ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

দাউদ হায়দার

শ্রদ্ধাঞ্জলি ॥ জাতির শিক্ষক

প্রকাশিত: ০৩:৪৮, ২৩ জুন ২০১৬

শ্রদ্ধাঞ্জলি ॥ জাতির শিক্ষক

বছর একুশ আগে, ‘ভয় পেয়ো না বেঁচে আছি’ শিরোনামে একটি বই পড়েছিলাম, পৃষ্ঠা সংখ্যা সাকল্যে ৯০, প্রবন্ধের বই। সম্ভবত প্রকাশকই পাঠিয়ে থাকবেন। মনে পড়ছে না সঠিক। বইটি সংগ্রহে নেই। কোন একজন সুবেশ বঙ্গীয় সন্তান, পড়ার ভান করে নিয়ে যান, তাঁর বয়ান ‘হারিয়ে গেছে।’ জানি, বই আর বউ ঘর থেকে বেরিয়ে গেলে ফেরত আসে না। ছোট ভূমিকা সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী লিখেছেন, স্মৃতি থেকে লিখছি। ভুলও হতে পারে। উদ্ধৃতিও হয়ত হুবহু নয়। শত্রু এবং মিত্রকে আলাদা করা দরকার, সাহস হারালে চলবে না।... নেতৃত্বের বিষয়টি আবশ্যক এবং প্রতিষ্ঠিত নেতৃত্বের দুর্বলতা, দুই সত্যের উন্মোচন জরুরী। বইয়ে দশ-বারোটি প্রবন্ধ, কয়েকটি খুবই ছোট। লক্ষ্য করি, ওর লক্ষ্যভেদ সরাসরি। ইনিয়েবিনিয়ে, অক্ষরের পর অক্ষর সাজিয়ে, ফালতু কথার কচকচানি নেই। মূল বক্তব্য কী, মুখ্য সেটাই। বলায় কোন মারপ্যাঁচ নেই। নির্ভার গদ্য, পা-িত্যে ভরপুর। প্রমথ চৌধুরী বা অন্নদাশঙ্কর রায়ের কাছ থেকে এই শিক্ষা, তৈরি করেছেন নিজেরই স্টাইল। ভাবীকালের লেখকদের শিক্ষণীয়। সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী নিজে শিক্ষক, শিখিয়েছেন ছাত্রছাত্রীকে, কী করে আসল কথা যুক্তি সহকারে বলতে হয়। বলার জন্যে সাতকাহন গাইতে হয় না, ধান ভানতে শিবের গীত নয়, ধান ভানাই পয়লা কাজ। সিরাজুলের বন্ধু দেবব্রত মুখোপাধ্যায়, লন্ডনে পড়েছেন একসঙ্গে, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজী বিভাগের প্রাক্তন অধ্যাপক (জিয়া হায়দারের ‘শুভ্রা-সুন্দর-কল্যাণী-আনন্দ’ ইংরেজী অনুবাদ করেছেন। বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত), বলেন একবার, সিরাজুল মৃদুভাষী। অনুচ্চ কণ্ঠ, কিন্তু গভীর যুক্তিবাদী। কাউকে ছেড়ে কথা-বলার লোক নন, নিজের বিশ্বাসে স্থির। ক্লান্তিহীন তার্কিক। ওর যুক্তি যদি ভুল হয়, কেউ শুধরে দিলে মেনে নিয়ে ওই বিষয়ে লেখাপড়া করে আবার শাণিত।... সিরাজুল একবার গল্পচ্ছলে বলেছিল, স্কুল-কলেজে পড়াকালীন মুসলিম লীগের ছাত্ররাজনীতির দিকে ঝুঁকেছিলেন, কর্মীও ছিলেন, মোহভঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকে, বিশ্বব্যাপী রাজনীতির চেহারাচরিত্র দেখে বামপন্থায় আস্থাশীল। সিরাজুল কতটা বাম-ঘেঁষা এখন, জান কি? বললুম, বামে চলেন, ডাইনে নয়। ওর বাম চলায় আমরা অনুপ্রাণিত। বাংলাদেশের হাজার হাজার মানুষও। রাজনীতিক নন, কোন দলেও নাম লেখাননি অথচ রাজনীতির চর্চা রাষ্ট্রসমাজের প্রেক্ষিতে, প্রেক্ষাপটে। এই প্রেক্ষাপট কিভাবে আলোচিত, বিচার বিশ্লেষণে, ওর লেখায় দেশকাল পরিষ্কার। বৈশ্বিক ঘটনাবলী, পরিস্থিতিও। নাস্তিক কি আস্তিক, বলতে অপারগ, যোগাযোগ নেই, এটুকু জানি, ধর্মাধর্মের উর্ধে, অসাম্প্রদায়িক। মানবিক, খাঁটি বাঙালী। মানবতাই পয়লা প্রেম। এই প্রেম সিরাজুলের মজ্জাগত, কৈশোর-যৌবনের শুরুতে, খামচানিতে, কারোর পাল্লায় পড়ে হয়ত, মুসলিম লীগের জাবালি-মন্ত্রে মজেছিলেন, মজতেই পারেন, তখন ছিল দেশভাগ, পাকিস্তানের উন্মাদনা, মুসলিম-হাওয়া, যুগের ভাঙন, ভ্রান্তিকাল। দোষের নয়। দেখতে হবে শ্রমজীবী মানুষ নিয়ে ওর ভাবনা, দেশী-বিদেশী রাজনীতি, সমস্যা কিভাবে আমাদের চেতনাকে কশাঘাত করছেন নিত্যদিন। আমরা জাগছি, জাগছি নানাভাবে। সিরাজুল এক গ-িতে স্থির নন। ইতিহাস ঘেঁটে, রাজনীতি ঘেঁটে, সমাজরাষ্ট্র ঘেঁটে আমাদের জানাচ্ছেন জাতি-জাতীয়তা-জাতীয়তবাদের মৌল উপাদান, সমস্যা, সমাধান কোথায়। বাঙালীর চরিত্র কী, সিরাজুল খুব ভাল জানেন, ওর মতো আর কেউ নন। বাংলাদেশের কোন লেখক নন। ঔপন্যাসিক তথা প্রাবন্ধিক নন। আমরা গর্বিত। সিরাজুল নানা বিষয়েই প্রবন্ধ লিখেছেন, শেক্সপিয়ারের নারী চরিত্র, বঙ্কিমের জাতীয়তাবাদ, শরতের সমাজ, বাংলাদেশের সাহিত্য নিয়ে, অনুবাদও করেছেন বিস্তর, নাটক, প্রবন্ধ (ওর অনুবাদ হাউসমানের ‘কাব্যের স্বভাব’ পড়েই কবিতা-কাব্যের মেজাজ বোঝার প্রাথিমক-বোধ।) এখন আর অনুবাদ করেন না বোধহয়। নিজের ভাবনাচিন্তা ছড়িয়ে দিচ্ছেন আজকের ঝিমিয়ে-পড়া সমাজদেশে। বছর পঁয়ত্রিশ আগে, আহমদ ছফা কলকাতায়। দেখা করি। নানা প্রসঙ্গে কথা। সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীও প্রাসঙ্গিক। আহমদ ছফা বলেন, সিক কেবল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নন, আমাদের জাতির শিক্ষক। সিকের মতো আর কোন অধ্যাপক, লেখক বাংলাদেশে নেই। জাতির শিক্ষক একজনই, সিক। কতভাবে আমাদের তৈরি করছেন, মন মানসিকতায়, যদি ভাব, নতজানু হবে। নতজানু অনেক দিনই, আশিতম জন্মদিনে শুভেচ্ছা, বিনতি। [email protected]
×