন শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ আবার সরকার গঠন করেছিল। এর আগে এই দলের আন্দোলন সংগ্রামেই প্রতিষ্ঠিত হয় সংসদীয় গণতন্ত্র, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান অনুযায়ী পূর্ণ মেয়াদ শেষে ক্ষমতা হস্তান্তর করে নির্বাচনে অংশ নেয় আওয়ামী লীগ। ২০০১ সালের পহেলা অক্টোবর অনুষ্ঠিত নির্বাচনে পরাজয়ের পর বিরোধী দলে অবস্থানকালে আওয়ামী লীগকে পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন ও নেতৃত্বশূন্য করতে বেশ কয়েকবার মারণাঘাত চালায় ক্ষমতাসীন বিএনপি-জামায়াত জোট। ২১ আগস্ট ভয়াল গ্রেনেড হামলায় শেখ হাসিনাসহ দলের শীর্ষস্থানীয় সকল নেতা অলৌকিকভাবে প্রাণে বেঁচে গেলেও ঝরে যায় অসংখ্য তাজা প্রাণ। ওয়ান-ইলেভেনের পর আবারও ঝড় আসে আওয়ামী লীগের ওপর। দীর্ঘ ১১ মাস কারাপ্রকোষ্ঠে বন্দী রেখেও বঙ্গবন্ধুর হাতেগড়া আওয়ামী লীগকে ভাঙ্গতে পারেনি নেপথ্যের কুশীলবরা। ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরে তিন-চতুর্থাংশেরও বেশি আসনে দেশের জনগণ ভোট দিয়ে ক্ষমতায় বসিয়েছিল আওয়ামী লীগকে। ষড়যন্ত্র এখানেই থেমে থাকেনি। ৫ জানুয়ারির নির্বাচন বানচালে মরিয়া হয়ে উঠে বিএনপি-জামায়াত জোট। হেফাজতের তা-বের পর নির্বাচন বানচালে শত শত মানুষকে ভয়াল ও নৃশংস কায়দায় পেট্রোলবোমা মেরে ও গায়ে পেট্রোল ঢেলে আগুন দিয়ে পৈশাচিক কায়দায় হত্যার মহোৎসব দেখেছে দেশবাসী। এমনকি নির্বাচনের দিনেও শতাধিক স্কুল-কলেজে আগুন দিয়ে ভস্মীভূত, প্রিসাইডিং অফিসারকে কুপিয়ে ও আগুন দিয়ে হত্যা চেষ্টার পরও সাহসী বীর বাঙালী ৪০ ভাগেরও বেশি ভোট দিয়ে টানা দ্বিতীয়বারের মতো ক্ষমতায় এনেছে ঐতিহ্যবাহী দল আওয়ামী লীগকে। দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসায় দলটির বয়স এখন প্রায় আড়াই বছর। ক্ষমতার এক বছরের মাথায় সরকার পতনের সুগভীর চক্রান্ত থেকে বিএনপি-জামায়াত জোট আবারও দেশব্যাপী ধ্বংসযজ্ঞ ও পুড়িয়ে আড়াই শতাধিক মানুষকে হত্যা করলেও শেখ হাসিনার দক্ষ নেতৃত্বে আবারও তাদের পরাজিত করতে সক্ষম হন। আওয়ামী লীগ বাঙালী জাতীয়বাদের মূলধারা। এটা বাঙালী জাতির গৌরবের যে দ্বিজাতিতত্ত্বের চোরাবালি থেকে বাঙালী জাতিকে পুনরুদ্ধার করেছিলেন বঙ্গবন্ধুর মতো একজন শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি; যিনি হাজার বছরের বাঙালী, জাতির সাধনা, ধ্যান-জ্ঞান। তাঁর বিপুল সংস্কৃতির ভা-ারের অন্তর্গত সত্যকে নিজের জীবনে ধারণ করে তা রূপ দিয়েছিলেন দীর্ঘ দুই শ’ বছরের ধর্ম ও রাজনীতির সংমিশ্রণে জাতীয়তাবাদের বিকৃতি থেকে আমাদের মুক্ত করে। আগামী দু’এক শতাব্দীর মধ্যেও জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের মতো একজন মহামানব, যুগ সৃষ্টিকারী কোন ব্যক্তির আবির্ভাব ঘটবে, তা কল্পনাও করা যায় না। তাই বাঙালী জাতি আওয়ামী লীগের শুভ জন্মদিনে বিনম্র শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতায় স্মরণ করবে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালী শেখ মুজিবুর রহমানকেও। আওয়ামী লীগের প্রথম কেন্দ্রীয় কার্যালয় ॥ আওয়ামী লীগ গঠিত হওয়ার পর প্রথম কেন্দ্রীয় অফিস প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে দলের প্রথম কোষাধ্যক্ষ ইয়ার মুহম্মদ খানের অবদান রয়েছে। তিনি তার ঢাকার ১৮ নম্বর কারকুন বাড়ি লেনের বাড়িতে নবগঠিত পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সদর দফতর প্রতিষ্ঠার জন্য স্থান বরাদ্দ দেন। শুধু তাই নয়, দলের প্রথম সভাপতি মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীকে ইয়ার মুহম্মদ তার বাড়িতেই থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করেন। বর্তমানে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয় ২৩ বঙ্গবন্ধু এ্যাভিনিউয়ে। কর্মসূচী ॥ আওয়ামী লীগের জন্মদিন উপলক্ষে নেয়া হয়েছে বিভিন্ন কর্মসূচী। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কর্মসূচীর মধ্যে রয়েছে- আজ সকালে কেন্দ্রীয় কার্যালয় ও দেশব্যাপী দলীয় কার্যালয়ে জাতীয় ও দলীয় পতাকা উত্তোলন, সকাল সোয়া সাতটায় বঙ্গবন্ধু প্রাঙ্গণে জাতীয় ও দলীয় পতাকা উত্তোলন, জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশন, পায়রা উন্মুক্ত ও বেলুন উড়ানো এবং বেলা ৩টায় আলোচনা সভা। দলীয় সভানেত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে আলোচনা সভায় দলের নেতারা ছাড়াও দেশবরেণ্য ব্যক্তিবর্গ বক্তব্য রাখবেন।
×